ভৌতিক গল্প ।। চাউমিন দোকানের ছেলেটা ।। অভীক মুখোপাধ্যায়
চাউমিন দোকানের ছেলেটা
অভীক মুখোপাধ্যায়
আকাশে এখনও ঘন মেঘের চাদর, যদিও ক্যালেন্ডার বলছে অক্টোবর মাস পড়ে গেছে তাও কিছু না হোক দিন দশেক হল। এখন বর্ষা আসে জুন মাস পেরিয়ে আর অক্টোবর মাসেও যাবার ইচ্ছে থাকে না তেমন। তা আকাশ যাই বলুক না কেন, দুর্গা পুজোর আর মাত্র চারদিন। সারা শহর আলোর মালায় সেজে উঠেছে। মাঝে মাঝেই বৃষ্টি আর জমা জলকে উপেক্ষা করে উৎসব পাগল জনতা সন্ধ্যে থেকেই জনজীবন স্তব্ধ করে দিচ্ছে ঠাকুর দেখার নামে সেই মহালয়া থেকেই।
আঠের তলার অফিসের নিজের কিউবিকিলে বসে মন খারাপ লাগে হীরকের। শহরের উপকন্ঠে এই তথ্য প্রজুক্তির শিল্পতালুকে উৎসবের রঙ লাগে না বড় একটা। সরকারী উদ্যোগে রাস্তার দু ধারে আলোর রোশনাই শুরু হলেও উৎসব উৎসব মেজাজটাই নেই। হীরকের বাড়ি কোলকাতা থেকে অনেক দূরে , বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানকারই একদা জমিদার বংশের বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম বংশধর হীরক। গ্রামের স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে তার কোলকাতায় আসা, তারপর কর্মসূত্রে বছর তিনেক ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ ঘুরে আবার কোলকাতা, তাও হয়ে গেল প্রায় বছর পাঁচেক। এই শিল্পতালুক থেকে অল্পদূরে যে নতুন উপনগরী গড়ে উঠেছে সেখানেই একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনে থাকে সে। বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই, গ্রামের বাড়িতে থাকা বাবা মায়ের সমস্ত রকম অনুরোধ উপরোধ উপেক্ষা করে সে এখনও ব্যাচেলর, অদুর ভবিষ্যতেও যে সংসারী হবে এমন আশাও খুব একটা নেই। তার একমাত্র ভালোবাসা হল বাইক, হ্যাঁ, তার রয়্যাল এনফিল্ড বাইকটা। বছর তিনেক আগে কেনা এই বাইকটা নিয়ে মাঝে মাঝেই উইকেন্ডগুলোতে সে বেরিয়ে পড়ে, কখনও দীঘা, কখনও অযোধ্যা পাহাড়, মুকুট্মণিপুর সোলো ট্রিপে। একবার পুরী ও গেছিল সে বাইক নয়ে।
পুজোর সময় হীরক ছুটি পায় না। তার কোম্পানি যে বিদেশী ক্লায়েন্টের কাজ করে, সেই ক্লায়েন্টের ছুটি অনুযায়ী হীরকরাও ছুটি পায়। স্বাভাবিকভাবেই দুর্গাপুজোয় তাদের ছুটি থাকে না উইক এন্ড ছাড়া।হীরকের দেশের বাড়িতে মানে তাদের গ্রামের বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়, শোনা যায় সেটাও নাকি বেশ কয়েকশো বছরের পুরনো।
এবারে তাদের অষ্টমীর পালা, মানে হীরকের পরিবারই মায়ের অষ্টমী পূজোর সব বন্দ্যবস্ত করবে। হীরকের মা বারবার তাকে বলছে একবার অন্তত আসার জন্য। গত বছর ছয়েক হল সে গ্রামের পুজোতে আসতে পারেনি। এর পরে তাদের অষ্টমীর পালা আসবে আবার নবছর পর। হীরককে সেন্টিমেন্টেও সুড়সুড়ি দিয়েছে তার মা, পরের পালার সময় বেঁচে থাকবেন কি না ঠিক নেই, এই সব কথা বার্তা বলে। মনে মনে যাবার খুব ইচ্ছে থাকলেও, হীরক অবশ্য এই সব কথা কানে তোলেনি, সাফ জানিয়ে দিয়েছে তার ছুটি স্যাংসান হবার কোন চান্স নেই, তাই সে আসতে পারছে না। উইক এন্ড পড়লে না হয় সে চিন্তা করে দেখত।
এমনি করেই পুজো শুরু হয়ে গেল। হীরক সাধারণত অফিস ঢোকে বেলা একটা নাগাদ কারণ সে কাজ করে ইউরোপিয়ান টাইম শিফটে। কাজের শুরুতেই তাদের একটা ডেইলি কল হয় ক্লায়েন্টের সাথে স্ট্যাটাস ডিসকাস করার জন্য। সেদিন মীটিঙে ঢুকেই হীরক শুনল খবরটা। তারা যে আর্জেন্ট ডেলিভারেবল টার ওপর কাজ করছিল, কিছু টেকনিক্যাল প্রবলেমের জন্য সেটা পিছিয়ে গেছে সপ্তাহ দুয়েক। আনন্দে হীরকের মনটা নেচে ওঠে, কোনরকমে মীটিং শেষ করেই ছুট লাগায় প্রোজেক্ট ডিরেক্টারের কেবিনের দিকে। তাদের এই ডেলী কলে ডিরেক্টার নিজেও থাকেন, কিছুই তাঁর অজানা নয়, হীরক কেবিনে ঢোকা মাত্র বলেন
ছুটি দিতে পারি , তবে একটা শর্তে...............
আমি রাজি............... শর্তটা কি না শুনেই বলে দেয় হীরক।
না শুনেই রাজি হচ্ছিস যে বড়, শুনে তো নে আগে শর্তটা............ডিরেক্টারের মুখে একটা হাসি খেলে যায়
সঙ্গে ল্যাপটপ নিয়ে যাবি, দরকার পড়লেই পিং করব, যা কিছু লাগবে করে দিতে হবে............
"ডান, কৌশিকদা..................এখন চলি তাহলে! একেবারে দশমীর পর ফিরবো......... হীরক কেবিন থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পেছন ফেরে।
এখন গেলে কেমন করে হবে? একটা নতুন প্রোজেক্টের বিড জমা করতে হবে, প্রেসেন্টেসানটা আগে বানিয়ে দে, কাল থেকে ছুটি।
ডিরেক্টারের কোথায় একটু দমে যায় হীরক। পরের দিন অষ্টমী, এখন বেরোলে বিকেল চারটের বাসটা পেয়ে যেত আরামসে, রাত সাড়ে নটার মধ্যে দেশের বাড়ি। কিন্তু কি আর করা যাবে!, তবু একবার রিকুয়েস্ট করে ডিরেক্টারকে
" ঠিক আছে, কৌশিকদা, সাড়ে সাতটার মধ্য একটু ছেড়ে দিও, তাহলে আজ রাতেই বেরিয়ে যাব......
" কাজ শেষ করে তুই বেরিয়ে যা, যত আগে শেষ করবি তত আগে বেরোতে পারবি.....................
কেবিনের বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে উত্তেজনায় ফুটতে থাকে হীরক। প্রথমে ভাবে ফোন করে মাকে জানাবে, তারপর আবার ভাবে, নাহ, থাক গিয়েই এক্কেবারে সারপ্রাইস দেবে সকলকে। আর একটা ডিসিসান ও নিয়ে নেয়, বাইক নিয়ে যাবে, অফিস থেকে ফিরেই বেরিয়ে পড়বে, ভোর ভোর পৌঁছে যাবে অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলির আগেই। বেশ একটা উত্তেজনার ভাব আসে । এত জায়গায় গেলেও সে এখনও পর্যন্ত কোনদিন বাইক নিয়ে দেশের বাড়ি যায় নি। আবার পরক্ষনেই মনে হয়, তার বাইকের পেছনের চাকায় একটা চোরা লীক আছে ওটা না সারিয়ে অত দূরের রাস্তায় যাওয়াটা কি ঠিক হবে! অফিসের কাজ মিটিয়ে সে যখন ফ্ল্যাটে পৌছবে তখন এই পুজোর বাজারে লীক সারানোর কোন দোকান খোলা পাওয়া মুশকিল। আবার বাইক না নিলে কাল সকালের আগে কোন কিছু পাওয়া সম্ভব নয়, না বাস, না ট্রেন, বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে বারোটা সাড়ে বারোটা বেজেই যাবে, লাভ হবে না কিছু। নাহ, বাইকটা যে ভাবেই হোক নিয়ে যেতে হবে। নিজের কিউবিকিলে বসে বাইরের দিকে তাকায় হীরক, আকাশ জুড়ে কালো মেঘ, ঝমঝমিয়ে নেমেছে বৃষ্টি। চোখ বন্ধ করে বাড়ির ঠাকুরের মুখটা মনে করে প্রাণপণে প্রার্থনা করতে থাকে।
অফিসের সব কাজ মিটিয়ে হীরক যখন বাইরে এল, তখন প্রায় সাতটা বাজে, পুরো অফিস চত্বর যেন খাঁ খাঁ করছে। এমনিতে নরমাল দিনে এই সময়ে এই এলাকা জমজমাট, কিন্তু পুজোর ছুটিতে ৯৯% অফিসই বন্ধ , ফুটপাথের যে গুমটিগুলো নানারকম খাবার বিক্রি করে সেগুলোও স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ। রাতের ডিউটি শেষ করে সাধারণত হীরক বেরোয় রাত এগারোটা নাগাদ, সেই সময়েও অ্যাপ রাইডের বাইক পেতে পাঁচ মিনিটের বেশী অপেক্ষা করতে হয় না, সেখানে আজ হীরককে ওয়েট করতে হল প্রায় আধ ঘন্টা।
শিল্পতালুক থেকে বেরতেই কিন্তু শহরের চেহারা অন্যরকম, চারিদিকে আলো, রাস্তায় জনস্রোত, বাম্পার টু বাম্পার গাড়ির ভিড়। সাধারণ দিনের পনের মিনিটের রাস্তা পেরোতে লেগে গেল প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
ফ্ল্যাটে পৌঁছে কোনরকমে একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিল। সারা পুজোটাই অফিস করতে হবে তাই এবারে সে আর নতুন জামা কাপড় কিছুই কেনেনি। মাস খানেক আগে কাছেই একটা মল থেকে ডিস্কাউন্টে একটা কুর্তা মত কিনেছিল , সেটাই ভরে নিল ব্যাগে আর একটা রেন স্যুট, যা বৃষ্টি হচ্ছে এখনও! তার বাইক চালানোর সেফটি গিয়ারসগুলো পরে ফ্ল্যাটের পারকিং এ চলে আসে, বাইকটা একবার ভালো করে চেক করে নেয়। পেছনের চাকাটায় হাওয়া কম আছে, হেডলাইট, ইন্ডিকেটার, ফগ লাইট, ঠিকঠাক আছে, ট্যাঙ্কে তেল যা আছে তাতে কিছু না হলেও ৬০/৭০ কিলোমিটার চলে যাবে হাসতে হাসতে। কিন্তু না, এই একটু এগিয়েই একটা বড় পেট্রল পাম্প আছে, ওখান থেকেই সে তেল ভরায় সচরাচর, ট্যাঙ্ক ফুল করে নেবে আর সঙ্গের পাঁচ লিটারের জ্যারিকেনটাও ভরে নেবে। রাস্তার পেট্রোল পাম্পকে সে একদম বিশ্বাস করে না। সেবার দীঘা থেকে ফেরার সময় নন্দকুমারের কাছে একটা পাম্প থেকে তেল ভরিয়ে যা ভুগেছিল। পুরো এক্সহস্ট সিস্টেমটা চেঞ্জ করাতে হয়েছিল একগাদা পয়সা খরচা করে। তারপর থেকেই এই জ্যারিকেনের ব্যবস্থা।
বাইক নিয়ে হীরক যখন পাম্পে ঢুকছে তখন সাড়ে নটা বেজে গেছে। শারদ সপ্তমীর সাড়ে নটা মানে তো সবে সন্ধ্যে। পেট্রল পাম্পে লম্বা লাইন, দুচাকা আর চার চাকার ভিড়ে নরক গুলজার অবস্থা। জনা চারেক কর্মী হিমসিম খাচ্ছে ভিড় সামলাতে। পাম্পে ঢোকার ঠিক মুখেই ফ্রি এয়ার মানে হাওয়া দেওয়ার মেশিনের সামনে বড় বোর্ড ঝোলানো, " আউট অফ সার্ভিস"। বেজায় দমে যায় হীরক, কি হবে তাহলে! এয়ারপোর্টের এক নম্বর গেটের বামদিকে যে রাস্তাটা নাগেরবাজারের দিকে যাচ্ছে ওই খানের আগে আর অন্য জায়গা খোলা পাওয়া দুস্কর। কিন্তু ওই রাস্তায় একবার ঢুকলে আটকে যাওয়ার সম্ভবনা প্রচুর, ওই রাস্তায় বড় বড় পুজোর সংখ্যা অনেক। আর না হলে সেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে। কিন্তু অতদুর যাবে কি? কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে হীরকের। এদিকে দেখতে দেখতে তার নম্বর এসে গেছে, যে ভদ্রলোক তেল দিচ্ছেন তিনি হীরকের মুখচেনা, একগাল হেসে জিজ্ঞেস করেন
"এবার কতদূর..............."
" দেশের বাড়ি......... শান্তিনিকেতন থেকে আরও ত্রিশ কিলোমিটার মত হবে।"
"পেছনের চাকায় তো হাওয়া কম মনে হচ্ছে............"
"হ্যাঁ, ওটাই ভাবাচ্ছে, আপনাদের এখানে হাওয়া দিয়ে নেব ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন তো দেখছি মেশিন খারাপ, এখন হাওয়া দেওয়ার জায়গা পাই কোথায়?" হীরকের গলায় উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট।
এই চত্বরে আর কোথাও পাবেন না, সিসি-টুর উলটো দিকের পাম্পটায় হাওয়া দিত আগে, এখন বন্ধ হয়ে গেছে, বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়েতে উঠেই একটা টায়ার সারানোর দোকান আছে, ওটা যদি খোলা থাকে" ভদ্রলোক উত্তর দেন।
"জানি , ওটা বন্ধ থাকলেই হয়ে গেল, ডানকুনি টোল প্লাজার আগে আর কিছু পাব না।" হীরক তেলের দাম মেটাতে মেটাতে বলে।
"না আছে, পুরনো বালি ব্রিজ দিয়ে চলে যান, বালি হল্টের পরে, রাজচন্দ্রপুরের আগে রাস্তার ধারে অনেক দোকান পাবেন, সারা রাত খুলে রাখে ওরা। লরি চলে তো সারা রাত ওই রাস্তায়"
একটু আস্বস্ত হয় হীরক। নতুন নিবেদিতা ব্রিজে না উঠে দক্ষিণেশ্বর থেকে পুরনো বালি ব্রিজ দিয়ে বালি হল্ট হয়ে রাজচন্দ্রপুর যাবার রাস্তাটা হীরক চেনে। তেল নিয়ে আবার যখন সে রাস্তায় নামল তখন রাত দশটা বেজে গেছে, রাস্তার গাড়ির ভিড়ে যদিও বোঝার উপায় নেই। চীনার পার্ক,কৈখালী, এয়ারপোর্টের একনম্বর, আড়াই নম্বর গেট পেরিয়ে সে যখন বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে উঠছে তখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে, স্বাভাবিক ভাবেই টায়ারের দোকানটা বন্ধ যেমনটা সে ভেবেছিল। দুশ্চিন্তাটা আবার বেড়ে যায় হীরকের, হাওয়া কমে যাওয়ায় কিছুতেই স্পীড উঠছে না। এদিকে নতুন করে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শুরু হওয়ায় রাস্তার ধারের ঝুপড়ি দোকান গুলো ভেঙে দিয়েছে, পুরো রাস্তা অন্ধকার, যতটা সম্ভব সাবধানে চালাতে থাকে হীরক। যে রাস্তা পেরোতে এমনিতে তার পনের মিনিটের বেশী সময় লাগে না, সেই রাস্তাটা পেরতেই আজ তার লাগল প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বালি ব্রিজ থেকে নামার সময়েই সে বুঝতে পারল আর সম্ভব নয়। বালিঘাট স্টেশানের পাশে বাইকটা দাঁড় করায় , নাহ কিছু করার নেই, হাওয়া একদম শেষ। পাশেই একটা ফাস্টফুডের দোকান, চা-পান-সিগারেটের দোকানও রয়েছে কয়েকটা। রাজচন্দ্রপুর এখান থেকে এখনও কিছু না হলেও প্রায় মিনিট দশেকের রাস্তা। এত বড় বাইক হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। কাছের দোকান গুলোর একটাতে জিজ্ঞেস করায় আশার কথা শোনে, পাশেই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ৫৪নং বাস স্ট্যান্ডের ডান দিকে একটা টায়ার সারানোর দোকান আছে, মালিক দোকানেই থাকে। দোকানদারকে তার বাইকটা একটু নজরে রাখতে বলে, অনেক আশা নিয়ে নীচে নামে হীরক। রাত এগারোটা বেজে গেছে, রাস্তায় পুজো দেখার ভীড় কিন্তু গিজ গিজ করছ্রে। বাসস্ট্যান্ড থেকে ডান দিকে গিয়ে অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে, আছে বটে একটা দোকান আর খোলাও আছে। দোকানে পৌঁছে দেখে বয়স্ক মালিক বসে আছে ভেতরে। জিজ্ঞেস করায় বলে, যে ছেলেটা কাজ করে সে চলে গেছে অনেক্ষণ, এখন হাওয়া দিতে হলে বাইক নিয়ে আসতে হবে এখানে। কি আর করা যাবে! হীরক এই জায়গাটা একেবারেই চেনেনা। যে সিঁড়ি দিয়ে সে নেমেছে ওখান দিয়ে বাইক নামানো সম্ভব নয় , তাই জিজ্ঞেস করে করে বেশ খানিকটা ঘুরে একটা নীমতলা না কি যেন একটা জায়গা দিয়ে ঘুরে শেষ পর্যন্ত সে তার বাইকটা এনেই ফেলল দোকানের সামনে, ততক্ষনে চাকার রীম প্রায় ঠেকে গেছে মাটিতে।
চাকায় পাঞ্চার আছে, হাওয়া দিয়ে লাভ হবে না, এক্ষুনি আবার বসে যাবে ...... বাইক দেখেই মন্ত্যব্য করে দোকান মালিক।
কি হবে তাহলে? আমাকে যে যেতেই হবে............ হীরক আক্ষরিক অর্থে অনুনয় করে।
কতদূর যাবেন ?
সেই বোলপুর.........
আমি করে দিতে পারতাম, কিন্তু আমার হাঁটুতে প্রব্লেম, বসতে পারিনা উবু হয়ে
আপনাকে বসতে হবে না, আপনি বলুন আমিই করে নিচ্ছি। আপনি খালি বলুন কি কি করতে হবে? হীরক মরিয়া হয়ে বলে।
আপনি কি করে করতে পারবেন? দেখি কি করতে পারি? এই সাইডটা করুন আগে হাওয়া দিয়ে দেখি পাঞ্চারটা ঠিক কোথায়?
বয়স্ক মালিক কাজ শুরু করেন, হীরক মনে মনে ঠাকুর ডাকতে থাকে। মিনিট পাঁচেক পরে মুখ খোলেন সেই মালিক,
একটা নয় পাশাপাশি দুটো লীক আছে, এমনিতে পাঁচ মিনিটের কাজ কিন্তু আমার সময় লাগবে একটু। ভাগ্যিস টিউবলেস টায়ার তাই , নয়ত করতে পারতাম না আজ। আপনি বরং এক কাজ করুন, সামনেই বুড়িমার আটচালার ঠাকুর দেখে আসুন, ভালো লাগবে, পাঁচশো বছরের পুজো।
এখানে খাওয়ার জায়গা আছে কোথাও? এতক্ষনে হীরকের মনে পড়ে তার খিদে পেয়েছে খুব, তাড়াহুড়োয় একদম খেয়ালই ছিলনা যে রাতে ডীনার করাটাই হয়নি তার।
এই তো সামনে বাসস্ট্যান্ডের উল্টো দিকেই তো বড় রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কাজ করতে করতেই উত্তর দেয় মালিক।
ঠিকই তো বেশ বড় একটা রেস্টুরেন্ট আছে বটে, বিরাট ডিজিটাল সাইনেজে ঝলমল করছে "দি টেস্ট"। ভাগ্য ভালো এত রাতেও খোলা, পুজর সময় বলেই বোধহয়। দোকানে বাইক রেখে ওখানে গিয়ে আবার একচোট অবাক হয় হীরক, একটা টেবিলও খালি নেই, বাইরে নাম লিখিয়ে ওয়েট করতে হবে, তা কিছু না হলেও অন্তত ঘন্টাখানেক তো বটেই। বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে হীরক।
রেস্টুরেন্টের উল্টোদিকেই ব্রিজের তলায় বিরাট অটো স্ট্যান্ড, সেইখানেই বেশ কয়েকটা খাবারের স্টল, রোল চাউমিন, মোমো, স্যান্ডউইচ, কাবাব আরও কত কিই না পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। হীরক এমনিতে এই সব রাস্তার ধারের গুমটি থেকে খাওয়া পছন্দ করে না, কিন্তু এই মুহূর্তে তার হাতে বিশেষ উপায় নেই। তাই অগত্যা এক প্লেট ভেজ চাউমিনের অর্ডার দিয়ে দোকানের বেঞ্চে বসে। দোকান অবশ্য এই রাতেও গম গম করছে, কিছু না হলেও জনা পাঁচেক খদ্দেরতো রয়েইছে তাকে ছাড়া। তার বাইকার ড্রেস দেখে কয়েকটি ছেলে উজিয়ে কথা বলতে চলে আসে , হরেক প্রশ্ন তাদের , কোথায় যাবে, কোন রাস্তায় যাবে, এতো রাতে কেন প্রশ্নের আর শেষ নেই। হীরক যতটা সম্ভব কম কথায় উত্তর সারার চেষ্টা করে, ইতিমধ্যে তার খাবার এসে গেছে, কথা থামিয়ে খাওয়ায় মন দেয় সে। বেঞ্চের একদম শেষ প্রান্তে বসা একটি ছেলে, এতক্ষণ চুপকরে সব কথা শুনছিল, এইবার মুখ খোলে
"ডানকুনি হাউসিং এর কাছে রাস্তায় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, রাস্তা পুরো জ্যাম.........পারলে জিটি রোড ধরুন"
খাওয়া থামিয়ে ছেলেটার দিকে তাকায় হীরক। এতক্ষণ ভালো করে লক্ষ্য করেনি, বেশ সুন্দর জামা কাপড় পরা একটি ছেলে, বয়স মনে হয় পঁচিশের আশপাশেই হবে
"আপনি জানলেন কি করে?" মুখে খাবার নিয়েই প্রশ্ন করে হীরক। এই রকম উটকো অ্যাডভাইস শুনে লং ড্রাইভে সে আগে অনেকবার বোকা বনেছে।
"আমি নিজেই তো যাচ্ছিলাম বর্ধমানের দিকে, এমন আটকে গেলাম.................." খানিকটা স্বগতোক্তির মতই করে ছেলেটা।
"ওঃ তাই নাকি, কিন্তু জিটি রোডের রাস্তা আমি ঠিক চিনি না আর এতো রাতের দিকে জ্যাম নিশ্চয়ই কেটে যাবে!"
"আপনি যদি চান আমি দেখিয়ে দিতে পারি জিটি রোডের রাস্তাটা, আমার সব চেনা" ছেলেটা নিচু গলায় জানায়। হীরক এবার সতর্ক হয়ে যায়, একলা যাচ্ছে, অজানা অচেনা কাউকে হুট করে বিশ্বাস করাটা ঠিক নয়।
"নাহ, ম্যাপ দেখে চলে যেতে পারবো, আর আমার বাইকে একটু প্রবলেম আছে।"
"আরে না না কোন ব্যাপার নয়............আমি দেখি কি পাওয়া যায় এত রাতে?" নিচু গলাতেই উত্তর দেয় ছেলেটি। ইতিমধ্যে হীরকের খাওয়া শেষ, প্লেট নামিয়ে দাম মেটাতে গিয়ে সে লক্ষ্য করে সবাই যেন তার দিকে কেমন একটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আজব ব্যাপারতো! এই মাত্রতো সব হামলে পড়ে জিজ্ঞেস করছিল কথায় যাবে, কোথা থেকে আসছে? আর এই দু মিনিটে হলটা কি? সে কি কোন ভিনগ্রহের প্রাণী!
যাই হোক ওসবে মাথা না ঘামিয়ে খাবারের দাম মিটিয়ে পাশের দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে টায়ারের দোকনের দিকে হাঁটা লাগায়, কিন্তু বেশ বুঝতে পারে বেশ কয়েক জোড়া চোখ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
দোকানে এসে সে তো অবাক, সব কাজ কমপ্লিট।
"বাহ, হয়ে গেছে.........খুব তাড়াতাড়ি করে দিয়েছেন তো! তা কত দেব?
" দিন না পঞ্চাশ টাকা, আমাকে তো কিছুই করতে হয়নি," দোকান মালিক মন্তব্য করেন " আপনি যে ছেলেটিকে পাঠালেননা সেই তো সব করে দিল ঝটপট"
কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়ে , " আমি তো কাউকে পাঠাইনি.........আমি তো এখানে এই প্রথম এলাম, চিনিই না কাউকে"
"কিন্তু ও তো বলল যে আপনি দোকানে চাউ খাচ্ছেন আর আপনিই পাঠালেন আমাকে হেল্প করতে, কাজ হয়ে গেলে আবার চলে গেল ওইদিকেই, ফরসা করে , নীল রঙের শার্ট পরে ছিল।"
চাউয়ের দোকানের ছেলেটা নীল রঙের শার্ট পরেছিল বটে, মনে পড়ে সুমিতের। কিন্তু ওতো বসেই ছিল সারাক্ষণ, তাহলে কে এল উজিয়ে হেল্প করতে! যাকগে, তার কাজ তো হয়ে গেছে, বেশী মাথা না ঘামিয়ে পার্স খুলে একটা একশো টাকার নোট বের করে দোকান মালিকের দিকে এগিয়ে দেয়
" খুচরো নেই আমার কাছে............"
"খুচরো লাগবে না , রেখে দন বাকিটা............ যা উপকার করলেন" বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে বলে হীরক।
" সোজা গিয়ে ওই গোলচক্কর থেকে পুরো ঘুরে ওপরে ব্রিজের উঠে যান......... হাইওয়ে পেয়ে যাবেন।" দোকান মালিক হাত বাড়িয়ে একটু দূরের একটা আইল্যান্ড দেখিয়ে দেন।
"যদি জিটি রোড ধরে যাই?" হীরক জিজ্ঞেস করে।
"তাহলে ওই চক্কর থেকে সোজা চলে যান নাক বরাবর। একদম চন্দননগর থেকে বাম দিকে বেঁকে সুগন্ধামোড় হয়ে হাইওয়ে ধরে নেবেন। কিন্তু ঘুর পড়বে অনেক।"
দোকান মালিকের কথায় একটু চিন্তায় পড়ে যায় হীরক। কথাটা ঠিক, এত রাতে অজানা রাস্তায় যাওয়াটা কি ঠিক হবে! কিন্তু তার কানে ক্রমাগত বাজতে থাকে ছেলেটার কথাটা, ডানকুনির কাছে রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট, রাস্তা জ্যাম। সে অন্যদের মুখে শুনেছে এই ডানকুনির জ্যাম কুখ্যাত, এক একবার নাকি পাঁচ ছয় ঘন্টাও লেগে যায় জ্যাম কাটতে।
শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের নাম নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় সে, যা হবার হবে, ডানকুনি হয়েই যাবে সে। দোকান থেকে কয়েক পা এগিয়েই বজরঙবলীর বিশাল মূর্তি। যদিও এত রাতে সামনে বড় পর্দা টাঙানো, তবু একবার বাইক দাঁড় করিয়ে একটা প্রনাম করে হীরক, ঠাকুরের কৃপাতেই তার বাইকের একটা হিল্লে হল, না হলে যে কি হত! তার ঘড়ি বলছে রাত পৌনে একটা, সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে সে সকাল সাতটা আটটা নাগাদ পৌঁছেই যাবে আশা করা যায়। রাস্তায় ইতিমধ্যে মানুষজন খুবই কমে গেছে, যদিও গাড়ির সংখ্যা সেই তুলনায় বেশী, আসলে কোলকাতায় রাতে ঠাকুর দেখতে যাওয়া আর ফেরা দুরকমের গাড়িই রয়েছে রাস্তায়। একটু এগিয়ে আইল্যান্ডটা ঘুরে ব্রিজে উঠতে যাবে ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি নামল। মনে মনে গজ গজ করতে করতে পাশের একটা বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে রেন স্যুট বের করে। এখন বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করলে চলবে না। দেরী হয়ে গেছে অনেক।
আবার বাইক স্টার্ট দেওয়া মাত্র একটা বিচিত্র ফিলিং হল হীরকের, ঠিক যেন তার বাইকের পেছনের সীটে কেউ বসল। অসম্ভব , জেনেও লুকিং গ্লাসে একবার পেছনটা দেখে নিল.........নাহ, সব কিছু ঠিক ঠাকই আছে। যতসব মনের ভুল। বৃষ্টিতে ব্যাগটা ভিজে ভারী হয়ে গেছে, তাই মনে হচ্ছে হয়তো।
ব্রীজে উঠে বাম দিকের রাস্তা ধরে হীরক। তলার রাস্তায় গাড়ি থাকলেও এই রাস্তায় গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। বালী হল্টের কাছে বাস স্ট্যান্ডে কয়েকটা বাস অবশ্য দাঁড়িয়ে যদি কোন যাত্রী পাওয়া যায়। সোজা এগিয়ে রাজচন্দ্রপুরের আগে টানা কয়েকটা স্পীড ব্রেকার পরপর, সেখানে আবার মনে হল পেছনে কেউ যেন বসে। আবার লুকিং গ্লাসে চোখ রাখে......সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য মনে হল একটা মুখের আদল, বুকের মধ্যে রক্ত ছলাত করে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে, নাহ, কেউ কোথাও নেই। এত বড় ভুল দেখল হীরক! বাইক দাঁড় করিয়ে আস পাশ দেখে, একটু এগিয়ে রাস্তার অন্য পারে একটা চায়ের দোকান খোলা। একটু চা দরকার। সারাদিনের ক্লান্তি আর এই পাংচার নিয়ে টেনসানের জন্যই এই সব ভুল্ভাল দেখছে সে।
চায়ের অর্ডার দিয়ে বাইকটা ভালোভাবে একবার দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে ব্যাপারটা।এমনিতে সব তো ঠিকই আছে, বৃষ্টিতে পুরো বাইকটা ভিজে, খালি পুরো সীটটা শুকনো। সামনের দিকটায় নাহয় সে নিজেই বসেছিল, কিন্তু পেছনটা শুকনো হয় কি করে। ব্যাগটা সাইডে লাগানো,সব কিছুই ঠিঠাক। তার পরেই ভাবে, বৃষ্টি তো বেশিক্ষণ হয় নি। কি যে সব ঘটছে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না। চায়ের কাপ হাতেই দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে
" সামনে কি কোথাও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে আজ?"
"হ্যাঁ, এই তো সামনে, ডানকুনি ঢোকার ব্রীজটার ওপর............ রাত দশটা নাগাদ, একদম স্পট হয়ে গেছে"
তার মানে ছেলেটা ঠিক কথাই বলেছিল।
"জ্যাম আছে নাকি সামনে?"
"একটু আগেও নাকি ছিল, তবে এখন মনে হয় কেটে গেছে" দোকানদার উত্তর দেয়।
তবু ভালো, মনে মনে ভাবে হীরক, অনেকের মুখে সে শুনেছে, এই চত্বরে জ্যাম একবার লাগলে তিন চার ঘন্টার আগে কাটে না। চা শেষ করে একটা সিগারেটও ধরায় সে। সামান্য একটা ঘুমঘুম ভাব আসছিল, ওটা কাটানো দরকার।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আবার রাস্তায়, হীরকের কিন্তু এখনও মনে হছে, পেছনে কেউ বসে। তবে কি চাকার হাওয়াটা আবার কমে গিয়ে গাড়ি ড্র্যাগ হচ্ছে! এই সব ভাবতে ভাবতেই ডানকুনি টোল প্লাজা। পূজোর সময় হলেও হাইওয়েতে লরির খামতি নেই। যতই ফাস্ট্র্যাক থাকুক না কেন সব কটা চ্যানেলেই লম্বা লাইন। অনেক কষ্টে যখন সে বেরোল তখন আবার টিপ্টিপিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, রাস্তায় এই দিকটায় কোন আলো নেই, বাইকের হেড লাইটটাই ভরসা। রাস্তা চওড়া করার কাজ চলছে, মাঝে মাঝেই ডাইভারসান, যতটা স্পীডে যেতে পারবে ভেবেছিল তাঁর ধারে কাছে পৌছতে পারছে না। রাত দেড়টা বেজে গেছে, এখনও সিঙ্গুরও পৌঁছুতে পারেনি। একটা বিরক্তি মনের মধ্যে চেপে বসতে থাকে। তাঁর ওপর সেই অস্বস্তি, খালি মনে হচ্ছে পেছনে কেউ বসে।
সিঙ্গুর পেরিয়ে একটু এগিয়ে "হাইওয়ে মিরচি" ধাবার লাইট দেখা যাছে, পেছনে কোন একটা ট্রাকের লাইটে রিয়ার ভিউ মিররে এক ঝলক সে দেখতে পেল ঠিক তাঁর কাঁধের কাছে একটা মুখ, অবিকল বালিখালের চাউমিন দোকানের সেই ছেলেটা। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সারা শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। পেছনের লরিটা চাপা দিয়েই দিত, কিন্তু না, ওই অবস্থাতেও হীরকের মনে হল দুটো হিম শীতল হাত যেন তার হাত ধরে বাইক্তাকে সামান্য ঘুরিয়ে নিরাপদে সরিয়ে দিল। কোনরকমে ব্রেক মেরে দাঁড়িয়ে পড়ে, বাইক চালাচ্ছে আজ কিছু না হলেও বছর আষ্টেক তো হবেই, এত দূর দূর গেছে, কিন্তু এমনটা কোনদিনও হয়নি। আগের বারেরটায় তার সন্দেহ আছে, কিন্তু এইবারে সে হলফ করে বলতে পারে সে ভুল দেখেনি। ছেলেটার মুখ সে দেখেছে। কিন্তু সেটাই বা কি করে সম্ভব! আর তার হাতের ওপর ওই ঠাণ্ডা হাত দুটো! সব কিছু কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে হীরকের। যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে মেরেকেটে শ খানেক মিতার দুরেই ধাবাটা। এখনও খোলা আছে, লাইট জ্বলছে। অইখানেই রাতটুকূ কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটলে তবে রওনা হবে, ঠিক করে ফেলে হীরক। রাতের বেলা হুট করে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়াটা মনে হয় ঠিক হয়নি।
আবার বাইক স্টার্ট দিতে যাবে একটু ধাতস্থ হয়ে, কানের কাছে কেউ যেন ফিস ফিসিয়ে গেল " ভোরে নয়, এখনি চল.................. পৌঁছুতে দেরী হয়ে যাবে"। গলাটা কি চেনা চেনা লাগল! কোথায় যেন শুনেছে গলাটা। বাইক চলতে শুরু করতেই আবার সেই ফিলিং, পেছনে কেউ বসে আছে।
দেখতে দেখতে ধাবার সামনে পৌঁছে গেল, ঘুরে ঢুকতে যাবে, মনে হল কেউ যেন শক্ত হাতে ধরে রয়েছে হ্যান্ডেলটা, বরফ শীতল হাতে। চেষ্টা করল হীরক কিন্তু পারল না ঘোরাতে। একটা কেমন যেন ঘোর লেগে গেল তার, বাইক ছুটতে লাগল নিজের মত। হীরক সাধারণত জোরে চালায় না, যতদূরেই যাক না কেন, পঞ্চাশ ষাটের বেশী সে কখনই চালায় না রাস্তা যতই ফাঁকা থাকুক না কেন। কিন্তু সেই তার বাইক এখন ছুটছে হাওয়ার মত। স্পিডোমিটারের কাঁটা নব্বই- একশোর ঘরে ঘোরাঘুরি করছে। কত ট্রাক, লরিকে যে সে কখনও ডান কখনও বাম দিক দিয়ে ওভারটেক করল তার ইয়ত্তা নেই।
এই রকম ঘোরের মধ্যে কতক্ষণ চালিয়েছে খেয়াল নেই, হঠাৎ করে যখন চটকা ভাঙল, তখন সে পালসীটের টোল প্লাজা ঢুকছে। টোল প্লাজার লোকগুলোকে তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে খুব একটা অস্বস্তি লাগল হীরকের। বেশ একটু ঘাবড়ে যায় সে।, কি যে হচ্ছে, কিছুই সে বুঝতে পারছে না। এ রকম তো নয় যে রাতে কেউ হাইওয়ে দিয়ে বাইক চালায় না। একবার ভাবল গিয়ে জিজ্ঞেস করে, তারপরেই ভাবে, কি দরকার!
পালসীট পেরতেই আবার সেই এক অবস্থা, বাইকটা যেন অন্য কেউ চালাচ্ছে। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল শক্তিগড়, বর্ধমান শহর ডানদিকে রেখে সে এগোতে থাকল, ১০৮ শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে গুসকরার রাস্তা ধরবে এমনটাই ইচ্ছে। দেখতে দেখতে পুছে গেল বর্ধমান শহরের শেষ প্রান্তে, এবার ডানদিকে ঘুরে ১০৮ শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে গুসকরার রাস্তা ধরবে।
১০৮ শিব মন্দিরের সামনে এসে বাইক দাঁড় করায় হীরক, এখন আর কোন অসুবিধে যেন নেই। ঘড়িতে ভোর চারটে, দিনের প্রথম অর্চনার সময় প্রায় হল বলে। মন্দিরের গেট বন্ধ তবু বাইকটা রাস্তায় রেখে গেটের সামনে পর্যন্ত হেঁটে যায় , বাইরে থেকেই একটা প্রণাম করে। মনের মধ্যে ভয় আর আতঙ্কের যে গুমোট ভাবটা চেপে বসেছিল সেটা যেন কিছুটা কমল।
মন একটু শান্ত হবার পর আবার বাইকে স্টার্ট দেয়। অবাক ঘটনা, এবার আর মনে হল না পেছনে কেউ বসে আছে। তাহলে এতক্ষণ কি সে ভুল ভাবছিল! এই সব এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতেই সে এগোতে থাকল। বেশ কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে খানা জংশন স্টেশানের আগের রেলগেট। গেট নামানো, ট্রেন পাস করবে হয়ত। রাস্তা আর ফাঁকা নেই, ভোরের হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে, সব্জির গাড়ি বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। গ্রাম বাংলার দিন শুরু হয়ে গেছে। রেলগেতের কাছেই চায়ের দোকানের উনুনে আগুন পড়েছে, গলগল করে ধোঁয়া উঠছে, সামনে বেঞ্চিও পেতে দিয়েছে।
রেল গেটের কাছে বাইকের ইগ্নিশান বন্ধ করে এই সবই দেখছিল, ঠিক তখনি এক ঝলক দেখল, না এবার রিয়ার ভিউ মিররে নয়, এক্কেবারে খালি চোখে। উনুনের ধোঁয়ার মধ্যেও সে স্পষ্ট দেখতে পেল, চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে গত রাতের চাউমিন দোকানের সেই ছেলেটা, সেই এক জামা কাপড়, বসে আছে ঠিক যেমন বসেছিল চাউমিনের দোকানে। জীবনে এত চমকায়নি হীরক, কিন্তু চোখ সরাল না সে, ছেলেটাও যেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে গেল
"কে তুমি......?"
কিন্তু পারল না, ঝম ঝম করে ট্রেন এসে পড়ল রেল গেটের সামনে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য বোধহয় পলক ফেলেছিল হীরক, পরমুহূর্তেই কেউ কোত্থাও নেই। আবার আতঙ্কে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় হীরকের। কি হচ্ছে এ সব! বার বার এই ছেলেটাকেই দেখছে কেন সে! আর বাইকের পেছনে কেউ বসে আছে এমনটাই বা মনে হচ্ছিল কেন? সব কিছু গুলিয়ে যায় আবার।
হীরকের চটকা ভাঙে রেল গেট খোলার আওয়াজে। বাইক স্টার্ট করতে যাবে কেউ যেন কানে ফিস-ফিস করে বলে " থ্যাঙ্ক ইউ........."। গলাটা হীরকের ভীষণ চেনা, গত রাত থেকে চাউমিন দোকানের সেই রহস্যময় ছেলেটার।
ঘন্টা দুয়েক পর আর কোন ঘটনা ছাড়াই হীরক পৌঁছল গ্রামের বাড়িতে। মেঘ না চাইতেই জলের মত হীরকের বাবা মায়ের আনন্দ আর ধরে না ছেলেকে পেয়ে। হীরকও যেন কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যায় রাতের সব ঘটনাগুলো।
ঘন্টা দুয়েক পর, স্নান করে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে ঘরে এসে লুচি আলুরদমের প্লেট নিয়ে হাতের সামনে খবরের কাগজটায় চোখ বোলাতে শুরু করে হীরক।। ভেতরের পাতায় একটা খবরে চোখ আটকে যায় হীরকের, একটা অ্যাক্সিডেন্টের খবর। সপ্তমীর সন্ধেবেলা এক বাইক আরোহীর মৃত্যু ডানকুনির কাছে। বাইক আরোহীর বয়স আন্দাজ পঁচিশ, বাড়ি বর্ধমান শহরে। কর্মসূত্রে কোলকাতাবাসী ছেলেটি পূজোর ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছিল। ডানকুনি ঢোকার ঠিক আগে পেছন থেকে আসা একটি লরি পিষে দেয় তাকে। লরি চালক পলাতক। ছেলেটির একটা ছবিও দিয়েছে সঙ্গে। ছবিটা দেখে হাত থেকে লুচির প্লেটটা পড়ে যায় হীরকের। ছবিটা চাউমিনের দোকানের ছেলেটার।
=====================