ধারাবাহিক উপন্যাস ।। মাধব ও মালতি ( পর্ব - ১০ ) ।। সমীরণ সরকার
0
September 01, 2025
মাধব ও মালতি
সমীরণ সরকার
পূর্বকথা:-
(অম্বিকা প্রসাদের নির্দেশ মতো অমরেন্দ্র আর অশোক মানবেন্দ্রের সব সময়ের সঙ্গী হল। তিনজনে একদিন বিকেলে কৃষ্ণপুরের জমিদার বাড়ি 'শিলাই ভিলা' দেখতে গেল। সেখানে জমিদার কৃষ্ণ কমল রায়ের প্রিয় সাদা ঘোড়া চেতক মানবেন্দ্র নারায়ণের মন কেড়ে নিল। জমিদার কৃষ্ণ কমল রায় মানবেন্দ্র নারায়ন কে একটি চ্যালেঞ্জ দিলেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ ওই চ্যালেঞ্জে জয়লাভ করলে তাকে চেতক নামের সাদা ঘোড়াটি জমিদার বাবু উপহার দেবেন, এই মর্মে কথা দিলেন।
গ্রামবাসীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে প্রতিযোগিতার অন্তিম ফল দেখার জন্য। মানবেন্দ্র নারায়ণের হাতে ঘোড়ার লাগাম তুলে দেওয়ার পর, মানবেন্দ্র খুব যত্ন সহকারে ঘোড়ার পিঠে চাপানো স্যাডলটি লক্ষ্য করল, তারপর ঘোড়াটার পিঠে চাপানো স্যাডলের দিকে নজর দিল। সে লক্ষ্য করে দেখল যে, তিনটি বিলেটের মধ্যে দুটি 'বিলেট' খুব টাইট করে বাঁধায় আরোহীর হয়তো কিছুটা সুবিধা হচ্ছে, কিন্তু ঘোড়ার বুকের এবং পেটের চামড়ায় গভীর দাগ পড়েছে। যা হয়তো ঘোড়াটির পক্ষে কষ্টকর বলে মনে হল মানবেন্দ্র নারায়ণের। সে 'ঘের' অংশটি একটু ঢিলে করে দিল। তারপর সে যে চেতকের শরীরের বিভিন্ন অংশে হাত বুলিয়ে দিল। ঘোড়াটার কানের কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে কিছু বলল। তারপর হঠাৎ চেতকের পিঠে চেপে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল সামনের দিকে।)
দশ
কিছুক্ষণ আগে চেতকের পিঠের বর্তমান আরোহীর বিচিত্র কাজকর্ম এবং তার ফলে চেতকের শরীরের বিভিন্ন অংশে যে আরাম অনুভূত হয়েছে এবং এখনো যে শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হচ্ছিল , তা চেতক তার সমস্ত সত্তা দিয়ে উপভোগ করছে। সেই সমস্ত অনুভূতি চেতকের কাছে এখনো টাটকা।তাছাড়া অন্যান্য প্রশিক্ষিত ভালো জাতের ঘোড়ার মতই চেতক তার পিঠে আসীন আরোহীর ওজন , লাগাম ধরার কায়দা এবং ঘোড়া ছোটানোর কৌশল থেকে বুঝতে পেরেছিল যে, এ তার রোজকার আরোহী নয়, ভিন্ন কেউ।
প্রতিদিনের গতানুগতিক পথে না চলে সবুজ ঘাসে ঢাকা বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে সামনের দিকে ঘোড়া ছোটানোর কারণে চেতক তার পিঠে উপবিষ্ট বর্তমান আরোহীর উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছিল।কে এই নতুন আরোহী? সে ঠিক কী চায় তার কাছ থেকে? তার আসল মালিক বা সহিস তার পিঠে আরোহন করেই তাকে জোরে ছোটানোর চেষ্টা করে, এই আরোহী তো সেরকম কিছুই করছে না।চেতক এগিয়ে চলেছে নিজের মত, স্বচ্ছন্দ গতিতে।
ঘোড়া ছোটানো শুরু করার আগে তার কানে যে বিচিত্র আওয়াজ করেছিল এই আরোহী, তা শুধু তাকে উদ্দীপনা যোগানোর জন্য ছিল না, ছিল গভীর মমত্ববোধের সুরেলা প্রকাশ। চেতক বেশ সচেতন হয়ে এগিয়ে চলেছিল সামনের দিকে।
দূর থেকে জমিদার কৃষ্ণ কমল এবং গ্রামের লোকেরা অবাক হয়ে দেখছিল এই তরুণের ঘোড়া ছোটানোর কৌশল।
প্রথমে শুধু গ্রামবাসীরা নয় ,কৃষ্ণ কমল নিজেও ভেবেছিলেন যে, মানবেন্দ্র নারায়ণ চেতকের পিঠে চেপে তাকে বাগে আনতে পারবে না। কিন্তু
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে মানবেন্দ্র নারায়ণ যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, বিস্মিত হচ্ছিল সবাই।
কিন্তু একটা ব্যাপারে কৃষ্ণ কমল স্থির ছিলেন যে,
ওই ছোকরা যেভাবে ঘোড়া ছোটাচ্ছে, তাতে ওই ঘোড়ার পিঠে চেপে ফুল সমেত কৃষ্ণচূড়ার ডাল ভেঙে নিয়ে আসা শুধু কষ্টকর নয়, অসম্ভব ।
কিন্তু , ওই ছোকরা মানবেন্দ্র নারায়ণ ঘোড়া নিয়ে কোথায় চলেছে? ওতো ওই কৃষ্ণচূড়া গাছ পেরিয়ে আরো সামনে চলে যাচ্ছে।
হ্যাঁ, মানবেন্দ্র নারায়ণ চেতককে নিয়ে ধীরে ধীরে দৃষ্টি আড়ালে চলে গেল। যেন মিলিয়ে গেল মাঠ পেরিয়ে দিগন্তে।
কৃষ্ণ কমল বিস্মিত হলেন। জনগণের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। মানবেন্দ্র নারায়ণের দুই সঙ্গী
অমরেন্দ্র আর অশোক দুশ্চিন্তায় পড়ল। সত্যি যদি কোন ক্ষতি হয়ে যায় মানবেন্দ্রের, তাহলে তারা বাড়িতে ফিরে গিয়ে ছোট কাকাকে কী কৈফিয়ত দেবে? তাদের কি তাহলে উচিত ছিল মানবেন্দ্রকে আটকানো? কিন্তু কিভাবে?
পুরো ব্যাপারটা যেভাবে পর পর ঘটে গেল, তাতে তো তাদের কোন ভূমিকাই ছিল না। কিন্তু এখন তো অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
ওদিকে মানবেন্দ্র চেতককে নিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর হাতের মোচড়ে
চেতককে উল্টো মুখে ঘুরিয়ে দিল। ঘোড়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে আবার সেই বিচিত্র আওয়াজ করল, যার সুরেলা বিস্তারে চেতক মুহূর্তের জন্য ছোটার ক্লান্তি ভুলে গেল।
এবার মানবেন্দ্র চেতকের গতি বাড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করলো। চেতক ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে ছুটতে শুরু করল।
কৃষ্ণ কমল সবিস্ময়ে দেখলেন, মানবেন্দ্র ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসছে , দ্রুত গতিতে।
কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে পৌঁছে মানবেন্দ্র ঘোড়া নিয়ে গাছটির চতুর্দিকে ঘুরতে শুরু করল। আস্তে আস্তে ঘোড়ার গতি বাড়ছিল। গাছের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ফুল ভর্তি একটা গাছের ডালের নিচে এসে মানবেন্দ্র ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে এমন ভাবে গতি রুদ্ধ করল যে, তাল সামলাতে না পারলে উপুড় হয়ে পড়ে যেতে পারে ঘোড়া ,মানবেন্দ্র ঘোড়ার সেই পতন আটকানোর জন্য ঠিক সেই মুহূর্তে তার পাদুকার সম্মুখভাগ দিয়ে চেতকের পেটে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সামান্য জোরে আঘাত করল। আর সেই আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই চেতক পিছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠল উপর দিকে। মানবেন্দ্র সেই সুযোগে ফুল ভর্তি একটি কৃষ্ণচূড়ার ডাল ভেঙে নিল। তারপর ঘোড়ার গতি নিয়ন্ত্রণ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
জনগণ চিৎকার করে উঠলো, জয় মা সর্বমঙ্গলা। ভট্টাচার্য মশাইয়ের নাতি জিতে গেছে। গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে সেই বৃদ্ধ এগিয়ে এসে মানবেন্দ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, সাবাস! আমার বয়স প্রায় সাড়ে তিন কুড়ি হতে চলল, কিন্তু সত্যি বলছি, এরকম ঘোড়া চালানো আমি কখনো দেখিনি। মা সর্বমঙ্গলা তোমার মঙ্গল করুন।
তাঁর প্রিয় ঘোড়া চেতককে ছেড়ে দিতে হবে বলে কৃষ্ণ কমল মনে মনে খুব ব্যথিত হচ্ছিলেন, কিন্তু যেহেতু তিনি হেরে গেছেন, কথার দাম তাঁকে রাখতেই হবে। শত হলেও তিনি এলাকার জমিদার । নিজের কথার মর্যাদা তাঁকে রাখতেই হবে।
তিনি এগিয়ে এসে মানবেন্দ্র কে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোমাকে দেখে সত্যি ভাবতে পারিনি যে, তুমি এত ভালো ঘোড়া চালাতে পারো। আমি বাজিতে যোগ্য লোকের কাছেই হেরেছি, এটা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করতে আমার কোন দ্বিধা নেই।
যাও , আজ থেকে আমার 'চেতক' তোমার হল।
(চলবে)
****************************************
Regards -
Dr. Samiran Sarkar
Khelaghar, Lautore
P.O : Sainthia, Dist : Birbhum.
W.B - 731234
Mob : 8509258727
Khelaghar, Lautore
P.O : Sainthia, Dist : Birbhum.
W.B - 731234
Mob : 8509258727