গল্প ।। সৈকতরেখা ।। সুদীপ্ত পারিয়াল
0
September 01, 2025
সুদীপ্ত পারিয়াল
দুপুর বারোটা নাগাদ আমাকে বেরিয়ে পড়তে হয়, আমার ছেলে রিককে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছি। বাড়ির খুব কাছেই স্কুল, তবুও ওর বন্ধুর মায়েদের সাথে আমারও বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। স্কুল জীবনের বন্ধু, কলেজ জীবনের বন্ধু, তারপর কিছুদিন চাকরি করেছিলাম, সেই সময়কার বন্ধু- সবকিছু মিলিয়ে ছেলে যখন হল তখন ভেবেছিলাম বন্ধুত্বের পর্ব বুঝি এবার শেষ হল। কিন্তু সব শেষেরই যে একটা শুরু থাকে, সেটা বুঝলাম ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করার পর।
যখন প্লে স্কুলে ছিল, তখন ওর বাবাই দিয়ে আসত। এখন দুপুরবেলা স্কুল হয়ে গেছে বলে আমাকে যেতে হয়।
আমাদের বাড়ির গলিটা পেরিয়ে সবে আমি বড় রাস্তায় পা দিয়েছি, দেখি গাড়ি সার্ভিসিং-এর দোকানটায় দাঁড়িয়ে আছে সৈকত। হঠাৎ আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে ১১বছর আগে।
ওকে মাঝে মধ্যে দেখতে পাই, ঠিক কথা। কিন্তু, আজকে একদম চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি চোখ নামিয়ে চলে যাচ্ছিলাম, ও সানগ্লাসটা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে ডাক দিল, কেমন আছো সুচিদি?
সৈকত আমাকে ওই নামেই ডাকত, ভুলে গিয়েছিলাম সম্পর্কের বুননগুলো। ওর ডাকের জন্যই বোধহয় আমার জড়তা কেটে গেল, আমি বললাম, ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?
- কেমন দেখছো?
সৈকত ওর জিম করা ফিট বডির মাসল দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল ও শরীরচর্চা নিয়ে দিব্যি রয়েছে।
এইটুকু কুশল সংবাদ নিয়েই আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি ও বলল, এই স্কুলেই তোমার ছেলে পড়ে?
- হ্যাঁ, ক্লাস টু-য়ে পড়ে।
- আমার সাথে বিয়ে হলে, আমাদের ছেলেকে আমি কখনো ওরকম পাতি বাংলা মিডিয়ামে পড়াতাম না।এখনকার দিনে যা কম্পিটিশন, তাতে এরকম সরকারি স্কুলে পড়ে কিছু লাভ নেই।
আমি বললাম, কি করব বলো? যার যেমন ক্ষমতা।
আমাদের বিয়ে নিয়ে অন্য কোন অসুবিধা ছিল না। ছিল শুধু আমাদের বয়সের সমস্যা। সৈকতের বয়স তখন ছিল ২১, আর আমি তখন ২৫ বছরের।
এখনকার দিনে এই সমস্যাটা তেমন কিছুই নয়, কিন্তু ওদের বাড়ি থেকে কিছুতেই মেনে নেওয়া হল না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো সৈকত নিজে থেকেও চায়নি। যদি ও একবার বলত তাহলে আমি গিয়ে ওর মা-বাবার সাথে কথা বলতাম।
যা হয়নি তা ভেবে কি লাভ? আমার স্বামী মোহন আমার থেকে প্রায় ১০ বছরের বড়। কিন্তু তবু ডাল ভাত খেয়ে আমরা বেশি সুখে আছি। ওর একটা ছোট্ট ব্যবসা আছে, আর তার সাথে ও টোটো চালাচ্ছে আজকাল।
আমাদের স্কুলের কাছাকাছি ওর বাড়ি। আমার এক বান্ধবীর সাথে ও প্রেম করত। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক ওদের বিয়েটা হয়নি। আমার সাথে বিয়ে হয়েছে মোহনের।
সৈকত অনেকদিন পর আমার হাতটা ধরল, বলল, আমার সাথে একবার ঝিল পাড়ে যাবে?
- কেন?
- এমনি, ওখানেই তো আমরা কথা বলতাম কত। যখন তোমার কথা খুব মনে পড়ে ওখানে গিয়ে বসে থাকি।
-এখন যে আমি আর আগের মতন নেই সৈকত, আমার ছেলের স্কুল ছুটির সময় হয়ে গেছে। যেতে হবে...
সৈকত আকুল ভাবে বলে, তাহলে তোমার নাম্বারটা দাও!
- আমি তো নাম্বার চেঞ্জ করিনি।
একটা ইতিবাচক বার্তা যেন সৈকত পেয়ে গেছে। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। দেখলাম অনেকক্ষণ আগেই ছুটি হয়ে গেছে রিকের। মাঝে মাঝে একটু তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যায়। ফেরার সময় দেখলাম একইভাবে ও দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছিলাম রিকের সাথে ওর চোখাচোখি করাবো না সৈকতের। কিন্তু এত সহজে এড়িয়ে যাবার মতন মুহূর্ত এটা নয়।
সৈকত রিকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমি তোমার একটা আঙ্কেল।
- ও, কিছু বলবেন?
- ভাবছিলাম তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাব।
রিক মায়ের হাত ধরে বলল, মা ছাড়বে না।
-তাহলে মা-ও সাথে চলুক।
আমি বললাম, আজ নয় অন্য কোনদিন।
সৈকত বলল, আচ্ছা বাবা সরি! তোমার স্বামীকে অপমান করে থাকলে আমি ক্ষমা চাইছি। আমাদের ছেলে হলে তাকেও এই স্কুলেই পড়াতাম।
- এবার আমরা তাহলে যাই!
- সময় দেওয়া যাবে না আজকে কিছুতেই?
এই গভীরভাবে আকুতির পর কিছুতেই আর না বলতে পারলাম না।
ওর বাইকটা সার্ভিসিং হচ্ছিল, তাই অন্য একটা বাইক নিয়ে, আমাকে পিছনে বসিয়ে আর রিককে সামনে বসিয়ে ও এগোতে শুরু করল বাইক নিয়ে। ঠিক আগের মতোই আমার হাত দুটো নিয়ে ওর কোমরের সাথে জড়িয়ে নিল।
আমি নিজের অজান্তেই ওর পিঠে মাথা দিতেই ওর তীব্র পুরুষ ঘ্রাণে একটা অযাচিত কান্নার দলা গলা থেকে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে আমার অন্তর থেকে।
রিক একটু দূরে দাঁড়িয়ে খেলছে, এখানে অনেক বাচ্চা ছেলেরা এখন থেকেই খেলতে শুরু করে দিয়েছে। আমি আর সৈকত আগে যেখানে বসতাম, সেখানেই বসে আছি। ১১ বছরে জায়গাটা অনেক বদলে গেছে। আগে বসার জায়গাগুলো এতটা সুন্দর করে সাজানো ছিল না। কিন্তু আগের সেই মনটা আজকে আর খুঁজে পেলাম না।
বললাম, এবার বলবে কেন নিয়ে এলে?
- একটা দিনের জন্য একটু তোমার সাথে সময় কাটাবো তাই।
- সেটা যে আর সম্ভব নয় খুব ভালো করেই তো জানো।
- তাহলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। শুধু তোমাকে দেখি, এতেই হবে।
- আমার ভালো লাগছে না। চলো আমাকে ছেড়ে দিয়ে আসবে, নয়তো আমি একাই চলে যাচ্ছি।
- এখন আমাকে তুমি সহ্য করতে পারছ না, কিন্তু একটা সময় তুমি আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল!--এত কেন বদলে গেলে সুচিদি?
- হয়তো সময়, বদলে দিয়েছে। এখন এভাবে আমাদের দেখা করা ঠিক নয়। যদি মোহন জানতে পারে...
- পারলে, পারবে। তুমি তো অন্যায় কিছু করছ না।
- ভর দুপুরবেলা প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে দেখা করা কোন অন্যায় জিনিস নয় তাহলে?
- পর পুরুষ!....
সৈকত হাসল। গম্ভীর একটা গুরুত্ববহ হাসি। আমি সেটা বুঝতে পারি, যে পুরুষ একদিন আমার একার ছিল, এখন সে অনেক দূরে সরে গেছে। তবে আমার মনে সৈকতের জায়গা যে ঠিক আগের মতনই আছে, তা আজকে আবার প্রমাণিত হয়ে গেল।
১১ বছর যদি কোন ঘর পরিষ্কার করা না হয় তাহলে সে ঘরে যেরকম ধুলো জমবে, প্রতিটা ইটে যেরকম উইপোকারা বাসা বাঁধবে, ঠিক তেমনি সৈকতের অবস্থানে মোটা একটা ধুলোর পরত জমেছিল, সেই ধুলোময় ঘরটায় এখন পরিস্করনের কাজ চলছে।
সৈকত আবার হাতটা ধরে আমার, বলে, তুমি ভালো আছো তো সত্যিকারের?
আমি ওকে ভাবছিলাম জিজ্ঞাসা করব সত্যিকারের ভালো থাকা ঠিক কাকে বলে? পরমুহুর্তে মনে হলো, ওর খবর তো জিজ্ঞাসা করা হয়নি একটাও। ওর জীবনে আর কোন নারী এসেছে কিনা তা তো জানা হলো না!
সারা জীবন ও কেন এভাবে কাটাবে?
সৈকত এবার আমার হাতটা নিয়ে চুমু খেলো একটা, তারপর সেটা ওর বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল, মাঝেমধ্যেই অক্সিজেনটুকু আমাকে দেবে গো? এর বেশি আমার আর কিছু চাই না!
আমি নিজেকে চরমভাবে সংযত করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম, আমার একটা কান্না পেয়ে যাচ্ছিল, অনেকক্ষণ ধরেই কান্নাটা আমার মধ্যে জমছিল, বাইকে করে ওর সাথে যখন আসছিলাম তখন ওর গায়ের গন্ধে আমার সেই পুরনো চেতনাগুলো ফিরে ফিরে আসছিল, দলা পাকানো কান্নাটা তখনো বেরিয়ে এসেছিল একবার।
আমার ছেলেটা ছুটে এসে আমাকে বলল, ওমা? কখন বাড়ি যাবে? খিদে পেয়েছে তো?
আমি ছেলের হাত ধরে উঠে পড়লাম, সৈকত বলল, ছেড়ে দিয়ে আসি চলো।
ও বাইকটা আনতে গেল, একটু দূরে বাইকটা রাখা আছে। আমি আর রিক রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম, ঠিক তখনই দেখি রিকের বাবা টোটো নিয়ে আসছে, এক মুহূর্তের জন্য মনের মধ্যে একটা ভয় এসে গেল, কিন্তু তারপরে যেন শান্তি নেমে এলো বুকে। সত্যি কথা বলতে আমার কল্পনাতেও আসেনি এই সময় রিকের বাবা আসতে পারে। আমাকে দেখে বলল, তুমি এখানে কি করছ?
রিক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি রিককে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়লাম টোটোতে। বললাম বাড়ি চলো তাড়াতাড়ি।
আবার সেই কান্নাটা আমাকে পেয়ে বসেছে, রিক কেমন যেন চুপ করে বসে আছে আমার পাশে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে।
আমি পিছন ঘুরে দেখলাম যেখানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানে এসে দাঁড়িয়ে সৈকত আমার দিকে দেখছে। ডান হাতটা তুলে একবার নাড়াল।
========================
সুদীপ্ত পারিয়াল
ঠিকানা: ধাড়সা ব্রাহ্মণ পাড়া, জি আই পি কলোনি,
হাওড়া – 711112