গল্প ।। কোনোও একদিন ।। জয়শ্রী ব্যানার্জি
0
September 01, 2025
কোনোও একদিন
জয়শ্রী ব্যানার্জি
ট্রেন থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকালো রিমা। স্টেশন এ খুব ভিড়। অফিস টাইম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো সে এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মে। তারপর বাইরে বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। মানুষ, রিকশা অটো ,বাসের ভিড় এ দৃষ্টি প্রসারিত করলো। হ্যাঁ ওই তো দেখা যাচ্ছে বাবাকে ! নীল চেক শার্ট পড়া বাবাও তাকে দেখতে পেয়েছে। হাত নাড়লো বাবা, রিমাও পাল্টা হাত নাড়লো। বাবা কাছে এগিয়ে এলো কতক্ষণ এসেছিস? এই তো মিনিট ১০ হবে বোধায় ! রিমা বলল, আচ্ছা চল ভিতরে কোথাও বসি। কিছু খাবি এখন? বাবা জিজ্ঞাসা করলো। ভাত খেয়ে এসেছি গো। ইউনিভার্সিটি তে ক্লাস আছে আজ ১২টা থেকে। ততক্ষন চলো কথা বলি।
ব্যস্ত স্টেশনের একটু নির্জনতা দেখে দুজনে বসলেন। সুকান্ত বাবু সস্নেহে রিমার দিকে তাকালেন। হলুদ তাঁতের শাড়িতে সুন্দর লাগছে যদিও দৃষ্টি তে বিষণ্ণতার ছাপ।
রিমা তাঁর বড়ো মেয়ে । মাস পাঁচ/ ছয় হলো বিয়ে হয়েছে। নতুন বিবাহিতা বলতে গেলে এখন!
ইংরাজী নিয়ে MA পড়ছে। কিছু দিন যেতে না যেতেই যে ভাবে ওকে হেনস্থা করা হচ্ছে নানা ব্যবহারে তাতে তিনি বাবা হিসাবে চিন্তিত। ফোন করতে পারে না খুব সুযোগ বুঝে লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু কথা বলেছে তাঁকে। কাল বিকালে কেউ ছিল না বাড়িতে ফোন করে মেয়ে বলল দেখা করতে চায় স্টেশনে। তার ক্লাস আছে একটু আগে বেরোবে । দরকার হলে ক্লাস অফ দেবে কিন্তু বাবা কে সে একটু দেখতে চায় ।কিছু কথা আছে।
মেয়ে তার স্বভাবে ভালো সরল মনের , মিশুকে সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করে খুব যে কাজে কর্মে এক্সপার্ট তা না তবে সময়ের সাথে সাথে একদিন পরিণত হবে ঠিকই । পড়াশোনায় ভালো ।জানার আগ্রহ আছে অনেক কিছু বিষয়ে ।সন্তান মনোকষ্টে থাকলে কোন মা বাবা ভালো থাকে!
বিয়েটা কি তাড়াতাড়ি দিয়ে দিলেন ? প্রশ্ন এলো মনে ।আরেকটু খোঁজ খবর নিলে ভাল হতো মনে হচ্ছে ।
মেয়ের মুখটাও কেমন শুকনো শুকনো লাগছে।
যা একটু চোখে মুখে জল দিয়ে আয় ।ঠিক আছি গো! রিমা উত্তর দিলো তার পর বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো ,তুমি খেয়ে বাড়ি থেকে কিছু খেয়ে এসেছো ?
হ্যাঁ। সুকান্ত বাবু ঘাড় নাড়ালেন কি বুঝছিস? ঠিক হয়েছে পরিস্থিতি ?
তুমি কি ওদের বলেছিলে যে প্রিয়ম কে বোতাম দেবে ? রিমা সুকান্ত বাবুর দিকে তাকায় , তেমন তো কোনো কথা হয়নি। কেনো কি বলছে ওরা? সুকান্ত বাবুর প্রশ্ন।
ওই বার বার শোনাচ্ছে শাশুড়ি, সোনার বোতাম দেবার কথা ছিল প্রিয়মকে, তোমার বাবা দেয়নি ।
প্রিয়ম অবশ্য আমায় কিছু বলেনি । বাড়ি থেকে কে কি দিয়েছে বিয়েতে শাশুড়ি খোঁজ নিচ্ছিল । আমি বেরিয়ে গেলে আমার ঘরে ঢোকে এটা ওটা আমার জিনিস পত্র নিয়ে দ্যাখে . ,বাড়ির কাজের মেয়েটা দেখেছে।সব থেকে বড় কথা উঠতে বসতে শুতে জাগতে বড়ো বউ এর সাথে তুলনা । সে এলে আমাকে চিনতেই পারে না। মন ভারী হয়ে থাকে । এত বাজে ব্যবহার করে । শ্বশুরের খাওয়া হয়ে গেলে শাশুড়ি সবাই কে নিয়ে খেতে বসবে টেবিলে ।আমার জায়গা হয়না ।আমি নিচে বসি । প্রিয়ম এরও কিছু ভাবান্তর হয়না এসব নিয়ে ।পাশে বৌদি ভাইঝি কে নিয়ে গল্প করতে করতে খায় । ফ্রিজে মাছ উপচে পড়ছে এদিকে রান্নার সময় আমার জন্য বরাদ্দ ল্যাজা। জানতাম নেই আর, ঠিক আছে আমায় দিলো কিন্তু যেখানে আছে সেখানে আমার জন্যই রোজ কেনো! বাড়িতে কোনোদিন খাইনি ।কাঁটা লেগে যায় গলাতে । ট্রে ভর্তি ডিম। বললে বিশ্বাস করবে না ।আমি ভাজলাম ।শাশুড়ি পাশে দাঁড়িয়ে দিয়ে ওই ডিম থেকে এত টুকু কুচি দিয়ে বলছে নাও তুমি টেস্ট করো।আরেকটা কি ভাজা যায়না বা হাফ দিক তাকে !
সুকান্ত বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ।ভেবেছিলেন মেয়েটা ভালো ঘরে পড়েছে ।অভাব হবে না এদিকে এই রকম মন ! মনে করার চেষ্টা করলেন বোতাম কি চেয়েছিলেন ওনারা ।কি জানি খেয়াল করতে পারছেন না । তাঁর শুনতে ভুল হয়েছে হয়তো কিন্তু বোতাম কোথায় পাবেন এখন ! সেটা বিক্রি করে অষ্টমঙ্গলা তে খরচ করেছেন । এই সময় বিয়ে উপলক্ষে তাঁর ধার । এই মুহূর্তে এখন তো বোতাম দিতে আর পারবেন না । তাঁর আরও দুটি সন্তান আছে । তাঁদের পড়াশোনার খরচ । ঈশ্বরের কৃপায় যদি ছেলেটার একটা চাকরি হয় ভবিষ্যতে তাঁর অবস্থা কিছুটা ফিরবে । বিয়ের খরচের দরুন জমি বিক্রি করতে হয়েছে কিন্তু রিমা যদি অসুখী হয় হেনস্থা হতে হয় বাবা হয়ে সেটা কি করে দেখবেন !
ট্রেন আসছে যাচ্ছে । ঘোষণা চলছে । লোক জন নামছে উঠছে । প্ল্যাটফর্ম এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকজন ।নজরে এলো এক যুবক একটি বাচ্ছা মেয়েকে বলছে তুমি মায়ের কাছে থাকো আমি এখনি আসছি ।মেয়েটি কিছুতেই শুনবে না । হাপুস নয়নে কাঁদছে না তুমি যাবে না আমায় ছেড়ে ।ওর মা বোঝাচ্ছে তিন্নি অমনি করে সোনা, বাবা একটা জিনিস কিনতে যাচ্ছে এখনি আসবে তুমি থাকো এখানে ।একটু পরেই আমাদের ট্রেন আসবে । বাচ্চাটি জেদ করে চলে, অবশেষে বাবা কোলে তুলে নেয় আর বাচ্ছাটিও চুপ । বাবার কোলে উঠে শান্তি তার । কোলে নিয়ে আদর করতে করতে যুবকটি প্ল্যাটফর্ম এর দিকে থাকা দোকান গুলোর দিকে এগোলো । সুকান্ত বাবুর মনে পড়লো রিমা ও এমনি তার বুকের কাছে শুয়ে থাকতো । বাইরে থেকে ফিরলেই ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো তাঁর কোলে । তিন সন্তান ই তাঁর কাছে খুব প্রিয় । বলতে গেলে জীবন । শুধু সন্তান রা না স্ত্রীকেও তিনি খুব ভালোবাসেন । পরিবার আত্মীয় স্বজন ,বন্ধু এদের ও তিনি নিজের ভাবেন ।
কি জানি প্রিয়ম কেমন ব্যবহার করছে ।মেয়ে হয়তো সব বলতে পারছে না ।
কটা থেকে ক্লাস তোর ? ১২ টা থেকে আছে । সে একটা ক্লাস বাদ গেলে কিছু হবে না। অসুবিধা নেই ।রিমা একটু উদাস সুরে বলল
সুকান্ত বাবু মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন খেয়েছিস?
হ্যাঁ।রিমা ঘাড় নাড়লো।সুকান্ত বাবু উপর শুনে সন্তুষ্ট হলেন না । মুখটা শুকনো কেনো ?
কিছু না ।ওই আর কি! কাল রাতে একটু কথা কাটাকাটি হয় শাশুরির সাথে নিজে মিষ্টি খেয়ে নিয়ে আমার নামে দোষ দেবে । সকালে এমন করছে রান্না ঘরে আমায় ঢুকতে দেবে না কিছুতেই ।কোনো রকমে কালকের না খাওয়া ডিমের তরকারি গরম করে তাও ভালো করে গরম হয়নি ঠান্ডায় বলতে গেলে সেটা দিয়ে এক মুঠো ভাত কোনো রকমে খেয়েছি ।
ঠাকুমার সাথেও দুর্ব্যবহার করে শাশুড়ি , ভালো করে খেতে দেয়না ।আমি একটু দেখাশোনা করি বলি ঠাকুমার, সহ্য করতে পারছেনা ।কি গল্প করি দুজনে আড়াল থেকে শোনে।আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলবে শ্বশুর আর প্রিয়মের কাছে জা আর শাশুড়ি মিলে, আর সেগুলো না যাচাই করে প্রিয়ম আমায় দোষারোপ করে ! যা আমি বলিনি করিনি ।বলতে বলতে রিমার দু চোখ জলে ভরে ওঠে । সেদিন হঠাৎ করে প্রিয়মের একটা জায়গায় কাজের সূত্রে ভোরে বেরোনোর ছিল ।হঠাৎ নাকি ঠিক হয়েছে ।বাড়ি ফিরে মা কে বলতে গিয়ে দ্যাখে মা বাবা ঘুমিয়ে গেছে তাই আর ওনাদের ওঠায় নি । আমায় বলেছিল ভোরে বেরোব আমায় তাহলে একটু চা করে দিও । সেই চা টা করে দিয়েছি নিজের স্বামীকে শুধু । আমি কোনো অপরাধ করিনি সারাদিন কেউ কথা বলল না ওরা আমার সাথে ।খেতেও ডাকেনি।পড়তে পড়তে চোখ লেগে গেছিল ।হঠাৎ চোখ খুলে দেখি পৌনে তিনটে ।সবার খাওয়া শেষ ।আমি একা খেলাম । তরকারি তে শুধুই আমার জন্য আলু রাখা। খারাপ দুপিস আম , একটা ল্যাজা ।প্রচুর চাল নেয় সেই ভাত বেড়ে যায় ফ্রিজে রাখে দিয়ে বলে ওটা রাতে খেয়ে নিও রিমা তোমাদের বাড়িতে রাতে তো ভাত হয় রুটি কি জিনিস জানো না, এই পাড়ায় কেউ গরম করে ভাত খায়না । আর নিজেদের জন্য ফুলকো গরম রুটি আলাদা তরকারি ।আমাদের বাড়িতে রাতে ভাত হয় কিন্তু এই ভাবে খাই কি আমরা? আমায় ওরা ভিখারীর মতো দ্যাখে ।
আমি অনেক জিনিস সঙ্গে করে আনিনি বলে, তোমার অভাব থেকে দিতে পারোনি বলে আমার এই শাস্তি !রিমার স্বরে কান্না স্পষ্ট ।
সুকান্ত বাবুর বুক চিন চিন করে উঠলো ।নিজের ব্যর্থতা ধরা পড়ল যেন! মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বললেন ভাবিস না সোনা যদি তেমন হয় তোকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো আমি ,তোকে আলাদা করে জমি দেবো।ভাবিস না ।তোর বাবা আছে বেঁচে ।আমি বুঝতে পারিনি রে ।তোর মা বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছিল আমিও ভাবলাম ভালো পরিবার খুব স্বচ্ছল ।বাড়িতে পড়াশোনা চাকরির পরিবেশ আছে তোর ভালো হবে তাই রাজি হয়েছিলাম ওদের প্রস্তাবে ।তোর বাবা আছে ।ভয় পাস না চিন্তা করিস না ।
তুই একটু বস আমি কিছু কিনে আনছি । খাবি তুই ইউনিভার্সিটি তে অফ পিরিয়ডে।
সুকান্ত বাবু উঠে গেলেন , রিমা ঘড়ি দেখলো ১১টা। উদাস দৃষ্টিতে সে সামনে চেয়ে দেখলো সকালের ঝিরঝিরে বৃষ্টির পর আকাশ এখন থমকে আছে ।
মাধবীলতার ঝাড় বৃষ্টি মেখে লাজুক মুখে স্নিগ্ধ রূপে হাসছে যেন। অদূরেই একটা গুলঞ্চ ফুলের গাছ । পাতা ফুল পড়ে আছে ঝরে নীচে ।
কত শত যাত্রী কেউ ধীর পায়ে কেউ ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে এদিক ওদিক । টক ঝাল লজেন্স ,হরেক রকমের জিনিস, সোনপাপড়ি, দিলখুশ,ঝালমুড়ি ইত্যাদি নিয়ে হকার দের ওঠা নামা ...ঠেলা গাড়িতে বিক্রি হচ্ছে সীতাভোগ মিহিদানা ।এক টিটি বিনা টিকিটের যাত্রী ধরেছে ! সম্ভবত ছুটি শেষে কাজে জয়েন করতে যাচ্ছে এক জওয়ান।ব্যাগ পত্র টিকিট হাতে নিয়ে নিজের স্লিপার খুঁজছে । একদল তরুণী উচ্ছ্বাস ভঙ্গীতে খেলার ড্রেস পড়ে এগিয়ে আসছে বাইরের দিকে । হয়তো কোথাও থেকে জিতে ফিরছে তারা ।চোখে মুখে তাদের প্রফুল্লতা । ২নম্বর প্ল্যাটফর্ম এর ট্রেনটা ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ।
একটু মেঘলা । সেই খুব ভিড় টা এখন একটু যেনো পাতলা লাগছে । এই এত লোক জন।কত তাদের কাহিনী । কারো জীবনে না চাইতেই মেলে কত কিছু , মসৃণ পথ, কারো সারাজীবন সংঘর্ষ।কেউ নিজের পার্থিব জীবন নিয়ে অবহেলার চোখে দ্যাখে কেউ সারাজীবন অন্য দের ওপরে ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে যায় ।কেউ সব উজাড় করে দিয়েও বিনিময়ে পায়না কিছুই ! কারো মা বাবা নেই তো কারো সংসার নেই । কারও প্রেমিক প্রেমিকা কথা রাখেনি কারও বা আবার স্বামী স্ত্রী তে বনিবনা নেই ।কেউ শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত অবহেলিত কেউ বা আবার কি সুন্দর গুছিয়ে সংসার করে !
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিমা ! তার পড়া নিয়ে শ্বশুর বিশেষ করে শাশুড়ি বিন্দুমাত্র খুশি না । প্রিয়ম অবশ্য পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলে না কিন্তু সে কি বোঝে ওকে! তার ভালোবাসা অপেক্ষা আকুতি সব কিছুই প্রিয়ম কেমন উপেক্ষার চোখে দ্যাখে । সব কিছুতেই খালি বৌদি ! আর তার বাপের বাড়ির লোক জন নিয়ে তার ওঠা বসা । রিমার বাপের বাড়ির কাউকে চেনেই না । খারাপ লাগে রিমার। বাপের বাড়ি ফিরে কি হবে! বাবার এত খরচ হলো বিয়েতে আবার ফিরে বোঝা হয়ে লাভ কি! তার পর আরও দুটো ভাই বোন ,সংসার ।বাবা কত টানবে ! বাবা তো চাকরি করে না জমির আয়ে ভরসা ।তার পর পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় বন্ধু দের মধ্যে যারা হিংসুটে তাদের মজা হবে ! হেরে যাব আমি? নিজেকেই প্রশ্ন করলো রিমা। আমি তো ময়দান ছেড়ে চলে যাবার মেয়ে না ।তার পরক্ষণেই মনে হলো ভালোবাসা কি জোর করে মেলে! ওটা তো একটা মানসিকতা ! অনুভূতি ।নিজের বোধ থেকে আপণ করে নেওয়া ।ওরা করে না ।চায় না রিমাকে। রিমার কষ্ট হলো ।বাবাকে সব বলা হলো না ।কি কষ্ট হয় থাকতে রিমার । যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে শাশুড়ি জা।শ্বশুরমশাই ভালো ।ভাসুর ও সেই ওদের দলে ।রিমার সাথে কথা বলে না ।স্বামীর ব্যবহার আবহাওয়া ।কখনও ভালো কখনও মন্দ ।রিমা বোঝে না কি করবে ! মানসিকতায় মিল নেই ওদের বাড়ির সাথে । বন্ধু বলতে ঠাকুমা ।রিমা তাও চেষ্টা করে মানিয়ে নিয়ে চলছে কিন্তু সে ভেঙে পড়ছে বৌদি আর শাশুড়ির ষড়যন্ত্রে। ভাবতে ভাবতে রিমার দৃষ্টি গেলো এক বৃদ্ধ বৃদ্ধার দিকে । বৃদ্ধা সম্ভবত অসুস্থ বা ক্লান্ত ।ঘুমিয়ে গেছেন স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে । পরম যত্নে বৃদ্ধ স্বামী তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন । ওনার একটি হাত বৃদ্ধার অন্য হাতটি ধরে রেখেছে । বৃদ্ধার হাতে শুধু শাঁখা পলা নোয়া। মাথায় জ্বলজ্বলে সিঁদুর ।
রিমার মনে হলো আর কোনো অলংকারের দরকার নেই ওনার ।ওনার স্বামী ওনার অলংকার ওনার অহংকার । রিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে বোতল বার করে জল খেলো । ইউনিভার্সিটি তে ক্লাসে কয়েক জনের হাতে ফোন দেখলেও তার মোবাইল ফোন নেই ।স্বামীর আছে ।ল্যান্ড ফোন ই ভরসা ।আর সেখান থেকে কথা বলতে গেলে শাশুড়ি দাঁড়িয়ে থাকে । সামান্য দু চার কথা বলে ছেড়ে দিতে হয় আর এদিকে স্নান সেরে শাশুড়ি বসেন তাঁর বাপের বাড়ির লোক দের ফোন করতে ।বহু ক্ষণ ধরে কথা চলে তখন পুরুষ মানুষ কাজে বাইরে ।এদিকে বিল এলে দোষ হয়ে যাচ্ছে রিমার ।
সে নাকি অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলে ।এই নিয়ে প্রিয়ম ও তাকে বলেছে না জেনে !
ব্যাগে রাখা কৌটো খুলে একটু জোয়ান মুখে দিল রিমা । একটু সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো ।বলা যায়না শ্বশুরবাড়ির কেউ পরিচিতর সাথে দেখা হয়ে গেলো এখানে, ব্যাস ! অমনি বাড়িতে বলে দেবে !
সুকান্ত বাবু সামনে এসে দাড়ালেন ।এই গুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখ রিমা । রিমা দেখলো বাবা দানাদার ,মাখা সন্দেশ ,দুটো মিষ্টি পাউরুটি আর একটা খেজুরের প্যাকেট আর এক শিশি হজমোলা এনেছে ওর জন্য । এত কিছু কি জন্য আনতে গেলে বাবা ? রাখনা খাবি তুই আর শোন এই ২০০ টাকা দ্যাখ . ভাড়া আছে টাউন সার্ভিস ধরার ?খুচরো ৫০ টাকা রাখ সুকান্ত বাবু জিনিস গুলো রিমার ব্যাগে ভরে দিলেন ।
রিমা বলল আছে ভাড়া। তাহোক রাখ বলে সুকান্ত বাবু ওর হাতে আরো ৫০ টাকা ধরিয়ে দিলেন ।
তুমি খাবে না বাবা ? আমি খেয়ে এসেছি । দুটো রসগোল্লা খেলাম আর মিষ্টি নিয়েছি বাড়ির জন্য ।
রিমা একটা ঝাল মুড়ির ঝাঁকার দিকে তাকাচ্ছে দেখে সুকান্ত বাবু জিজ্ঞাসা করলেন,
ঝালমুড়ি খাবি? হ্যাঁ বলে রিমা ঘাড় নাড়লো ।
ঝালমুড়িকে ডেকে দুটো ঠোঙা দিতে বললেন সুকান্তবাবু। মেন লাইনের একটা ট্রেন বেরিয়ে গেলো।হঠাৎ গেলো গেলো চিৎকার শুনে সবাই সামনে তাকিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিতে লাগলো । অদূরেই নিমেষে মানুষের জটলা ।সুকান্ত বাবু এগিয়ে গেলেন কি হয়েছে ভাই ওখানে? রিমা ও এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ালো । ঝালমুড়ি ওয়ালাও ঝাঁকা রেখে ভিড়ে এগিয়ে দেখতে গেলো,
এক মহিলা ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দিয়েছে ।একজন উত্তর করলেন। ততক্ষণে ঝালমুড়ি ওয়ালা চলে এসেছে ,বললো এক বিবাহিতা মহিলা ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দিয়েছে । দুটি বাচ্ছা ছেলে মেয়ে কাঁদছে পাড়ে। পুলিশ এসেছে ।
ইসস আহারে! সুকান্ত বাবু বলে উঠলেন রিমা বলল বাচ্ছা দুটির কি হবে বাবা ? কোনো মানে হয়! সন্তান দুটোকে এমনি করে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর দিকে ঠেলে দিয়ে এ যাওয়ার কোনো মানে হয়না!
পরক্ষণ ই মনে হলো না জানি কত কষ্ট পেয়ে এই রকম করে চলে গেলো মহিলাটি। আহারে! মনের ঠিক ছিল না হয়তো নাহলে বাচ্ছা রেখে মা কি পারে যেতে এমন করে!
সুকান্ত বাবুর মন টা খারাপ হয়ে গেল । রিমার ওপরে প্রভাব না পড়ুক এই ঘটনার। হয়তো বিবাহিতা মহিলাটি সাংসারিক জীবনে সুখী ছিলেন না মনের দুঃখে মরণ বেছে নিলেন আবার অন্য কারণও হতে পারে !
তিনি বলেন কপাল এর লিখন কে আটকাবে! তিনি চায়ছিলেন রিমা কে নিয়ে বেরিয়ে যেতে ।যদিও মন টা কষ্ট হচ্ছিল বাচ্ছা দুটির জন্য ! যদিও পুলিশ এসেছে তারা হয়তো খুঁজে বার করবে ঠিকই কোথায় ঠিকানা তাদের। আর যদি না পাওয়া যায়! মনটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেলো । ঝালমুড়ি নিয়ে ভারাক্রান্ত মনে বেরিয়ে এলেন দুজনে স্টেশনে থেকে। দাঁড়িয়ে খেয়ে নিলেন দুজনে এক পাশে। দুজনেরই খিদে পেয়েছিল কিন্তু সেই ভাবে ঝালমুড়ির স্বাদ লাগছিল না হয়তো মনটা খারাপ বলে।
দুজন বাচ্চা ছেলে ভিক্ষা চায়ছিল ওদের কাছে রিমা তাদের মিষ্টি পাউরুটি দুটো আর দুজনকে পাঁচ পাঁচ করে কয়েন দিলো ।।
তার পর একটা টাউন সার্ভিস দেখে সুকান্ত বাবু রিমা কে তুলে দিলেন বাসে।
উঠেই রিমা সিট পেয়ে গেলো জানালার দিকে ।জানালা দিয়ে বাবার দিকে তাকাতে তাকাতে
রিমার খুব মন খারাপ লাগছিল মনে হলো বাবা কে ছেড়ে সে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে কিংবা বাবা হয়তো দূরে চলে যাচ্ছে। আর বোধয় দেখা হবে না । রিমা হাত নাড়লো ।বাবাও ।বাবাকে ক্রমশ ঝাপসা লাগতে লাগলো রিমার ।
মেয়ে দৃষ্টির বাইরে গেলে সুকান্ত বাবু আবার হাঁটা দিলেন স্টেশনের দিকে । সদ্য মা হারা দুই বাচ্ছা দুটি কি ঠিকানা বলতে পারলো পুলিশকে! প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে সুকান্ত বাবু অ্যাক্সিডেন্টের জায়গার দিকে এগোলেন ।ভিড় এখন পাতলা । দেহ তুলে নেওয়া হয়ে গেছে । বাচ্ছা কাউকে দেখতে পেলেন না ।সবাই যে যার গন্তব্য এর দিকে এগোচ্ছে । এই তো জীবন! একটু আগেই কি প্রবল ভাবে অস্তিত্ব ছিল আর তার কয়েক মিনিট পরেই আর নেই কিছু ! সব কিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে । কাউকে কি আর ভাবাচ্ছে এই না থাকাটা ! সব কিছুই চলছে আবার আগের মতো শুধু কেউ একজন টুক করে চলে গেলো । কোলহাল ছাপিয়ে ট্রেনের ঘোষণা কানে আসছে । সুকান্ত বাবু আকাশ দেখলেন, বৃষ্টি আসছে আবার হয়তো রক্তের দাগ মুছতে !
=========================
জয়শ্রী ব্যানার্জি।
পাল্লা রোড, পূর্ব বর্ধমান।