(পূর্বকথা:---ধনী রাজনীতিবিদ কনক নারায়ণের মা বিধুমুখী দেবী পৌত্র মানবেন্দ্র নারায়ন কে সঙ্গে নিয়ে তাঁর পিত্রালয় গড়বেতায় গেছিলেন, প্রিয় পৌত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ কে সুন্দরী বাল বিধবা পূর্ণিমার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য।
ওখানে বিধুমুখী দেবীর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র অমরেন্দ্র ও অশোক মানবেন্দ্র নারায়ণের সর্বক্ষণের সঙ্গী হল। একদিন বিকেলে ওরা তিনজন কৃষ্ণপুরের জমিদার বাড়ি 'শিলাই ভিলা' দেখতে গেল।
ওখানে জমিদার কৃষ্ণ কমল রায়ের আস্তাবলের চারটি ঘোড়ার মধ্যে 'চেতক' নামে একটি সাদা ঘোড়া মানবেন্দ্রের খুব পছন্দ হলো।
জমিদার কৃষ্ণ কমল রায়ের সঙ্গে বাজিতে জিতে মানবেন্দ্র নারায়ণ চেতকের মালিকানা লাভ করল।)
।। এগারো।।
মানবেন্দ্র নারায়ণ জমিদার কৃষ্ণ কমল রায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন যেন 'চেতক' আপনার কাছে যেমন সুস্থ ও সবল ছিল, আনন্দে ছিল, আমার কাছেও ঠিক তেমনই যেন সুস্থ ও সুন্দর থাকে, ভালো থাকে।
মানবেন্দ্র নারায়ণের মুখে একথা শুনে কৃষ্ণ কমল রায় প্রীত হলেন। তাছাড়া মানবেন্দ্র নারায়ণ যেভাবে সর্বসমক্ষে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে, তাতে কিছুক্ষণ আগে চেতককে হারানোর যে দুঃখ তাঁর মনকে ব্যথিত করেছিল, তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হলো।
কৃষ্ণ কমল রায় মানবেন্দ্র নারায়ণের মাথায় হাত রেখে বললেন, যদিও তুমি বাজি জিতে যাওয়ায় প্রথমটায় আমার মনে একটু দুঃখ হয়েছিল এই ভেবে যে, আমার প্রিয় ঘোড়া 'চেতককে' ছেড়ে আমাকে থাকতে হবে । কিন্তু সত্যি বলছি ,এখন সেই দুঃখ আর আমার মনে নেই। আমি মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করছি যে, 'চেতক'একজন যোগ্য মালিকের কাছেই যাচ্ছে। আমি সর্বসমক্ষে এটাও স্বীকার করছি যে, তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেকটা ছোট হলেও আমার চেয়ে অনেক ভালো ঘোড়সওয়ার তুমি।যাত্রা শুরু করার আগে তুমি যেভাবে ঘোড়ার সমস্যা লক্ষ্য করে ওকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলে, আরাম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলে, সেটা আমি এতদিন ধরে ঘোড়ার পিঠে চেপেও লক্ষ্য করিনি। আর একটি ঘোড়া তার মালিকের কাছ থেকে যা চায়, তা হল নিরাপত্তা এবং আরাম। তারা তাদের জীবনের জন্য ভয় পেতে চায় না, তারা যত্ন নেওয়ার ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝতে পারে।আর ঠিক সেই কারণেই তুমি জিতে গেছো।
দেখো ,ঘোড়া সাধারণত খুব দয়ালু এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রাণী। ওরা মানুষের প্রতি খারাপ প্রতিক্রিয়া সাধারণত দেখায় না, যদি না কোন কারনে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে যায়। ঘোড়া খুব বুদ্ধিমান এবং প্রভু ভক্ত প্রাণী।
তুমি হয়তো জানো, তবু আমি আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলি,ঘোড়ার কান সাধারণত ঘোড়ার মেজাজের লক্ষণ চিহ্নিত করে। ঘোড়া যদি তার কান দ্রুত সামনে-- পেছনে ঘোরাতে থাকে, তাহলে এটি সাধারণত একটি ইতিবাচক লক্ষণ এবং এর অর্থ হল যে, তুমি যখন তার সঙ্গে কথা বলছ তখন ঘোড়াটি মনোযোগ সহকারে সেটা শুনছে। এর অর্থ এটাই যে,সে তোমাকে পছন্দ করছে।
ঘোড়া যদি তোমাকে পছন্দ করে তাহলে সে তোমার কাঁধে মাথা রাখবে। তোমার ঘোড়া তোমার ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করে এবং একজন সত্যিকারের বন্ধুর মতো সান্ত্বনা খোঁজে। ঘোড়া তোমার চারপাশে চাটলে বা হাই তুললে বুঝবে ঘোড়া আরামে আছে। তোমাকে তার নিরাপদ স্থান বলে ভেবে নিয়েছে। ওরা তাদের চোখ কান এবং শরীর দিয়ে তার মালিকের প্রতি গভীর মনোযোগ দেয় এবং মালিক কে অনুভব করে।
ঘোড়া হয়তো শব্দ করে বলতে পারবে না যে, 'আমি তোমাকে ভালোবাসি', কিন্তু ঘোড়া প্রতিদিন তার চোখ, স্পর্শ, শান্তিপূর্ণ আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেবে যে সে তোমাকে ভালোবাসে।
মানবেন্দ্র নারায়ণ, ঘোড়ার পিঠে চাপার আগে চেতকের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, ওর কানে কানে কথা বলে তুমি ওর মন জিতে নিয়েছিল।
তাই ও তোমাকে জিতিয়ে দিয়েছে।
মানবেন্দ্র নারায়ণ এবার জমিদার কৃষ্ণ কমলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে
গড়বেতার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ঘোড়ার পিঠে চাপার আগে সে অমরেন্দ্র এবং অশোককে তার সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে চাপার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল। অমরেন্দ্র হাতজোড় করে বলেছিল, মাপ করে দাও মানবেন্দ্র, হাত পা ভাঙ্গার ইচ্ছে আমার নেই।
----একটু আগে আমার ঘোড়া চালানো দেখে কি তোমার এটা মনে হলো খুড়ো?
----না, ঠিক তা নয়, আসলে আমার এখন ঘোড়ায় চাপতে ইচ্ছা করছে না।
অমরেন্দ্রের কথা শুনে অশোক জোরে হেসে উঠলো। অমরেন্দ্র রাগতস্বরে বলল, তুই হাসছিস কেন অশোক?
-----ও কিছু না, এমনি। আমি বলি কি মানবেন্দ্র, একটা কাজ করা যাক।
----কী করতে বলছো?
----তুমি একটা কঠিন বাজিতে জিতে এই সাদা ঘোড়াটা পেয়েছো । কাজেই আজকের দিনের মূল আকর্ষণ তুমি । তুমিই আজকের নায়ক । আমি বলি কী ঘোড়ার পিঠে চেপে তুমি গড়বেতা গ্রামে প্রবেশ করবে আর আমরা তোমার দু'পাশে পদাতিক সৈন্যের মতো হেঁটে হেঁটে তোমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাব।
অমরেন্দ্র বলল, একদম ঠিক বলেছিস অশোক। যাত্রা শুরু করো মানবেন্দ্র। হ্যাঁ , তুমি আস্তে আস্তে চলবে কিন্তু, আমি ছুটতে পারবো না।
মানবেন্দ্র হাসি হাসি মুখে বলল, তোমার আদেশ
শিরোধার্য খুড়ো।
উপস্থিত জনতা চিৎকার করে উঠলো,জয় মা সর্বমঙ্গলার জয়। জয় জমিদার কৃষ্ণ কমল রায়ের জয়। জয় মানবেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর জয়।
ঘোড়ার পিঠে চেপে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করলো মানবেন্দ্র। যতক্ষণ পর্যন্ত চেতককে দেখা গেল, কৃষ্ণ কমল রায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ওরা চোখের আড়াল হলে কৃষ্ণ কমল রায় মাথা নামিয়ে ধীর পদক্ষেপে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন। প্রজারা ও নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল।
ঘোড়ার পিঠে চেপে মানবেন্দ্র নারায়ন যখন গড়বেতা গ্রামে প্রবেশ করল, তখন সন্ধ্যা আগত প্রায়। গ্রামের ছেলের দল তখনও খেলছিল পদ্ম দিঘির মাঠে।
গড়বেতা গ্রামে কোন ঘোড়া নেই। গ্রামে যারা বয়সে বড়, তারা কাজে কর্মে বাইরে গিয়ে ঘোড়া দেখলেও গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা ছবিতে ঘোড়া দেখলেও জ্যান্ত ঘোড়া
কখনো দেখেনি। তাই তারা ঘোড়া দেখে হৈ হৈ করে উঠলো।
অমরেন্দ্রের নির্দেশ মতো মানবেন্দ্র নারায়ণ সত্যি সত্যি এতক্ষণ বেশ আস্তে ঘোড়া চালাচ্ছিল। দুলকি চালে চলছিল চেতক। তার মজা লাগছিল।
কিন্তু গড়বেতা গ্রামে প্রবেশ করার মুখে ছেলেপুলের দল যখন চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে ছুটে এলো,মানবেন্দ্র নারায়ণ মনে মনে ভাবল,
একে তো নতুন জায়গা, তার উপরে ছেলের দলের এই ধরনের চিৎকার, চেতক বিরক্ত হয়ে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে না তো?
না, একটু সাবধান হতে হবে।
তাই সে অমরেন্দ্র ও অশোক কে উদ্দেশ্য করে একটু জোরেই বলল, খুড়োমশাইরা , ছেলের দল যেভাবে চিৎকার করছে, চেতক রেগে যেতে পারে। আমি বলি কি, এখন তো গ্রামে চলে এসেছি, আমি চেতককে একটু জোরে ছুটিয়ে
বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছি। তোমরা ধীরে ধীরে এসো। আর যদি সম্ভব হয় তো এই ছেলের দলকে যেভাবে পারো, একটু ঠেকিয়ে রাখো।
অমরেন্দ্র ও অশোক সমস্বরে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে। মানবেন্দ্র নারায়ণ চেতককে একটু জোরে ছুটিয়ে এগিয়ে গেল।
হঠাৎ চেতককে জোরে ছুটতে দেখে ছেলের দলের মধ্যে হই হই পড়ে গেল। ওদের মধ্যে সর্দার গোছের একটি ছেলে ছিল। সে ছেলের দলের উদ্দেশ্যে বলল, তোরা পিছু পিছু আয়, আমি ঘোড়ার সঙ্গে ছুটছি।
অশোক ও অমরেন্দ্র দুই হাত প্রসারিত করে ছেলের দলকে আটকে দিয়ে বলল, খবরদার বলছি, এক পা এগোবি না তোরা। তোদের ষাঁড়ের মতো চিৎকার শুনে ঘাবড়ে যাবে ঘোড়া।
ছেলের দল একটু থমকে গেল।
একটু সময় থেমে থাকার পর সেই সর্দার গোছের ছেলেটি একটু নিচু হয়ে অমরেন্দ্রের প্রসারিত হাতের তল দিয়ে পেরিয়ে গিয়ে একটু
দূরে গিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি ঘোড়া দেখতে চললুম, তোরা পারিস তো পিছনে আয়।
অমরেন্দ্র রেগে গিয়ে বলল, তবে রে শয়তান ছেলে, তোকে দেখাচ্ছি মজা!
কথা শেষ করেই অমরেন্দ্র ছেলেটিকে তাড়া করল।
(চলবে)
*****************************************
From:- Samiran Sarkar,
Khelaghar,Sainthia,
Birbhum,W.B.
PIN--731234
Mob--8509258727