চাবি
সপ্তদ্বীপা অধিকারী
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সন্তান গর্ভে আসার প্রাথমিক পর্বে ত্রিপর্ণা একদম খেতে পারত না। যা-ই খেতো বমি পেত। জোর করে কিছু খেলেই ওয়াক ওয়াক করে সব উঠে যেত। পেটে যা থাকত, যতটুকু থাকত, সবটুকু উঠে যেত। কিচ্ছু থাকত না পেটে। মাঝে মাঝে তাও ওয়াক ওয়াক হত আর নাল নাল থুতু বের হতো। কোনো মাছ-মাংস-ডিম ছুঁতেও পারত না।। কী বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ লাগত সব কিছুতে। কোনো সব্জিও খেতে পারত না। গন্ধ লাগত। এমন কি জলেও বিশ্রী গন্ধ। আর সবসময় মাথা ঘুরত। না খেলে মাথা তো ঘুরবেই। ডক্টর বলেছিলেন জোর করে খেতে। বা আচার, টক এইসব দিয়ে খেতে। একমাত্র টকজাতীয় কিছু খেতে ভাল্লাগত। আচার খেতেও ভালো লাগত। ভীষণ রুগ্ন আর দুর্বল হয়ে গেছিল ত্রিপর্ণা। খুব রোগা হয়ে গেছিল। খুবই। চার মাস থেকে আবার খাওয়ায় রুচি এসেছে। শরীরও সেরে উঠেছে আবার। ত্রিপর্ণা জানত না যে অমলেশের এতোখানি রূপ-দুর্বলতা। একজন শিক্ষিত পুরুষ এভাবে ভাবতে বা বলতে পারে বলে সে কল্পনাই করতে পারে না। কী তীব্র আঘাত সে করতে পারে! বিশেষ করে এই বাক্যটা সে আজও হজম করতে পারে না।
"শুকনো যেন শুঁটকি মাছ হয়ে উঠছে দিন দিন!"
অমলেশ এখন একদম ঠিক আছে।
আর ওইরকম কথা বলে না।
অবশ্য ত্রিপর্ণাও পাল্টেছে।
তারও শরীর এখন রসে টইটম্বুর।
অমলেশ এখনো আগের মতোই ভালোবাসে।
ত্রিপর্ণা মাঝে মাঝে ভাবে যে, সব পুরুষ মানুষই কি এই রকম? শরীর-সর্বস্ব? ভালোবাসা মানে কী তাহলে? এখন যখন ত্রিপর্ণা মাঝে মাঝে ওই কথাগুলো বলে অমলেশ চুপ করে থাকে। ত্রিপর্ণার অভিমান শেষ হয় না।
ও বলে--"একবার তো ডিভোর্স করার কথাও ভেবেছিলাম।" অমলেশ সেই আগের মতোই হয়ে গেছে। ভালোবাসায়-আদরে ভরিয়ে রাখে তাকে।
নিয়মিত চেক আপ করানো থেকে শুরু করে খেতে দেওয়া পর্যন্ত অত্যন্ত যত্ন নেয় অমলেশ। আর বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ত্রিপর্ণার ছবি তোলে। ত্রিপর্ণার লজ্জা করে। "এই মোটা পেট, মোটা মোটা ইয়ের ছবি তুলো নাতো।"
ও বলে। অমলেশ বলে--"সৌন্দর্যের তুমি কী বোঝো?"
ত্রিপর্ণার ঝট করে মনে পড়ে যায়!
বলে--"আচ্ছা, আমার যদি বাজে রোগ হয়, যদি ওইরকম শুকিয়ে যাই, রসকষহীন হয়ে যাই, তুমি মনেহয় তাহলে ছাগল-কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেবে,না?"
অমলেশ মুখ চেপে ধরে বলে--"আবার বাজে কথা?" কখনো বলে--"থামবে তুমি?"
কখনো বলে না যে--"ভুল হয়েছে। আর হবে না!"
কখনো বলে না--"ক্ষমা করো প্লিজ।"
ত্রিপর্ণার ভীষণ ভয় করে। ত্রিপর্ণা এমনিতেই ছিল স্বার্থপর। এখন আরো নিরেট হয়ে ওঠে। কাউকে বিশ্বাস করে না। পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষ নেই বলেই ক্রমে তার ধারণা জন্মায়।
আগামী মাসের দশ তারিখে ত্রিপর্ণার ডেলিভারি ডেট। ত্রিপর্ণা ভাবতে থাকে একটা ভালো কাজের লোক রাখা দরকার। কী করে কী হবে জানে না সে।
অমলেশের প্রোমোশান হয়েছে। ওর অফিসের অনেক চাপ। ও যায় তাড়াতাড়ি এবং ফেরে দেরি করে। সংসারের একটা কুটো নেড়ে দুটো করার সময় পায় না।
দশ তারিখে বাড়ির কেউ না থাকলে কেমন লাগবে ত্রিপর্ণার? মোটেই ভালো লাগবে না! সবারই কাজ আছে। সবারই কাজ থাকে। তাই বলে ডেলিভারির দিন কেউ থাকবে না? ত্রিপর্ণার মনটা খারাপ হয়ে যায়। মাকে মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে। মনেহয় আজও মা বেঁচে আছেন। মা থাকলে এই সময় ঠিক আসতেন। তাঁর সন্তান হবে আর তার মা আসবেন না? তা কখনো হয়? বোনও আসত নিশ্চয়ই। কিন্তু ওদের সাথে সম্পর্ক রাখতে গেলে এই এতো বড়ো বাংলো কিছুতেই করতে পারত না। বাংলোর কথা মনে করতেই ত্রিপর্ণার মনেহয় সে যা করেছে সব ঠিক করেছে। তার সন্তানের জন্য সে এইটুকু সুখ রেখে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে।
সামনের মাসের দশ তারিখ অমলেশ নিশ্চয়ই যাবে। ত্রিপর্ণা ভাবে।
অমলেশকে সে কথা বলতেই ও বলল--"এটা আবার জিজ্ঞাসা করার মতো কথা? আমি যাব নাতো কে যাবে? আমার সন্তান আসছে পৃথিবীতে আর আমি যাব না?"
নয় তারিখ সকাল থেকেই যেন সাজো সাজো রব। অমলেশ নিজেই রান্না করেছে। খাইয়েছে যত্নে। কাগজপত্র, টাকা-পয়সা,বাচ্চার ন্যাপকিন, তোয়ালে আগে থেকেই কিনে ডেটল কাচা করে রেখেছিল ত্রিপর্ণা। সেই সব উঠল গাড়িতে।
পরদিন নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই রওনা হল দুজনে। ত্রিপর্ণাকে পারলে অমলেশ কোলে করে নিয়ে যায় এমন ভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরছিল। নার্সিং হোমে পৌঁছে অমলেশের কেমন যেন লাগছিল। সব ঠিকঠাক থাকবে তো? ত্রিপর্ণা অমলেশের দিকে চাইতেই বুঝতে পারল অমলেশ মনে মনে ভেঙে পড়েছে। ভিতরে ভিতরে অমলেশ কি কাঁদছে? ত্রিপর্ণা অমলেশের হাত ধরে বলল--"চিন্তা করো না। আমরা ঠিক আছি। ঠিক থাকব।"
অমলেশের কেন যেন মনে হচ্ছে ত্রিপর্ণা ওর কামনা নয়। ওর কামনা হল সন্তান। ত্রিপর্ণা সামনে থাকলে ও স্বাধীনভাবে চিন্তাও করতে পারে না।
ওর জীবনে যা ঘটেছে তার কোনো ব্যাখ্যা ওর কাছে নেই। ও কি কিছু ভুল করেছে? সত্যিই কি অলৌকিক কিছু আছে? সত্যিই ঈশ্বর বলে কেউ কি নিক্তি হাতে বসে আছেন, সকলের দোষ এবং গুণের পরিমাণ মাপার জন্য?
নইলে ওর সাথে এইসব কেন ঘটল? কিংবা কীভাবে ঘটল? ও জানত যে ও পিয়ার সাথে দেখা করেছে। সেই পার্কেই। এবং পার্কের অন্ধকারে ওরা মিলিত হয়েছে শারীরিকভাবে। যে মুহূর্তে সে পিয়ার সাথে শারীরিক মিলনে ব্যস্ত ছিল ওই মুহূর্তেই ও একদম আচমকা দেখল যে ও আসলে ত্রিপর্ণার শরীরে উপগত। এটা ওকে চরমভাবে চমকে দিয়েছে। কিন্তু ওই মুহূর্তে অমলেশ ভেবেছিল যে ও নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছে। কয়েকদিন ধরে পিয়ার কথা ভাবছিল ও। তাই হয়ত স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু স্বপ্ন এতো জীবন্ত কেমন করে হয়? পিয়ার গায়ের একটা গন্ধ আছে। সেই গন্ধ শুধু পিয়ার গায়েই আছে। অমলেশ সেই সন্ধেতে সেই গন্ধই পেয়েছিল। অথচ একদম হঠাৎ ওর যখন সম্বিত ফেরে ও দেখে ও ত্রিপর্ণার উপর। সেই মুহূর্তেই তার নাকে ত্রিপর্ণার গন্ধই লেগেছে। অমলেশের বেশ কিছুদিন ধরে এই চিন্তায় যখন মাথা খারাপ হবার যোগাড় তখন ও একদিন দেখল ওর প্যাণ্টে চোরকাটা লেগে। ত্রিপর্ণাই একদিন ওর প্যাণ্টটা তুলে কাচতে দেবার সময় বলেছিল--"এই তোমার প্যাণ্টে চোরকাঁটা এলো কোত্থেকে?"
অমলেশ অবাক হয়ে বলে--"চোরকাঁটা আবার কোত্থেকে আসবে?"
ত্রিপর্ণা প্যাণ্টটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বলে--"এই দেখো!"
হতভম্ব হয়ে প্যাণ্টের দিকে চেয়ে থাকে অমলেশ। এই প্যাণ্টটাই সে পরে ওইদিন পিয়ার সাথে পার্কে দেখা করতে গেছিল। আর ওখানে মানে পার্কের ঠিক ওই জায়গাটাতেই যে চোরকাঁটা আছে তা অমলেশের থেকে ভালো কেউ জানে না।
অমলেশকে ওই প্যাণ্টটা নিয়ে ওভাবে ভাবতে দেখে ত্রিপর্ণা প্যাণ্টটা কেড়ে নিয়ে চলে গেল। যেতে যেতে বলল--"আমার অনেক কাজ। চোরকাঁটা নিয়ে ভাবো সারাদিন ধরে। আমাকে প্যাণ্টটা দিয়ে দাও। তারপর ভাবো।"
অমলেশ চমকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ত্রিপর্ণা মিটিমিটি হাসছে।
অমলেশও হাসল। কিন্তু মাথায় তখন ওর ভূত চেপেছে। চেতনায় তখন অন্ধকার।
সারাদিন অপেক্ষা করতে পারল না। অফিসে গিয়েই পিয়াকে ফোন করল।
অমলেশের বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ। ও যেন জানত,স্বপ্নে যা যা ও দেখেছে ঠিক তাই তাই ঘটতে চলেছে ওর সাথে। ও উপলক্ষ মাত্র। যেন জন্ম জন্ম এই ঘটনা ঘটেই চলেছে। যেন এর হাত থেকে ওর কোনো পরিত্রাণ নেই। ঠিক তাই হল প্রথম ফোনেই। রেকর্ড বেজে গেল--"এই নাম্বারটির কোনো অস্তিত্ব নেই!"
অমলেশ জানে এবার ও রাজুকে ফোন করবে। অমলেশ ফোন রেখে দিল। নাহ! ও রাজুকে কেন ফোন করবে। ও জানে রাজু ওকে কী কী বলবে। ও তো জানে যে ওর জীবনে কী কী হতে চলেছে। অমলেশ ফোন বন্ধ করে পকেটে ঢোকাতে গেল। ঠিক সেই সময় একটা ফোন। ফোনটা অন করেই ও বলল--"কে?রাজু?"
ফোনটা কেউ কুট করে কেটে দিল। এইভাবে প্রলোভোন দেখালে কেউ কি নিজেকে সংযত করতে পারে?
অমলেশ এরপর রাজুকে ফোন করল। এবং সেদিন যা যা রাজু বলেছিল হুবহু তাই তাই বলে গেল। অমলেশও একই কথা বলল। এবং পিয়ার নাম্বার পেল। পিয়াকে ফোন করতেই পিয়া জানতে চাইল যে সে কেমন আছে? হুবহু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
তবে পিয়া বারবার করে ওই পার্কে যেতে বলেছিল। অমলেশ যায় নি। কিন্তু যায়নি মানে এই নয় যে পিয়াকে সে ভুলে গেছে। বরং পিয়ার যে মোহময় আকর্ষণ তা থেকে সে বেরোতে ব্যর্থ চেষ্টা করছে, এটাই প্রমাণিত।
বিয়ের আগে কেন সে পিয়ার এই রূপটা চিনতে পারেনি? এখন কেনইবা এভাবে চিনছে? কেন এভাবে ডাকছে? পিয়ার কী যোগ্যতা আছে ত্রিপর্ণা হওয়ার? দশটা পিয়ার যোগফলেও একটা ত্রিপর্ণা হবে না! ভাবতে না ভাবতেই অমলেশের মোবাইলে ফোন ঢুকল একটা। অমলেশ মোবাইলের দিকে চাইতেই দেখতে পেল পিয়া কলিং...!
এক মুহূর্তেই সে উঠে পড়ল।পিয়ার ফোন এসেছে। পিয়া কলিং...! এইটুকু ইনফরমেশনই যথেষ্ট! অমলেশ লাফিয়ে উঠল।ঘড়ির দিকে তাকাল। এখন গেলে আর অন্ধকার হবে না।বোঝাপড়াটা তার আগেই কমপ্লিট হয়ে যাবে। অমলেশের অন্ধকারেই মারাত্মক ভয়।
সে সামনের দিকে একটা পা বাড়াতেই একজন সিস্টার এলেন সামনে।
বল্লেন--"কংগ্রাচুলেশনস! আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন!
ত্রিপর্ণার সংসারের চিত্র এখন অনেকটাই পালটে গেছে। পুটশ আসার পর বেশি পরিবর্তন হয়েছে অমলেশের। সে পুটুশকে ছেড়ে কোথাও যেতেই চায় না। অফিস তো যেতেই হয়। কিন্তু তার বাইরে অমলেশের অন্য কোনো কাজ নেই। অমলেশ ইচ্ছে করলে আরো প্রোমোশন নিতে পারত। কিন্তু ও বলে।--" আর চাই না। পুটুশকে পেয়ে আমার জীবন সার্থক হয়ে গেছে।"
আর পুটুশটাও হয়েছে তেমনি। বাবার গলার আওয়াজ শুনলেই খুঁজতে থাকে। কোত্থেকে এল শব্দটা? এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরায়! ঘাড় তো এখনো শক্ত হয়নি। অথচ সে ঘোরাতেই থাকে। আর বাবাকে দেখতে পেলেই এক গাল হেসে দেয়। ফোকলা মাড়ি বের করে।
অন্যদিকে বাচ্চাটা হবার পর ত্রিপর্ণার শরীর অনেকটাই ভেঙে গেছিল। উপযুক্ত খাদ্য,বিশ্রাম এবং যত্নে ত্রিপর্ণার শরীর এবং স্বাস্থ্য একদম আগের মতো হয়ে গেছে। ত্রিপর্ণা আবার কাজে যোগ দিয়েছে। একজন কাজের লোক আছে পুটুশকে দেখাশোনা করার জন্য।
আজো অমলেশ তাড়াতাড়ি ফিরেছে। ঘরে ঢুকেই ডেকেছে--"পুটুশ!"
ওমনি পুটুশ সাড়া দিয়েছে। তবে ওর নিজস্ব ভাষায়। যার অর্থ ও নিজেই শুধু জানে।
কাজের মেয়েটা পুটুশকে কোলে করে বাইরের ঘরে এসেছে। বাবাকে দেখেই এমন জোরে লাফালাফি শুরু করেছে যেন পারলে এখুনি বাবার কাছে ছুটে চলে যায়। অমলেশ হাসে। সব কিছু পাওয়ার খুশিতে। সে তারপর হাতমুখ ধুয়েই মেয়েকে নিয়ে বসে পড়ে। চা খায়। মেয়ের সাথে কথা বলে। কাগজ পড়ে। মেয়ের সাথে কথা বলে। টিভি দেখে। মেয়ের সাথে কথা বলে।
মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকায়। কতো লেট করছে ত্রিপর্ণা! এতোক্ষণ তো চলে আসার কথা। ফোন করে। রিং হয়ে যায়। ফোন ধরে না কেউ। কাজের মেয়েটা জিজ্ঞাসা করে--"দাদা, কী রান্না করব?"
অমলেশ জবাব দেয় না! ও আবার ফোন করে। রিং হয়ে হয়ে কেটে যায়।
দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় অমলেশ। সাতটা বেজে গেল। এখনো আসছে না কেন? এতোক্ষণ ওর রাগ হচ্ছিল। এখন চিন্তা আরম্ভ হয়। কোনো বিপদ-আপদ হয় নি তো আবার? এত দেরি তো কখনো হয় না!
অমলেশ এবার একটা মেসেজ পাঠায়।
"কোথায় তুমি? ফোন ওঠাচ্ছো না কেন? চিন্তা হচ্ছে তো!”
হোয়াটস আপে ঢুকেই দেখল ত্রিপর্ণা আজ সকাল ছয়টার পর আর অন লাইনই হয়নি। সে আরো একবার ফোন করে। প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে ফোন করছে অমলেশ। ফোন না ধরুক। ব্যস্ত থাকতেই পারে। ওর আজকাল কাজ অনেক বেড়েছে। দায়িত্ব বেড়েছে। কিন্তু দেরি হলে একটা খবর দেবে না? কী আশ্চর্য!
ভাবতে ভাবতে অমলেশ বেড রুমে যায় । আর অবাক হয়ে দেখে ত্রিপর্ণার মোবাইলটা ওখানেই পড়ে রয়েছে। গতকাল রাতে চার্জে বসানো হয়েছিল তা আর খোলাও হয় নি। অমলেশ ফোনটা নিয়ে বাইরের ঘরে আবার এসে বসল। আনমিউট করল। ওরা কেউ কোনোদিন কারো মোবাইল ঘাঁটে না। ছুঁয়েও দেখে না। প্রয়োজনও পড়ে না। আর দুজনেই দুজনের কাছে এতোখানি বিশ্বস্ত যে আলাদা করে কিছু জানানোর প্রয়োজনও পড়ে না। তবুও আজ অমলেশ ত্রিপর্ণার মোবাইলটা খুলল। হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে দেখতে লাগল।
অনেক অজানা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। ত্রিপর্ণা সেগুলো খোলেওনি। কতগুলো নাম্বার ব্লক করেছে। দেখতে দেখতে একটা নাম্বারে এসে অমলেশ থমকে গেল! এই নাম্বারটাও অপরিচিত। মানে সেভ করা নেই। কিন্তু মেসেজে না ঢুকেও বাইরে থেকে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে মনেহচ্ছে সুপর্ণা মেসেজ করেছে। প্রথম কথাটাই এরকম:"দিদি, মা আর নেই..."
অমলেশ মেসেঞ্জার খুলল। যা ভেবেছিল তাই। সুপর্ণা মেসেজ করেছে। লিখেছে:
"দিদি, মা আর নেই। এই মুহূর্তে মাকে শ্মশানে নিয়ে এসেছি। ভাই আসার সময় একবার জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। তুই তো আমাদের সব্বাইকে ব্লক করেছিস। ব্লক না করলেও তোকে আমরা আর কখনো নিজেদের মধ্যে ডাকতাম না।
তুই তো জানতিস,মায়ের ক্যানসার হয়েছে। তোকে জানিয়েছিলাম সে কথা।আমাদের কুসুমতলি গ্রামে ভালো ডাক্তার নেই, সে কথাও বলেছিলাম। তোর দয়া পেতে চেয়েছিলাম তখনো। যদিও মা তোর সাহায্য নিয়ে বাঁচতেও চাইতেন না। তবুও বলেছিলাম। তুই দেখেছিলিস সে সংবাদ। মানে নীল রঙ হয়ে গেছিল সেই মেসেজ।"
অমলেশের মনে পড়ে গেল একদিন ত্রিপর্ণার মোবাইলে মেসেজ এসেছিল। সে নিজে দেখেছিল। পুরোটা পড়া আর হয়নি। তখন ত্রিপর্ণা বাথরুমে ছিল। সেইদিনই এবং সেই মুহূর্তেই ত্রিপর্ণা গর্ভবতী হবার সংবাদ দিয়েছিল। তাই পুরোটা তার আর পড়া হয় নি। কিন্তু পড়াটা তার উচিত ছিল বলেই মনে করছে সে এখন। সুপর্ণা লিখেছে:
"দিদি,আমাদের যে মুহূর্তেই প্রোমোটার বলেছিল, ঘর খালি করতে, সেই মুহূর্তে তুই যদি মায়ের মুখটা দেখতিস! ভাই মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল যে, সে আছে। মা যেন চিন্তা না করেন। আমিও নির্ভর করেছি ভাইএর কথায়। আবার আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতাম কিন্তু তুই সেই সুযোগ দিলি না। দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় আর মানসিক আঘাতে মা শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন। খালি বলতেন-- "আমি মা হয়ে তোদের দুজনকে ঠকালাম। ঠকালামই শুধু না। অসহায় করে রেখে যাচ্ছি।" মা হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতেন। আমার কাছে আর ভাইএর কাছে। মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ল। চিকিৎসার টাকা নেই। তুই জানিস কুসুমতলি গ্রামে যে কয়েকজন ডাক্তার আছেন তাঁরা সবাই হাতুড়ে। দূরের সরকারি হাসপাতালে দেখালাম। ওঁরাই বললেন যে রোগটা ক্যান্সার। এবং অপারেশান করলে ভালো হয়ে যাবেন মা। এইকথা শুনেই তোকে মেসেজ করেছিলাম। মাকে না জানিয়ে। ভেবেছিলাম এটা পড়ে তুই ছুটে আসবি। মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নিবি। আমি আর ভাই মাকে রাজি করাব। কিন্তু তুই এলিনা। প্রোমোটারের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও সব শুনে উনি আমাদের জায়গায় যে ফ্ল্যাট করেছেন, সেখানকার একটা ফ্ল্যাটে আমাদের থাকতে দিয়েছেন। ভাই পাগলের মতো চাকরি খুঁজছে। টাকা ধার করে মায়ের চিকিৎসা চালাচ্ছে ভাই। আমি ট্যিউশানি করে সংসার চালাচ্ছি।
মা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে।
ভাই সেই সময় পাগল পাগল আচরণ করত। বারবার সরকারি হাসপাতালে যেত--"মায়ের অপারেশানটা এখানে করুন না! প্লিজ! দয়া করুন।" বলত কেঁদে কেঁদে।
ওঁরাই বলেছিলেন যে ক্যান্সারের চিকিৎসা হয় ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে। ভাই সব রকমেই চেষ্টা করেছিল। ওখানকার ডাক্তার বলেছিলেন এটা একদম প্রাথমিক স্টেজ। অপারেশান করালে উনি অনেক বছর বাঁচবেন। মায়ের অপারেশানটা করাতে পারিনি। এইটা মানতে কষ্ট হচ্ছিল। চোখের সামনে মাকে রুগ্ন, শুক্ন হয়ে যেতে দেখলাম। দিনদিন মাকে শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে যেতে দেখলাম।
মাকে আমরা বলিনি যে মায়ের ক্যান্সার হয়েছে। কিন্তু মা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। খেতে পারতেন না একদম। একদিন বলেছিলেন,"তোদের একটা অনুরোধ করতে চাই যাবার আগে!"
আমি বল্লাম--"কোথায় যাবে তুমি মা?"
মা কি বললেন জানিস দিদি??
মা বলেন--"মৃত্যুর পর কোথায় যায় মানুষ তা তো জানিনা। তবে আমার মা-বাবার সাথে দেখা হলে, তাঁদের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব। নিশ্চয়ই কোনো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছিলাম কখনো নিজের অজান্তে!"
মায়ের কান্নার শক্তি ছিল না তখন। শুধু চুপ করে গেলেন হঠাৎ।
মায়ের শরীরে ঘি মাখালাম এইমাত্র দিদি। ঘি কেন মাখায় জানিস দিদি? ভালো করে পুড়বে বলে। আমি আর ভাই আমাদের দুইজনের মায়ের শরীরে ঘি মাখালাম। মায়ের শরীরটা কী ঠাণ্ডা রে দিদি! মায়ের চোখ দুটো বন্ধ। বয়স তো বেশি নয় রে দিদি! কী সুন্দর এখনো মায়ের শরীরের গড়ন! আহা! আমার মা! আর ভাইএর মা। তোকে এতো কিছু কেন লিখছি কে জানে! তুই যে পড়বি না তা জানি। তুই এখন কী করছিস রে দিদি! খুব মজা করছিস নারে! অত টাকা তোর! তোর তো সারাজীবন খালি মজা করার ভাগ্য! কিন্তু আমার যেন মনেহয় আমার এই চিঠি তোর হাতে গিয়ে ঠিক পৌঁছাবে। দিদি, কিছু কিছু কথা মানুষের জিহ্বা উচ্চারণ করে না। চেতনার অন্তর্গত রক্তেই কথা বলে।
দিদিরে, এইমাত্র মায়ের শরীরটা ইলেক্ট্রিক চুল্লির ভিতর চলে গেল। স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে মা আমার চলে গেলেন ভিতরে। দরজা বন্ধ হবার আগেই দাউ দাউ টকটকে আগুন দেখতে পেলাম আমি। তারপর দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আমরা গঙ্গার পাড়ে এসে বসে আছি। ভাই আর আমি। দুজনে দুজনের হাত ধরে বসে থাকলাম। ভাই অনেকক্ষণ পরে বলল--"ছোড়দি, মা যে পুড়ছেন তাতে তাঁর কষ্ট একেবারেই হচ্ছে না। যতটা কষ্ট বেঁচে থাকতে তিনি পেয়েছেন!"
আমাদের ডাকছে। চল্লিশ মিনিট তার মানে পার হয়ে গেছে! এবার
আমরা মায়ের অস্থি নিয়ে গঙ্গায় ভাসাব।
দিদিরে, মায়েরা কিন্তু ক্ষমা করতেই চান। শুধু মায়েরা কেন যাঁরা ভালোবাসেন,তাঁরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন, ক্ষমা করে দেবার জন্য!
মা মুখে যাই বলুন না কেন, আমি জানি মাও তোকে ক্ষমাই করতেন!
মা তো তোর কারণে অসময়ে ছুটি পেয়ে বেঁচে গেলেন! কিন্তু তুই? দিদিরে, মাটির কলসিতে করে মায়ের ভস্ম নিয়ে গঙ্গায় ভাসালাম রে!
এই জীবনে মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইবার সুযোগ আর তুই পেলি নারে!
ফেরার সময় ভাই বলল--"দিদিরে! মা মরেনি আমাদের। মৃত্যুর এতো ক্ষমতা নেই যে আমাদের মাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবেন। বেঁচে থেকেও যাকে কখনো স্বীকার করব না, মৃত্যু তো হয়েছে তার!"
জানিস দিদি, ভাই আমাকে আর ছোড়দি বলবে না। আমি বুঝতে পেরেছি। মায়ের অস্থি বিসর্জনের সাথে সাথেই আমরা দুই ভাইবোনই সেটা বুঝতে পেরেছি।
তোকে আমরা আর আমাদের দিদি বলে ভাবি না। কোনোদিন তোর আর পরিচয়ও দেব না। আমরা এক ভাই, এক বোন!
তুই অনেক টাকা করেছিস। টাকা নিয়ে সুখ থাকিস।
ইতি-- সুপর্ণা।"
মেসেজ শেষ করার সাথে সাথে কলিং বেলের আওয়াজ হল।
অমলেশ সাড়া দেবার আগেই পুটুশ চিৎকার করে উঠল।তারমানে ও ও ওর মায়ের জন্য অপেক্ষা করেছে। এবং শব্দ শুনেই বুঝতে পেরেছে যে তার মা এসেছে।
অমলেশের বারবার মনে হচ্ছে যেন কোথায় কোনো যোদ্ধা বসে আছে, তার কাছে সে হেরে যাচ্ছে। হেরে যাচ্ছে বারবার
সেদিন দরজা খুলে অমলেশ ত্রিপর্ণার সাথে একটি অপরিচিত মেয়ে দেখে হকচকিয়ে যায়। ত্রিপর্ণা ভিতরে ঢুকে বলে--"কীরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ভিতরে আয়!"
মেয়েটি ত্রিপর্ণারই বয়সি। বেশ সুশ্রী। মাথায় লম্বা চুল বিনুনি করা। একটা ম্যাড়মেড়ে সুতির শাড়ি গায়ে জড়ানো। সস্তা এবং রঙ চটা।
ত্রিপর্ণা দামি জুতো খুললে মেয়েটিও তার সস্তা জুতো জোড়া খোলে। ত্রিপর্ণা সোফা দেখিয়ে বসতে বলে। তারপর পরিচয় করিয়ে দেয়--"আমার ছোটোবেলার বান্ধবী পলি। ওর ভালো নাম পূর্ণিমা। আর পলি এইটাই আমার সাত রাজার ধন এক মানিক শ্রীল শ্রীযুক্ত অমলেশ চক্রবর্তী। "
অমলেশ বলে--"বুঝতে পারলাম না। তোমার ছোটোবেলার বান্ধবী মানে?"
ত্রিপর্ণা বলে--"মানে আবার কী? ও কুসুমতলী গ্রামের মেয়ে। আমাদের ধরমপুর গ্রাম থেকে যেতে এক বেলা লাগে। তবে দুজনেই "নয়ানজলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে" পড়াশুনা করেছি।"
পুটুশ আর পারছে না।লাফালাফি করেই যাচ্ছে। মা যে কথা বলছে না তার সাথে সেটা ঠিক বুঝতে পেরেছে। মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের সবরকম চেষ্টাই সে করে চলেছে।
মাও আর পারল না। পলির দিকে চেয়ে বলে--"শোন, বাকি কথা পরে হবে। আগে হাত মুখ ধুয়ে আয়। আমিও ফ্রেশ হয়ে ওকে কোলে নেই আগে! দেখছিস তো অবস্থা!"
বলেই ত্রিপর্ণা বলল--"পুটুশ সোনা কী করছে!"
পুটুশ কী বুঝল তা ও-ই জানে। আর বুঝে এক গাল হেসে দিয়ে মুখ দিয়ে নানারকম আওয়াজ করল। কী যে বলল তাও মনেহয় ও-ই জানে! ত্রিপর্ণা তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। পলিকেও একটা নির্দিষ্ট দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল--"ওইদিকে বাথরুম আছে। তুই যা।"
ত্রিপর্ণা হাত-মুখ ধুয়ে পুটুশকে নিয়ে বসল।
অমলেশ বলল--"কী ব্যাপার? একেবারে ঘরে নিয়ে এসেছো?"
ত্রিপর্ণা ইশারা করে--"পরে বলছি।"
তারপর পুটুশকে নিয়ে খেলতে থাকে। পুটুশ হাসে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। হঠাৎ কী মনে হতে মায়ের মুখটা দুই হাতে ধরে কামড়াতে থাকে। ত্রিপর্ণা কৃত্রিম ব্যথা পেয়ে কাতরায়! আর তাই দেখে পুটুশের সে কি হাসি! খিলখিল খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
পলি এলে ত্রিপর্ণা বলে-- "তুই এখানে বোস। আমি একটু দেখে আসি রান্নার কী ব্যবস্থা করেছে মেয়েটা!"
পলি বলে-- "যা করেছে তাতেই হয়ে যাবে।"
ত্রিপর্ণা বলে-- "সে তো বটেই।বাড়িতে যা আছে তাইই করবে। অমলেশ আবার ফ্রিজ খালি রাখতে জানে না। মাছ, মাংস, ফল ইত্যাদি সবসময় ভর্তি করে রাখে। দেখি কী রান্না করা যায়!"
পলি একটু হাসল ।
ত্রিপর্ণা পুটুশকে কোলে নিয়েই রান্না ঘরে যাচ্ছিল।
অমলেশ বলল-- "ওকে আমার কাছে দিয়ে যাও। রান্নার বিভিন্ন গ্যাসের কাছে ওকে নিয়ে যেও না!"
ত্রিপর্ণা পুটুশকে অমলেশের কাছে দিয়ে রান্না ঘরে গেল।
ইতিমধ্যে পলির মোবাইলে একটা ফোন ঢুকল। পলি ফোনটা অন করে বলল--"হ্যাঁ,পৌঁছে গেছি।"
ওদিক থেকে কী বলা হল তা কেউ শুনল না। পলির কথা অমলেশ এবং ত্রিপর্ণাও শুনতে পাচ্ছে।
পলি বলল-- "ঘুমিয়ে পড়েছে? ঠিক আছে। তুমি খেয়ে নাও। খাওয়ার সাথে সাথে শুয়ো না যেন। খাবার জল এনেছো? "
এইটুকু বলে পলি যেন কিছু শুনছে। কিছুক্ষণ শুনে নিয়ে বলল-- "আমি খুব সকালেই চলে আসব। চিন্তা করো না। হুম। হুম। রাখছি।!"
ত্রিপর্ণা এবং অমলেশ পলির সমস্ত কথাই শুনল। পলি ফোন রাখতেই ত্রিপর্ণা বলল-- "কীরে কার সাথে কথা বললি? তোর বর?"
পলি বলল--"হুম।"
ত্রিপর্ণা বলল-- "এক রাত্রে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি?"
পলি বলল--"না,না। এখানে তো আমি একাই থাকি। ও আজ এসেছে। কাল আবার চলে যাবে!"
ত্রিপর্ণা বলল--"ও। ঠিক আছে। আয় আমরা খেয়ে নেই!"
সবকিছুই অতি স্বাভাবিক ঘটনার মতোই এগিয়েছে।
শুধু পুটুশ পলির দিকে তাকিয়ে বারবার ঠোঁট উলটে উলটে কাঁদছে।
পলি সেদিকে চেয়ে দেখে বলল-- " কাঁদছো কেন মা?"
পুটুশ তার জবাবে আরো জোরে জোরে কাঁদে।
ত্রিপর্ণার হঠাৎ ভীষণ বিরক্ত লাগল। দেখছে ওকে দেখেই কাঁদছে! তার উপর ওর সাথে কথাটা না বললেই তো হতো, তাই না?
ত্রিপর্ণা হঠাৎ বিশ্রী ভঙ্গিতে কাজের মেয়েটাকে বলল-- "রিনি এদিকে আয়!"
কণ্ঠ শুনে রিনি ছুটে এল।--"কী হয়েছে বৌদি?"
মেয়েকে ওর হাতে দিতে দিতে বলে-- "নিয়ে যা এখান থেকে!"
কিন্তু পুটুশ কিছুতেই রিনির কাছে যাবে না! মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আরো চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
ত্রিপর্ণার ভীষণ রাগ হচ্ছে। এখন মনেহচ্ছে ওকে বাড়িতে না আনলেই হতো। কোনো কমন সেন্স নেই!!
পলি হঠাৎ উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে।
বলল-- "দে আমার কাছে। তুই খেয়ে নে। দুইজনই না খাওয়ার চেয়ে একজন অন্তত খেয়ে নিক।"
বলে পুটুশকে কোলে নিতে চেষ্টা করল। পুটুশ কিছুতেই যাবে না! ভুরু-ফুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে পলির দিকে চরম বিরক্তি নিয়ে। পলি মাথার পাশে হাত দিয়ে মুখ হা করে ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ করে ডাকল। পুটশের কান্না থামল। কিন্তু এক সেকেণ্ডের মধ্যে আবার শুরু করল। পলি এক বিন্দুও দেরি না করে মেঝেতে চার হাতে পায়ে ঘোড়া সেজে গেল। জোরে জোরে ছুটতে লাগল আর মুখে শব্দ করতে লাগল। "টগবগ টগবগ","টগবগ টগবগ"! পুটুশের ভুরু সোজা হল। পলি সোজা হয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে পুটুশ আবার কেঁদে উঠল। পলি এত দ্রুত "স্যরি স্যরি" বলেই ঘোড়া হয়ে টগবগ টগবগ বলে ছুটতে লাগল যে সব্বাই হেসে ফেলল আর পুটুশ? সেতো খিলখিল খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল! এবার পলি ব্যাগ খুলে একটা চকলেট বার করল। পুটুশ ওমনি পলির দিকে ঝুঁকল। পলি কোলে নিয়ে চকোলেট দিল। পুটুশ চকোলেট খেতে খেতে গভীর ভাব করে নিল পলির সাথে। ত্রিপর্ণা ভীষণ বিরক্ত হয়ে চেয়ে ছিল এতোটা সময়। ওর এত্তো রাগ হয়েছিল যে পলিকে বার করে দেবে এমনই ভাবছিল। নেহাত খেতে খেতে উঠে পড়েছে তাই। নইলে ত্রিপর্ণা আজই ঘাড় ধরে বার করে দিত পলিকে।
কিন্তু তাকে বার করে দিতে তো হলোই না। বরং তার মনে এক নতুন চিন্তার উদয় হল। সে যে বন্ধুকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে এক অত্যন্ত বদ মতলবে, তাকেই বলল-- "তুই আয় তো পলি। খেয়ে নে আগে!"
পলি পুটুশকে রিনির কাছে দিতে গেল,পুটুশ দুই হাতে পলির গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। রিনি ত্রিপর্ণার চোখের ভাষা বোঝে। একটু আগে সে ভেবেছিল যে এই মুহূর্তে মনেহয় তারই উপর দায়িত্ব পড়বে পলিদিদি বেরিয়ে যাবার পর দরজাটা বন্ধ করার। তারপর আবার খেতে বসতে বলার মধ্যে আন্তরিকতার সুর দেখে কনফিউজড। এখন ও বুঝতে পারছে না জল কোন্ দিকে গড়াবে। তবুও একটু ইতস্তত করে ও পুটুশকে একটু জোর করে নিতে যেতেই ত্রিপর্ণা এক ধমক দিল--"ছেড়ে দে রিনি। একদম ছুঁবি না।"
রিনি ছেড়ে দিতেই পুটুশের কান্না বন্ধ। সে পলির গলা জড়িয়ে পলির কোলে বসে থাকল। পলিও ওকে কোলে নিয়েই ভাত খেল।
ত্রিপর্ণা বলল--"তুই কি ম্যাজিক জানিস নাকি পলি? আজ সকাল থেকেই ও ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। তুই কী করে থামালি রে?"
পলি বলল-- "আমি কিচ্ছু ম্যাজিক জানি না। বরং তুই জানিস না যে তোর মেয়ের দাঁত উঠছে। এই সময় কখনো কখনো ওদের পেটের সমস্যা হয়। খেতে ইচ্ছে করে না। তোর পুটুশের তো গাটাও গরম রে! খেয়াল করিস নি?"
ত্রিপর্ণা বলল-- "কী বলিস তুই? ওর জ্বর হয়েছে? কই দেখি, দেখি।"
পলি বলল-- "জ্বর হয় নি। জ্বর জ্বর ভাব। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে ওর। কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না ওর! এই সময় একটু চকলেট খেলে কিচ্ছু ক্ষতি হবে না! কিন্তু মনটা ওর ভালো থাকবে। তাছাড়া সারাদিন মা-বাবাকে না পেলে ওর এমনিতেই তো খারাপ লাগে।আমরা বুড়ো হয়ে গেছি, এখনো মায়ের আদর পেতে সাধ হয়!"
ত্রিপর্ণা বলল-- "না রে,পলি।আমি সত্যিই খেয়াল করিনি যে ওর জ্বর হয়েছে..! না মানে জ্বর জ্বর মতো হয়েছে। তোকে অনেক ধন্যবাদ।"
ত্রিপর্ণা মেয়েকে কোলে নেবার জন্য হাত বাড়ালো। মেয়ে পলির গলা জড়িয়ে ধরল জোরে এবং কান্নার উপক্রম করল!
সেইদিকে ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল অনেকক্ষণ ত্রিপর্ণা!
শোয়ার ব্যবস্থা হলে ত্রিপর্ণা বলল--"পুটুশকে বরং তুই তোর কাছেই শুতে নে। আমি তো ওই পাশের ঘরেই থাকছি। সমস্যা হলেই ডাকিস কেমন!"
পলি বলল-- "না। তোর কাছেই নে। মা আর বাবার কোনো তুলনা হয় না। ওর হাত-পা কামড়াচ্ছে। এই দেখ আমি পা টিপে দিচ্ছি। তাই ও অন্য কারো কাছে যেতে চাইছে না।"
ত্রিপর্ণার নিজেকে খুব হেয় লাগছিল। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। সহ্য করাও ওর পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
প্ল্যান বানাতে ওর সময় লাগে না।
পুটুশ কখন ঘুমিয়ে পড়েছে পলির কোলে। ত্রিপর্ণা ঘুমন্ত পুটুশকে নিয়ে নিজেদের বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।অমলেশ শুতে এলেই বলল--"তোমাকে সেই কেলে কুচ্ছিত একটা গ্রাম্য মুচির মেয়ের গল্প করেছিলাম,মনে আছে?"
অমলেশ বলে--"সেই কুসুমতলি গ্রামের তো? তার কথা কখনো ভোলা যায়?"
ত্রিপর্ণা বলে--"এই সেই পলি। ওর ভালো নাম পূর্ণিমা।"
অমলেশ বলে--"ও। ওর তবে বিয়েটাও হল!"
ত্রিপর্ণা বিশ্রী ভাবে হাসতে হাসতে বলে-- "মুচির মেয়ে বিয়ে করেছে একজন ক্যাওড়ার ছেলেকে।"
অমলেশ বলল-- "তাই??"
ত্রিপর্ণা বলে-- "হুম। তার থেকেও বড়ো কথা একজন নিরক্ষরকে....!"
বলে ত্রিপর্ণা কেমন যেন টেনে টেনে হাসতে লাগল।
অমলেশ বলে-- "কিন্তু পলি তোমার সাথে গ্রাজুয়েশান কমপ্লিট করেছিল না?"
ত্রিপর্ণা বলে-- "কমপ্লিট করেছিল তো। আর পড়াশুনায় দারুণ ভালো ছিল। লেটার নিয়ে পাশ করেছিল তো হায়ার সেকেণ্ডারিতে।"
অমলেশ বলে-- "সত্যি? মেয়ের ক্যালি আছে বলতে হবে!"
ত্রিপর্ণা বলে-- "ক্যালি? ওকে আমি সহ্য করতে পারি না।একদম ছোটো থেকেই ও বারবার আমার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমেছে। প্রায়মারি স্কুল ছিল আমাদের গ্রামে। পলি ওই কুসুমতলি গ্রাম থেকে রোজ হেঁটে হেঁটে আসত। সেই তখন থেকেই ও আমার শত্রু।"
ত্রিপর্ণার গলা দিয়ে যেন বিষ ঝরে ঝরে পড়ছে।
অমলেশ চরম অবাক হয়ে বলল--"মানে? ও তোমার শত্রু?"
ত্রিপর্ণা বলে-- 'হুম। পারলে ওর সার্টিফিকেট কেড়ে আগুনে পুড়িয়ে দিতাম!"
অমলেশ প্রথমে ভাবছিল ত্রিপর্ণা বুঝি মজা করছে। বস্তুত ত্রিপর্ণার বন্ধু নেইও বলতে গেলে। ত্রিপর্ণার এহেন অবস্থা দেখে অমলেশ বলল-- "তোমাকে বুঝতে পারি না! সত্যি বলছি!"
কিছু যেন ভেবে, আসলে কিচ্ছু না ভেবেই ত্রিপর্ণা বলে বসল--"নিজেকে বুঝতে পারো তো ঠিকঠাক?"
অমলেশ চমকে উঠল।অমলেশের পিয়ার কান্নাভেজা চোখদুটো মনে পড়ল। অমলেশের মনে হল সে যেন কোথাও কিছু একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে।ভীষণ রকম ভুল।
সেদিন ত্রিপর্না পলিকে রাস্তায় দেখেছিল। ও অফিস যাচ্ছিল। ফুটপাথ দিয়ে তো অনেক মানুষই যাতায়াত করে। চোখে পড়েও পড়ে না। সাধারণ দৃশ্য কে আর চেয়ে চেয়ে দেখে? কিন্তু ত্রিপর্ণা সেদিন দেখেছিল। দেখেছিল কারণ হাঁটাটা বড্ড চেনা লাগছিল। একটা ম্যাড়মেড়ে শাড়ি জড়িয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিল মেয়েটি। শরীরের পিছনে যে বিনুনিটা দুলছিল হাঁটার তালে তালে এপাশ আর ওপাশ, এই হাঁটার ভঙ্গি আর ওই চুলের বিনুনি বড্ড চেনা। এক ধাক্কায় ত্রিপর্ণাকে কতো কিছু চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে আছড়িয়ে ফেলল এক কিশোর বেলায়। আর ত্রিপর্ণা বলে উঠল--"এই পলি?"
মেয়েটি শুনতে পায়নি। সম্ভবও নয়। সকাল বেলার অফিস টাইমের কোলাহলে শোনা সম্ভব নয়। ত্রিপর্ণা ড্রাইভারকে বলল--"সামনে গাড়ি দাঁড় করান।"
সামনেই ছিল বাস স্ট্যাণ্ড। গাড়ি দাঁড়াতেই ত্রিপর্ণা দেখল পলি বাসে উঠতে যাচ্ছে। জানালার কাচ নামিয়ে সে বলল--"পলি, এই পলি?"
পলি অবাক হয়ে এদিক ওদিক চাইছে। শুনতে পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু বিশ্বাস করতে চাইছে না হয়তো। এই শহরে কে তার নাম ধরে ডাকবে? ভাবতে ভাবতে আবার হাত বাড়িয়ে বাসের হ্যাণ্ডেল ধরে বাসেই উঠতে চাইল। ত্রিপর্ণা আবার ডাকল--"এই পলি। এইদিকে। এই যে, সাদা রঙের মার্সিডিজ।"
পলি এইবার ফিরল ত্রিপর্ণার গাড়ির দিকে। ত্রিপর্ণা হাত নেড়ে ডাকল--"চলে আয়।"
পলি এক গাল হেসে এগিয়ে গেল। ত্রিপর্ণা গাড়ির দরজা খুলে দিল আর পলি বাসের বদলে ত্রিপর্ণার এসি গাড়িতে উঠে বসল।
গাড়ি চলতে লাগল। ওদের কথাও। ত্রিপর্ণা বলল--"তুই এই শহরে কবে এলি?"
পলি বলে--"কবে এলি মানে? আমাকে তো মাঝে মাঝেই আসতে হয়।"
ত্রিপর্ণা বলে--"বিয়ে করেছিস দেখতেই পাচ্ছি। সেই কুচকুচে কালো ক্যাওড়ার ছেলেটাকেই?"
পলিও হাসতে হাসতে বলল--"ওই কুচকুচে কালো ক্যাওড়াটাকেই ভালোবাসি যে!"
ত্রিপর্ণাও হাসল। বলল--"তুই নিজে পড়াশুনায় এত্তো ভালো হয়েও কী করে যে একটা নিরক্ষরকে ভালোবাসলি এবং বিয়ে করলি?"
পলি বলল--"প্রথমত ও নিরক্ষর নয় রে পর্ণা। ও আমাদের সাথেই মাধ্যমিক পাশ করেছিল। তুই ভুলে গেছিস মনেহয়!"
ত্রিপর্ণা বলে--"ওহ হ্যাঁ, মনে পড়েছে তো।"
বলে আরও হাসতে হাসতে বলল--"ঊনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামল শেষে!"
পলিও হাসল। কোনো উত্তর দিল না। ত্রিপর্ণা এবার বলল--"শোন, আজ তুই আমাদের বাড়িতে যাবি।"
পলি বলে--"নারে। অনেক কাজের চাপ। তাছাড়া মেয়েটাকে রেখে এসেছি। ও বেশিক্ষণ না দেখলে কাঁদে।"
ত্রিপর্ণা বলে--"আজ তোকে আমার সাথেই থাকতে হবে এবং রাতেও আমার বাড়ি যেতে হবে। কাল ফিরবি।"
পলি বলল--"আমি আজ কিছুতেই যেতে পারব নারে পর্ণা। আমাকে বিশেষ একটা কাজে আসতে হয়েছে। সেটা না করে আমি কোত্থাও যেতে পারব না।"
ত্রিপর্ণা পলিকে নিয়েই অফিস গেল। পলিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার অফিস দেখাল। তারপর বলল--"তুই বরং আমার গাড়ি নিয়ে যা। কাজ-টাজ করে রাতের দিকে ফিরে আয়। তারপর আমরা এক সাথে আমার বাড়িতে ফিরব।"
তখন পলি রাজি হয় এবং পর্ণার গাড়ি নিয়ে সারাদিন কাজ করেছে। তারপর রাতে ফিরেছে।
সমস্ত শুনে অমলেশ বলল--"সব বুঝলাম। কিন্তু ওকে তো তুমি এক্কেবারেই ভালোবাসো না!"
মুহূর্তেই ত্রিপর্ণার ভিতরে যেন বিষাক্ত সাপ ঢুকে পড়েছে এবং সেই সাপেরই বীভৎস বিষ ত্রিপর্ণার মুখ দিয়ে কথার আকারে বার হচ্ছে।
বলে--"আমার শরীরে যত আছে রাগ সব দিয়ে আমি ওর ক্ষতি চাই। সেই ছোট্টবেলা থেকেই ও আমাকে জ্বালাচ্ছে। ওকে আমি সহ্য করতে পারিনা।"
অমলেশ ত্রিপর্ণাকে শান্ত করে। বলে--"যদি ভালোই না বাসো, যদি এতোটাই ঘেন্না করো, তাহলে ওর থেকে দূরে থাকলেই তো হয়!"
ত্রিপর্ণা বলে--"নাহ! তা কেন? আমাদের স্কুলের দিদিমনিরা সারা জীবন ওকে মাথায় তুলে নেচেছেন। প্রতি মুহূর্তে ওর সাথে তুলনা করেছেন! আমি ওকে সহ্য করতে পারতাম না। তখন ও আমায় অনেক কাঁদিয়েছে। অনেক অপমান করেছে।"
ত্রিপর্ণা থামলে অমলেশ বলে--"দেখো ওর সাথে তুলনা করাটা অন্যায়। মানছি। কিন্তু তাতে ওর কী দোষ?"
ত্রিপর্ণা বলে--"ও গরিবের মেয়ে। ক্যাওড়াদের মেয়ে। সেইজন্য সব্বাই ঘেন্না করত। কিন্তু যেই পড়াশুনা পারত, যখন পরীক্ষার ফল প্রকাশ হতো দিদিমনিরা তখন ওকে পারলে যেন বুকে তুলে নেয়! কী প্রশংসা! বাপরে!"
অমলেশ বলে--"বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সেতো ছোটোবেলায়। ভুলে যাও ওসব।"
ত্রিপর্ণা শুয়ে ছিল। লাফিয়ে উঠে পড়ল।
বলল--"ভুলে যাব? আমি? ওই অপমান? একজন ক্যাওড়ার মেয়ের কাছে হেরে যাবো?"
অমলেশ বলে--"দেখো, আসলেই তুমি কি হেরেছো? আজ তুমি কোথায় আর ও কোথায়?"
ত্রিপর্ণা বলে--"এইটাই। এইটাই ওকে দেখাতে এনেছি। জানো সারাদিন আমার গাড়ি নিয়ে কাজ করেছে। লজ্জাও নেই। আমি বললাম আর ওমনি আমার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। নির্লজ্জ আর বেহায়া!"
অমলেশ বলল--"একদম তাই। তুমি ওইসব নিয়ে ভেবো না তো!"
ত্রিপর্ণা বলল--"ভাবব না মানে? তুমি কিযে বলো না! কাল অফিস দেখিয়েছি। এবার বাড়ি দেখাব। তারপর...!"
ত্রিপর্ণা কিছু যেন ভাবে।
তারপর বলে--"শোনো, ও বলছিল ও মাঝে মাঝে কলকাতায় আসে। কিসব কাজ-টাজ আছে। তো আজ সারাদিন ও একটা ভাড়ার বাড়ি খুঁজছিল। আমি ভাবছি আমাদের উপরের তলাটা তো খালিই পড়ে আছে। ওখানেই ওকে থাকতে দেই।"
অমলেশ এবার হা হা করে উঠল।
বলল--"আরে ওই ঘরের ভাড়া ও গুনতে পারবে?"
ত্রিপর্ণা বলল--"ও কেন, ওর চোদ্দ গুষ্টিকে বেঁচে দিলেও ওই ঘরের এক মাসের ভাড়া ওরা দিতে পারবে না!"
অমলেশ শান্ত হয়ে বলল--"এইটাই তোমাকে বোঝাতে চাইছিলাম।"
ত্রিপর্ণা বলল--"তুমি এখনো বোঝোনি ডিয়ার! আমি এই ঘরেই ওদের থাকতে দেবো। ভাড়া যা দেবে তাইই নেবো। তারপর একটা গেট টুগেদার পার্টি করব। সমস্ত দিদিমনিদের ডাকব। তাঁরা দেখি আজ কী বলেন। আজ আমার বাড়ির ভাড়াটিয়া পলি কায়পুত্র।"
অমলেশ বলে--"দেখো, অনেক.. অনেকগুলো টাকা নয়ছয় হয়ে যাবে। যতোদিন থাকবে ততদিন আমাদের ক্ষতি।"
ত্রিপর্ণা বলে--"তুমি চিন্তা করো না। দুই এক মাস রেখেই বার করে দেব। আর বার করার সময় চুরি-টুরির একটা কেসও দিয়ে দেব! আর এইমাসেই গেট টুগেদার পার্টি করব। অল্প ক্ষতি হবে ঠিকই কিন্তু আমার বুকের ভিতরে যে আগুন তা তো খানিকটা হলেও থামবে!"
অমলেশের তাও সহ্য হচ্ছে না। বলছে--"তুমি শুধু শুধু কতোগুলো টাকা খরচ করছো কিন্তু!"
ত্রিপর্ণার মন তবু অশান্ত! ওর অন্তর যেন এক বিষের ভাণ্ড! কিছুতেই ঠাণ্ডা হতে চাইছে না। অবশেষে অমলেশও মত দিল। অদ্ভুতভাবে, অমলেশ মত দেবার সাথে সাথে ঠোঁট উলটে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল পুটুশ। অমলেশ সঙ্গে সঙ্গে ওর পিঠ চাপড়াতে শুরু করল। কিন্তু মেয়ে থামল না। কান্না তার যেন উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে কোথায় যেন এক দঙ্গল নিশাচর ভূতের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠল। ভূতের মতোই তাদের দেখা যায় না আলোকমালায়। অথচ অন্ধকারে তাদের অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে না। সেই অন্ধকারের ভূত অথবা ভূতের অবয়ব যেন পুটুশকে চেনে। অথবা পুটুশ তাদের। সে যেন আগাম সংবাদ পায়। সে তাই কাঁদে। ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে কাঁদে। বলে---"না না না না না না!" বলে আর কাঁদতে থাকে। "না" যেন কোনো নরম ঠোঁটে উচ্চারিত শব্দ নয়। এ যেন শক্তিশালী কোনো অবয়ব। মেয়ের যেন এইটুকু "না" বলতে শক্তিক্ষয় হচ্ছে। যেন সবটুকু বলা হচ্ছে না। যেন এই "না" শুধু একা নয়। এর বিস্তৃতি আছে। অস্তিত্ব আছে। গভীরতা আছে। সেইজন্যই মেয়ে সুর করে করে এর বিশালতা বোঝায়। কেউ বোঝে না। তারা মেয়ের জনক আর জননী। তারা ভাবে তাদের শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলনের ফলেই এই ক্ষুদ্র আর ছোট্ট মেয়ের ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়েছে। তারা তাই এই বাচ্চার সব জানে। বাচ্চার কান্না কমে না। রাত বাড়ে। গভীর রাতে অবশেষে মেয়ে আঙুল তুলে জানালায় দেখায়। মা বলে--"ওখানে কী দেখাও পুটুশ সোনা?"
পুটুশ কাঁদে। আর আঙুল দেখায় আর সুর করে করে বলে--"না,না,না,না,না,না!"
মা সেদিকে চেয়ে দেখে। এক তাল অন্ধকার। অন্ধকারের কোনো অবয়ব থাকে না। মা বলে--"ওখানে কিচ্ছু নেই সোনা। কিচ্ছু নেই!"
বাবাও বলে--"কিচ্ছু নেই পুটুশ মা! এই তো আমি। তোমার বাবা! আর এই দেখো তোমার মা! মা আর বাবা থাকলে কি কেউ আসতে পারে মেয়ের কাছে?"
মেয়ে কী বুঝল তা মেয়েই জানে। কিন্তু কান্নাটা থামল! থামল ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি ফিরল না জানালা থেকে। ওইদিকে তাকিয়েই বাবার গলা জড়িয়ে মেয়ে যখন হেচকি তুলছে, ঠিক তখুনি দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ! ত্রিপর্ণা চমকে উঠেছে। অমলেশও। তাহলে তারা কি ভয় পাচ্ছে? কিন্তু কীসের ভয়?
বাইরে থেকে ভেসে এলো--"পর্ণা, তোর মেয়ের শরীরটা ঠিক নেই রে! ওর পা দুটো টিপে দে। তাহলে ও নিশ্চিত ঘুমিয়ে পড়বে।"
ত্রিপর্ণার শরীর রি রি করে উঠল। কী বেয়াক্কেলে মেয়ে রে বাবা! শালা গ্রাম্য ভূত একখানা! মাঝরাতে স্বামী-স্ত্রীর ঘরে নক করছে! সামান্য ম্যানার জানে না!
ত্রিপর্ণার এই চিন্তার মাঝেই পুটুশ হাত বাড়িয়ে বলল--"যা যা যা যা যা যা!"
মেয়েটাও বুঝতে পেরেছে যে বাইরে থেকে কেউ ডাকছে। শুধু সেটুকুই সে বোঝেনি। যে ডাকছে সেই ব্যক্তি যে তার বিশেষ চেনা তাও বুঝিয়ে দিয়েছে। আর সে যখন "যা যা যা যা" উচ্চারণ করে তখন সে বোঝাতে চায় এরকমই--"এখানে এসো আর আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করো।"
ত্রিপর্ণা তার চিন্তাকে ভুলে দরজা খুলে দিতেই পলি বলে--"স্যরি ডিয়ার। পুটুশের কান্না সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই নক করেছি।"
ততক্ষণে পুটুশ পলির দিকে হাত বাড়িয়েছে। ত্রিপর্ণা অবাক হয়ে গেল! মাত্র কয়েক ঘণ্টায় মেয়ে ওকে চিনে নিয়েছে। পলির কোলে উঠে পুটুশ পলির গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখল। স্পষ্ট ঘুমোবার ইঙ্গিত। ত্রিপর্ণা ইশারায় পলিকে তার মেয়েকে নিয়েই চলে যেতে বলল। পলি চলে যেতেই ত্রিপর্ণা অমলেশকে বলল--"শুধুমাত্র পুটুশের জন্যই এখানে ওই ক্যাওড়ার ঝিটাকে তার ফ্যামিলি সমেত রাখতে হবে।"
ঘাড় নেড়ে সায় দিলে অমলেশ। পরক্ষণেই বলল--"ঘর ভাড়া কতো নেবে?"
ত্রিপর্ণা বলল--"সে দেখছি। ওর কাছে আমার মেয়েটা সুস্থ থাকবে! এটাই কি যথেষ্ট নয়?"
অমলেশ বলল--"তা ঠিক। বিরাট অঙ্কের একটা অর্থের ক্ষতি হবে।"
ত্রিপর্ণা বলল--"আমিই ব্যবস্থা করব। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না!
সেদিন রাত্রে পুটুশ একবারো আর কাঁদেনি। ত্রিপর্ণা সকালে উঠেই পলির ঘরে গিয়ে দেখে যে, মেয়ে তার
গভীর ঘুমে মগ্ন। ত্রিপর্ণার খুব ভালো লাগলো। হেসে পলিকে বলল--"রাতে আর কাঁদেনি, নারে?"
পলি বলল--"নাহ। কাঁদেনি। তবে ওর শরীরটা ঠিক নেই পর্ণা।"
ত্রিপর্ণা বলল--"তা তো বুঝতেই পারছি। আমি আজ ডাক্তার ডাকবো অফিস থেকে ফেরার সময়।"
পলি বলল--"ডাক্তার কিচ্ছু করতে পারবে না। ওর মায়ের ওম দরকার।"
ত্রিপর্ণা হেসে ফেলে। বলে--"মায়ের ওম দরকার বলতে কী বোঝাচ্ছিস?"
পলি বলে--"ওর শরীরটা ঠিক নেই তো! ও মায়ের বুকের দুধ পান করবে, মায়ের কোলে থাকবে তবেই সুস্থ হবে। ওর অন্য কোনো রোগ নয়রে পর্ণা!"
ত্রিপর্ণা বলল--"তুই কী বলতে চাইছিস? আমি চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে ওকে নিয়ে সারাদিন আদিখ্যেতা করে বাড়ি বসে থাকব?"
পলি বলে--"ওর অসুস্থতার সময় মা হিসেবে তাইই তো করবি। মানে করা উচিত!"
ত্রিপর্ণা বসে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল--" তুই কি পাগল-টাগল হয়ে গেছিস? তুই কাল আমার অফিসে গেছিস। সব দেখেছিস। কত্তো বড়ো একটা দায়িত্ব পালন করতে হয় আমাকে তা নিশ্চয়ই বুঝেছিস। আর আমার এই যে বাড়িখানা দেখছিস, এর দাম কতো জানিস?"
ত্রিপর্ণা কথাটা বলে একটু হাসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপর বলল--" তোর অবশ্য এই বাড়ির অর্থমূল্য বা আমার অফিসের কাজের মূল্য বোঝার মতো যোগ্যতা নেই। আমি শুধু শুধু রাগ করছি। তুই কী করে এসব বুঝবি? কুসুমতলি গ্রামের একটা ক্যাওড়ার ঘরের গ্রাজুয়েটের পক্ষে কখনো আন্দাজ করাও সম্ভব নয়। তুই যে ওই পরিবার থেকে গ্রাজুয়েট হতে পেরেছিস, এটাই যথেষ্ট। আমি সেটুক বুঝি রে। তোর কোনো দোষও নেই রে পলি! তবে তোকে বলি যে, আমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা বাচ্চাকে ব্রেস্ট মিল্ক পান করাই না। বাচ্চা হয়েছে বলে নিজেকে মা, মা ভাবতে ভাবতে শালা নিজের মায়েরও মা হয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা বাঙালিদের, আমি তা থেকে শত যোজন দূরে।
আর ফর ইওর কাইণ্ড ইনফর্মেশন আমি কখনোই আমার ওই পুচকুকে ব্রেস্ট ফিডিং করাইনি। আমি এত্তো তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যেতে চাই না।"
পলি কিচ্ছু জবাব করছে না। তাতেও ত্রিপর্ণার কিচ্ছু যায়-আসে না। ছোটো থেকেই সে এইরকম। সহজে কাউকে সেভাবে মানে না। পলি বাথরুমে গেল। ওকে বলে গেল--"খেয়াল রাখিস। পড়ে-টরে যায় না যেন। নতুন ঘরের নতুন খাট তো।"
একদম স্বাভাবিকভাবেই বলল। তার গলায় কোনো ঝাঁঝ নেই। ত্রিপর্ণার রাগটা হঠাৎ বেড়ে গেল! এ কীরে বাবা! অপমান করলাম, গায়েই মাখছে না!
বাথরুম থেকেই পলি পুরো রেডি হয়ে বেরিয়েছে। দেখেই ত্রিপর্ণা রেগে গিয়ে বলল--"সেকি তুই এখুনি চলে যাচ্ছিস?"
পলি বলল--"হ্যাঁ রে। আমার মেয়েটাও ছোটো তো। আর ওর বাবাকে আবার আজই ফিরতে হবে।"
ত্রিপর্ণা বুঝতে পারল যে, পলি কোথাও ছোটো খাটো ঘর নিয়েছে, যেখানে ও মেয়ে নিয়ে থাকে আর ওর বর ওই সুবল না কী যেন, সে মাঝে মাঝে আসে। এমনই পোড়া কপাল ওদের যে, স্বামী-স্ত্রী এক
সাথে থাকতেও পারে না। মনেহয় ব্যবসা-বানিজ্য একটু উন্নত হয়েছে, তাই আরও একটু ভালো বাসা খুঁজছে।
ত্রিপর্ণা বলল--"তোকে একটা কথা বলি পলি।"
পলি বলল---" সে বল। কিন্তু আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবেরে। মেয়েটা কাল সারারাত আমাকে দেখেনি। তোর মেয়েরই বয়সি।"
ত্রিপর্ণা কিছু বলতে যাবে... ঠিক সেই সময়। ঠিক সেই সময় পুটুশ জেগে গেল। জেগে গিয়েই খুকখুক করে খানিকক্ষণ মেয়েটা কাশল। তারপরই মাসি... মাসি... ডাকছে আর কাঁদছে এবং কাশছে। পলি পড়ি কি মরি ছুটে গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল--"এই তো তোমার মাসি! এই যে তোমার মাসি!"
অতি সাধারণ কথা! তাও পলি যে কীভাবে সুর মিশিয়ে বলছে..., যেন কথা নয়, গান! মেয়েও কান্না ভুলে, কাশি ভুলে হেসে হেসে বলে---"আমাল মাসি... আমাল মাসি...!"
পলি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে ত্রিপর্ণাকে দিতে গেলে মেয়ে পলিকে চেপে ধরে রাখল। কিছুতেই সে তার মায়ের কাছে যাবে না! ত্রিপর্ণা হাতে যেন স্বর্গ পেল। সে পলিকে বলল--"পলি তুই তো বাড়ি খুঁজছিস ভাড়ার জন্য। আমার একটা ফ্ল্যাট খালিই পড়ে আছে। থাক না রে আমার ফ্ল্যাটে।"
পলি বলল--"কতো ভাড়া?"
ত্রিপর্ণা থমকালো। পলিকে ভাড়া না বলে থাকা যায় না। পলিকে যতটুক চেনে তাতে ওকে দয়া দেখানো অসম্ভব। আর এখন তো পুটুশের জন্যই তার পলিকে দরকার। ও পলিকে এইটুক বিশ্বাস তো করেই যে, ও কখনোই লোভী বা অসৎ নয়।
সে বলল--"দ্যাখ, আমার ওই ফ্ল্যাটের ভাড়া তো অনেক রে! তোকে যদি একটু কম করে ভাড়া দিতে বলি তুই কি মাইণ্ড করবি?"
পলি হাসল। সেই হাসি। এই হাসিটা সে একদম ছোট্ট থেকে কীভাবে যেন আয়ত্ব করে নিয়েছে। কিছুতেই ওকে সহজে অপমান করা যায় না। মনে পড়ে গেল ত্রিপর্ণার। সেই ছোট্টবেলার পলিকে ওর মনে পড়ে গেল। কিন্তু ও কিছুই করতে পারছে না। ওর চাকরির জন্য পুটুশকে ও সময় দিতে পারে না। তার থেকেও বড়ো কথা হলো এই যে, তার পুটুশ পলিকে খুব পছন্দ করেছে। ত্রিপর্না বলল--"পলি, আমি স্বার্থপরের মতো বলছি, আমার মেয়েটার জন্য থাক আমার বাড়িতে। তাতে তো তোর অসম্মান হবে না,তাই না?"
পলি একটু ভেবে বলল--"তোর ফ্ল্যাটটা দেখা। এখুনি। কেননা, সুবল ফোন করেছিল। বলেছে যে আজই ফ্ল্যাট বুকিং করতে যাচ্ছে।"
ত্রিপর্ণা মনে মনে খুব হাসল। পলি তাহলে পাল্টিয়েছে। লোভী হয়েছে। থাকে তো বস্তিতে। অথচ বলছে ওর বর নাকি ফ্ল্যাট বুকিং করবে এবং আজই! মনে মনে খুব হাসল ত্রিপর্ণা। খুব হাসল। তারপর ফোন করল অমলেশকে।
বলল--" রিনি কী করছে গো?"
অমলেশ বলল--"রান্না ঘরে তো ও। আজ মাটন করছে।"
ত্রিপর্ণা বলল--" শোনো না, রিনিকে দিয়ে চার তলার চাবিটা পাঠাও না গো!"
অমলেশ বলল--"ঠিক আছে। বলছি ওকে। কিন্তু যা কিছু করবে চিন্তা-ভাবনা করে। আর হ্যাঁ, আর একটা কথা, এগ্রিমেণ্ট করবে না?"
ত্রিপর্না বলল--"ঠিক আছে। কিন্তু দেরি কোরো না। এখুনি পাঠাও। তুমি তো ফ্রি আছো। রান্না ঘরে একটু দেখো না!"
অমলেশ বুঝতে পারল তার ত্রিপর্না কেন তার সমস্ত কথার জবাব দিল না। নিশ্চয়ই ওই মেয়েটা সামনে বসে আছে। ওর ঘরেই তো ও গেল।
সে ডাকল--"রিনি, এই রিনি!"
রিনির গলাও শুনল ত্রিপর্ণা। অমলেশ বলল--"এদিকে আয়। শোন।"
একটু বাদেই রিনি চাবি নিয়ে এল। চাবি নিয়ে ত্রিপর্ণা বলল--"চল। দেখাই তোকে।"
পলি ফ্ল্যাট দেখে বলল--"দ্যাখ, আমরা আড়াইজন মানুষ। এতো বড়ো ফ্ল্যাট তো লাগে না।"
ত্রিপর্ণা বলল--"তোর মেয়ে আর আমার মেয়ে এক সাথে বড়ো হবে। আয় নারে পলি। এখানেই থাক তোরা।"
পলি বলল--"সে আসব। আসছি। কিন্তু কয়েকটা কথা। প্রথমত: এই ফ্ল্যাটের ভাড়া হিসেবে মাসে মাসে তোকে কুড়ি হাজারের বেশি দিতে পারব না। আর দ্বিতীয়ত: আমি কিন্তু মাঝে মাঝে গ্রামে যাই। তখন সুবল থাকে এখানে। এইভাবেই ম্যানেজ করছি আমরা সব।"
ত্রিপর্ণা রাজি হয়ে গেল। কিন্তু একটা জিনিস ওকে অশান্ত করে তুলল খুব।
ও নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে অমলেশকে বলল--" আমার আশ্চর্য লাগছে এই শুনে যে, ও
ফ্ল্যাটের ভাড়া কুড়ি হাজার করে দেবে বলল। আচ্ছা এতো টাকা ও পাবে কোথায়? মাসে মাসে কুড়ি হাজার টাকা দেবার মতো ক্ষমতা ওর হয়ে গেছে? আশ্চর্য!"
অমলেশ বলল--"তোমার ওই ম্যাদামারা বান্ধবী দেবে কুড়ি হাজার? তাও প্রতি মাসে? হাসিও না।"
ত্রিপর্ণা বলল--"আর যাই বলো না কেন, প্লিজ ম্যাদামারা এবং আমার বন্ধু বোলো না!"
অমলেশ বলল--"তোমারই তো বন্ধু! ভাড়া দিলে নিজেদের ফ্ল্যাটে। অতো কম টাকায়। ওই ফ্ল্যাটের ভাড়ার দাম কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রতি মাসে। এতোটাও আর্থিক ক্ষতি মেনে নেবে প্রতি মাসে?"
ত্রিপর্ণা বলল--"আরে ওয়েট ডিয়ার। সারাদিন আমার মেয়েকে দেখবে। তার জন্য নিশ্চয়ই টাকা নেবে না। ওর বরকে বাগানের কাজে লাগিয়ে দাও। ওই মালিকে ছাড়িয়ে দাও।"
হা হা করে হেসে উঠল অমলেশ--" এটা একটা কাজের কাজ করেছো। ওরা তো গ্রামের সহজ-সরল মানুষ। মনেহয় ফাঁকি দেওয়া-টেওয়া সেরকম বোঝে না! তবে গাছের পরিচর্যা কিন্তু শিখতে হয়। না শিখে কেউই কিন্তু প্রপার কেয়ার নিতে পারে না!"
ত্রিপর্ণা বলল--"তুমি এক কাজ করো। প্রথম প্রথম কয়েকদিন নিজের হাতে ধরে কাজ করা শিখিয়ে দিও। তুমি নিজের হাতে শেখালে ও খুব ভালো শিখবে। আর ও তো একটা আস্ত অকম্মার ঢেঁকি! কিচ্ছু কাজই করে না। বউএর আয় খায় বসে বসে।"
অমলেশ বলে--"সেকি? একদম কিচ্ছু করে না?"
ত্রিপর্ণা বলে--"আরে লেখাপড়া জানবে তারপর তো কিছু করবে।"
অমলেশ বলে--"হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে বটে। ভুলে গেছিলাম। কিচ্ছু লেখাপড়া জানে না। কী যেন একটা দোকান না কী যেন আছে!"
ত্রিপর্ণা বলে--"আরে টিমটিমে একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে টিমটিমে একটা মিষ্টির দোকান। তা গ্রামে-গঞ্জে তো তেমন দোকান-টোকান নেই! ওই একটাই দোকান। তাই কোনোরকমে ডাল-ভাতটুক জুটে যায়।"
অমলেশ বলে--"তাহলে তোমার বান্ধবী নিশ্চয়ই ভালো কিছুই করে। নইলে মাসে কুড়ি হাজার টাকা ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়?"
ত্রিপর্ণা বলে--"একদম ঠিক বলেছো। খোঁজ নিতে হবে, বুঝলে!"
অমলেশ বলে--"আরে ছাড়ো তো! ওইসব ক্লাসের মানুষজন সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে নিজেদের অসম্মানে পড়তে হবে! ছাড়ো!"
ত্রিপর্ণাও মেনে নিল। বলল--"একদম ঠিক।"
অমলেশ বলল--"এরপর ওই রিনিকেও ছাড়িয়ে দিও। ওই টাকাটাও বেঁচে গেলে অনেকগুলো টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স হবে।

