আমার চোখে মোহময়ী দার্জিলিং
(পর্ব-২)
ম্যাল থেকে চা খেয়ে হোটেলে ফিরে বাবা সবাইকে জানিয়ে দিলে সবাই তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নাও। আজ আমরা ভারত-নেপাল সীমান্তে পশুপতি মন্দির তৎসংলগ্ন মার্কেট দেখতে বের হব । সেই মত দ্রুত স্নান-খাওয়া করে রেডি হয়ে বের হয়ে পড়লাম । হোটেল থেকে আমাদের গাড়ি ঠিক করা ছিল । দুটো গাড়িতে আমরা ১১ জন ভাগ হয়ে বসে পড়লাম। গাড়ি ছাড়লো সকাল ন'টায়। দু'দিকের বনজ গাছ গাছালি পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে । মনে হয় যেন স্বপ্নের জগতে চলেছি। মেঘলা আকাশ দার্জিলিংয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই রোদ তো এই মেঘ। সেদিনও আকাশ ঘন কুয়াশা ও মেঘে ভরা ছিল ।
যাই হোক আমরা বেলা ১১ টা নাগাদ ভারত নেপাল সীমান্তের ভিউ পয়েন্ট এসে পৌছালাম । এখানে এখন ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টিতে এতটাই ঝাপসা ছিল যে ভালো করে কিছুই দেখতে পেলাম না । এখানে একটা ছোট্ট মার্কেট ছিল ।সেখানে শীতের নানান পোশাকও খেলনা বিক্রি হয় । এখানে একটু ঘোরাঘুরি করে আমাদের গাড়ি এবার পশুপতি মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হল।
প্রায় ৪০ মিনিট পরে যখন ভারত নেপাল সীমান্ত উপস্থিত হলাম তখন আকাশে রোদ ঝলমল করছিল। এখন দুপুর১২ টা বাজে। আমাদের চেকিং হলো । সবাই আইডেন্টি কার্ড দেখিয়ে পাস সংগ্রহ করলো।আমাদের ও পুষ্পেন্দু কাকুদের অসুবিধা হলো না। সমস্যা হল জয়দেব জ্যেঠুর । অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও আই কার্ড বের করতে না পারায় অগ্যতা তাঁকে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম। এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে নেপালে ঢুকতে হয় । মিনিট পাঁচেকের রাস্তা কিন্তু অত্যন্ত খাড়াই । বয়স্ক ও বাচ্চাদের কথা ভেবে বাবা ও কাকু কিছুতেই হেঁটে যেতে রাজি হলেন না। আমরা ২২০ টাকা দিয়ে একটি গাড়ি ভাড়া করলাম। তার মধ্যে ঠেলেঠুলে দশজন ই ঢুকে পড়লাম । এই প্রথম আমি বিদেশের মাটিতে পা রাখতে চলেছি ভেবে বেশ অন্যরকম এক শিহরন লাগছিল মনে। হোক না সে নেপাল ।
এখানকার মার্কেটে ঘোরাঘুরি করলাম ।
আবার বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। পশুপতি মন্দির এ ঢুকে ভগবান শিবের বিগ্রহ দর্শন করলাম। মা ,ঝুমা আন্টি, দাদু দিদা ,বাবা প্রণাম করে প্রণামী দিলেন । এখানে বাবা ও কাকু বেশকিছু ভিডিও করলেন । ছবিও তোলা হলো। রাস্তার দু'ধারে সাজান দোকান । কলকাতা শহরের মতো অত বড় মার্কেট নয়। বরং গ্রামের বাজারের মতোই বলা যেতে পারে।সব ধরনের শীতের পোশাক, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, খেলনা প্রভৃতি দিয়ে সাজানো গুছানো বাজার। প্রায় ঘন্টাখানেক মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে আবার আমরা আমাদের দেশ ভারত বর্ষে ফিরে এলাম । তখন বেলা প্রায় একটা। এখান থেকে টিফিন করে আমরা মিরিকের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
মিরিকে যাওয়ার পথে দার্জিলিং এর অন্যতম আকর্ষণ চা বাগান দর্শন করলাম । রাস্তার দু দিকে ছোট্ট পাহাড়ি ঢালে সারি সারি অসংখ্য চায়ের বাগান। তার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পাইন গাছ । আমরা এখানে বেশ কিছু ছবি তুললাম । মিরিখে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় তিনটে বেজে গেছে। এখানে হোটেলে খাওয়া দাওয়া হল। তারপর পার্কে ঢুকে চারিদিক দেখতে লাগলাম। অসম্ভব সুন্দর পরিবেশ। সাজানো ফুলের গাছ গাছালি তে বেশ মনোরম লাগছিল। তখন ও বৃষ্টি হয়েই চলছিল। এখানে এই প্রথম পাহাড়ি লেক দেখলাম । এত উঁচুতে ও এতবড় একটি লেক দেখে বেশ বিস্ময় জাগ ছিল মনে।
লেকের উপর একটি ব্রিজ ছিল। সন্ধ্যায় আমরা হোটেলে ফিরলাম । আজকের মত ভ্রমণ শেষ হলো।
পরের দিন সকালে আমরা গাড়ি করে প্রথমে চিড়িয়াখানা ও তারপরে মিউজিয়াম দেখলাম। চিড়িয়াখানায় বিভিন্ন প্রাণী দেখলাম । এখানকার চিড়িয়াখানা কলকাতার মত অত বড় নয়। কিছু পশুপাখি থাকলেও কলকাতার চিড়িয়াখানার কাছে তার কিছু নয়। তারপর এখান থেকে মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে গিয়ে শেরপাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখলাম। এই প্রথম ১৯৫৩ সালের এভারেস্ট অভিযানের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে অদ্ভুত ভালো লাগছিল। তেনজিং নরগে এর গ্লাভস, হেলমেট ,ট্রেন্ট, বরফ কেটে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কুঠার, স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। তাই ছবি তুলতে পারলাম না।এখানে আমি ও জেঠু ট্রেকিং করলাম । আমাদের দেখানো হয়েছিল কিভাবে পাহাড়ে উঠতে হয়? তার জন্য নকল ট্রেকিং এর ব্যবস্থা করা। এরপর মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে আমরা বাতাসিয়া লুপ এসে মধ্যাহ্নভোজন করলাম। এই পার্ক টা ছোটখাটো হলেও খুব সুন্দর সাজানো । প্রচুর ফুলের গাছ ও পাহাড়িয়া গাছ ।তারপর ওখান থেকে আমরা গেলাম টাইগার হিলে । যাওয়ার পথে পাহাড়ের কোলে সাদা সাদা থোকা থোকা মেঘেদের লুকোচুরি দেখেছিলাম । মনে হল যেন মেঘেরা এসে এখানে আটকে পড়েছে। খুব সুন্দর লাগছিল উপরে নীল আকাশ। আর কালো পাহাড়ের গায়ে সাদা থোকা থোকা মেঘেদের আনাগোনা। আর দেরি না করে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য টাইগার হিলে রং উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কিন্তু এখানে এত কুয়াশা যে কিছুই দেখা গেল না। মনটা খারাপ করে আমরা ফিরে এলাম।
কিন্তু সেখানেও রাস্তায় এত জ্যাম ছিলো যে যেতে যেতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল।
এরপর আমাদের গন্তব্য রক গার্ডেন । রক গার্ডেন ভালো করে দেখা সম্ভব হলো না। সেখানে পৌঁছাতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। সাদা দুধের মত ঝর্ণার জলের ফেনা জলের গর্জন আমাকে চমকে দিয়েছিল । আমরা রক গার্ডেন দর্শন করে রাত আটটা নাগাদ হোটেলে ফিরলাম।
(ক্রমশ)