বন জ্যোৎস্নায় হাসনুহানা
প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের টিকিট টা কেটে নিয়ে পাঁশকুড়া গামী ট্রেনে ওঠা অনিন্দ্য। ট্রেনে তেমন ভিড় নেই। আজ বুধবার। পরের দিন বৃহস্পতিবার বিধানসভার ভোট। বাস নেই বললেও চলে। ভোটের কাজে বাস গুলো সব বুকিং হয়ে গেছে। হাওড়া তে কোন বাস না পেয়ে অনিন্দ্য মেচেদা পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে তারপর না হয় মেচেদা থেকে স্টেট বা পাবলিক বাস বা ট্রেকার বা অন্য কিছুর সাহায্যে রামগড় যাওয়া যাবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রেনে ওঠে। ট্রেনের কামরার উপরের দিকে জিনিসপত্র রাখার র্যাকে একটা বড় ব্যাগ এর পাশে নিজের ছোট্ট অ্যাটাচি রেখে একটা সিট দখল করে বসে। ট্রেনটা পাঁচটা দশে ছাড়ার কথা। ঘড়ির দিকে তাকায় অনিন্দ্য। ঘড়ির কাঁটাও পাঁচটা দশে। ট্রেনটা ঠিক সময়ে ছাড়লে তাড়াতাড়ি মেচেদা পৌঁছতে পারবে। আবার সেখানে বাস পাওয়াও কম ঝামেলার নয়। এবার ট্রেন চলতে শুরু করেছে। ভালোভাবে জায়গা নিয়ে অনিন্দ্যও বসে অন্যান্য যাত্রীদের মত। আর জায়গার অভাবও ছিল না। ট্রেন টা ছিল প্রায় ফাঁকা। এক যুবতী , পঁচিশ বয়স বছর বয়স হবে, ঠিক অনিন্দ্যর সামনাসামনি বসে। খেয়াল ছিল না অনিন্দ্যর। মেয়েটির জন্ম না চোখ ই তার উপস্থিতিকে বুঝিয়ে দেয়। সিটে বসতে গিয়ে মেয়েটিকে অনিন্দ্য দেখেছিল। মাথা নিচু করে সানন্দা পত্রিকা পড়ছিল। তখন মেয়েটার মুখটা অনিন্দ্যর সামনে ধরা পড়েনি। আর ধরা পড়েনি তখন মেয়েটার চনমনে চোখ দুটিও। গল্প-উপন্যাস কাব্যে কোন লেখক বা কবির বর্ণনায় কোন নারীকে অভিনন্দন ভালো লাগলেও বাস্তবের কোন নারীকে তেমন ভালো লাগেনি। আবার ভালো লাগেনি বললে ভুল হবে, বন্ধুত্ব করার জন্য তেমন কোন নারী তার কাছে আসেনি সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপনের হাত বাড়িয়ে দিয়ে। এরই ফাঁকে এক এক স্টেশনের প্লাটফর্ম আসে, আবার তারা চলেও যায়। এমনই এক প্লাটফর্ম থেকে ওঠে এক ফেরিওয়ালা। একগুচ্ছ আমলিকর প্যাকেট নিয়ে। ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত পোশাক পরে মুখে ভাষার বিচ্ছুরণে আমলকির গুনাবলী বলে চলে, 'ডা বিধান চন্দ্র রায় সকলকে আমলকি খেতে বলতেন। ক্যান্সার দূর করতে পারে এই আমলকী, আরো অসংখ্য রোগ নির্মূল করতে পারে এই আমলকী, সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ভিটামিন সি থাকে এই ফলে। আপনারা দু' একটা নমুনা এমনি টেস্ট করতে পারেন। এর জন্য পয়সা দিতে হবে না, ভালো লাগলে কিনে নিতে পারেন। প্রতিটি প্যাকেটের মূল্য দশ টাকা।'কথাগুলি বলার ফাঁকে দু-একটা আমলকি ওই কামরায় উপস্থিত প্রত্যেককে দিতে দিতে অনিন্দ্য ও ওই মেয়েটির সামনে আসে। লোকটি আমলকি বার করেছে, এমন সময় অনিন্দ্য আর ওই মেয়েটি দুজনেই হাত বাড়ায় আমলকি নেওয়ার জন্য। পরস্পর পরস্পরের হাতের আলতো ছোঁয়ায় দুজনই লজ্জা হাতটা গুটিয়ে নেয়। আর ওই লোকটি আমলকি দিতে গিয়ে হাতে আমলকি নিয়ে থমকে গিয়ে মজার কৌতূহলে ওদের দুজনের দিকে তাকায়। কিউ আর হাত বাড়ায় না। লোকটি দু'জনকেই হাত বাড়িয়ে আমলকি দিয়ে দেয়। তারা পরস্পর পরস্পরে দিকে লাজুক হাসি ছুঁড়ে দিয়ে যে যার হাত পেতে আমলকি নিয়ে নেয়। আমলকি টি মুখে পুরে অনিন্দ্য দশ টাকা বার করে এক প্যাকেট আমলকি কিনে নেয়। আর সেই প্যাকেটটাকে অ্যাটাচিতে রেখে আবার যথাস্থানে সে বসে যায়।
ট্রেন এগিয়ে চলছে। অনিন্দ্য জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঠেকেছে। আর কিছুক্ষণ পরে সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। মধ্যে মধ্যে ছড়িয়ে থাকা খেজুর , ঝাউ,সুপারি ,নারিকেল, কোথাও কোথাও ইউক্যালিপটাস বিষন্নতায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, সূর্যের দিকে চেয়ে ,বিদায়-সম্ভাষণ দিতে। মধ্যে মধ্যে ট্রেনের কামরার অন্য প্রান্ত থেকে অনিন্দ্যর কানে আসছে ভোটের গরম টুকরো টুকরো বিতর্ক। তার সঙ্গে দক্ষিণের প্রাণ জুড়ানো বাতাস গ্রীষ্মের গরমে শরীরের অস্বস্তি কে মুক্তি দিয়ে যায়।
অনিন্দ্যর গায়ের রং শ্যামলা। মুখের গড়নটা খুব সুন্দর না হলেও খারাপ নয়। পায়ে বাদামী রঙের বুটের সাথে ইস্ত্রি করা সাদা প্যান্ট শার্টে খুবই স্মার্ট লাগছে। ট্রেনে বাসে সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকানো তার অভ্যাস বা পছন্দ নয়। আবার তাকানোকে ও খারাপ ও মনে করে না। তার যুক্তিতে সুন্দরীর দিকে তাকানোর মধ্যে গুণী শিল্পী রাই শিল্পরস অনুভব করতে পারে। যদিও এ ভাবনা প্রথমদিকে আসেনি, বহু সাহিত্য পাঠেই তার মননশীলতায় ধরা পড়েছে। কেউ খারাপ ভেবে বসবে বলে কোন সুন্দর নারী মুখের দিকে তাকাতে অনিন্দ্য দ্বিধাবোধ করে। কিন্তু ওই দুটি চোখের চঞ্চলতা, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে শরমে রাঙানো হাসি সামনেই যেখানে হাজির, তাহলে একটু এক পলক তাকিয়ে দেখতে ক্ষতি কি! এইরকম ভাবতে ভাবতে অনিন্দ্যর চোখের দৃষ্টিটা মেয়েটির দিকে গিয়ে থামে। মেয়েটি তখন অন্যদিকে আনমনায় তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। তার দিকে অনিন্দ্যকে তাকাতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির হাসি বিহীন শুকনোমুখে পাশে থাকা ওই সানন্দা পত্রিকা টি তুলে নিয়ে পড়তে থাকে। অনিন্দ্য মনে মনে ভাবে, আমার এই তাকানোটাই ওর মুখকে শুকনো করে দিল। ওর দিকে তাকানোকেই ও খারাপ মনে করেন। চোখটা অন্য দিকে ফেরালো অনিন্দ্য। এমন সময় অনিন্দ্য দেখতে পায় কামরার গেটের কাছে কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। তাদের কথাবার্তা শুনে অনিন্দ্য র মনে হলো ওরা কলেজ পড়ুয়া। কোন প্রফেসরের কাছে টিউশন সেরে বাড়ি ফিরছে। তাদের উল্লাস ভরা আলাপন যেন একগুচ্ছ চাঁপা ফুলের সুবাস গোটা কামরায় ভরিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে ট্রেনের মধ্যে থাকা অনেকের দৃষ্টি তাদের দিকে স্থির ভাবে আটকে যায়। ব্যাতিক্রম অনিন্দ্য ক্ষেত্রেও নয়। এবার অনিন্দ্যর সামনে বসা মেয়েটি দুটো হাত আগের মত ম্যাগাজিন তাকে ধরে ঘাড়টাকে বাম দিকে ঘুরিয়ে গেটের কাছে ঐ মেয়েগুলোকে এক পলক দেখে নিয়ে ম্যাগাজিনের এক প্রান্ত বরাবর লুকিয়ে দেখার মতো অনিন্দ্য র দিকে তাকিয়ে ফলো করছে, অনিন্দ্য ওই মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আছে কিনা! আর অনিন্দ্য এটা বুঝতে পেরে ইচ্ছে করেই গেটের কাছে ওই মেয়েদের দিকে তাকিয়ে মনোযোগে তাদের কথাগুলো শোনার ভান করে। কিছুক্ষণ অনিন্দ্য এভাবে তাকাতে সামনের মেয়েটি এবার ম্যাগাজিন গুটিয়ে পাশে সশব্দে রেখে কটাক্ষ দৃষ্টিতে অনিন্দ্যর দিকে তাকায়। ওই দৃষ্টিতে অনিন্দ্যকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, তুমি হ্যাংলা ছেলের মত মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আছ কেন?অনিন্দিতা অনুভব করে চোখটা আবার অন্য দিকে ফেরায়। মনে মনে অনিন্দ্য ভাবে, এ কেমন ধরনের মেয়ে! অনেক তো উপন্যাস গল্প পড়েছি ,এমন কখনো পেয়েছি কিনা সন্দেহ। আমি be bb তো ওর দিকে তাকাই নি, ওরা অত মাথা ব্যথা কেন? আশ্চর্য মেয়ে। এমন সময় এক ফেরিওয়ালা ওই কামরায় আসে বিভিন্ন ধরনের পেন বিক্রি করতে। একটা প্যাকেটে এক ধরনের পেন দুটো আছে। দাম দশ টাকা। অনিন্দ্য ও ওই মেয়েটির দুজনের ই পছন্দ। টাকা বার করে মেয়েটি পেনের প্যাকেট নিয়ে নিলে অনিন্দ্য ও টাকা বার করে ওই ধরনের পেন কিনতে, কিন্তু ফেরিওয়ালার কাছে ওই ধরনের পেনের প্যাকেট আর নেই। ফেরিওয়ালা তা অনিন্দ্যকে জানায়। আরো জানায়, অন্য ধরনের পেইন নিতে পারেন। প্রত্যুত্তরে অনিন্দ্য বলে, বাড়িতে অনেক পেইন আছে। ওই পেনের সেটটা পছন্দ হয়েছিল, তাই কিনতে চেয়েছিলাম। এমন সময় মেয়েটির ফেরিওয়ালাকে বলে, আপনি বরং আমার এই পেন সেটটা ওনাকে দিন, আমি নেব না। সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দ্য বলে, না- না, উনি কিনে নিয়েছেন, আমার দরকার নেই। তখন মেয়েটি বলে, এমনি আমি কিনেছিলাম। আমার যে খুব ভালো লেগেছিল তা নয়। এবার জোর করে ফেরিওয়ালার হাতে পেনের সেটটা গুঁজে দেয়। আর অনিন্দ্য আমতা আমতা করে ফেরিওয়ালাকে দশ টাকা দিয়ে পেনের সেটটা নিয়ে নেয়। ফেরিওয়ালা দশ টাকা মেয়েটির হাতে তুলে দিয়ে অন্যত্র চলে যায়।
সত্যি বিচিত্র ধরনের মেয়ে। পেনের সেটটা কিনেও আবার আমার জন্য ফিরিয়ে দিল, দয়া দেখাল। নিজেকে মহান করার চেষ্টা। রক্তে ভাবতেই জানালা দিয়ে বাইরে অনিন্দ্যর চোখে যেতে দেখে কোলাঘাটের ব্রিজটাকে ট্রেনটা অতিক্রম করছে, কোলাঘাটের পরের স্টেশন মেচেদা, অনিন্দ্যর মনটা কেমন যেন বিষণ্নতায় ভরে এলো। ট্রেনটি কোলাঘাট পেরিয়ে মেচেদা স্টেশনে পৌঁছলে অনিন্দ্য র্যাক থেকে তার অ্যাটাচি নিয়ে
ট্রেন থেকে নামে।
দিগন্ত রেখাটির পারে সূর্য অস্ত গেছে। পৃথিবীতে তার আলোর মৃদু আভা টুকু ছড়িয়ে রয়েছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে অনিন্দ্য। হাতের ছোট অ্যাটাচি। মধ্যে মধ্যে ট্রেনের ওই মেয়েটি মনের মধ্যে উকি মেরে যায়। মেচেদা স্টেশন টা আরো অনেক দূর হলে ভালো হতো। হয়তো আরো কত কি ঘটতো! যা হয়নি তা ভেবে লাভ কি?
গাড়ি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ভগবান, একটা যেন বাস পেয়ে যাই। ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধার উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকিয়ে এদিকে ওদিকে না তাকিয়ে অনিন্দ্য ছুটতে থাকে বাসস্টপেজের দিকে। বাস স্টপেজ না বলে বা ডিপো বলা ভালো। এখান থেকে অনেক বাস ছাড়ে। দীঘা-মেচেদা ,নন্দীগ্রাম- মেচেদা ,হলদিয়া -মেচেদা আরো কত বাস। কিন্তু একটা দেখা যাচ্ছে নন্দীগ্রাম- মেচেদা। তাহলে কি দীঘা- মেচেদা নেই? এদিক ওদিক তাকাতে অনিন্দ্য দেখতে পেল অন্য প্রান্তে উত্তর-পূর্ব দিকে একটা স্টেট বাসের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তুই এগিয়ে সিওর হয় স্টেট বাস ই, এখান থেকে স্টেট বাস বলতে হলদিয়া- মেচেদা বা দীঘা -মেচেদা। এটা কি যে কি তা বোঝার জন্য দ্রুত পায়ে ওই বাসটির দিকে এগিয়ে যায় অনিন্দ্য। এমন সময় অনিন্দ্য দেখতে পায় একটি মেয়েকে ওই বাসে উঠতে। গাঢ় নীল শাড়ি পরা, মাথায় খোপা, পিছনটা দেখে অনিন্দ্যর মনে দূঢ় ধারণা হয় যে, ট্রেনের সেই মেয়েটি ই এই মেয়ে। দৌড়তে দৌড়তে বাসের সামনে গিয়ে নেম প্লেটটায় লেখা দীঘা- মেচেদা দেখে অনিন্দ্যর খুব স্বস্তি বোধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাসে উঠে অনিন্দ্য। বাসের ভিতর সব সিটের দিকে চোখ মেলে অনিন্দ্য দেখে কোথাও বসার জায়গা নেই। সাথে সাথে অনিন্দ্য কে দেখতে পায় মেয়েটি পাশে যাত্রীদের সরে যেতে বলে একটা সিট বের করে। দেখতে পায় ওই মেয়েটিকেও, একেবারে পেছনের সিটে বসেছে। জায়গাটা যে আছে চোখের ইশারায় মেয়েটি অনিন্দ্য কে বোঝায়। অনিন্দ্য তা বুঝতে পেরে মেয়েটির পাশে ওই সিটটায় গিয়ে বসে। বাস চলতে শুরু করেছে। দুজন পাশাপাশি বসাতে প্রত্যেকের শরীরের এক এক ছুঁয়ে আছে। মেয়েটির ডান হাতের নরম স্পর্শ অনিন্দ্য হৃদয়ে যেন নতুন উন্মাদনার সৃষ্টি করে। তবুও নিজেকে সামলে নিজের শরীরকে একটু পেছনের দিকে কাত করে অনিন্দ্য মেয়েটির শরীরের স্পর্শ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ চলার পর রাস্তা খারাপের জন্য বোধহয় বাসটি বেশ দোল খেতে শুরু করেছে। এর জন্য মেয়েটি নিজেকে সামলে বসতে পারছে না। না পারারই কথা। মোটা কালো রঙের বড় ব্যাগ কোলে রেখে দুটো হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। মধ্যে মধ্যে ঢেউ যেমন কূলে গিয়ে আছড়ে পড়ে, তেমনি বাসের দোলায় মেয়েটির ব্যাগ ও তার সাথে ডান হাতটি পর্যায় বৃত্তি গতিতে অনিন্দ্য ওকে ধাক্কা দিয়ে যায়। মেয়েটির অসুবিধা হচ্ছে দেখে অনিন্দ্য মেয়েটিকে বলে,' ব্যাগটা আমায় দিন, আপনার বসতে অসুবিধা হচ্ছে।'মেয়েটি তখন ঠোঁটের এক কোণে লাজুক হাসি নিয়ে বলে,'না না, আপনার বলার জন্য আমাকে ধন্যবাদ।'এদিকে বাস সো-সো করে চলছে বাসের পেছনের দিকে দোলটা একটু বেশি হয়। তার ওপর বাস টা খুব জোরে ছুটছে।একটু বেশি দোল খাওয়াই স্বাভাবিক। চলতে চলতে বাসটি আবার জোরে একটা ঝাঁকুনি দিল। মেয়েটি ব্যাগসহ নিজে অনিন্দ্য র গায়ের ওপর প্রায় আছড়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দ্য ধমক দেওয়া সুরে বলে, 'ব্যাগটা তখন নিতে চাইলাম, তখন সম্মানে বাধল! দিন-,ব্যাগ টা দিন'বলেই অনিন্দ্য মেয়েটির কাছ থেকে প্রায় জোর করেই ব্যাগটা কেড়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বলে,' আমার জন্য আপনি কষ্ট পাবেন?
অনিন্দ্য বলে, তাহলে আপনার কষ্ট দেখে আমি পাশে বসে মজা উপভোগ করি।'এবার মেয়েটি কিছু না বলে চুপ হয়ে যায়। একটু ক্ষণের পর মেয়েটির মুখ খোলে,'মানে আমি বলতে চাইছিলাম আমি তো অনেক দুর যাবো-'
মেয়েটির কথা শেষ করতে না দিয়ে অনিন্দ্য বলে, 'কতদূর যাবেন?'
- 'পিছাবনী।'
_ 'ওইখানে আপনার বাড়ি?'
_ 'হ্যাঁ, ওইখানে। আপনার বাড়ি?'
_ 'আমার বাড়ী রামনগর। রামনগর ঠিক নয়, রামনগর থেকে তিন কিঃমিঃ উত্তরে এগ্রা লাইনে লালুয়া পুল বাস স্টপেজের কাছে। গ্রামটার নাম সাবিত্রাপুর। আপনার বাড়ি কি পিছাবনী বাস স্টপেজের কাছে?'
_ 'বাস স্টপেজের থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটা পথে পূর্ব দিকে। পিছাবনীর দিকে গেছেন কখনো?'
_'না, এমনি পিছাবনী তে যায়নি। কলকাতা যাওয়ার সময় বাসে পিছাবনীর উপর দিয়ে যাওয়া, এই টুকুই মাত্র।'
_ 'আমিও আপনার ওইদিকে কোনদিন যাইনি। আচ্ছা পিছাবনী থেকে আপনাদের বাড়ি কত দূর হবে?'
একটু ভেবে অনিন্দ্য বলে, 'হ্যাঁ, প্রায় কুড়ি কিমি হবে।'
বাস ঠিক আগের মতো সো-সো শব্দ করে চলছে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে মনকাড়া গ্রীষ্মের দক্ষিণে হাওয়া। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ চাপ। রাস্তার দু'পাশে ঝাউ, ইউক্যালিপটাস আর বাবলা গাছ গুলি বাসের বিপরীত দিকে দুরন্ত গতিতে ছুটছে। বাসের মধ্যে কয়েকটা সবুজ আলো জ্বলে আছে। পেছনের দিকে আবছা আলোয় মেয়েটির মুখ ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। নাকে ও কানে সোনায় বসানো পাথরের উজ্জ্বল আলোর ঝিলিক মেয়েটির স্মার্টনেস কে যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শরীরের নিটোল গরম টা যেন জলপূর্ণ দিঘির প্রকাশ।- 'কলকাতায় আপনার কি করা হয়?'মেয়েটি অনিন্দ্যকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।
_'বেলেঘাটায় সেল ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট এ চাকরি করি। আপনি কি করেন?'
-'না, না আমি চাকরি টাকরি কিছু করি না। পড়াশুনা করে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিচ্ছি।'
-'কত পর্যন্ত পড়েছেন?'
- 'বাংলায় এম.এ.পাশ করে বি.এড . গত বছর করেছি। আর আপনি?'
- 'প্লেন বি. এ. পাশ করেছি। আসল কথা কি জানেন, বাড়ির অবস্থা আমার ভালো ছিল না। টেনে পড়ার সময় বাবা মারা যায়। ঘরে মা ,আর একটা ছোট বোন আছে। কলকাতায় টিউশন পরড়য়ে বি.এ. পর্যন্ত পড়েছি। তারপর পরীক্ষা দিয়ে কোনরকমে এই চাকরিটা জুটিয়েছে।'
--'এখন যা চাকরির অবস্থা, কত এম এ., এম .এস .সি বসে আছে। সে তুলনায় আপনার ভাগ্য ভাল বলতে হয়।'
-'হ্যাঁ তা বলতে পারেন'।
-'কত বছর আপনার চাকরি হয়ে গেল?'
_'পচিশ বছর বয়সে পেয়েছিলাম। এখন আমার বয়স তিরিশ। হ্যাঁ প্রায় পাঁচ ছয় বছর হয়ে গেল।'
এরই ফাঁকে কন্টাকটার প্রত্যেকের কাছে টিকিট দিয়ে ভাড়া নিয়ে যায়। বাসটা তখন হলদি নদী ব্রিজ অতিক্রম করে চন্ডিপুর এর দিকে চলেছে। রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আউশ ধানের ক্ষেত। দুজন তাকিয়ে আছে জানালার ফাঁক দিয়ে ফুটে ওঠা জ্যোৎস্নালোকে মাখা প্রকৃতির দিকে। কিছুক্ষনের অনিন্দ্য বলে,'এখন কোথায় থাকেন? কোন মেসে?'
মেয়েটি জানালা থেকে ঘাড় ফিরিয়ে অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
'হ্যাঁ। মেসে থাকি। যাদবপুরে। আপনি কোথায় থাকেন?'
-- 'বাগমারি তে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি।'
হঠাৎ বাসে ইঞ্জিনে কড্ কড্ করে বিকট শব্দ। পঁচিশ তিরিশ ফুড এগিয়ে গিয়ে বাস থামে। কী হল বলে বাসের সকলে উৎসুক মুখে কন্টাকটার ড্রাইভার এর দিকে তাকায়। দশ পনেরো মিনিট ড্রাইভার ইঞ্জিন খুলে কি একটা চেষ্টা করে না পেরে বলে,'একটা পার্টস খারাপ হয়ে গেছে। কোলাঘাট থেকে আনতে হবে। বাস চালু হতে দু তিন ঘন্টা লেগে যাবে।'কথাটা শুনে সকলের মুখে হতাশা দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। এদিকে ভোটের জন্য রাস্তায় বাস নেই বললেই চলে। এমনি করে বাসে বসে সময় কাটানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। অনিন্দ্য হাত ঘড়ির দিকে তাকাতে মেয়েটি জানতে চায়,'কটা বেজেছে?'ঘড়ি দেখে অনিন্দ্য বলে,'সাতটা চল্লিশ।'বাস থেকে কিছু যাত্রী বাইরে বেরিয়ে শরীরের হাওয়া লাগিয়ে আরাম বোধ করছে।' আপনার বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হবে না?'কথাটি বলে মেয়েটি অনিন্দ্যর দিকে তাকায়। অনিন্দ্য উত্তর করে,'না-না, তেমন অসুবিধা হবে না। রামনগরে রিক্সা অনেক থাকে।'কথাটা শেষ হতে না হতেই কয়েকজন যাত্রী বলে 'বাস আসছে ,বাস আসছে।'বলেই তারা যে যার ব্যাগ বের করে বাস থেকে নেমে যেতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে একটা দীঘা গামী বাস। এই বাস থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ওই বাসটায় ও প্যাসেঞ্জার প্রায় ভর্তি। জানলা দিয়ে অনিন্দ্য দেখে মেয়েটিকে বলে,'চলুন, চলুন, ওই বাসটায় আমাদেরও উঠতে হবে। না হলে আমাদের ভাগ্যে দুর্ভোগ আছে।'সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিও উঠে পড়ে। অনিন্দ্য বাসের উপরে র্যাকে অ্যাটাচি বের করে আর মেয়েটির বড় ব্যাগটি তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনিন্দ্য তখন মেয়েটিকে বলে,'আপনি অ্যাটাচি নিয়ে নামুন, আমি ব্যাগটা নিয়ে নামছি।'বলে ওরা বাস থেকে নামতে থাকে। বাস থেকে নেমে ওরা অন্যান্য যাত্রীর মত ছুটতে আরম্ভ করে। একটুখানি ছুটতেই মেয়েটির ছোট পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। কয়েক পা বেশি এগিয়ে গিয়েও অনিন্দ্যকে থমকে যেতে হয়। মেয়েটির হিল দেওয়া জুতো হোঁচট খাওয়ার সময় তার পা থেকে বেরিয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে চলে যায়। অনিন্দ্য পিছু হটে মেয়েটির কাছে আসতে সে বাসটা ছেড়ে চলে যায়। বাসায় অনিন্দ্য তাকিয়ে থাকে চলমান ওই বাসটির দিকে। মেয়েটি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বলে,'আমার জন্য আপনি বাসটায় যেতে পারলেন না, ইস্, আপনাকে অসুবিধায় ফেললাম।'
--'আরে অসুবিধা কি আছে! আপনার কোথায় লাগলো, দেখি দেখি !'
---'তেমন কিছু হয় নি। বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটায় পাথর টা লাগাতে একটুখানি ছড়েছে।চতুর্থ খন্ড:--- অনিন্দ্য অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে,'রক্ত বেরোচ্ছে? ব্যথায় কাতরানো মুখে মেয়েটি উত্তর করে,'হের রক্ত বেরোচ্ছে।' 'বাসে চলুন কেমন ছড়েছে দেখা যাবে।'ব্যাগ অ্যাটাচি নিয়ে দুজন বাসে ওঠে। বাসের র্যাকে অ্যাটাচি, পেছনের সিটের ওপর ব্যাগ রেখে আলোর কাছে গিয়ে মেয়েটির পায়ের আঙুলে চোখ রাখে অনিন্দ্য। দেখে ফোঁটা কয়েক রক্ত ছড়িয়ে গিয়ে বুড়ো আঙ্গুল সহ পায়ের আঙ্গুল কে লাল করে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কন্ডাক্টারকে জিজ্ঞেস করে অনিন্দ্য,'ডেটল বা কাটা ছোড়ার ওষুধ আছে?'কন্ডাক্টার না বলাতে মেয়েটিকে নিয়ে বেরিয়ে আসে কোথাও ডাক্তার-খানা বা কোন ঘরে ডেটল পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে। রাস্তার দুই দিক প্রায় ফাঁকা। ঘরবাড়ি খুব কম। প্রায় তিনশ মিটার উত্তর পূর্ব দিকে একটা পাকা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পূর্ণিমা চাঁদের আলো সারা আকাশে মিষ্টি রোশনাই ছড়িয়ে নিজেকে মোহময়ী করে তুলেছে। বাঁকা কয়েকটা রাস্তা পেরিয়ে ওই বাড়ি যায়। বেশ ভালো করে মেয়েটির পায়ে ডেটল লাগিয়ে ওই বাড়ি থেকে কাপড় নিয়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দেয়। আর ওরা ওই বাড়ি থেকে জল চেয়েও খায়। সেখানে আধ ঘন্টা কাটানোর পর ফিরে আসার সময় অনিন্দ্য মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে,'এবার ভালো লাগছে তো?'মেয়েটি উত্তর দেয়,'হ্যাঁ ভালো লাগছে। আরো ভালো লাগছে এই জ্যোৎস্নায় আলোয় ফাঁকা পরিবেশে সবুজ ঘাসের উপর হাটতে।'পাশাপাশি দুজন হাঁটছিল। অনিন্দ্য মৃদু হেসে মেয়েটিকে বলে,'কোথায় যেন রোমান্সের গন্ধ পাচ্ছি!'মাথা ঝাকিয়ে মেয়েটি বলে,'আপনার মনে কখনো রোমান্স আসে না?'অনিন্দ্য উত্তর করে,'না বলছি না, আসি অবশ্যই...'কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মেয়েটি বলে,'দেখুন দেখুন পুকুরটার ওপারে দেখুন, কত ফুলের গাছ, সুন্দর করে কাটার বেড়া দিয়ে আটকে রেখেছে। ব্যথার জন্য আসার সময় খেয়াল ছিল না। ও প্রান্ত টা পুরো ফাঁকা, দূরে ঝাউ, ইউক্যালিপটাস, জোৎস্নার আলোয় সব কেমন মিষ্টি লাগছে। চলুন না বাসে না বসে ঘাটের কাছে ফাঁকা মতন ওইখানে বসি। ধুলো লাগবে না, দূর্বা ঘাস তো, ভগবান আমাদের জন্য আসন করে দিয়েছে।'অনিন্দ্য মৃদু হাসলো। দুজন পাশাপাশি বসে ঘাসের ওপর। তখন দু'জনকেই খুব রোমান্টিক লাগছিল। দুজনেই গোগ্রাসে প্রকৃতির অমন সুন্দর রূপ পান করছিল আনমনা হয়ে। সবুজ প্রকৃতিকে আরো মোহময়ী করে তুলেছে জোনাকির মিটমিট করা আলো। গোটা সবুজ প্রকৃতিকে চাঁদ তার না ওড়নায় ঢেকে রেখেছে আরো রহস্যময়ী করে তোলার জন্য। রূপের মাধুরীতে বিভোর হয়ে অনিন্দ্যর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,'অপূর্ব!'মেয়েটিও সাথে যোগ করে,'সত্যি অপূর্ব!'
অনিন্দ্যর মুখ থেকে স্পষ্ট উচ্চারণে আবৃতি ঢং-এ বেরিয়ে আসে কবিতা।
ওরে মোহময়ী রাত-
তারার আকাশে জেগে থেকে
জোনাকি আলোয় মেতে
শ্যামলা গায়ে ওড়না পড়ে
আছিস বেশ সুখে,
কেন আমায় টানিস তুই
অমন করে আজ!
মেয়েটি হেসে বলে,'বেশ তো, আপনি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন। কবিতার চর্চা করেন মনে হয়! আচ্ছা এ কবিতাটি কার লেখা?'
_'এটা একটা কবিতা হলো নাকি! মুখে দু একটা ভাষা এল সাজিয়ে তা বলে দিলাম। তা যদি আপনি কবিতা মনে করেন তাহলে....'বিস্ময়ে মেয়েটি বলে,'আপনি কবিতা কখনো লিখেছেন?'অনিন্দ্য বলে,'হ্যাঁ, এইরকম অনেক কবিতা লিখেছি। কিন্তু একটাও ছাপাইনি। বা কোন ম্যাগাজিনেও পাঠাইনি।'
মেয়েটির বিস্ময়ে বলে,'কেন আপনি পাঠাননি?'
_'এইরকম কবিতা লিখি অবসরে, শুধু মন কে আনন্দ দেওয়ার জন্য।'
_'না, আপনাকে, বেশি প্রশ্ন করে এমন সুন্দর রাতের সৌন্দর্য উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত হব তা আমি চাইনা, বরং আপনার আজকের অনুভূতির কথাই শুনি।'
অনিন্দ্য হাতের ইশারায় মেয়েটিকে বলে,'দেখুন ওই উত্তর-পূর্বদিকে মেঘগুলো কেমন স্তরে স্তরে সেজে রয়েছে যেন মনে হয় কোন এক অচিন দেশ, দেখছেন আপনি, কেমন সুন্দর মেঘের পাহাড়, কেমন সুন্দর মেঘের সমুদ্র, কেমন সুন্দর মেঘের দিঘী, ইস্ আমার যদি দুটো ডানা থাকতো পাখির মত, আমি উড়েই চলে যেতে পারতাম।'
নীল সাগরের ঢেউ দিয়ে যায়
কিনারায় বাজে স্রোত,
অণুতে অণুতে বেজে ওঠে প্রাণ,
তনুতে হিল্লোল।
মেয়েটির মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,'বাঃ সুন্দর!' দুষ্টুমিতে অনিন্দ্য বলে, কোনটি, আমার আবৃত্তি না এই মোহময়ী রাত্রি?'
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলে,'দুটোই। আজকের এই রাত যেন মাতাল করা এক নেশায় ভরিয়ে রেখেছে।'সাথে সাথে অনিন্দ্য প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আরম্ভ করে-
ওরে মাতাল করা রাত্রি
নীল কপালে টিপ পড়ে তুই
হাস্নুহানায় জেগে
জুঁই ডালিয়া গায়ে সেঁটে
সাজিয়ে ছিস নিজেকে,
আমি এখন সন্ধ্যেবেলার যাত্রী
পথের মাঝে আটকে রেখে
আছিস বেশ সুখে-
ওরে ও মাতাল করা রাত্রি।
'আমার যে কি ভালো লাগছে, বলে বোঝাতে পারবো না।'আবেগের ঘন দীর্ঘশ্বাসে কথাটা বলে মেয়েটি অনিন্দ্যর দিকে তাকায়।
অনিন্দ্য শান্ত ভাবে আবেগের মতো করে বলে,'তাই!'মেয়েটি মাথা নেড়ে বলে,'তাই নয়কি! ফুলের বাগান, সবুজ ঘাসের মাঝে দীঘির জল, অমন সুন্দর চাঁদ, তার ওপর পাশে একজন...,'পুরো কথাটি না বলে থেমে যায় মেয়েটি।পঞ্চম খন্ড:----- অনিন্দ্য কৌতূহলে বলে,'থামলেন কেন? তার ওপর পাশে একজন কি?'
মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলে,'না। কিছু নয়..... ভালো কথা শুনতে নেই।'
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার মেয়েটি বলে,'আচ্ছা আমরা আসবো বলেই কি এমন দিঘী, চাঁদ, ফুলের বাগান, দূরে সুপুরি গাছের সারি- এরা প্রত্যেকে হাজির হয়েছে।'
মাথা নেড়ে অনিন্দ্য বলে,'হ্যাঁ, আপনি আমার সাথে এখানে কিছু সময় কাটাবেন বলে রাতকে আমি সাজাতে বলেছিলাম, চাঁদকে তার মিষ্টি রোশনাই নিয়ে নীল আকাশের বুক চিরে অমন সুন্দর ভাবে ফুটতে বলেছিলাম। জল ভরা দিঘি কে সুন্দর ঘাসে সাজতে বলেছিলাম। ওই যে বাগান দেখছেন, ওখানেই গোলাপ, রজনীগন্ধা, চামেলীদের ফুটতে বলেছিলাম।'
মেয়েটি হেসে বলে,'তাই? অসংখ্য ধন্যবাদ।'
দুজন- দুজনের দিকে চোখের পলক ফেলে এদিকে ওদিকে তাকানোর ফাঁকে আবেগ ঘন আকর্ষণে এমনি করে কয়েকটা মুহূর্ত ভাষাহীন নীরবতায় কেটে যাওয়ার পর মেয়েটি বলে,'আচ্ছা, এর আগে কাউকে সাথে নিয়ে আজকের মত এমন রাত কাটিয়েছেন?'
অনিন্দ্য মাথা নাড়িয়ে জানায়,'না।'
_'কেন, আপনার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে কোনো চাঁদনী রাতে বসে সময় কাটাননি?'
মাথা নেড়ে অনিন্দ্য উত্তর দেয়,'না।'
উৎকন্ঠায় জানতে চাই মেয়েটি,'কেন?'
হেসে অনিন্দ্য বলে,'বিয়েই করিনি।'
এবার মেয়েটি হেসে বলে,'ও তাই।'
মেয়েটির চোখে মুখে চঞ্চলতার সাথে উৎফুল্লতার ছাপ। বাগানের দিকে তাকিয়ে বলে, 'ইচ্ছে করছে বেড়া টপকে বাগানের ফুলগুলো সাথে আমিও মিশে যাই। দেখুন দেখুন দক্ষিণ পশ্চিম দিকে ফুল গুলো কেমন ফুটে রয়েছে।'
মেয়েটির কথা শুনে অনিন্দ্য বাগানের দিকে তাকিয়ে ঠোট নাড়িয়ে আওয়াজ তোলে-
ভোরের মল্লিকা, লুকিয়েছিস কোথায়? দেখ, তুই দেখে যা-
সাঝের চামেলী আলো করে আছে
মুঠো মুঠো জোছনায়।
ফুলের কাছ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মেয়েটি অনিন্দ্যর দিকে চেয়ে অবাক হয়ে দেখে। মেয়েটির এই রকম অবস্থা দেখে অনিন্দ্য বলে,'কি হলো আপনার?'
_ 'বিভ্রান্তিতে পড়লাম।'
_'কেন?'
_'কার দিকে তাকাই! ফুলের, না আপনার দিকে?'
_'কেন, যে এত সুন্দরের স্রষ্টা, ঐ চাঁদের দিকে...'
মেয়েটি অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।
অনিন্দ্য চাঁদের উদ্দেশ্যে বলে
সুন্দরী ওগো চন্দ্রমা
তোমার বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস
প্রেমের সুরভী ছড়িয়ে দিয়ে
রোশনাকে করেছ রাশ
চার দিকে ঝরে মুক্ত আকর
ভরা গাঙ্গে জোছনায়
কপোত কপোতী বসে জেগে রয়
তোমার প্রেমের আঙিনায়।
অনিন্দ্যর কবিতা শুনতে শুনতে মেয়েটি যেন ভাবছে বিভোর হয়ে, বা অন্য কোন জগতে চলে গেছে। টনক নড়ে যখন শুনি অনিন্দ্যর কন্ঠে,'কি ভাবছেন?'
থতমত খেয়ে মেয়েটি বলে,'না, তেমন কিছু নয়।'ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অনিন্দ্য বলে,'অনেক সময় কেটে গেল। গাড়ি ছেড়ে দিলে ব্যাগ আর অ্যাটাচি দুটো খাওয়াতে হবে আমাদের।'অনিন্দ্য উঠে দাঁড়াতে মেয়েটিও উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটি এমন ভাবে ওঠে যেন তার উঠতে ইচ্ছে ছিল না।
দুজন গুটি গুটি পায়ে চলতে থাকে। দু'জনের মুখের কোনো ভাষা নেই। মাঝে মাঝে তাদের কানে আসে বাসে ইঞ্জিন সারানোর বিদঘুটে আওয়াজ। গাছের কাছে পৌঁছে অনিন্দ্য কন্ডাক্টারের কাছে জানতে পারে বাস পা৺চ দশ মিনিটের মধ্যে ছাড়বে। বাসের মধ্যে অনেকে চলে যাওয়াতে ওরা দুজন বাসের মাঝ বরাবর বসে, ব্যাগ, অ্যাটাচি ও সাথে রাখে।
_'আপনাকে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখছি।'কথাটি অনিন্দ্য বলে মেয়েটির দিকে তাকায়। তার সাথে চোখে মুখে কৌতূহলের ভঙ্গিতে বলে,'ব্যাপার কি, কি হলো?'
অনিন্দ্যর দিকে করুন দৃষ্টিতে একটুখানি তাকিয়ে বলে,'না-তেমন কিছু নয়।'বলেই মেয়েটি মুখটা নিচু করে। সাথে সাথে তার যেন একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মেয়েটির মুখে কথা ফোটার জন্য অনিন্দ্য বলে,'আপনার নামটা তো জানালেন না?'
মেয়েটি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,'আপনি তো জানতে চাননি!'
অনিন্দ্য বলে,'এইতো এখন জানতে চাইলাম।'
লাজুক চোখে মেয়েটি বলে,'অনিমা গিরি। আপনার নাম?'
অনিন্দ্য বলে,'অনিন্দ্য মাইতি।'এর ফাঁকে কখন যে বাস চলতে শুরু করেছে অনিন্দ্যর খেয়াল ছিল না। জানালার পাশে বসে অনিন্দ্য। জানালার বাইরে চোখ যেতে যেতে তখনই অনিন্দ্য বুঝতে পারে বাইরে আলোর সমুদ্র। মতে মতে দক্ষিনের বাতাস দু'জনকেই আনমনা করে তোলে। অনিন্দ্যর মুখে জড়ো হওয়া ভাষা কবিতা রূপে বেরিয়ে যায়।
শ্যাম সবুজে জোছনায় ভরা
গাঢ় রাত্রির কোরক
নীলিমায় যত সন্ধ্যাতারা
এই পৃথিবী তার ধারক
নেচে নেচে আসে দখিনা বাতাস
নেভায় গায়ের জ্বলন
বসে অনুভবে স্বাদ পাই ঠিক
কার রাঙানো ঠোঁট চুম্বন!
'কোন নারীর রাঙানো ঠোঁটের চুম্বনের স্বাদ তাহলে পাওয়া হয়ে গেছে!'বক্রোক্তিটি অনিন্দ্যর দিকে ছুঁড়ে দেয় মেয়েটি।
'আরে না- না, তেমন সৌভাগ্য হয়নি। কল্পনার ও একটা অনুভব আছে। এই অনুভবের স্বাদ কবিতায় ঢুকিয়েছি মাত্র।'কথাটি বলে থামে। মেয়েটির দিকে কৌতুহল চোখে আবার অনিন্দ্য বলে,'একটা কথা বলব?'
_'বলুন।'
_'আপনি কখনো কাউকে ভালবাসেননি, মানে যাকে প্রেম বলে, ওই প্রেম-টেম করেননি?'
_'মাথা খারাপ!'
_'কেন, প্রেম টেম পছন্দ করেন না বুঝি?'
_'না না, তা নয়। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়েছি। প্রেমকে তো আগে পছন্দ করব। কিন্তু আমার বাবার জন্যই তো এই সব থেকে দূরে, বাবাকে খুব ভয় করি। আমার মা নরম প্রকৃতির। আমরা দুই বোন, ভাই নেই। বাবা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। তার সাথে রাজনীতি ও করেন। জেলা পরিষদে দাঁড়িয়ে জিতেছেনও। আমার ওপরে পাঁচ বছরে বড় দিদি, সে একজনকে ভালবেসে বিয়ে করেছে। প্রথম তিন বছর তো তার সাথে বাবা কোন সম্পর্কই রাখেননি। পরের দিকে মায়ের পীড়াপীড়িতে দিদির সাথে এখন সম্পর্ক ভালো। এদিকে বাবা আমাদের খুবই ভালবাসেন, বাবা যাতে কষ্ট না পান তাই এসবে কোনো মন দিই নি। তাছাড়া আগে তেমন কেউ আসেনি, যাকে মনে প্রাণে ভালোবাসা যায়। আমার কথা তো শুনলেন, এবার আপনার কথা বলুন না?'
_'আমার কথা!'
,_'হ্যাঁ, আপনার কথা। আপনার জীবনে কোন নারীর কথা। মানে আপনার প্রেমের কথা।'
অনিন্দ্য একটু চুপ করে ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।
_'কি, বলছেন না কেন?'তাড়া দেয় মেয়েটি।
দুষ্টুমির চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,'খুঁজছি।'
অবাক চোখে মেয়েটি বলে,'খুঁজছি মানে?'
অনিন্দ্য বলতে আরম্ভ করে---
'কত বার খুজেছি আমি তারে
পর্বত সমতলভূমি পেরিয়ে
কত নদীর তীরে-
কাজল কালো আঁখিতে গড়া
মোর শত জনমের একমাত্র প্রিয়ারে!'
কৌতূহলে মেয়েটি বলে,'খুঁজে কি পেয়েছেন?'
অনিন্দ্য বলে চলে-
'পাকা ধানের খেতের পারে
উদাসি দুটি চোখে
আনমনা হয়ে দেখেছিল
শুধুই সে আমাকে।'
আবেগ মথিত ভারী গলায় মেয়েটি বলে,'তারপর?'
_'তারপর,
হঠাৎ যেন দমকা হাওয়া
উড়িয়ে নিল তাকে,
আধার ঘরে হাতরে বেড়াই
সেই প্রাণ-প্রিয়াকে!'
এমন সময় বাসটি কন্টাইতে স্টপেজ দেয়। ওদের সেদিকে খেয়ালই নেই। দুজনেই চাতক চাতকীর মত ফাগুনের গল্পে মেতে। অনিন্দ্য কবিতা শেষ করে ভীরু চোখে তাকায়। মেয়েটির সমানভাবে আবেগ মথিত গলায় ভীরু চোখের কা৺পুনিতে বলে,'আপনার প্রিয়াকে খুঁজে পেয়েছেন?'অনিন্দ্যর কাঁপুনি গলায় ধীরভাবে বেরোয়,'পেয়েছি আবার পাইনিও।'প্রত্যুত্তরে মেয়েটিও কিছু বলতে আরম্ভ করবে, এমন সময় সদ্য বাসে ওঠা কাঁচা পাকা চুলের একজন বয়স্ক লোক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,'অনিমা, এত দেরী হল যে, আয় এখানে সিট খালি আছে। এখানে ভোটের মিটিং-এ এসেছিলাম।'
কাঁচা পাকা চুলের লোকটির কথায় অনিমা মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে অনিন্দ্যকে শোনায়,'আমার বাবা!'
মিটি উঠে ব্যাগ নিয়ে, সামনের দিকে গেটের কাছে, বাবার পাশে বসে।
পিছনে বসা অনিন্দ্য মেয়েটির দিকে বারবার তাকানোর চেষ্টা করে। লক্ষ্য করে মেয়েটি তার দিকে তাকাচ্ছে কিনা। কিন্তু না, একবারও তাকায়নি।
কিছুক্ষণ পর আসে পিছাবনী বাস স্টপেজ। ব্যাগ হাতে বাবা এগোন, পেছনে মেয়ে।
গেটের কাছে সবুজ আলো, বাবা নামার সময় মেয়েটি একবার তাকায় অনিন্দ্যর দিকে। তার করুণ চোখের দৃষ্টিতে এক আর্তি ফুটে ওঠে, সে আর্তিতে যেন অনিন্দ্যকে বুঝিয়ে দেয়,'তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার ছিল।'