Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। শুভদীপ রায়


পাগল


সরবিট্রেটটা জিভের নীচে দিয়ে ধপ করে বসে পড়েন শশাঙ্কবাবু। লোকজন বিশেষ নেই, তাও যে দু-একজন ছিল তারাই এগিয়ে এসে ধরেছিল নয়তো আজই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। 

একটু ধাতস্থ হলে অশক্ত হাতে প্যাকেটগুলো কুড়িয়ে নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে এগিয়ে যায় বাড়ির পথে। দুএকজন এগিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু উনি ধন্যবাদ দিয়ে তাদের বিদায় জানালেন। আজ অফিসে ভীষণ চাপ ছিল, তারপর ঘুরে ঘুরে বাজার করা-  এত রাত হয়ে যাবে বুঝতে পারেননি। কিসের জন্য যেন আজ ট্রেনগুলোও অসম্ভব ভিড় ছিল। দুটো ট্রেন দেখে শেষে তিন নম্বরটা আর ছাড়তে পারলেন না শশাঙ্ক পালিত। কোনমতে ভিড় ঠেলে নামতে গিয়ে এই হাল। যাইহোক,  শশাঙ্কবাবু রিক্সা স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালেন। স্টেশন চত্বরের বাইরে লোকজন বিশেষ নেই। হাতঘড়িতে দেখলেন সবে ১০.৩০ বাজে, তাও এত অস্বাভাবিক রকমের ফাঁকা, এমনকি একটা রিক্সাও পর্যন্ত নেই। আর অপেক্ষা না করে হাঁটা লাগালেন তিনি। 

ট্রেনে এতো ভিড় অথচ রাস্তাঘাট ফাঁকা। স্টেশনেও তেমন বেশি কেউ ছিলনা। কি ব্যাপার রে বাবা! সব দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে নাকি? শশাঙ্কবাবু হাঁটতে থাকেন আর কল্পনা করতে থাকেন গল্প হলে কি কি হতে পারতো। "হয়তো বিদেশী শত্রুর আক্রমণ হয়েছে। এমার্জেন্সি জারি হয়েছে। "। এর আগে এমার্জেন্সির অভিজ্ঞতা শশাঙ্কবাবুর দু একবার হয়েছে বটে, তবে তা এরকম না। ছোটবেলায় দেখেছেন টিভিতে যখন রামায়ণ দিত রাস্তাঘাট দোকানপাট এমনই শুনশান হয়ে যেত। 

"হয়তো ভিনগ্রহের প্রাণীদের আক্রমণে আমাদের শহরটা ফাঁকা হয়ে গেছে কিম্বা সব মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে... " এমন সে অনেক সিনেমাতেই দেখেছে। 

"কিম্বা ধরো একশো বছরের ঘুম ভেঙে রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো…" এসব উদ্ভট ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে একটা পাগল শশাঙ্কবাবুর সামনে এসে পড়ে। "যাবি আমার সাথে, যাবি ?" পাকা চুল দাড়ির জঙ্গল থেকে চোখ আর নাকটা উঁকি দিচ্ছে। পরনে ময়লাটে ছেঁড়া গেঞ্জি আর একটা রংচটা নীল জিন্সের হাফপ্যান্ট। শশাঙ্কবাবু ভয়ে ছিটকে যান। এদিকে পাগলটা নাছোড়বান্দা। হাত ধরে টানতে থাকে "যাবি আমার সাথে, যাবি?" 

সম্বিত ফিরে পেয়ে শশাঙ্কবাবু চোখ পাকিয়ে হাতঝাড়া দিয়ে তাড়া দিল, 'যা যা', তারপর রাস্তা থেকে পাথর তুলে ছোঁড়ার ভঙ্গী করতে পাগলটা ছুটে গলির অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। 

শশাঙ্কবাবুর কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকে। কিন্তু এমন পাগল তো পথেঘাটে আকছার দেখা যায়, আর বেশি না ভেবে আবার চলতে থাকেন। একটু দূর যেতেই মনে হয় অন্ধকার ছায়ার ভিতর থেকে কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলেন না। এবার আবার একটা ঢেলা তুলে নিয়ে জোরে জোরে পা চালাতে থাকেন। 

ঘরে ঢুকে স্ত্রীর হাতে বাজারের ব্যাগটা দিয়ে শশাঙ্কবাবু সোফার উপর গা এলিয়ে দেন। আলগোছে টাইটা খুলতে খুলতে ঈশারায় এক গ্লাস জল চান। 

"আজকে একটা স্ট্রোকই হয়ে যেত। " 

স্ত্রী জল এনে দিলে এক নিঃশ্বাসে গোটা গ্লাসটা শেষ করে হাঁফাতে থাকেন। 

-- অপারেশনটা করিয়ে নিচ্ছ না কেন? ডাক্তার তো বললো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব... 

-- হ্যাঁ এই বছরই.... আচ্ছা বাবান কই? 

শশাঙ্কবাবুর স্ত্রী খাবার বাড়তে বাড়তে উত্তর দেন, "তোমার জন্য অপেক্ষা করে করে ঘুমিয়ে পড়েছে।"

শশাঙ্কবাবু ব্যাগ থেকে একটা রঙীন কাগজে মোড়া প্যাকেট বের করে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন, "এই দেখো, ওর জন্য এনেছি, ওর মাথার কাছে রেখে আসবো?"

-- না কাল ঘুম থেকে উঠলে নিজে হাতে করে দিও খুশি হবে।

শশাঙ্কবাবু ট্যাবলেটটা গিলে নিয়ে একটু গলা উঁচিয়ে বললেন, "তোমার কি দেরি আছে? লাইটটা অফ করে দেব কি? "

-- না হয়ে গেছে, তুমি শুয়ে পড়ো। আমি এসে আলো নেবাচ্ছি। 

"তাড়াতাড়ি এসো, আমাকে সকালে উঠতে হবে", শশাঙ্কবাবু শুয়ে পড়েন। একটু পরে ওনার স্ত্রীও ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে চুল বেঁধে আলো নিবিয়ে খাটে এসে বসেন। তারপর হাততালি দিয়ে ঠাকুরের নাম জপ করে শুয়ে পড়েন। শশাঙ্কবাবু একটু হাসি নিয়ে একটু ব্যঙ্গ করে বলেন, "বুড়িধাড়ির এখনো ভয় লাগে? " স্ত্রী কোন উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শোয়। "বাবানও একা ঘুমাতে পারে, আর তুমি এই বয়সেও..." শশাঙ্কবাবু হাসতে থাকেন। "ভালো হয়েছে তুমি ঘুমাও তো এখন, তোমার না সকালে উঠতে হবে" অভিমানী সুরে বলেন স্ত্রী। শশাঙ্কবাবুর ধীরে ধীরে চোখ বুজে আসে। 


অফিসে যাবার আগে বাবানের ঘরে গিয়ে তাকে উঠিয়ে জন্মদিনের উইশ করে গিফ্টের প্যাকেটটা দিলে বাবানের চোখে সে কি আনন্দ! এইটুকু তৃপ্তির জন্যই তিনি হার্টের অসুখ নিয়েও ওভার টাইম করেন। এই হাসিটুকু তার সব ক্লান্তি সব দুঃখ এক নিমেষে ভুলিয়ে দেয়। শশাঙ্কবাবু বেরিয়ে যান। রাস্তায় আবার সেই কালকের রাতের পাগলটা! একে আগে এখানে দেখেননি কোনদিন। ঠিক তাদের বাড়ির সামনেই বসে আছে। মাটি নিয়ে কি সব করছে আপন মনে। "কালকের সেই পাগলটাই কি?" শশাঙ্কবাবুর কিছু একটা খটকা লাগল। কালকের মতো পাগলামি এখন নেই। আপনমনে খেলা করছে বাচ্চাদের মতো। "তাও ওর চোখদুটো …', কিছু একটা অস্বস্তি হচ্ছে শশাঙ্কবাবুর কিন্তু অনেক ভেবেও কিছু পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারলেন না। 


বাবান হুড়মুড়িয়ে রঙীন কাগজের মোড়কটা খুলে দেখে সেই দামী রিমোট কন্ট্রোল এরোপ্লেনটা। এটা যে সে কবে থেকে চাইছিল, শেষ পর্যন্ত মা বলেছিল ফার্ষ্ট হলে বাবা কিনে দেবে। মা কথা রেখেছে। 

বাবানের আজ জন্মদিন। দু-তিনজন বন্ধু আসবে। খাওয়া দাওয়া হইহুল্লোড় হবে। বাবান কিন্তু এরোপ্লেনের প্যাকেটটা খুললো না। তারপর যারা যারা এলো সকলকে বার বার করে দেখাতে লাগলো, 'এটা বাবা আমাকে দিয়েছে, দেখো কি সুন্দর না? '

রাতে যথারীতি শশাঙ্কবাবুর আসতে দেরি হোলো। বাবানের মা জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো, "আজ একটু আগে আসতে পারতে। সবাই তোমায় ভীষণ এক্সপেক্ট করছিলো। বাবান তো..." তাকে থামিয়ে দিয়ে শশাঙ্কবাবু করুণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলেন, "কি করবো বলো, ওভারটাইম করছি জানোই তো"

-- আচ্ছা বসো খাবার গরম করা আছে, ফ্রেশ হয়ে নাও। 

শশাঙ্কবাবু হাত মুখ ধুয়ে গামছায় গা মুছতে মুছতে স্ত্রীর পাশে এসে বসেন। "আচ্ছা ঐ পাগলটা... " স্ত্রী খাবার বাড়তে বাড়তে বলেন, "ঐ বাড়ির সামনে যে লোকটা বসে আছে... "

-- হ্যাঁ আগে কখনো দেখেছো? 

-- না। বোধহয় ঝড়ের জন্য এখানে চলে এসেছে। 

-- তা হতে পারে। 

-- জানো আজ খাবার দিতে গিয়েছিলাম। ও বললো, 'তোমার ছেলের জন্মদিন মা?'

-- ও জানলো কি করে? 

-- আমিও তাই জিজ্ঞাসা করলাম। বললো সবাই 'হ্যাপি বার্থডে' গাইছিলো শুনলাম। 

-- তার মানে পাগল নয় বলো? 

-- কথা শুনে তো মনে হোলো না। তবে সুস্থও নয়। সারাদিন বসে থাকে, গায়ে মাটি মাখে আর একটা ভাঙা আয়না আছে ওটায় মুখ দেখে বসে বসে। 

-- বেশ তো কাল আমার একটা জামা প্যান্ট দিয়ে এসো না। 

শশাঙ্কবাবু আর গত রাতের কথাটা বললেন না। রাতে শোওয়ার সময় স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন,  "আচ্ছা এই পাগলটাকে কোথাও দেখেছ মনে হচ্ছে? " ক্লান্ত গলায় স্ত্রী বললেন, "না আমি তো আগে দেখিনি। আজকে অনেক কাছ থেকে দেখলাম। আগে দেখলে ঠিক মনে পড়তো। কেন বলোতো?"

--  ওকে যেন আগেও কোথাও দেখেছি

-- সব পাগলদের দেখতে একই রকম লাগে। এখন ঘুমাতে দাও তো। বিরক্ত কোরোনা

-- না আসলে ঐ ঐ চোখ দুটো!

শশাঙ্কবাবু একটু ভেবে দেখলেন সত্যি তো রাস্তা ঘাটে কতো পাগল রোজ দেখেন, তেমন পার্থক্যতো চোখে পড়েনা। তাছাড়া ওর দাড়িভরা মুখে শুধু চোখগুলোই ঠিক করে দেখেছেন শশাঙ্কবাবু,  নয়তো স্ত্রীর কথা মতো পুরো মুখটাই চেনা চেনা লাগতো। আদৌ অসহায়তার কি কোন রকমফের হয়! ভাবতে ভাবতে ঘুমে শশাঙ্কবাবুর চোখ বুজে আসে। 


ঝড়বৃষ্টিতে খেলার মাঠে কাদা হয়ে আছে, তাছাড়া জলও জমেছে বেশ। তাই পাড়ার ভালো ছেলেরা কেউই খেলতে বেরোচ্ছে না। অবশ্য রতন, কালু, ভুনুয়ারা নিশ্চয়ই এখনো ফুটবল খেলছে, কিন্তু মা ওদের সাথে বেশী খেলতে দেয় না বাবানকে, মা বলে যারা স্কুলে যায় না তারা নাকি দুষ্টু ছেলে। অগত্যা বাবানকে ঘরেতেই এরোপ্লেন নিয়ে খেলতে হচ্ছে। এখন ঘরের ভিতর তো আর সমস্ত ফিচার দেখা যাবে না তাই বাবানের মনটা কেমন আনচান করছে। জানলার কাছে এসে বসল বাবান। বাইরে তখনো ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরে দেখে ওদের দরজার সামনে একটা বুড়ো মতো লোক ঐ বৃষ্টির মধ্যেই বসে আছে।

 বাবান নীচে গিয়ে মাকে ডেকে দেখায়, "ঐ দেখো মা, দাদুটা কি দুষ্টু। বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি না গিয়ে রাস্তায় বসে খেলছে। ঐ দেখো কাদা মাখছে। " ছেলের কথায় হাসিই পেল মণিকা দেবীর। " হ্যাঁ সত্যিতো খুব দুষ্টু। দাড়া তো আমি বকে দিয়ে আসছি। " মণিকাদেবী স্বামীর দুটো পুরনো শার্ট-প্যান্ট নিয়ে ঐ পাগল বৃদ্ধের কাছে গেলেন। ঐ পাগলটা তখনো কাদা নিয়ে খেলছে। কিছু একটা মূর্তি বানাচ্ছে আর বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে। তবুও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই আর জল থেকে আড়াল করারও কোনো চেষ্টা নেই। "এই জামা প্যান্ট টা পরে নিন আপনার পোশাকটা তো ছিঁড়ে গেছে আর ভিজেও.... এই বৃষ্টিতে না বসে ছায়ায় এসে বসুন না" লোকটা হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে বিকট শব্দ করে হেসে উঠল। "পোশাক তো বদলাতেই হবে অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। দে দে " শার্ট আর প্যান্টটা নিয়ে দুহাত দিয়ে তাতে কাদা লেপতে থাকে পাগলটা। মণিকাদি তাকে আটকাতে গেলে সে মণিকাদেবীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আবার ওর মুখের দিকে তাকায়, " যাবি আমার সাথে যাবি? " মণিকাদেবী ভয় পেয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক টানাটানির পর পাগলটা নিজেই তাকে দূরে ঠেলে দেয় তারপর আবার আপনমনে নিজের কাজ করতে থাকে। মণিকা আর একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে ছুটে ঘরে চলে আসে। পাগলটার গায়ে অসুরের শক্তি, হাতে এখনো আঙুলের দাগ স্পষ্ট। একটু ব্যথাও হচ্ছে। মণিকা দেবী মনে মনে স্থির করলেন জীবনে আর কোনো পাগলকে দয়া দেখাতে যাবেন না। "মা ঐ দেখো এখনো ওখানেই বসে আছে। " বাবান মাকে জানলার দিকে দেখিয়ে বলে। " ওও বাজে লোক ওর সাথে একদম মিশবে না.... এটা কী? " বাবানের হাতের আংটিটায় চোখ পড়ে গেলে ভালো করে দেখতে থাকেন। এ তো হুবহু সেই আংটিটা যেটা ঐ পাগলটার আঙুলে আছে। হ্যাঁ হাতে কাদা মাখা থাকলেও এই আংটিটা বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। একটা বড় নীলচে বেগুনী পাথর, তার চারপাশে রূপো দিয়ে সাপের নকশা কাটা। "এ আংটি তুমি কোথায় পেলে বাবান? " বাবানের মা আংটিটা খুলে নেয়। 

" আমার ঘরে জানলার কাছেই পড়েছিল, বোধহয় কালকে কেউ "

- আচ্ছা এটা এখন আমার কাছেই থাক। তুমি ঘরে গিয়ে হোমওয়ার্ক শেষ করে নাও আমি খাওয়ার করছি

বাবান উপরে চলে গেলে মণিকা দেবী আংটিটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকেন। জানলার বাইরে পাগলটা এখন একদৃষ্টে তাদের বাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে। মণিকাদেবীর খুব অস্বস্তি হয়। সে পর্দাটা টেনে রান্নাঘরে চলে যায়। 


পরিচয়হীন, সমাজ-সম্বলহীন হয়ে মানুষের বিদ্রুপ আর উপেক্ষা নিয়ে কত পাগল এই শহরের বুকে স্রেফ জ্যান্ত লাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ সারাদিন ধরে শশাঙ্কবাবু শুধু এটাই ভেবে চলেছেন, এত মেন্টাল হসপিটাল এন জি ও তৈরী হচ্ছে এদের জন্য- আদৌ কি কিছু হচ্ছে। তাছাড়া রোজ পৃথিবীতে কত পাগল মারা যাচ্ছে তবু পাগলের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। এইতো দুদিন আগে শশাঙ্কবাবুদের অফিসের গাড়ির সামনে হুট করে একটা পাগল এসে পড়ে। হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতেই মারা যায়। তারপর মিউনিসিপ্যালিটি থেকে গাড়ি এসে নিয়ে যায় সৎকারের জন্য। এই ঘটনায় শশাঙ্কবাবু ভিতরে ভিতরে খুব ভেঙে পড়েন কারণ যখন অ্যাক্সিডেন্টটা হয় তখন তিনিই ড্রাইভারের সাথে কথা বলছিলেন। যদিও আদতে এক্ষেত্রে তার কোনো দোষই ছিল না। তাঁর স্ত্রীও তাকে সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তার মধ্যে একটা অপরাধবোধ চলতেই থাকে, হয়তো আরেকটু সচেতন হলে এই মৃত্যুটা আটকানো যেত। অদ্ভুতভাবে এই ঘটনার দুদিন পর থেকে ঐ এলাকায় আরেকটা পাগল দেখা যেতে লাগলো। শশাঙ্কবাবুর পাপবোধটাও আস্তে আস্তে লাগব হতে থাকলো।


শশাঙ্কবাবু বাড়িতে এলে তার স্ত্রী তাকে সবটা জানায়। শশাঙ্কবাবু একটু হেসে স্ত্রীকে বেশি দুশ্চিন্তা করতে বারণ করে বটে তবে তারও মনে যে একটা চাপা দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারে। জানলার পর্দা সরিয়ে একবার পাগলটাকে দেখে নেয়।  পাগলটা এখনো এদিকেই তাকিয়ে। 


আজ একটু রোদ দিচ্ছে। তেমন হলে কাল রোববার, সামনের রাস্তাটায় প্লেন ওড়াবে বাবান। "পড়তে যেতে হবে, চারটে বাজে", মায়ের ডাকে বাবান রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে নীচে নামে। বাবান বেরিয়ে গেলে মণিকাদেবী তার পছন্দের সিরিয়াল চালিয়ে বসেন। 

দেখতে দেখতে কখন ৭.৩০ বেজে গেছে খেয়ালই হয় নি, এখনো বাবান বাড়ি ফেরেনি। স্যারকে ফোন করলে স্যার জানান যে অনেকক্ষণই সবার ছুটি হয়ে গেছে। শশাঙ্কবাবুকে ফোন করতে গিয়েও করলেন না। নিজে এগিয়ে গিয়ে দেখতে যাবেন, এমন সময়ে কলিংবেল বাজলো। দরজা খুলে বাবানকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মণিকাদেবী। 

-- কিরে এতোক্ষণ কোথায় ছিলি?

-- এইতো ঐ দাদুটা একটা গল্প শোনাচ্ছিল। শুনতে শুনতে দেরি হয়ে গেছে। 

মণিকা দরজার বাইরে দেখে পাগলটা একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গাটা কেমন যেন শিউরে উঠল। ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল। বাবান ব্যাগ রেখেই সোফায় বসে টিভিটা চালিয়ে দিল। 

-- তা এখানে এসে গেছিস একবার চেঁচিয়ে বলে তো দিতে পারতিস। আমি টেনশান করে যাচ্ছি। 

-- এতো ভয় পাও কেন মা? আমি তো বড়ো হয়ে গেছি, তুমি জানো এই দাদুটা আমার মতো বয়সে মংপুর জঙ্গলে.. 

-- হাত মুখ ধুয়ে নে, খেতে দিচ্ছি

"ও মা, এই লজেন্সটা দিয়েছে আমায়। বললো তোমাকে দেখিয়ে খেতে"। বাবান পকেট থেকে একটা রঙীন রাংতায় মোড়া লজেন্স দেয় মায়ের হাতে। 

" আচ্ছা পরে খাবে। কে দিয়েছে? "

-- কেন ঐ দাদুটা। 

মণিকাদেবী বিস্মিত চোখে লজেন্সটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। 

রাতে শশাঙ্কবাবু ফিরলে মণিকাদেবী লজেন্সটা দেখান। 

-- এটা কি? মনে হচ্ছে বিদেশী কোম্পানির। কোথায় পেলে? 

-- ঐ পাগলটা বাবানকে দিয়েছে। 

শশাঙ্কবাবু লজেন্সের প্যাকেটটা দেখতে থাকেন। 

শশাঙ্কবাবু নিরুত্তর থাকলে মণিকাদেবী তার হাত ধরে জানলার কাছে নিয়ে যায়। 

-- এই দেখো সারাদিন বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। কি বিশ্রী চাহনি। আমার একদম ভালো লাগছে না। 

-- আমি কি করবো? 

-- তা আমি জানিনা। কিছু একটা করো। বাবানের সাথেও কথা বলছে। ছেলেধরা নয়তো? 

-- ধুস তুমিও না.. আচ্ছা আমি দেখছি কি করা যায়! 


রবিবারের সকাল দেরি করেই শুরু হয়। বাবান জলখাবার শেষ করে এরোপ্লেন নিয়ে বেরিয়ে গেল। রাস্তাঘাট বেশ শুকিয়ে এসেছে। তবে মাঠে বোধহয় এখনো জল জমে আছে। বাবান রিমোট কন্ট্রোলটা অন করে প্লেনটা উড়িয়ে দিল। এতো মন দিয়ে প্লেন চালাচ্ছে যেন খেলনা নয়, সত্যি কোনো এয়ারলাইন্সের পাইলট। 

"কি গো খোকাবাবু প্লেন ওড়াচ্ছো?", ফোকলা দাঁতের ফাঁক থেকে কথাগুলো বেরিয়ে এল। বাবান রিমোটের দিকে আবার চোখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো," তোমার দাঁতগুলো কোথায়? "

-- তা খোকাবাবু ওগুলো তো এমনি দাঁত ছিল না, সোনার দাঁত ছিল। ঝড়ে উড়ে যাবে বলে লুকিয়ে রেখেছি। 

-- ধুস্ তুমি মিথ্যা কথা বলছো

বাবান পাগলটার দিকে তাকায় আর তখনই একটা শব্দ করে প্লেনটা গাছে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। 

বাবান ঊর্ধ্বশ্বাসে ওদিকে ছুটে যায়। ওর খুব কান্না পাচ্ছিল। পাগলটা ওর কাঁধে হাত রাখে, "'কেঁদো না খোকাবাবু। আমার কাছে একটা মন্ত্র আছে, সব ভাঙা জিনিস জোড়া লেগে যায়। পুরানো জিনিস নতুন হয়ে যায়। " বাবান কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা প্লেনটা নিয়ে ওর দিকে তাকায়, "সত্যি বলছো তুমি? "

পাগলটা উঠে দাঁড়ায়, "তুমি বিশ্বাস করছো না? তবে এসো আমার সাথে।" মা তাকে যার তার সাথে যেখানে সেখানে যেতে ভীষণভাবে বারণ করে দিয়েছে। এমনিতে মায়ের কথার অবাধ্য হয় না বাবান, কিন্তু বাবার দেওয়া এত সুন্দর প্লেনটার এমন পরিণতি  সে কিছুতেই মানতে পারে না। পাগলটা হাঁটা শুরু করে। বাবানও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার পিছন পিছন যেতে থাকে। 

পথে যেতে যেতে বাবান কত রকম গল্প শুনলো- আফ্রিকার বাজারে ক্রীতদাস বিক্রী, মিশরের ফ্যারাওয়ের শবযাত্রা, নেপালের অদ্ভুত সব বাক্স তৈরীর পদ্ধতি, পানিপথের যুদ্ধ, আরো কত কী! এসবই নাকি ঐ পাগল নিজের চোখে দেখেছে ওর নিজের অভিজ্ঞতা। 

-- তা কী করে হয়? তোমার কত বয়স? 

-- কেন? ৬০ বছর

-- তাহলে? আমাকে বোকা পেয়েছো? আমি জানি তুমি মিথ্যে বলছো। 

পাগলটা কোন উত্তর দেয়না শুধু হেঁটে চলে। হাঁটতে হাঁটতে কত দুর এসে গেছে বাবান! এদিকে সন্ধে হয়ে আসছে, বাবান এতক্ষণ ধরে হাটছে? কই তেমন ক্লান্তি তো লাগছে না। "আর এতক্ষণ হলই বা কি করে এইতো সকালবেলাই.."

-- কি ভাবছো বাবুসোনা? 

-- কই গো কতদূর? 

"এই তো", বলে পাগলটা একটা মাঠের সামনে নিয়ে আসে। বিশাল বড়ো মাঠ, বাবানদের পাড়ার মাঠের মতো দুতিনটে বসে যাবে এখানে। এত বড় মাঠ কিন্তু তেমন ঘাস নেই, বালি বালি।

-- কই গো প্লেনটা সারিয়ে দাও এবার এখানেই ওড়ানো যাবে। তুমি জান ওটা কত উঁচুতে উড়তে পারে? ঐ অতটা , তার চেয়েও উপরে - ঐ গাছটারও উপরে

-- তার জন্য যে আমার যন্ত্রপাতি লাগবে, চল ওটা আগে নিয়ে আসি? 

বৃদ্ধ আবার চলতে থাকে। সারা আকাশটা তখন লাল হয়ে আসছে। 

-- এত দেরি হয়ে গেল যে মা তো বকবে

-- না আমি বলে দেব তাহলেই আর বকবে না

-- মা তোমার ওপরও খুব রেগে আছে, তুমি সেদিন মায়ের কথা না শুনে বৃষ্টিতে ভিজছিলে… 

একি! এতো বড়ো মন্দির আছে এখানে! বাবান তো কোনদিন এতো বড় মন্দির দেখে নি। মাঠের ওপার থেকেও তো দেখতে পায় নি। কী বিশাল থামগুলো আর চুড়াটাও কী সুন্দর। ডুবন্ত সূর্যের লাল রঙটা যেন চুড়ার গায়ে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে। 

--এইতো এসে গেছি। 

বৃদ্ধ সেই আংটিটা কোচর থেকে বার করে বাবানের হাতে দেয়, "এই নাও খোকাবাবু এটা পরে নাও, তোমার মা বোধহয় ভুল করে ফেলে দিয়েছিলেন।"

বাবানকে আর কিছু ভাবতে না দিয়ে পাগলটা মন্দিরে ঢুকে যায়। বাবানও আংটিটা আঙুলে গলিয়ে পিছন পিছন ছুটে যায়। 

বড়ো বড়ো থামের চারপাশে নক্সা কাটা। ভিতরটা অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। 

-- তুমি মিথ্যে কথা বললে কেন? 

-- না খোকাবাবু আমি মিথ্যে বলছি না। 

-- বলছো তো। একজন মানুষ এতদিন বাঁচে নাকি? 

-- আমার তো মাত্র ষাট বছর 

-- কিন্তু পানিপথের যুদ্ধ, ফ্যারাও এগুলো আমি স্কুলে পড়েছি। এগুলো অনেক বছর আগের। তুমি যে বললে চোখের সামনে

-- মানুষের শরীরটা পোশাকের মতো খোকাবাবু। বুঝলে? 

পাগলটা বাবানের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে তারপর আবার পাথর ঘষে আগুন জ্বালাতে মন দেয়। 

-- তুমি যেমন জামাকাপড় ছাড়ো ঠিক তেমনই। 

বাবান অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। 

"এই যেমন ধরো, তুমি যদি তোমার পোশাক পরে থাকো তবে তুমি খোকাবাবু, আবার তেমনই যদি তুমি রাজার পোশাক পরো তবে তুমি রাজাবাবু।"

মশালটা ধরিয়ে পাগলটা হাসতে হাসতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মশালের আলোয় বাবান দেখতে পায় সামনে বেদীর উপর অদ্ভুত একটা মূর্তি। এমন বিভৎস ঠাকুরের মূর্তি আগে সে কখনো দেখেনি। 

-- এই যে তোমার শরীরটা যদি আমি পরে নিই, তাহলে আমার বয়স কত হবে? দশ

দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আওয়াজটা যেন ঘুরতে থাকে। পাগলটা মশালটা একটা হাতলে রেখে একটা থালা তুলে নেয় বেদীর উপর থেকে। বাবানের এবার একটু ভয় লাগছে। পাগলটা লাল রং তুলে নিজের কপালে দিয়ে বাবানের মাথায়ও আবিরের মতো কিছু মাখিয়ে অট্টহাসি হেসে উঠল। ' তাহলে খোকাবাবু? রাস্তায় দেখেছ আমার মতো কত পাগল ঘুরে বেড়ায়, কত পাগল- সবাই একই রকম। রোজ কত পাগল জন্মাচ্ছে কত পাগল মরছে- কিছু পড়ায় তোমাদের ইস্কুলে?' বাবান মাথা নাড়ে। ওর ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। পাগলটা ঐ মূর্তির পা থেকে চকচকে একটা ছুরির মতো জিনিস তুলে নেয়, "আমাকে যে আরো অনেক কিছু দেখতে হবে। তোমার মত বাবুসোনাদের গল্প বলতে হবে, আমার কি মরলে চলবে? তাইতো একটু বুড়ো হলেই আমি বয়স কমিয়ে নিই" ধরা গলায় কোনক্রমে বাবান প্রশ্ন করল "কি ভাবে?" পাগলটা বাবানের দিকে এগিয়ে আসছে। আরো জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলে "আমি যে মন্ত্র জানি, বাবান"। 


চায়ের টেবিলে বসে কাগজ পড়ছিলেন শশাঙ্কবাবু, স্ত্রী এসে পাশে বসলেন। ময়দা মাখছে লুচি হবে জলখাবারে। রোববারের সকাল। জলখাবারটা বেশ জমিয়ে হয় আজ। শশাঙ্কবাবুও সপ্তাহে এই একটা দিনই একটু সুযোগ পান পরিবারের সাথে সময় কাটানোর। 

-- বাবান উঠেছে? 

-- তোমার প্লেনটা ওর এত পছন্দ হয়েছে ওটা মাথার কাছে নিয়েই ঘুমাচ্ছে। নামার আগে দেখে এলাম। 

-- ও খুশি থাকলেই... 

-- কিছু ভাবলে কি করবে? 

-- কী ব্যাপারে? 

-- আরে ঐ পাগলটার

শশাঙ্কবাবু জানলার দিকে তাকান। 

-- কই নেই তো? 

মণিকাদেবী উঠে গিয়ে পাগল লোকটাকে খোঁজার চেষ্টা করেন, তারপর দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখেন ওর আয়না,পুটলি কিচ্ছু নেই ওখানে, শুধু কাল যে জামা প্যান্টটা দিয়েছিলেন সেটাই পড়ে আছে। তাতে কাদার দাগ। 

-- কই গো নেই তো কোথাও? 

-- ও চলে গেছে তার মানে। এবার শান্তি তো? 

-- চলে গেছে একেবারে? 

-- আমি না কিছুতেই মনে করতে পারছি না ওনাকে কোথায় যেন দেখেছি। চোখ দুটো এতো চেনা চেনা লাগছে

-- মংপুর জঙ্গলে দেখে থাকবে

শশাঙ্কবাবু তড়িৎ গতিতে কাগজ নামিয়ে বলেন, "হ্যাঁ, একজাক্টলি। কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে? '

-- তোমার ছেলেকে গল্প করছিল। 

-- বাবানকে 

মণিকাদেবী দরজা লাগিয়ে চেয়ারে এসে বসেন 

শশাঙ্কবাবু বলে চলেন, "আরে হ্যাঁ কিছুতেই মনে পড়ছিল না। রোহিতকে মনে আছে? আমার ছোটবেলার বন্ধু। সেবার মংপুর জঙ্গলে আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম। ওখানে একটা বুড়ো মতো লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। ওই লোকটা নাকি বিক্রমাদিত্যের সময়ে ছিল, তানসেনের গান শুনেছে, বোঝো কান্ড! আমরা তখন বাচ্চাকাচ্চা আমরা তো রীতিমতো ফ্যান হয়ে গেছিলাম। তারপর", শশাঙ্কবাবু কী যেন একটা মনে করলেন, "তারপর একদিন ঐ লোকটা আমাদের বলল ম্যাজিক দেখাতে নিয়ে যাবে। লজের ম্যানেজার তো শুনে খুব রাগ করল, বলল ও একটা পাগল ঐ লজের বাইরে বেশকিছু মাস ধরে... আমি আর গেলাম না কিন্তু রোহিত যে যাবেই সে আমি জানতাম। কথা শোনা ওর স্বভাবে ছিল না আর বারণ করলে তো..." শশাঙ্কবাবু একটু চুপ করে যান, তার চোখেমুখে একটা আতঙ্ক ফুটে উঠছে, "ও আমায় বলেছিল পরদিন যাবেই। পরদিন যখন অনেকবেলা অব্দিও ও উঠল না আমরা গিয়ে দেখি ওর ঘরে.... "

শশাঙ্কবাবু বিহ্বল হয়ে উঠে পড়েন, " বাবান কই বাবানকে ডাকো। বাবান বাবান"

শশাঙ্কবাবু বাবানের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ওর ঘরের দিকে ছুটে যায়। মণিকাদেবী কিছু বুঝতে না পেরে স্বামীর পিছনে ছুটে যায়  "কী হয়েছে? এরকম করছ কেন? কী হল? "। 

অদ্ভুত ব্যাপার বাবানের ঘর ভিতর থেকে লক করা। 


=================


 

শুভদীপ রায়

চারুকুঠি, জি বসু স্মরণীয়

বারুইপুর, কোলকাতা -৭০০১৪৪

৭০৪৪৫৪৮২৫০

Suvadeep Roy

Charukuti, G. Bose Sarani

Baruipur, Kol 700144

7044548250






Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.