Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। সুব্রত সুন্দর জানা


অচেনা ভালোবাসা


 

'চারটে বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, কারশেড থেকে সোনারপুর লোকালের মাথা দেখা দিয়েছে‌। কিন্তু ও তো এলো না। ও-তো প্রতি দিন আমার আগেই এসে পৌঁছায়।' রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভাবতে থাকে সঞ্জয়।

     আজ আট মাস হলো সঞ্জয় সোনারপুরে এসেছে‌। পড়ে বিদ‌্যাসাগর কলেজের সান্ধ‌্য বিভাগে‌। তাই তাকে প্রতিদিন চারটে পাঁচের সোনারপুর আপ লোকাল ধরতে হয়। এ সব নিত‌্য দিনের ব‌্যাপার। কিন্তু ওকে দেখতে না পেয়ে প্রথম পরিচয়ের সেই দিনটার কথাই বার বার মনে পড়ছে সঞ্জয়ের। সেটা ভাদ্র মাস। কলেজের প্রথম দিন‌ে ক্লাসে পৌঁছতে দেরী হওয়ার ভয়ে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছিল সঞ্জয়। ফাঁকা প্লাটফর্মে ঝাঁ ঝাঁ করছে ভাদ্রের রোদ। সঞ্জয় তিন নম্বর প্লাটফর্মের সামনের দিকে এগিয়ে সান বাঁধানো বটগাছটার নীচে বসে পড়ল। পাশেই বসেছিল একটি মেয়ে, পরনে লাল পাড় শাড়ি, বুকে স্কুলব‌্যাচ, নিশ্চয় কোন স্কুলের ছাত্রী। অবশেষে ট্রেন এলো। দৌড়ে গেটের রডটা ধরতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সঞ্জয়। অসাবধান বশতঃ রডের সঙ্গে সে মেয়েটির হাতটিকেও চেপে ধরেছে‌। মেয়েটি লজ্জায় মুখ নীচু করল। প্রথম দিনের এই ঘটনাটি আজও ভুলতে পারেনি সঞ্জয়। সেদিন ট্রেনে উঠে দুজনে বসেছিল মুখোমুখি হয়ে, জানালার ধারে‌। কিন্তু কেউ সেদিন কারোর মুখের দিকে তাকাতে পারেনি‌। দেখতে দেখতে ট্রেন এসে দাঁড়ালো ঢাকুরিয়া স্টেশনে‌। মেয়েটি নেমে গেল। আজ সঞ্জয় তার জন‌্যই অপে‌ক্ষা করছে‌। চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল ক‌্যানিং লোকাল। প্লাটফর্মে এদিক ওদিক চোখ চালিয়েও মেয়েটিকে দেখতে পেলো না সঞ্জয়। আবার অতীতের মধ্যে হারিয়ে গেল সে‌। মনে পড়ল আর এক দিনের ঘটনা। সেদিনও সঞ্জয়ের সহযাত্রী ছিল মেয়েটি‌। ট্রেন চলতে চলতে বাঘাযতীনের পরে হঠাৎ থেমে গেল, লোডশেডিং। টানা আধঘন্টা ট্রেনটা দাঁড়িয়ে‌। সকলের সঙ্গে প্রচন্ড ঘামে ভিজছে মেয়েটিও। ওর নাকের ডোগাটাই যেন বেশী ঘামছিল। চঞ্চলা হরিনীর মত মুখটা মুছে নিয়ে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,- 'কটা বাজে দাদা?' মেয়েটির মুখ থেকে এই প্রথম 'দাদা' সম্ভাষণ শুনে চমকে উঠেছিল সে‌। তাড়াতাড়ি ঘড়ি‌ দেখে বলল,- 'পাঁচটা পঞ্চান্ন।' মেয়েটি একটি দীর্ঘশ্বাস টেনে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকালো সঞ্জয়ের দিকে‌। তারপর মুখ নীচু করে মুচকি হাসলো সে‌। সঞ্জয় প্রথমটা কিছু বুঝতে পারেনি, তারপর ঘড়িটা ভালোকরে দেখেই সে লজ্জায় কুকড়ে গেল। তখন চারটে পঞ্চান্ন বাজে‌।

     তারপর কতদিন না কেটে গেছে‌। একসঙ্গে বটের তলায় বসা, একসঙ্গে ট্রেনে যাওয়া, তারপর ঢাকুরিয়াতে মেয়েটির নেমে যাওয়া এবং কল্পনার ছবি আঁকতে আঁকতে সঞ্জয়ের কলেজে পৌঁছানো- এই ছিল তাদের প্রাত‌্যহিক রুটিন। কিন্তু অজকাল সঞ্জয় মাঝে মধ্যে কেমন অন‌্যমনস্ক হয়ে পড়ে, ক্লাসের লেক্চার তার কানে ঢোকে না। কখন চারটে পাঁচের ট্রেন আসবে সেই চিন্তায় সারা দিনটা কেটে যায়। অথচ যার চিন্তা সঞ্জয়কে পাগল করে, সঞ্জয় তার নাম পর্যন্ত জানে না। জানে না মেয়েটি তাকে কেমন চোখে দেখে‌। কিন্তু জানতে তাকে হবেই। কারণ এভাবে চললে পরীক্ষাতে সে নিশ্চয় ফেল করবে‌। গ্রামে ফিরে মুখ দেখাত পারবে না। তাই সময় থাকতেই একটা ফয়সালা করে নিতে চায় সঞ্জয়।

     রাতে ঘুম হল না তার। সারা রাত ধরে মেয়েটিকে কি বলবে আর কি না বলবে তাই নিয়ে ভেবে কাটাল। পরের দিন মনে মনে প্রস্তুত হয়ে সে একটু তাড়াতাড়ি প্লাটফর্মে এসে মেয়েটির অপে‌ক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু সে এত দেরী করছে কেন? সে যদি আজ না আসে? যদি আর কোনদিন না আসে? এসব ভাবতে পারছে না সঞ্জয়। অজানা উৎকণ্ঠায় তার বুক কেঁপে ওঠে‌। ক‌্যানিং লোকালের পর আরও একটা ট্রেন বেরিয়ে গেল। হঠাৎ একনম্বর প্লাটফর্মের শেষ প্রান্ত থেকে একটা হৈ‌-চৈ এর শব্দ ভেসে এল। হয়ত কোন দুর্ঘটনা। কিন্তু ওদিকে কোন নজর নেই সঞ্জয়ের। সে মনে মনে ভাবছে কি‌ বলে‌ মেয়েটির সঙ্গে কথা আরম্ভ করবে? তার কুশল জিজ্ঞাসা করবে, না কি সরাসরি বলবে‌- 'দেখ তোমার জন‌্যই আমি অপে‌ক্ষা করে আছি‌।' হঠাৎ একজনের ধাক্কায় সঞ্জয়ের চিন্তায় ছেদ পড়ল। লোকটার কাছেই সঞ্জয় জানতে পারল ওখানে একটা স্কুল ছাত্রী চাপা পড়েছে‌।

     সহসা শিউরে উঠল সঞ্জয়। অজানা আশঙ্কায় দৌড়ে গেল সেখানে‌। দেখল,- তারই কল্পলোকের রাজকন‌্যা সবুজ দূর্বার শ্বেতশুভ্র ফুলসজ্জায় নীরব হয়ে শুয়ে আছে‌। সারা শরীরে বিশেষ কোন আঘাত লাগেনি‌। লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালের প্রচণ্ড ধাক্কায় তার কপালটাই কেবল রক্তে রঙিন হয়ে গেছে, যেন নবপরিনিতার অসাবধানতায় ঘেঁটে যাওয়া সিন্দুরের টিপ।

     ছড়িয়ে থাকা বই-পত্রগুলি হাওয়ায় উড়ছে‌। সে দিকে চোখ যেতেই একটা ডায়েরীর পাতায় সঞ্জয়ের চোখ আটকে গেল। পাশাপাশি দু'টি‌ ছবি আটকানো- একটি তার, অন‌্যটি সেই মেয়েটির। সঞ্জয়ের ছবির উপরে কলেজের আংশিক স্ট‌্যাম্প লাগানো। এটা যে ট্রেনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আইডেন্টিটি কার্ডেরই ছবি, তা বুঝতে অসুবিধা হল না সঞ্জয়ের। সঞ্জয়ের ছবির নীচে তার নামটিও যত্ন করে লেখা, যেমন যত্ন করে পাশের ছবিটির নীচে লেখা রয়েছে 'শর্মিলা'।

     সঞ্জয়ের ইচ্ছা হল সে শর্মিলার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে‌- 'শর্মিলা আমি তোমাকে ভালোবাসি‌।' কিন্তু হৃদয় ভাঙা জলোচ্ছাসে তার চোখ মুখ বন্ধ হয়ে গেল। পড়ন্ত সূর্যের শেষ রশ্মি চ্ছ্বটায় উজ্জ্বল নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল সঞ্জয়।

     সোনারপুর লোকাল প্লাটফর্মে ঢুকল, আবার বেরিয়ে গেল।


---------------



 


সুব্রত সুন্দর জানা

গ্রাম ও পোঃ- গণেশনগর

থানা – কাকদ্বীপ

জেলা – দঃ ২৪পরগনা

পিন নং- ৭৪৩ ৩৫৭

ফোন নং- ৯১৪৩১৫৭৩৩৮





Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.