Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক উপন্যাস।। পর্ব ৪ ।।সোনালী দিনের উপাখ্যান ।। দেবব্রত ঘোষ মলয়


পূর্বকথন:-


কলকাতার বাড়িতে হঠাৎই হাজির হন মননের বাবা অখিলবাবুর গ্রামের মেয়ে বিন্দুবাসিনী। তিনি অনুরোধ জানান তাঁর প্রয়াত বাবার শেষ উইল অনুযায়ী তাঁদের সম্পত্তির অর্ধেক অখিলবাবুকে নেবার জন্য। মনের কোণে সন্দেহের কাঁটা বিঁধে যায় মানদার।
এরপর ... 

পর্ব - ৪


বিন্দুবাসিনী চলে যাবার পর এক সপ্তাহ কেটে যায়। মানদার মনে তোলপাড় চলতে থাকে। বিয়ের পঁচিশ বছর পর ভালবাসা কিছটা অভ্যাস হয়ে যায়, অনেকটা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মত। তাছাড়া উকিলবাবুর ভালবাসায় এত বছরে যেমন প্রকাশের আতিশয্য দেখে নি মানদা, তেমনই বিন্দুমাত্রও অবহেলা দেখেনি কোনোদিনই। আজ সেই উকিলবাবুর কৈশোরের সহপাঠিনী বিন্দুবাসিনীর অকস্মাৎ আবির্ভাবে একবারও মনে প্রশ্ন জাগেনি, ওদের মধ্যে প্রেম ভালবাসার কতটা গভীরতা জন্মেছিল। শুধু যেটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না মানদা, এতগুলো বছরে উকিলবাবু একবারও বিন্দুবাসিনীর সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্যই করেনি - কেন? বিন্দুবাসিনীর বাবার উইলে অর্ধেক সম্পত্তি উকিলবাবুকে কেন দেওয়া হয়েছে? 
এর মধ্যেই একদিন দুপুরে বাড়িতে হাজির হন এক মধ্যবয়সী মানুষ। রোগা কিন্তু ঋজু গড়ন, একমুখ না কাটা দাড়ি, পরনে ধুতি পাঞ্জাবি আর হাতে কাঠের বাঁটওয়ালা সেকেলে ছাতা।
 
 
 
 
 
পুঁটির মা তো ঢুকতেই দেবে না  ময়লা ধুতি আর ধুলোমাখা ছেঁড়া চপ্পল দেখে। সে সময়েই  অখিলবাবু সিঁড়ি দিয়ে নেমে কোথাও যাবার উদ্দেশ্যে সদর দরজায় উপস্থিত হন। তখনই মুখোমুখি হন আগন্তুকের। তাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ওঠে তাঁর। বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন - কি ব্যাপার চাটুজ্জে? আগন্তুক হাত জোড় করে নমস্কার করে বলেন - আজ্ঞে একটা কথা ছিল বড়বাবু। বিন্দুর বিষয়ে।
চকিতে সতর্ক হয়ে ওঠেন অখিলবাবু। বলেন - তা বাড়িতে কেন? তোমাকে না বাড়িতে আসতে বারণ করেছি। এসো অফিসঘরে, তাড়াতাড়ি বল যা বলার।
মানদা পুঁটির মার কাছে আগন্তুকের বিবরণ শুনেই সোজা নীচে নেমে অফিসঘরের দরজায় আড়ি পাতেন, যেটা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। আর দুজনের কথোপকথন শুনতে শুনতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাঁর। মনে হতে থাকে তাঁর এতদিনের সাজানো সংসার তাসের ঘরের মত ভেঙে যেতে বসেছে। কিন্তু বরাবরের স্থিতধী মানদা নিজেকে সামলে ধীর পায়ে উঠে যান দোতলার ঘরে।
বড়বউ?
উকিলবাবুর ডাকে সম্বিৎ ফেরে মানদার। 
তুমি কিভাবে হারাধন চাটুজ্জের নাম জানলে? তখন উত্তেজনায় খেয়াল করিনি। 
উকিলবাবুর চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে উত্তর দেন মানদা - তুমি কি ভাব তুমি লুকোলেও আমি কিছু জানতে পারব না?
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান অখিলবাবু। তাহলে কি তাঁর অনুপস্থিতিতে চাটুজ্জে মানদার কাছেও এসেছে। জানিয়ে দিয়েছে তাঁর জীবনের একমাত্র গোপন ঘটনা যা এত বছর সযত্নে লুকিয়ে রেখেছেন তিনি।
মানদা বলে ওঠেন - ছি ছি। ছেলের বিয়ের বয়স হয়ে গেল, আর এখন কি না আমাকে জানতে হল তোমার একজন রক্ষিতা আছে। এর চেয়ে আমার মৃত্যু হল না কেন?
ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দেন মানদা। আর পুঁটির মা বুঝতে পারে এই প্রথমবার এই বাড়িতে কিছু অশান্তি হতে চলেছে। বিমর্ষ হয়ে যায় সে।
***********
সেদিনের ঘটনার পর তিন দিন কেটে গেছে। ঝিন্টি আর আসেনি এ বাড়িতে। মনন অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। তাহলে কি ঝিন্টি সেদিনের হঠাৎ জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া পছন্দ করেনি। নাকি লজ্জা পেয়েছে। কিন্তু লজ্জায় কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারে না। আজ সে কলকাতা ফিরে যাবে। কলেজের ছুটি শেষ হয়েছে।
মন, মন বলে ডাকতে ডাকতে বড় মামী পৃথুলা শরীর নিয়ে হেলতে-দুলতে মননের ঘরে চলে আসেন। স্নেহের স্বরে বলেন - কিরে মন ট্রেনের তো দেরি হয়ে যাবে। আয় বাবা নিচে এসে খাওয়া-দাওয়াটা সেরে নে। কত করে বললাম আর দুটো দিন থেকে যা।
মনন হেসে বলে - আবার আসবো মামীমা। চল।
আজ মামীমা অনেকগুলো পদ রান্না করেছেন। মনন বলে ওঠে - কি করেছো মামীমা, এত খেতে পারি আমি। 
কপট ধমক দিয়ে মামীমা বলেন - কোন কথা নয়। চুপ করে সব খেয়ে নিবি। আবার কতদিন পরে মামার বাড়ি আসবে তার কোন ঠিক আছে। মানু তো কতদিন হয়ে গেল আসেই না। জামাইকেও দেখি নি কতদিন। এরপর কয়েকদিন সময় করে মা বাবাকে নিয়ে চলে আসবি কেমন।
অন্যমনস্ক ভাবে ঘাড় নেড়ে সায় দিতে দিতে মনন খাওয়া শেষ করে। ওদিকে রিক্সাওলা ভজা এসে গেছে সদর দরজার বাইরে। তার রিক্সার হর্নের প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। এখন বাড়িতে মামারা কেউ নেই। কাল রাতেই সব মামার সঙ্গে দেখা করে প্রণাম সেরেছে মনন। তিন মামীকে প্রণাম করে মনন এগিয়ে চলে সদর দরজার দিকে। মামিমারা সবাই সদর দরজার দিকে এগিয়ে দিতে আসে তাকে।জামা কাপড়ের বড় ব্যাগটা তার হাত থেকে নিয়ে রিক্সায় সিটের নিচে রাখে ভজা। ছোটবেলা থেকে মনন দেখেছে ভজা এই বাড়িতে কোন অতিথি এলেই রিক্সা করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। এই বাড়িতে ও খাওয়া-দাওয়া করে অনেক সময়। মননের হাতে একটা ব্যাগ অতিরিক্ত হয়েছে। মামার বাড়ি থেকে নানা জিনিসপত্র আর মিষ্টি দিয়ে ব্যাগটা ভরে দিয়েছে তার মামীরা। সবাইকে হাত নেড়ে টাটা করে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বাড়িটাকে দেখে মনন। ছোটরা সবাই এখন স্কুলে। রিক্সায় এগিয়ে চলে গ্রামের পথে। দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে মোরাম বিছানো মাটির রাস্তা। অনেকটা দূর স্টেশন এখান থেকে। ভজার সঙ্গে এটাসেটা গল্প করতে করতে এক সময় স্টেশনে পৌঁছে যায় সে।
এখানে স্টেশনটা খুবই ছোট কিন্তু খুব সুন্দর। চারপাশে গাছ গাছালিতে ঘেরা। সব সময় অসংখ্য পাখির ডাক শোনা যায়। লোকজন খুবই কম। প্লাটফর্মে দু-তিনজন চাষী মানুষ তাদের ফসলের বোঝা নিয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। ট্রেন আসতে এখনো প্রায় আধঘণ্টা দেরী। মনন চলে যায় প্লাটফর্মের শেষের দিকে। এদিকটা একদম নির্জন। ট্রেনের শেষ কামরা পড়ে বলে এখানে মানুষজন বিশেষ আসে না। এই শেষের দিকে আর প্ল্যাটফর্মের সিমেন্টের বানানো বেঞ্চি নেই। একটা বড় গাছের গোড়ায় সিমেন্ট দিয়ে গোল করে বাঁধানো একটা বেদী। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার জন্য ও বসে পড়ে ওই বেদীতে আর তখনই লক্ষ্য করে ওভারব্রিজের দিক থেকে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে আসছে ঝিন্টি। আজ একটা নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ পড়েছে। ফর্সা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মননের মনটা খুশিতে ভরে যায় ওকে দেখে। দৌড়ে এসে  পাশে বসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে - চলে যাচ্ছো মনদা। এই দেখো তোমার জন্য এই পেয়ারাগুলো নিয়ে এসেছি আর মা নারকেল নাড়ু বানিয়ে দিয়েছে। মননের হাতে একটা কাগজের ঠোঙায় আট-দশটা গাছের ডাঁসা পেয়ারা আর একটা টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি নারকেল নাড়ু তুলে দেয সে। মনন একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে তুই আসিস নি কেন তিন দিন? সেদিন তুই রাগ করেছিলি?
অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে ঝিন্টি বলে - রাগ করে কেন মনদা? মনন গলার স্বর নিচু করে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে - ওই যে সেদিন তোকে জড়িয়ে ধরলাম, একটা চুমু খেলাম তাই।
চোখ বন্ধ করে ঝিন্টি বলে - বিশ্বাস করো মনদা, সেদিন খুব ভাল লেগেছিল আর লজ্জাও লেগেছিল। সেদিন সারা রাত আমার খালি তোমার মুখটা ভেসে আসছিলো। তুমি চলে গেলে আমার খুব মন খারাপ হয় মনদা তুমি বোঝ না? তুমি আবার কবে আসবে? মনন ঝিনটির হাত ধরে বলে - দূর পাগলী মন খারাপ করার কি আছে? আমি সামনের ছুটিতে আবার মামার বাড়ি আসবো। শুধু ফাইনাল এক্সামটা হয়ে যেতে দে।
স্টেশনের মাইকে ঘোষনা হয় ডাউন প্লাটফর্মে হাওড়া যাবার গাড়ি আসছে। মনন উঠে পড়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে।  আর তখনই হঠাৎ মননের গালে একটা চুমু খেয়ে দৌড় দেয় ঝিনটি। আর দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করে বলে - তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু। তার মিলিয়ে যাওয়া ছুটন্ত শরীরটাকে দেখতে দেখতে এক অনির্বচনীয় ভালোলাগায় ভরে যায় মননের মন। নিজের গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে যেন ধরে রাখতে চায় আদরের মিষ্টি পরশটা। প্লাটফর্মে ঢুকে পড়ে ডাউন ট্রেন। কলকাতার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মনন।

ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.