ছোটগল্প ।। কুকুর ।। কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ।।
কুকুর
কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
অতুল আর গুঞ্জাকে আপনারা চেনেন না। আসুন পরিচয় করিয়ে দিই।
অতুল পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছরের ছাপোষা বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত । হাইট পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি , মাঝারি গায়ের রঙ, একটু ফরসার দিকে, মাধ্যামিক স্কুলের শিক্ষক। এটুকু বললে পাত্রপাত্রীর কলাম ভর্তি হয় , কিন্তু মানুষটাকে চেনা যায় না। মানুষ চেনা যায় তার চরিত্র বুঝে। চরিত্রের কথা বলতে গেলে অতুল শান্তশিষ্ট, নিরীহ, গোবেচরা ধরনের পুরুষ । স্কুলে ছাত্র সামলাতে তার খুব একটা সুখ্যাতি নেই , ঘরে বউ সামলাতেও যে সুখ্যাতি থাকবে না তা বলাই বাহুল্য । অতুলের ঘরে বেশীরভাগ সময়টাই কাটে বই পড়ে আর খুকিকে সামলাতে। খুকি মানে তার পাঁচ বছরের কন্যাসন্তান।
এবার গুঞ্জার কথায় আসি। গুঞ্জা অতুলের আট বছরের বিবাহিত জীবনের স্ত্রী। তাদের নামে যেমন পুরোনো আর নতুনের মেলবন্ধন ঘঠেছে, তাদের স্বভাবেও বিস্তর ফারাক। গুঞ্জা ছটফটে , আধুনিক ও ডাকাবুকো টাইপের মেয়ে। ঘর গোছানোর কাজে অতুল যতটা পটু, ঘরের বাইরেটা সামলাতে গুঞ্জা ততটাই পটু। ফলে স্বভাবতই এ বাড়িতে কর্তা নয় , কত্রীর ইচ্ছাতেই কর্ম।
সেদিন রবিবার, সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। হালকা বৃষ্টি পড়ে চলেছে ।
অতুল সকাল থেকে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে। এমনিতে ওদের রবিবার উঠতে আটটা বেজে যায়। সেদিন বৃষ্টির জন্য সাড়ে আটটা বেজে গেছে। সকালে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা নিয়েই অতুল আবার বই হাতে বিছানায়। গুঞ্জার শর্ত- দুবেলা চা করার দায়িত্ব অতুলের । খুকি এখনো ঘুমোচ্ছে। অতুল হাল্কা করে জানলাটা খুলে দিল। জানলা দিয়ে বৃষ্টির অল্প ছাট আসছে। রবিবার নটা বাজলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাজারের থলি হাতে অতুলকে বেরোতে হয়। অতুল ঠিক করল হাজার কথা গুঞ্জা শোনালেও এই আবহাওয়ায় সে আজ আর বাজারে বেরোচ্ছে না।
এই সময় গুঞ্জা এসে ফরমাশ করল বাজার যেতে হবে । আজ খিঁচুড়ি আর কষা মাংস হবে। অতুল আঁৎকে উঠল। এই বৃষ্টিতে কে মাংস আনতে যাবে ? অতুল আবার আলস্য ভরে বই হাতে শুয়ে পড়ল। গুঞ্জা কিছুক্ষন গজগজ করে, মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে চুপ করে গেল।
এরকম করে সারাদিন গেল, বিকেল গেল । অবশেষে সন্ধ্যার মুখে "অপদার্থ ", "সেন্সলেস" এসব কথার ঝাঁঝে বৃষ্টিটা একটু কমতে বেরোতেই হল থলি হাতে ।
মোড়ের মাথা থেকে খাসির মাংস আর খুকির জন্য কাঠি চকোলেট কিনতে কিনতেই আবার ঝেঁপে বৃষ্টি শুরু হল। তার সাথে লোডশেডিং। মাংসের দোকানে কিছুক্ষন অপেক্ষা করে "ধুত্তোরি" বলে অতুল বেরিয়ে পড়ল।
পায়জামা গুটিয়ে ছাতাটা সাবধানে ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল অতুল। এই বৃষ্টিতে অন্ধকার রাস্তা পুরো ফাঁকা। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রাস্তায় হাঁটুর নিচু অবধি জল। নর্দমা আর রাস্তা এক হয়ে গেছে। অতুলের প্রতিটা পা ফেলায় যেন মনে হচ্ছে এক ঘন্টা সময় চলে যাচ্ছে।
গলির মুখে আসতেই অতুল আড়চোখে লক্ষ্য করল একটা কালো কুকুর তার পিছু নিয়েছে। একটু এগোতেই পাড়ার ভ্যাট- আবর্জনা । জায়গাটা এমনিতেই জনশূন্য । তার পর চৌধুরিদের বাড়ী – বেশ কয়েকবছর বন্ধ , সামনে আগাছা জন্মে গেছে। কালো কুকুরটা তার পিছন পিছন হাঁটছে। অতুলের ভয় হল মাংসের লোভে কুকুরটা যদি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, এই বৃষ্টির সন্ধ্যায় তার চিৎকার কেউ শুনতে পাবে না। কুকুরটা পাগলও হতে পারে । ভালো করে না দেখতে পেলেও অতুল অনুভব করতে পারল কুকুরটা লম্বাটে , শীর্ণকায় , জল ঠেলে ঠেলে আসার ক্লান্তিতে জিভ বার করে হাঁপাচ্ছে।
সে পিছন ফিরলো। কিন্তু আশ্চর্য , কোন কুকুরই নজরে পরল না। অতুল দাঁড়িয়ে পড়ল। তার হাত পা ভয়ে নড়ছে না। বৃষ্টির জোর আরো বাড়ছে। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে জোরে দৌড়াতে লাগলো। অনুভব করল কুকুরটাও পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে।
অতুল একবার ভাবল মাংসটা ফেলে দেয়। কিন্তু গুঞ্জা কি তার কথা বিশ্বাস করবে ? ভাববে হয়ত সে দোকান অবধি যায়নি, অজুহাত দিচ্ছে। পকেটে হাত দিয়ে দেখল মোবাইলটাও আনেনি। আলো কপালে নেই , অন্ধকারেই হাঁটতে হবে। যা থাকে কপালে ! অতুল দৌড়ানোর চেষ্টা করল। শিরীষ গাছটার কাছে হোঁচট খেয়ে পড়ল। একটু হলেই সে ড্রেনে ঢুকে যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, অতুলের মনে হল যেন কুকুরটাও তার সাথে হোঁচট খেল। অতুল ভয় পেলেও জোর করে পিছন ফিরে তাকালো। কিন্তু অদ্ভূতভাবে এবারেও কোন কুকুর দেখতে পেল না।
অতুল বুঝতে পেরেছে কালো কুকুর নয় , কোন ভৌতিক কিছু তার সাথে ঘটছে। মা হলে বৃষ্টির সন্ধেবেলায় মাছ মাংস আনতে গেলে পকেটে একটা লোহা দিয়ে দেয়। গুঞ্জা একবিংশ শতকের শিক্ষিত মেয়ে , এসব মানে না। অতুলও যে খুব একটা মানে তা নয়। তবে আজ তার মনে হচ্ছে পুরোনো প্রথাগুলো একেবারে ফালতু নয়। সারা গা মাথা বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। কেন যে গুঞ্জার কথা শুনে সকাল বেলায় বাজারে গেল না ?
হঠাৎ করে অতুলের মাথায় রোখ চেপে গেল। সে কুন্ডুদের গ্যারেজটার নীচে দাঁড়াল। মনে মনে ভাবল, শেষ দেখে ছাড়বে। যদি সত্যিকারের কুকুর হয় তো ছাতা করে কয়েক ঘা দেবে, আর ভূত হলেও তার সাথে মোলাকাত করবে। মিনিট দশেক দাঁড়িয়েও কিছু নজরে পড়ল না। শুধু অনুভব করল তার ভেজা পিঠে একটা লোমশ মুখ নাক ঘষছে।
অতুল জোরে হাঁটতে শুরু করল। একটা বাঁক নিয়ে দূর্গা মন্ডপটা টপকেই বাড়ি। ওই তো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। জোরে হেঁটে এসে দরজায় ধাক্কা মেরে হাঁপাতে লাগল অতুল। অনুভব করল কুকুরটাও তার সাথে হাঁপাচ্ছে। গুঞ্জা আলো হাতে দরজা খুলল। অতুল দেখল কালো কুকুরটা আধো আলো দরজায় লাফ মেরে মিলিয়ে গেল।
অতুল কিচ্ছুক্ষনের জন্য থমকে গেল। তারপর আপনমনে হাসল ।
গুঞ্জা বক্রদৃষ্টিতে তাকাল , " হাসছ কেন ? "
অতুল জামা খুলতে খুলতে বলল , " ও কিছু না । খুকিকে চকলেটটা দিয়ে দাও।"
ঠিকানা- রাজগঞ্জ, বর্ধমান
যোগাযোগ- ৯১২৬৫৭৩০১০