পুরস্কার
সুনন্দ মন্ডল
রঘুনাথপুর। ছোট্ট একটা গ্রাম। ঝাড়খন্ডের সীমানা। যদিও বীরভূমের সঙ্গেই ওঠা বসা সবার। এমনকি হাট-বাজার, হাসপাতাল সবই বীরভূমে। মাত্র পঞ্চাশ থেকে ষাট ঘর লোকের বাস রঘুনাথপুরে। এখনো কাঁচা রাস্তায় হাঁটা চলা, কিছু কিছু গলি পাকা হয়েছে।
কিন্তু গ্রামের যুবক মোহন্ত আধুনিক। সে পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো। চিরকাল বিদ্যালয়ের গন্ডিতে প্রথম হয়ে এসেছে। গ্রামে কোনো বিদ্যালয় ছিল না। তাই পাশে বীরভূম এলাকায় একটি বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণী পাশ করে। তারপর বীরভূমেরই একটি শহরে চলে যায়। মাধ্যমিক স্তরে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে বিদ্যালয়ে প্রথম স্থান পায়। ভালো রেজাল্ট পেয়ে তার খুব নাম ডাক হয়। উচ্চ পদস্থ বিভাগ থেকে পুরস্কার পায়। এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মহাশয়ও তাকে পুরস্কৃত করেন। বীরভূমের নামটাও উজ্জ্বল হয়ে উঠল তারই সাথে।
ঐ বিদ্যালয়ে সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করল মোহন্ত। তার জন্য টিউশন ও পড়াশোনার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে নিরেন বাবু। চাষবাসই সম্বল। কিন্তু বিগত কয়েকবছরে জমি যম হয়ে উঠেছে। ভালো ফলন তো নয়ই, চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে গেছে। আর কোন রোজগারের পথ নেই, তাই কষ্ট করে দিনমজুরি খাটতে বাধ্য হয় নিরেন বাবু। লোকে সৎ চাষি হিসেবে 'বাবু' সম্বোধন করত। মোড়ল মানুষ, সেই কিনা দিনমজুর করছে! এটা দেখে কয়েকজন জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলেন, ছেলেকে পড়াতে, তার সব খরচ জোগাতে এই পথে নামতে হয়েছে তাকে। 'হাত আর পা, খাট আর খা' এই প্রবাদে বিশ্বস্ত নিরেন কাজে লেগে পড়ল। সারাদিন খাটুনি। না-খাওয়া,না-দাওয়া শরীর অল্পদিনেই ভাঙতে শুরু করল।
গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তি সুজন। তিনি নিরেনের এই অবস্থা দেখে প্রশ্ন করলেন, "কী রে, নিরেন? তোর ছেলে তো ভালো ফল পেয়েছে। বিদ্যালয়ের সাথে তোরও মান রেখেছে। তা মান্য ব্যক্তি, তুই কেন এতসব করছিস?"
--"দাদা, আমি তো ওরই জন্য এসব করছি। চাষে ভালো ফল পাচ্ছি না। তা রোজগার ছাড়া ছেলেকে নামি স্কুলে, নামি জায়গায় পড়াব কি করে?", প্রত্যুত্তরে বলল নিরেন।
--"সে ঠিকই তো! তা তোর এই পরিশ্রমের মূল্য পাবি তো? সঠিক পুরস্কার পাবি তো?"
--"পরিশ্রম করছি পুরস্কারের আশা ছাড়াই। তাছাড়া ছেলে ভালো থাকবে, ভালো ফল পাবে, ভালো জায়গায় চাকরি করবে, এটাই তো একটা বাবার কাছে অনেক পাওনা।"
--"তা ঠিকই বলেছিস। জানিস তোর মত আমার একটা বন্ধু ছিল বর্ধমানে। তারও ছেলে পড়াশোনা করে ভালো ফল পেয়ে চাকরি করছে আমেরিকায়। বাবা-মা'কে সেই ছেলে আজ আর চেনে না। তাই ভাবছিলাম তোর কথাও।"
--"দেখো দাদা, আমি ওসব ভাবি না। জীবনে যাই পাব, সেটাই ধরে নেব সবচেয়ে মূল্যবান পাওনা। আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
রোজগারের টাকা নিজের সংসার খরচের জন্য কিছু রেখে সবই পাঠিয়ে দিল ছেলের জন্য। মোহন্ত আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে পড়াশোনায়। বুদ্ধি শান দেওয়া ফলার মতোই, তার ধারে কাছে কোনো ছাত্রই পৌঁছাতে পারে না। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে নিরেনের সংসারে আরও অনটন শুরু হল। ছেলের বিয়ের পর বৌমাকে যে গয়নাটা উপহার দেবে ভেবেছিল, সেটাও বিক্রি করতে বাধ্য হল নিরেন। ছেলে ওসব কিছুই জানত না। পড়াশোনায় ব্যস্ত, তাছাড়া বয়স অল্প, এসব কী কেউ কানে তোলে! মোহন্তর মা প্ৰথমে আপত্তি জানালেও, নিরেন বলে "ছেলের বিয়ের সময় পণের টাকা থেকেই গয়না গড়িয়ে দেওয়া যাবে। এখন ওসব ভাবার দরকার কী বলো?"
গয়না বিক্রি হলো। নগদ মূল্য ১ লক্ষ টাকা। সবই পাঠানো হলো ছেলেকে। একবারেই নয়, ধাপে ধাপে। ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক দিল। তারপর বাড়ি ফিরে এলো। অপেক্ষা সেই ফলের। রেজাল্ট বেরোলো। অনেক উচ্চ মানের রেজাল্ট। সারা পশ্চিমবঙ্গে সেরা দশের মধ্যে নবম স্থান পেল মোহন্ত। নিরেনের বুক ফুলে ঢোল। টিভির পর্দায় ছেলেকে দেখে গর্বে কেঁদে ফেলল। পাড়ার সকলকে মিষ্টি বিলালো। সবাইকে ডেকে ডেকে শোনাল ছেলের পাশের কথা। ছেলের পিঠ চাপড়ে বলল, এটাই হয়তো তার পরিশ্রমের ফল। সে মনে মনে ভাবল, জীবনে অনেক পরিশ্রম করে চাষের জমিও ভালো ফল দেয় নি, কিন্তু অল্পদিনের পরিশ্রমে একমাত্র ছেলেই ভালো ফলন দিল। এটাই তার কাছে একমাত্র সেরা পুরস্কার।
এদিকে মোহন্ত আবার চলে গেল বিদ্যালয়ে। সাথে বাবা-মা'ও। সেখানে প্রধান শিক্ষক মহাশয় পুরস্কার দিলেন দামি কলম। সেখানকার বিধায়ক দিলেন একটি মোবাইল ও মানপত্র। মন্ত্রী মহাশয় দিলেন উত্তরীয়, স্বর্ণ পদক। একটি ক্লাব দিল ১ লক্ষ টাকার চেক। অন্যান্য শিক্ষক ও বন্ধুরা সকলেই কিছু না কিছু উপহার দিলেন। কেউ বই, কেউ কলম, কেউ ডায়রি। কেউ মিষ্টির প্যাকেট। কিন্তু বাবা-মা দিলেন চুমু। বাড়ির একমাত্র ছেলে, বংশের গৌরব, আগামীর উত্তরাধিকারীর পিঠে শুধুই প্রশংসার চাপড়।
ছেলে খুশি, আনন্দে চোখে জল। বাবা-মা'র কষ্টের মান রেখেছে সে। এবারে এলাকার গরিব দুঃখীদের জন্য ডাক্তারি পড়তে চায় মোহন্ত। মিডিয়ার সামনেই জানাল তা। বাবা-মার কোনো আপত্তি নেই তাতে। ছেলের ঘাড়ে কোনো কিছুই চাপিয়ে দিতে চায় না নিরেন ও তার স্ত্রী।
বাড়িতে ফিরে এলো সকলে। মোহন্তর জন্য ভালো ভালো খাবারের আয়োজন। সবই চেটেপুটে খেল সে। হঠাৎই তার মা ১ লক্ষ টাকার কথা তুলল। আসলে ছেলেকে পড়াতে গিয়ে অনেক ধার দেনাও হয়েছে। সেটা শোধ করার জন্যই পুরস্কার পাওয়া চেকটা চেয়ে বসল মোহন্তর মা। সে এসব কিছুই যেহেতু জানত না, তাই দিতে অস্বীকার করল তা নয়, ডাক্তারি পড়তে তো খরচ হবেই, সেকথা জানিয়ে টাকাটা দিলো না মোহন্ত।
এদিকে ডাক্তারি পড়তে শুধু কি ১ লক্ষ টাকায় হবে? আরও কত খরচ হবে ভেবে নিরেন হতাশ হয়ে পড়ল। ওদিকে সকলের সামনে কথাও দিয়ে ফেলেছে ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবে। যাক ওসব ভেবে লাভ নেই, পড়াবে যখন পড়াবেই।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। বিক্রি করে দেওয়া হল কয়েকটি অনাবাদী জমি। বেশকিছু টাকা হল তাতে। ভর্তি হয়ে ছেলে সেরা মেডিকেলে সুযোগ পেয়ে চলে গেল দিল্লি। নিরেন ও তার স্ত্রী সংসার চালাতে একেবারেই অথর্ব হয়ে পড়ল। শেষপর্যন্ত মোহন্তর মায়ের যা কিছু গয়না ছিল সেগুলোও বিক্রি করে দেওয়া হল। এক্ষেত্রে নিরেন আপত্তি জানালেও তার স্ত্রী বলল, ছেলে অনেক বড় ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরে আসবে। তখন বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করবে। তাছাড়া তখন অনেক গয়না হবে। এখন এসব রেখে লাভ নেই।
হ্যাঁ, মোহন্ত ডাক্তারি পড়ছে। ভালো ছাত্র। তাই উন্নতির পথেই আছে সে। হঠাৎ ওখানকার নামজাদা পরিবারের মেয়েকে ভালোবেসে ফেলল মোহন্ত। মেয়েটিও তারই সাথে একই কলেজে মেডিকেল নিয়ে পড়াশোনা করছে। অনেকবছর বাড়ি ফিরল না সে, কিন্তু ততদিনে মেয়েটিকে বিয়ে করে বসল। ডাক্তারিও পাশ করল। ভালো ফলাফলের জন্য আবার স্বর্ণপদক, মানপত্র, লক্ষাধিক টাকার চেক পুরস্কার পেল।
এবার গ্রামে ফেরার পালা। বউ নিয়ে সকলকে চমকে দেবার সময় এসেছে। কিন্তু বউ যেতে রাজি হলো না। মোহন্তকেও যেতে দিলো না নিজের বাড়ি। সাপ্তাহিক চিঠি প্রদানের মতোই মোহন্ত ঐ সপ্তাহেও চিঠি দিল বাড়িতে। সে বাড়ি ফিরতে পারবে না। এখানকার হাসপাতালে চাকরি নিয়েছে সে। নতুন কাজ। ছুটি নেই। বিয়েও করেছে, সে কথা জানালো চিঠিতে। ওদিকে বাবা-মা শুধু অপেক্ষা করতে থাকল। চাকরি পাবার পর থেকে যদিও মাসে মাসে টাকা পাঠাতে থাকল, কিন্তু তাতে সংসারে সুরাহা হয় না। বেশ কয়েকবছর ওভাবেই টাকা পৌঁছাত নিরেনের বাড়িতে।
বছর পাঁচেক পরে টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেল। অভাবী সংসারের হাল ধরতে আবার মাঠে গিয়ে পরিশ্রম শুরু করল। যে টুকু জমি অবশিষ্ট ছিল, তাতেই ফসল ফলাতে চেষ্টা করল। বয়সের ভারে একসময় ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ল নিরেন। তার স্ত্রীও ছেলে ফিরে না আসার শোকে কেঁদে কেঁদে অসুখে পড়েছিল অনেক আগেই। এদিকে মোহন্ত বউয়ের আদর, শ্বশুরের আভিজাত্য, আর নিজের অহংকারে ভুলে গেল গ্রামের কথা। গ্রামের মানুষের চিকিৎসার কথা। ভুলে গেল বাবা-মা'র কথাও। নিরেন ও তার স্ত্রী সারাদিন পরিশ্রম করে, আর রাতের বেলা বালিশের কিনারা চোখের জলে ভেজায়। এতদিন ছেলে পুরস্কার পেয়েছে জেনে সুখলাভ করেছিল তারা, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ছেলের দেওয়া মূল্যবান ও শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করল। সেসময় মনে পড়ল, গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তি সুজন বাবুর সেদিনের কথা।