ছোটগল্প ।।এক পাগল কবি ও তাঁর ভূত লন্ঠন।। তাপসকিরণ রায় ।।
এক পাগল কবি ও তাঁর ভূত লন্ঠন
তাপসকিরণ রায়
পল্টু বাবু কবিতা পাগল ছিলেন। কবিতা পড়ার চে কবিতা লেখায় অনেক বেশী সময় দিতেন তিনি। গ্রামের লোকরা
তাঁকে বাহবা দিত। পত্র পত্রিকায় ঘষে মেজে সম্পাদকেরা দু-একটা কবিতা ছেপেছেনও। পল্টু বাবুর গ্রামে প্রায় রাতেই লাইট থাকে না। তাই সময়ে অসময়ে কবিতা লেখার জন্যে তিনি একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে নিজের পাশে রেখে দিতেন। নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হত। স্ত্রী রেগে বলত, 'আমাকে রাতের রান্নাটা করতে দেবে না কি ?'
পল্টু বলতেন--'তোমার রান্নার চে আমার কবিতা লেখাটা অনেক বড়। দেখো, মনে কখন যে কবিতার ভাব উদয় হবে তা আমিও কি ছাই
বলতে পারি ।' স্ত্রী মাথা ঝাঁকিয়ে বলত, 'আর রাতের খাওয়ার কি হবে ? এক রাত না খেলে চলবে তো ?'কবিতা বনাম রান্না নিয়ে এমনি বিতণ্ডা স্বামী-স্ত্রীতে লেগেই থাকত। তাই রাতের খাওয়া দাওয়ার সঠিক কোন সময় থাকত না তাঁদের। পল্টু বাবু তাঁর জেদের বসে একটু পর পর লন্ঠন রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসে তাঁর মনের উদয় হওয়া দু-লাইন কবিতা লিখে ফেলতেন--'
কি করছ তুমি?
পা দুটো তোমার ছুঁয়ে আছে ভূমি।
এ কথা জেনো, এই মাটিই তোমার দেশ মা--
যে মাটিতে তোমার ছুঁয়ে আছে দুটি পা!…', ইত্যাদি ইত্যাদি...
দিনে নানান কাজের হেপাতে কবিতা লেখা হত না বললেই চলে। কখনও সখনও দিনের বেলার ফুরসতে পথ চলতে চলতে তাঁর ভাবনার উদয় হত। তিনি কোন জাগা নিয়ে বসে পড়তেন। তারপর কাগজ কলম বের করে নিয়ে খসখস করে মনের মাঝ থেকে উঠে আসা কবিতা গড়গড়িয়ে লিখে যেতেন।
সন্ধ্যে বেলা আবার দু-চার জন বন্ধুবান্ধব আসত। পল্টু তাঁদের কবিতা শোনাত। তারা 'বা,বা',করে উঠত।
সে দিন রাতেও স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়ে ছিল। তিনি বলে ছিলেন, 'ধুর ছাই লেখারও তো একটা পরিবেশ চাই !' রাতে তিনি রেগে মেগে লন্ঠন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ছিলেন খোলা মাঠে। সঙ্গে কাগজ কলম তো থাকতই। খোলা মাঠে তখন চৈতের খরার গরম হাওয়া চলতে থাকত। আর রোজ রাতে জমির আলে লন্ঠন রেখে কাগজ কলম বের করে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করতেন--
'কালটাই বড় খারাপ, চৈতের লূ,
তাতানো সাঁড়াশির মত ঘরের স্ত্রী,
রাগে লাল গনগনে তার মুখ !...', ইত্যাদি ইত্যাদি--
পল্টু মনে করতেন, দুঃখ ব্যথা আসলেই আসল কবিতা মন থেকে বেরিয়ে আসে। তা মিলের হোক আর অমিলের গদ্য কবিতা।
যাইহোক, পল্টু পাগল কবিই ছিলেন বটে।
সেই পল্টু কবি হঠাৎ একদিন মারা গেলেন। গ্রামের ডাক্তার বলল, লূ লেগে মারা গেছেন। চৈতের রাতের গরম হাওয়া তিনি সহ্য করতে পারেননি। স্থানীয় ডাক্তার ফেল করে যাওয়ায় তাঁকে বাইরে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই পল্টু মারা গেলেন।
সেই কবি পল্টু মারা তো গেলেন। কিন্তু তাঁর গ্রামের অনেকে বলত, 'পল্টু কবি মরে নাই !' রাত কিছুটা বাড়লে যারা সেই খোলা মাঠের আলের দিকে যেত যেখানে দেখতে পেত লন্ঠন নিয়ে পল্টু কবিতা লিখতেন, তারা দূর থেকে দেখতে পেত, সেই কালিঝুলি মাখা লন্ঠনটা জ্বলছে ! আর এ কি--ভয়ংকর সে দৃশ্য ! লন্ঠনের টিমটিমে আলোর সামনে বসে আছে পল্টু কবি ! এ দৃশ্য দেখে সবাই চমকে উঠত, তারা দেখত, পল্টু ঠিক আগের মতই বসে আছেন। চশমা চোখে মাথা নিচু করে তিনি রীতিমত খসখসিয়ে কবিতা লিখে যাচ্ছেন ! চশমার ভেতর থেকে তাঁর চোখ দুটো যেন মাঝে মধ্যে জ্বলে জ্বলে উঠত!
কখনও আবার আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটত। ভয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা দেখতে পেত, পল্টু কবি হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। কি দেখত সে আকাশে ?
হঠাৎ প্রথমে খসখস একটা শব্দ তাদের কানে এসে লাগত, তারপর তাদের কানে আসত অস্পষ্ট অথচ গুরু গম্ভীর একটা আওয়াজ, শূন্য থেকে যেন কাটা কাটা কবিতা পাঠ চলতে থাকত--
'লন্ঠনের...অস্পষ্ট আলোয়...আমি যেন...নিজেকেই...ঠাওর করতে ...পারছি না--
মনে হয়...আমি...অন্য কোন লোকে...বাঁধা হয়ে আছি !
কবিতা...আমার...শ্বাসের মধ্যে...ডুবে থাক--
আমি...ছায়া নিয়ে...মায়া নিয়ে...খেলা করে যাই....'
আর তাদের কবিতা শোনা হত না--এ দৃশ্য যারা দেখত তারা ভয়ে অবচেতন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ওরা যখন দেখতে পেত, পল্টু কবি তাদের দিকেই জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে। আর থেমে থেমে বিড়বিড় করে কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছে। তখন তারা পড়িমরি করে ছুটতে থাকত গ্রামের দিকে। গ্রামের কাছাকাছি এসে ওরা একবার ফিরে তাকাত, ওরা দেখত, সেই লন্ঠন নিয়ে ধীর গতিতে পল্টু কবি যেন গ্রামের দিকেই এগিয়ে আসছে ! আর আসতে আসতে হঠাৎ তাদের চোখের সামনেই লণ্ঠনটা দপ দপ করে নিভে যেত। তারপর সব কিছু অদৃশ্য হয়ে যেত। শেষে চারদিক গাঢ় এক অন্ধকার আস্তরণের মধ্যে ডুবে যেত।
----------------------
address:Tapaskiran Ray
flat no.406/4th floorCARAVS Building/
station road/civil lineJabalpur (M.P.)
PIN-482001
Mobile no. 919424306671
Face book--Tapaskiran ray / face book
Mail address-- tkray1950@gmail.com
জীবনী : নাম : তাপসকিরণ রায়। পিতার নাম : স্বর্গীয় শৈলেশ চন্দ্র রায়। মাতাঃ শ্রীমতী বেলা রায়। জন্মস্থান : ঢাকা, বাংলা দেশ।
স্বর্গীয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রকাশনায় কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে লেখকের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : চৈত্রের খরায় নগ্ন বাঁশির আলাপ। উদার আকাশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত লেখকের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থঃ তবু বগলে তোমার বুনো ঘ্রাণ। শিশু বিতান প্রকাশনী থেকে দুটি শিশু ও কিশোর গল্প গ্রন্থঃ (১) গোপাল ও অন্য গোপালেরা (২) রাতের ভূত ও ভূতুড়ে গল্প, প্রকাশিত হয়েছে। নান্দনিক থেকে প্রকাশিত লেখকের গল্প সঙ্কলন, গুলাবী তার নাম। এ ছাড়া বেশ কিছু সংকলন গ্রন্থে লেখকের কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসাদ, সারাক্ষণ, পথের আলাপ, লং জার্নি, দৌড়, কালি কলম ও ইজেল, রেওয়া, কর্কট ক্রান্তি, দিগন্ত, বৈঠকী আড্ডা, নিরুক্ত, কবিতার সাত কাহন, অঙ্কুর, আত্মদ্রোহ, বেদুইন ইত্যাদি বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় লেখকের গল্প, কবিতা ছাপা হয়েছে। এ ছাড়া ঐহিক, কালিমাটি, কৌরব, আদরের নৌকা, সৃষ্টি, পরবাস ইত্যাদি আরো কিছু অন লাইন পত্রিকাতে তিনি লেখেন। শিশু-কিশোরদের পথের দাবী, পথের সুজন, কিচিরমিচির, ছেলেবেলা, জয়ঢাক, ম্যাজিক ল্যাম্প, ইচ্ছামতি, কচিকাঁচা, আগডুম বাগডুম ইত্যাদি পত্রিকায় লেখকের উপন্যাস, গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।
পত্রিকা গ্রূপের দোয়েল পত্রিকা, কিচিরমিচির, সেতু অন্যপথে, মানভূম সংবাদ, আনন্দ কানন, আজ আগামী ইত্যাদি পত্রিকায় লেখকের শিশুকিশোর উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছেl
লেখকের সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার অনলাইন ব্লগ পত্রিকা স্বরধ্বনি।