শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সামনে দাঁড়িয়ে থমকে গেল ময়ূরী।
বিপাশাদি বললেন - এসো।
খুব গরম পড়েছে।
বিপাশাদি বললেন - খুব গরম লাগছে?
রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ময়ূরী বলে - না না এ কিছু নয়।
-জল খাবে?
বিপাশাদি তাঁর ঢাউস অফিসব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে এগিয়ে দেন। ময়ূরীর বুক দুরু দুরু। সে কি পারবে? একটা ট্রেনিং নিয়েছে বটে তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা এখনও হয়নি। হ্যাঁ, একটা ট্যুইশান পেয়েছে। বিপাশাদির মেয়ে, এই স্কুলেই পড়ে, মাত্র শুরু করেছে। বিপাশাদি এই স্কুলের সন্ধান দিয়েছেন। এটি একটি স্পেশাল স্কুল। যে সব বাচ্ছারা বৌদ্ধিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত তারাই এ স্কুলের ছাত্র ছাত্রী। ময়ূরী গ্রামের মেয়ে। বিপাশাদির বাড়ি এসেছিল পূর্বপরিচিত বলে, বিপাশাদি একটা ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে দিলেন স্পেশাল এডুকেটরের। এখন বিপাশাদিই তাকে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে এসেছেন। একটু পরেই ডাক পড়ল ইন্টারভিউ রুমে। চারজন বসে আছেন। তিনজন নারী ও একজন পুরুষ। ময়ূরী কখনও ইন্টারভিউ দেয় নি। এই প্রথম। আরও দুজন প্রার্থী রয়েছে।
-বসুন।
ময়ূরী কলের পুতুলের মত বসে নমস্কার করলো। - আপনার নাম?
-ময়ূরী পোদ্দার।
-সার্টিফিকেটগুলো?
ময়ূরী দিল।
সব্বাই দেখলো।
-কখনও স্পেশাল চাইল্ড হ্যান্ডল করেছেন?
-করেছি তবে সেভাবে নয়।
-মানে অভিজ্ঞতা নেই, তাই তো?
-আমি পারব। - কাঁপা গলায় বললো ময়ূরী ।
-মেন্টাল ডিসয়্যাবিলিটি কী কী ধরণের হয় আইডিয়া আছে?
-আছে।
-বলুন।
ময়ূরী বলল।
-দেখুন যা দেখবার আমরা দেখে নিলাম। আপনাকে একঘন্টা একটা ছাত্রীকে নিয়ে বসতে হবে। আমাদের হাতেকলমে পরীক্ষা হয়, আমরা সেটাও দেখে নিই। মাধুরী সম্ভবত গ্রেড ফোর স্টাফ, দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। বলল-আসুন। লম্বা করিডোর পার হয়ে একটা ছোট ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়াল মাধুরী। বলল-এখানে ক্লাশ করবেন। - খুব ছিমছাম ছোট্ট ক্লাশরুমটি। একখানা বেশ বড় টেবিল, চারদিকে চারটি চেয়ার, সামনেরটা শিক্ষকের । মাধুরী ওটা দেখিয়ে বলল-এখানে বসুন। আমি ছাত্রী নিয়ে আসছি। - মাধুরী চলে গেল। বসলো ময়ূরী। ঘরটার ভেতর একটা মৃদু সুবাস আছে। দেয়ালে আইনস্টাইনের ছবি। একটা স্তব্ধ নীরবতা। দূরাগত কিছু ধ্বনি আসছে ছাত্র ছাত্রীদের, সে ধ্বনি যেন চোখে দেখা পৃথিবীর নয়, বিকল্প বিশ্বের। সে বিশ্বের বাসিন্দা যারা তাদের দৃষ্টি ভিন্ন, ভাবনার গতিপ্রকৃতিও ভিন্ন, ঐ জগতের বাসিন্দা একটি ছাত্রীকে আজ সঠিকপদ্ধতিতে শেখাতে হবে ময়ূরীর, তাহলেই চাকুরি হওয়ার সম্ভাবনা। ময়ূরী গাঁয়ের মেয়ে, তেমন চৌকস নয়, তবু জীবিকার তাগিদে এই নগরে আসতে হয়েছে তাকে। কৃষিজীবী বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় অনন্যোপায় হয়ে তাকে আসতে হলো। মাধুরী একটি ফুলের মত ফুটফুটে ছাত্রী নিয়ে ঢুকলো। বয়েস এই দশ/এগারো হবে। মাধুরী বলল - এই আপনার ছাত্রী। - তারপর ফিসফিস করে বলল-সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। অফিসরুম থেকে ওরা দেখবে। সাবধানে। - সতর্ক করে মাধুরী চলে গেল। খুব নার্ভাস লাগছে। মেয়েটিকে বসিয়ে দিয়ে গেছে মাধুরী।
- তোমার নাম কি? - ময়ূরী জিজ্ঞেস করল।
- বুলবুলি। তোমার নাম কি?
-ময়ূরী।
-তুমি আমার বন্ধু হবে?
-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
-তুমি আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে?
-নিশ্চয়ই, নিয়ে যাব।
-তাহলে চলো।
-কবে যাবে বলো?
-এক্ষুনি।
-এখন নয় সোনা, পরে তোমাকে নিয়ে যাব।
-না না এক্ষুনি চলো। চলো চলো।
এইবার ময়ূরীর হাত ধরে টানছে মেয়েটি। চেয়ার থেকে উঠিয়ে দিল। ময়ূরী দেখল জানালার বাইরে নীল আকাশ, সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। এখন শরৎকাল। ময়ূরী কে জানালার পাশে নিয়ে গেছে, মেয়েটি টানছে দরজার দিকে। এই চাপানউতোর কাটাতে ময়ূরী গান গেয়ে উঠল। 'আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা....' এখন বুলবুলি আপনমনে নাচছে, ময়ূরী গাইছে। কী একটা অনাবিল আনন্দের অনুভব হলো, ভুলেই গেল সে এটা ইন্টারভিউ, এক বিকল্প বিশ্বের ভেতর ধীরে ঢুকে পড়ছিল ময়ূরী, এদিকে দরজায় মাধুরী এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে তার মেঘ ও রৌদ্রের খেলা।
....................................................................