প্রেম অহংকার জোনাকি
দেবনাথ সুকান্ত
একটি বাস চলতে শুরু করলো, এক নম্বর গিয়ার থেকে দুই, তার থেকে তিন, তার থেকে চার। এবার সে তার স্টপেজ থেকে বেরিয়ে একটি রোটারিকে ঘুরে, বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাবে। সে কালো ধোঁয়া ছেড়ে এগোতে শুরুর করলও আর আকস্মিক চোখ ঘুরে বাঁদিকে তাকিয়ে দেখলও, রোটারির পরে যে ফুটপাত আছে তার উপর দিয়ে একটি ছেলে ছুটছে। প্রাণপণ ছুটছে সে, যেন তার জীবন চলে যাচ্ছে এই বাসের সাথে। তার দেহটুকু ছুটে আসছে শেষ বারের মতো। সে ধরে ফেলবে, সে নিশ্চয়ই ধরে ফেলবে। ছুটছে ছেলেটি আপ্রাণ। সে বাসের প্রায় নাগালে এসে তাকালও বাসের দিকে। বাসটিও ঘুরে দেখলও ছেলেটি এগিয়ে আসছে। করুণা হল তার। সে কি একটু ব্রেক কষবে? নাকি সে আরও জোরে চেপে দেবে এক্সেলারিটর। দেখবে কত জান আছে সেই ছেলের। কিন্তু সে তো কারোর পরীক্ষা নিতে আসেনি। সে তো এসেছে মানুষকে তার ডেস্টিনেশানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তা হলে তো তার কিছুটা স্লো করা উচিৎ। সে আবার একবার ঘুরে তাকালও ছেলেটির দিকে। না সে করুণাই করবে। সেটাই তার কাজ, তাকে মানায় ভালো। কিন্তু একি ছেলেটি তো তাকে প্রায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে তো বাসে ওঠার জন্য ছুটছে না। সে তো তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়। ছেলেটি বাসের কেবিনের পাশে চলে এসেছে, আর হয়তো কয়েক পা। সে বাসকে ছাড়িয়ে যাবে। ছেলেটি মাথা নিচু করে যেন গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে কয়েক পা এগোল। পাশে থেকে বাসও চাপ দিল তার এক্সেলারিটারে। কালো ধোঁয়া ছেড়ে সেও কিছুটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো এবার। তবু ছেলেটি মরিয়া। আর কয়েক পা বাকি, সে মাত দেবে বাসকে। না হলে বাস তার রোটারি ছাড়িয়ে এগিয়ে যাবে সোজা বাঁ দিকে। সে আর পারবে না। ছেলেটি জীবনের সব কিছু দিয়ে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো। বাসকে মাত দিল সে। এখন সে বাসের থেকে এক ফুট এগিয়ে দৌড়চ্ছে। বাসের জানালায় বসে থাকা সবকটি মুখ দেখছে তাকে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কন্ডাকটর অবাক চোখে তাকিয়ে। ঠিক যেখানে এই রোটারি ছেড়ে বাস এগিয়ে যাবে, সেখানে ফুটপাতের পরেও কিছুটা ঘাস জমি আছে। ছেলেটি এবার ফুটপাত ছেড়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। যেন তার যুদ্ধজয় শেষ। পকেট থেকে এক তাড়া চিঠির বান্ডিল ছুঁড়ে দিল আকাশের দিকে। সেটি মাটিতে নামার আগেই জোরে কিক করলো সেই বান্ডিলে। নীল লাল হলুদ সাদা চিঠির কাগজ ছিটকে গেল মহাকালে।
কিন্তু এবার?
এখন কি একটু ব্রেক নেওয়া প্রয়োজন। আর যে কটি চিঠি আকাশে উড়েছে, তাদের কি জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন। দেখো তোমরা কী হারালে। নাকি যে কান্না বাসের সাথে বাঁ দিকের রাস্তা হয়ে চলে যাচ্ছে সময় ছাড়িয়ে। তাকে বলা উচিৎ, হারের গ্লানি মৃত্যু সমান, যদি না সে প্রেমের হার হয়। জানি না, বাস তার গোটা চল্লিশ বছরের জীবনে দেখেনি এসব। সে দেখেছে কেউ হয়তো কাউকে তুলে দিতে এসেছে। না হলে নিতে এসেছে কাউকে। কেউ কাউকে ডেকে যখন পায়নি তখন তাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসবে, এ অভিজ্ঞতা নতুনই বলা যায়। আর থাক, বেশি না ভাবাই ভালো তার পক্ষে। সে তো তার গন্তব্যে পৌঁছাবে। দেখি সেখানে কি অপেক্ষায় রয়েছে।
একে একে সবাই নেমে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ একজন বসে আছে শীতের কাঁথার মতো। তার কেউ নিতে আসার নেই। কেউ ছেড়ে যাওয়ার নেই। কন্ডাকটর তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে খালি। না সে কিছু বলতে চায় না। কেননা সবার মতো তারও এ অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। সিটে বসে থাকা সে তাকাতে পারছে না। কিন্তু জানে সময় পেরিয়ে গিয়েছে আর ফেরার উপায় নেই।
সবুজ সালোয়ার লাল পাটিয়ালা, ওড়না তার সজাগ হয়ে থাকা চ্যালেঞ্জের উপর আলগোছে পড়ে থাকে। কখনও সরে যায় কখনও ঘুরে তাকায়, কেউ দেখছে না তো। কেউ যদি দ্যাখে, সে তাকায় যেন ছাই ভস্ম গিলে খাবে আর যদি কেউ না দেখলও, তখনও দেখে নেয় কে সেই চরম সাহসী উদাসীন। নাকি সালা নপুংসক। লাল টিপ, হলুদ হ্যান্ড ব্যাগ আর ওড়না যেন কালকূট। হাতের এদিক ওদিকে ওড়না কন্ডাকটরের গায়ে যখন পড়ে যাচ্ছে, জেগে উঠছে মেয়েটির জিরো টলারেন্স। তার হেঁটে চলা এক উদ্ধত কাটারি। সে চলে যাবে। চলে যাওয়াই উচিৎ।
আর অন্য দিকে এতক্ষণ পর যে বাস কিছুটা শান্তির জন্য চোখ বুজে ঝিমতে ঝিমতেও পারানিটুকু নিয়ে ভাবছে। সে কি বাস্তবে হেরে গেল? ছেলেটি কি তাকেই হারাতে এসেছিল নাকি? এই যে মেয়ে চির বিষণ্ণ এক জীবনের দিকে চলে যাচ্ছে তাকে ডেকে বলবে। জানো আমাদের এই রুট ব্যবসার লাইনে যে কন্ডাকটার যত বেশি খিস্তি দেয় জানবে তার ইনকাম তত কম। তুমি যে কিছুটা গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়েছ, তাতেই বোঝা যাচ্ছে তোমার অহং গলে ঘাম হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে পোড়া অঙ্গ। মেয়েটি হাত বাড়ালও। রিক্সা।
এখন তিনটি চরিত্র তিন দিকে, আর মাঝে উড়ে চলেছে সেই লাথি খাওয়া চিঠি। সেই ছেলে হাঁটতে হাঁটতে একটি মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে, সেই মেয়ে রিক্সা করে পেরিয়ে যাচ্ছে শহরের সব থেকে বড় লাভার্স পয়েন্ট। আর সেই বাস অপেক্ষায় কখন তার পরের ট্রিপ আসবে। সে আরও কিছু যাত্রী সাথে করে একই রাস্তায় একই গতিতে এগিয়ে যাবে। কিন্তু ঠিকানা হবে নতুন নতুন। কেননা যারা নেমে যাবে তাদের কিছুটা হলেও ছোঁয়া থেকে যাবে বাসের ভিতর। মেয়েটির ছেড়ে যাওয়া পারফিউম বা কন্ডাকটরের প্রতি অবহেলা। মেয়েটি যখন তার নিঃসঙ্গ বাথরুমে এই পাপ মোচন করবে, দেখতে পাবে কিভাবে অহংকারের কালো বিন্দু নিজেদের অসীম গ্র্যাভিটি নিয়ে ব্যতি-ব্যস্ত।
অবশ্য সবকিছু কি এভাবেই হতে হবে? তার তো কোনও মানে নেই। মেয়েটি রিক্সা থেকে নেমে যেতে পারে, সে এগিয়ে যেতে পারে পায়ে হেঁটে, বাজারের মাঝ দিয়ে। একপাশে হকারদের ছাউনি অন্য পাশে স্থায়ী দোকানের বুড়ো মালিক। ছেলেটিও হয়তো তার কোথাও স্ট্যান্ড করে রাখা বাইক পিছনে ফেলে সস্তার এক বিয়ার বারে দাঁড়াবে, কিছু একটা যেন রয়ে গেল। কে যেন পিছন থেকে ডাকল। যেমন ছেলেটি পিছন ফিরে তাকিয়েছে। তেমনই মেয়েটিও ঘুরে তাকালও, কোনও এক হকার ডেকেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এত ভিড় যে কারোর কথাই শোনার উপায় নেই। তবু কেউ তো ডেকেছে। মেয়েটি পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেছে। আরে এই দোকানটা তো ছিল না এখানে? যাওয়ার সময় তো দেখতে পাইনি। তবে এখানে এলো এখন? নাকি আমি এতটাই অন্যমনস্ক ছিলাম যে খেয়াল করিনি। কিন্তু কেন এই অন্যমনস্ক। আমি তো আর সে সব নিয়ে ভাবছি না। সে তো আমার গু মুতের মতোই ফেলে এসেছি পিছনে। মেয়েটি এক সিটি গোল্ড দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দিন সে ভেবেছে ইমেটেশনের কিছু গয়না কিনবে। কিন্তু এই দোকানটা চোখে পড়েনি কেন? ভিতর থেকে সেলস গার্ল ডাকল, বলল কিছু দেখাতে পারি? মেয়েটি বলল যা কিছু দেখাতে পারেন। ছেলেটি অন্য দিকে একটি টেবিলের সামনে বসেছে। পকেট থেকে বাইকের চাবি টেবিলে রেখে আঙুলে করে ঘুরিয়ে চলেছে। ওয়েটার বলছে কিছু অর্ডার করবেন? ছেলেটি দুবারে শুনে বলল যাকিছু নিয়ে এসো।
সময় এগিয়ে গেছে কিছুটা, কিছুটা নয় বলতে গেলে অনেকটা হতে পারে। সেই সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারের দিকে। বাস আরও কয়েকবার সেই একই রুট ধরে এগিয়ে গিয়েছে আর ফিরেও এসেছে। প্রতিবারই ঘুরে দেখেছে সেই ফুটপাত পেরনো মাঠের দিকে। কিন্তু কিছুতেই সেই চিঠিগুলোকে খুঁজে পায়নি। বরং দেখেছে মেয়েটি একটি নকল গয়না নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে যে সোনার মতো চকচকে রঙিন বস্তুটি রয়েছে তার যেদিক মেয়েটির দিকে ফেরানো, সে দিক যতটা বিষণ্ণ ঠিক ততটাই উজ্জল আয়নায় প্রতিফলিত দিকটি। এবং মেয়েটি নিজের দেহের সব আবরণ খুলে তা গায়ের উপর রাখছে। কেন জানিনা চোখের কোনায় সামান্য জল আসছে তার। ছেলেটিও কোনও রকমে তার ঘর পর্যন্ত পৌঁছেছে। দরজা খুলেছে তার মা। সে মায়ের গায়ে এলিয়ে দিয়েছে শরীর। তারপর এক স্বপ্ন দেখেছে তাকে কে যেন নিতে এসেছে, ডাকছে দূর থেকে অনেক। কিন্তু সে কিছুতেই তাদের ডাকে সারা দিতে পারছে না। তাকে যেতে হবে এই হয়তো শেষ ডাক, নাহলে আর তারা আসবে না। সে রয়ে যাবে একলা। অথচ সে সাড়া দিতে পারছে না।
হঠাৎ তাদের দুজনেরই ঘরের সামনে একটা জোরে ব্রেক কষার শব্দ এলো। মনে হল যেন কোনও এক বাস খুব জোরে ব্রেক করে দাঁড়ালো হঠাৎ। চমকে উঠলো মেয়েটি, তার গায়ের উপর আলগোছে রাখা গয়না পড়ে গেল মাটিতে। সে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো আয়নার সামনে। চোখে চোখ গেল তার। সামনে তারই নিরাবরণ শরীর, কত অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। দুটি কাঁধ যেন ঝুঁকে মাটির সাথে মিশে যেতে চাইছে। বুক দুটি ভিতর দিকে ঢুকে যেতে চাইছে যেন। পেট যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অস্বাভাবিক স্থূল দেখাচ্ছে নাভির অংশ। কোমরের স্থুলতা অদৃশ্য। পা দুটি যেন আর তার ভার সইতে পারছে না। আর ছেলেটি। সেও চমকে উঠে তাকিয়েছে মায়ের দিকে। কোথাও কিছু ভাঙার শব্দ হল নাকি? কিছু অনেক উঁচু থেকে মেঝেতে পড়ার। ছেলেটি দেখছে তার মা তার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু চোখ কোনও ভাষা নেই। এক অর্থহীন চাহুনি। যেন তাকে চিনতেই পারছেনা, বা আগে থেকেই জানা ছিল সে আজ এভাবে মদ খেয়ে ঘরে ফিরবে। তার চোখে মুখের অস্থিরতা তার মায়ের চোখে ফুটে উঠেছে। মেয়েটি আয়নার সামনে থেকে সরে যেতে চাইছে কিন্তু, পারছে না। তাকে যেন বেঁধে রেখেছে কেউ। সে তার বুক থেকে অবাঞ্ছিত পেটিকোট খুলে ফেলে দিল। খুলে দিল তার কটি বস্ত্র। তার বৃন্ত দুটি এভাবে মুখ নিচু করে তাকিয়ে আছে কেন? তারাও কি আয়নার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে? আর তার যৌন-কেশ যেন তাদের ঘনত্ব হারিয়েছে। বুকের ভিতর বাজ পড়লো তার। বুকের ভিতর বাজ পড়লো ছেলেটিরও। মা, কেউ এসেছে বাইরে? মা বলল, কই শুনিনি তো। ছেলেটি বলল, না আমি ঠিক শুনেছি, একটি বাস এসে থেমেছে ঠিক আমাদের ঘরের সামনে। অন্যদিকে মেয়েটিরও পা পড়লো তার গা থেকে পড়ে যাওয়া গয়নার উপর। মনে পড়লো কোনও বাস কি এসে থেমেছে আমার ঘেরের সামনে। খুব দ্রুততায় জামা গায়ে দিতে শুরু করলও সে। ওদিকে ছেলেটিও প্রায় টলোমলো পায়ে দরজার সামনে। তারা একসাথে দু'দিকে দু'জনে দরজার হাতলে তার দিল। আর ঠিক তখনই সেই বাস তার রাতের শেষ ট্রিপে দেখতে পেল, মাঠের সেই মাঝখানে একটি বদ্ধ পাগল বা নিশাচর মানুষ বা ভিখারি, চিঠিগুলি খুঁজে পেয়েছে। সে একটি একটি করে চিঠি পড়ছে আর একটি একটি করে জোনাকি এসে বসছে তার হাতে পরবর্তী চিঠির উপরে।
------------------
সুকান্ত দেবনাথ
সি ২/১৪ বিদ্যাসাগর পল্লী
দুর্গাপুর ১৩
পশ্চিম-বর্ধমান
৯০৬৪২০০২৬৯