সোনালী দিনের উপাখ্যান
দেবব্রত ঘোষ মলয়
পূর্বকথন
আচমকাই ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয় অখিলবাবুর। তাঁকে ভর্তি করা হয় বড় হসপিটালে। সেখানে আবার আগুন লাগে। সে আগুন পুরোপুরি নেভার আগেই ডাক্তারবাবু জানান - অখিলবাবু আর নেই। তারপর ...
পর্ব ৬
দোতলার বড় ঘরের খাটে শায়িত মানদা। পরনে লালপার সাদা শাড়ি, চুল বিশ্ৰস্ত, মুখে কান্নার ছাপ। মাথার কাছে বসে একমাত্র মেয়ে বিমলা। জামাই উমাচরণ ব্যবসার কাজে পাটনায়, আজ রাতেই এসে পড়বে। সামনের সোফায় বসে মননের বড়মামা আর মামী। ঘরের ডানদিকে একটা আরামকেদারা, অখিলবাবু রাত্রের দিকে এই কেদারায় বসে মানদার সঙ্গে জরূরী সাংসারিক কথাবার্তা সেরে নিতেন। সেই আরামকেদারায় বসে ছোটকাকা।
গতকাল আচমকাই সিভিয়ার হার্ট এটাকে অখিলবাবুর চলে যাবার পরই খবর ছড়িয়ে যায় আত্মীয় মহলে। রাতেই বহু আত্মীয় এসে শেষ দেখা দেখে যান অখিলবাবুকে। মনন খুবই ভেঙে পড়ে বাবার এই আকস্মিক প্রয়াণে, সে সময়ে ছোটকাকা আর বড়মামা তাকে আগলিয়ে নিয়ে সব কাজ সম্পন্ন করেন। এঁরা সবাই রাত্রে থেকে যান এই বাড়িতে। আজ পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনায় বসেছেন সবাই।
- মন এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি? - বড়মামা জিগ্যেস করেন মানদাকে।
মানদা এক ভাবেই চোখ বুজে শুয়ে থাকেন। বড়মামা আবার বলেন - দেখ মানু যে যাবার সে তো চলে গেছে। মনও খুব ভেঙে পড়েছে। কিন্তু এখন তো বিস্তর কাজ। জামাইয়ের ব্যবসাপত্তরের দেখভাল, ব্যাংকের কাজ, তারপর ধর না পুরোহিত ডাকা, শ্রাদ্ধশান্তির আয়োজন, নিমন্ত্রনের লিস্ট, ডেকোরেটর, ক্যাটারার সব সব। বোন তোকে তো উঠতে হবে, হাল ধরতে হবে, মনকে দিয়ে সব দায় উদ্ধার করাতে হবে ...
হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন মানদা। ভাঙা গলায় বলেন - কাল সকালেও তো দিব্যি ছিলেন, ঘুণাক্ষরেও কিছু আঁচ করা যায়নি যে এতবড় একটা বিপদ আসতে চলেছে। তোমার জামাই তো মস্ত মানুষ ছিলেন, বুদ্ধিমান, বিবেচক কিন্তু বেঁচে থাকতেও আমাকে শান্তি দিলো না, মরার সময়ও না। আমাকে কিচ্ছু বুঝিয়ে দেয় নি কোথায় কি আছে, ব্যাংক বল, ব্যবসা বল - এখন রক্ষিতাও বোধহয় এর থেকে বেশি জানে।
ঘরে যেন বাজ পড়ে। মামার ভ্রূ কুঁচকে যায়। মামীর চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। ছোটকাকা অবাক বিস্ময়ে বলে ওঠেন - তোমার কি শোকে দুঃখে মাথা খারাপ হয়ে গেল বৌদি? আমার শিবের মত দাদা আর তুমি পার্বতী সদৃশ বৌদি, তোমাদের তো কোনোদিন ঝগড়াও হতে দেখেনি কেউ। আজ তবে এসব কি বলছ?
এনন সময়ে ঘরে ঢোকে মনন। পরনে ধরা, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, কোমরে গোঁজা আসন। তাকে দেখেই মামীমা উঠে গিয়ে হাত ধরে বলেন - বাবা মুখে কিছু দিয়েছিস? একদিনেই বাছার আমার সোনার বরণ কালি হয়ে গেল।
মায়ের পায়ের কাছে বিছানার এক কোনে কোমরে গোঁজা আসন পেতে বসে মনন। বড়মামাকে জিজ্ঞেস করে - মামাবাবু ডেকেছিলে?
হ্যাঁ বাবা, দেখ আমি বুঝতে পারছি এত কম বয়সে হঠাৎ পিতৃহারা তোমার মনের অবস্থা। বাবা মা কারোর চিরকাল থাকে না। তুমি বুদ্ধিমান। এখন সামনে অনেক কাজ। দেখতে দেখতে কটা দিন কেটে যাবে। বাবার কাজ তো হেলাফেলা করে করতে পারবে না, তিনি মানী মানুষ ছিলেন। চল, একটা খাতা পেন্সিল নিয়ে এসো, আমরা বরং কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখি।
এরপর প্রায় দু ঘন্টা কেটে যায় নিমন্ত্রনের প্রাথমিক তালিকা, ডেকোরেটর, ক্যাটারার ডেকে পাঠানো, পুরোহিতের সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদি নানাবিধ কাজের মধ্যেই। এর মধ্যেই পুঁটির মা দুবার চা দিয়ে গেছে, ফল কেটে দিয়েছে মননকে। পুরো সময়টা মানদা একটাও কথা বলেনি, বিছানা থেকে ওঠেওনি। বড়মামির ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকে না। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করেন না তিনি।
এসময়েই ঘরে প্রবেশ করেন বাড়ির কুলপুরোহিত নিধু ঠাকুর। পরনে গরদের ধুতি, গায়ে নামাবলী। হাতে একটি পাঁজি। পুঁটির মা একটি বেতের মোড়া দিলে তাতেই বসেন ঠাকুরমশাই।
মনন উঠে প্রণাম করতে যায় তাঁকে। দুহাত তুলে তাকে নিবৃত্ত করেন নিধু ঠাকুর - আরে আরে কি করছ মন। এখন তোমার মহাগুরু নিপাত এর দশা চলছে, এ সময়ে কাউকে প্রণাম করতে নেই। আচ্ছা তোমার বাবার ভালো কোন ছবি আছে?
এবার কথা বলে বিমলা - হ্যাঁ ঠাকুরমশাই। গত পুজোতেই গ্যালাক্সি স্টুডিওর নির্মলেন্দু বাড়িতে এসে কিছু ছবি তুলেছিল। তখন বাবার দু তিনটে ভালো ছবিও তোলা হয়েছে।
ব্যাস ব্যাস ওতেই হবে - বলেন নিধু ঠাকুর। দুখানা ছবি বাধিয়ে নাও এখুনি, কাজের দিন লাগবে। আর হ্যাঁ মন, একটা কাগজ কলম নিয়ে বোসো, আমি ফর্দ করে দিই। দেখতে দেখতে হাতে গোনা কত দিন চলে যাবে।
সব কিছু শেষ হতে দুপুর হয়ে যায়। নিধু ঠাকুর বিদায় নেন। এতক্ষনে বিছানায় উঠে বসেন মানদা। হাত নেড়ে কাছে ডাকেন মনকে। মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু স্বরে বলেন - তোর বাবা তো ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল। এবার ওঠ বাবা, হবিশ্যি করতে হবে, স্নান সেরে ধরা পাল্টাতে হবে, পরনের টিকে ধুয়ে মেলে দিতে হবে।
মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো শোনে মনন। কতটা বোধগম্য হয়েছে বোঝা যায় না। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে এতক্ষন পরে। এত বড় ঝড় তার জীবনে আগে আসেনি। মানদা কোলের উপর ছেলের মাথা চেপে ধরে নিজেও কাঁদতে থাকেন। ঘরে উপস্থিত সবার চোখে জল।
ক্রমশঃ