Click the image to explore all Offers

গল্পঃ অপরাধী ।। সুবিনয় হালদার




   

অপরাধী

সুবিনয় হালদার



দ্বিপ্রহরের সূর্যটা আস্তে আস্তে ঢলতে শুরু-করেছে পশ্চিম আকাশের দিকে! তির্যক ভাবে আলোটার তেজ ম্রিয়মাণ হতে হতে নিভে যাবে! রাকেশের অবিবাহিত জীবনের ছায়াটা আজ তেমনি বড় থেকে আরও বড় হতে চলেছে- নিঃসঙ্গ-একা-!  আজ বড্ড মনে পরে রমার কথা! তার মামার বাড়ির সেই কিশোর বেলা - সেই যৌবনের উদ্দীপ্ত একটা সময়ের কথা! যখন রাকেশের বাবা আভিজাত্য এবং গোঁড়া জাতপাতের ঊর্ধে উঠে অপেক্ষাকৃত নীচকুলজাত গরিব এক মহিলাকে বিয়ে করে চলে আসে মামার বাড়ি! ঠাকুরদার সাথে কোন-কালেই বনিবনা হয়নি বাবার! শিক্ষিত  সুদর্শন বাবা খুব সহজসরল ছিলো! মামাদের গ্রামে তথা আশেপাশে গ্রামের মানুষ জনের কাছে বেশ গর্বের ও সম্মানীয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছিল; তাঁর কাজে ব্যবহারে! সবার বিপদেআপদে সুখেদুঃখে  পাশে দাঁড়াত, সুপরামর্শ দিত! রাকেশ; বাবা মার একমাত্র সন্তান! মামার বাড়ির আদর যত্নে প্রতিপালিত! মামাদেরও গ্রামে একটা সুনাম আছে! দাদু পরাধীন ভারতে ম্যাট্রিকুলেশান্ পাশ! যখন পাশ করে; আশেপাশের গ্রাম থেকে প্রচুর মানুষজন দেখতে এসেছিলো! দাদু নাকি তখন আঁশফল গাছে উঠে বসেছিল! একদিন দাদু-দিদিমা দালানে বসে রাকেশকে গল্প করেছিলো! তারপর দাদু নাকি মিলিটারিতে যোগ দেয়! হাবিলদার ছিলো! রাকেশের দুই মামা এবং বড় মামার পরে মা কিন্তু রাকেশ বড়মামার ছবিই দেখেছে শুধু! বড় মামাও মিলিটারিতে ছিলো! একদিন ছুটিতে বাড়ি ফিরে আসার পর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘুরতে যায়! দুপুরবেলা ঘরে এসে সেই যে ঘুমিয়েছিল, সে ঘুম আর ভাঙেনি! একটা মেয়েকে ভালোবাসতো বড়মামা! ছুটিতে এসে ঘুরতে বেড়িয়ে জানতে পারে সেই মেয়েটি মামারই এক বন্ধুকে বিয়ে করে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে! দিদিমা কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেছিলো! দাদুকে সবাই খুব Respect করতো! দাদু গানবাজনাও জানতো! গ্রামের দুচার জন দাদুর কাছে গানের প্রাথমিক পর্বটা শিখে পরে বেশ নাম করেছিলো! তবে দাদু বিনা পারিশ্রমিকেই শেখাত Time Pass এর জন্য! ফলে মামার বাড়ি গানের চর্চার একটা বেশ ভালো পরিবেশ ছিলো! বাড়িতেই হারমোনিয়াম, ডিগি-তোবলা, নাল, খোল সবই ছিলো, তবে এসব রাকেশকে কোনদিনই টানতো না! দাদু মারা যাবার পরে অবশ্য রাকেশ এটা নিয়ে আপসোস করেছে বারবার! মাধ্যমিক পরিক্ষা দেবার দুতিন বছর আগে দিদিমার সঙ্গে নিজের বাড়ি ঘুরেও এসেছে একবার! রাকেশের ঠাকুরদা এলাকার নামজাদা লোক! রাকেশকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে কি আদরটাই-না করেছিলো! নিজের ভুল বুজতে পেরে রাকেশকে পাশে বসিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের কথা, বাবা কাকা পিসিদের কথা ঠাকুরমার কথা সব বলেছিলো! বলতে বলতে চোখদুটো ভিজে যায় এবং মামার বাড়ি থাকার জন্য বাবার একগুঁয়েমিকেই দায়ী করেছিল! কাকাদের সাথে বাবার ভালোই যোগাযোগ ছিলো! বিপদেআপদে দাদাকেই তারা মহত্ত্ব দিতো! কারন বাবা চিরকাল শুধুই ব্যবহৃত হতো, তা সে নিজেদের মানুষজনের কাছেই হোক বা বাইরে অন্য কারোর কাছে! বড়ছেলের খুব সাধারন আটপৌরে খাটুন্তে বৌ হিসাবে মা-কেও সবাই খুব ভালোবাসতো! ছোটমামার বিয়ের পর হঠাৎ একদিন ঠাকুরদার মৃত্যুসংবাদ এলো! রাকেশ তখন সবে গ্র্যাজুয়েট complete  করেছে! ওই তখন কয়েকদিনের জন্য রাকেশরা সবাই ওদের নিজের বাড়ি গিয়েছিলো! এর ঠিক ছ-মাসের মাথায় ব্রেণস্টোকে বাবাও মারা যায়! তখন রাকেশ খুবই ভেঙে পরে!  পুরো সংসারের চাপটা সে তখন অনুভব করে! বিভিন্ন কাজের চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে রাকেশ প্রাইভেট টিউশানি করতে থাকে! 

প্রাইমারী স্কুলের বন্ধু জগা, এটা ওর ডাকনাম, ভালো নাম জগন্নাথ !  রাকেশ আর জগা একই ক্লাসে পড়তো আর জগার বোন রমা এক ক্লাস নীচে! রোগা শ্যামলা তালপাতার সেপাই এর মত দেখতে জগা আর রমা স্কুলে সবার থেকে আলাদা ব্যতিক্রমী! খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতো! রাকেশ জানে যে জগা রমা খুবই গরিব, বাবা নেই ওদের, রমা তখন সবে হয়েছে ওর বাবা এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় কলকাতা থেকে সব্জী বিক্রি করে বাড়ি ফেরার পথে! এখন ওর বিধবা মা সেই কাজই করে, তবে শরীর সাথ দেয়না বলে সপ্তাহে দু-চার দিন গ্রামের হাটেবাজারেই অল্প কিছু বেঁচে যাওয়া সব্জী নিয়ে বেচাকেনা করে! তাতে করে তিন মায়েপোয়ে খুবই কষ্টেসৃষ্টে দিনগুজরান হয়! কথাগুলো যে একেবারে মিথ্যে নয় সেটা রাকেশ বুঝেছিল যখন রমা অষ্টম ক্লাসের পর স্কুলটা ছেড়ে দিয়েছিলো আর জগা মাধ্যমিক পরিক্ষা দিয়ে! 

তারপর বেশ দীর্ঘ কিছুসময় নানান জটিল এবং সমস্যাবহুল হয়ে পরে রাকেশের জীবনে! পড়াশোনার চাপ, ঠাকুরদা, বাবাকে হারানোর মানসিক ধাক্কা কষ্ট সব এলোমেলো করে দেয়! মাঝে মাঝে অবশ্য রমার সাথে দেখা হতো! কেমন কি খবর, এমনই দু-একটা কথা, খোঁজখবর নেওয়া! ইচ্ছা থাকলেও বাড়িতে গিয়ে দেখা করা সম্ভব হতোনা!  এর কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন জগার সাথে দেখা হয় রাস্তাতে! জগা এড়িয়ে চলে যাবার চেষ্টা করলে রাকেশ কিছুতেই যেতে দেয়নি, জগার সামনে দাঁড়িয়ে তার হাতটা ধরে বলে - কিরে ; কি খবর? কোথায় গিয়েছিলি? জগা একগাল হেসে শীর্ণ বিধস্ত কন্ঠে বলে ভালো রে, তুই ভালো তো? রাকেশ জগার মুখের দিকে চেয়ে উত্তর দিতে গিয়ে লক্ষ্য করে জগার ঘর্মাক্ত পরিশ্রান্ত শ্যামলা মুখ রোদে পুড়ে কাঠকয়লা আর তার চোখদুটো লালচে হয়ে জলে ভরে উঠেছে! মুখমণ্ডলে স্পষ্ট কান্না আর চাপা কষ্টের ছাপকে লুকিয়ে হাসার চেষ্টা করছে ! রাকেশ কি বলবে ভেবে না পেয়ে যেইনা বুকে জড়িয়ে ধরেছে, জগা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো! রাকেশের চোখ দুটোও অন্তর বেদনায় ভিজে গেল! নিজেকে কোনমতে  সামলে জগা বললো - কাকু মারা যাওয়ার খবরটা আমি পাই কলকাতাতে! তখন আমি আসতে পারিনি কাজের প্রেশারে! আর তার জন্য নিজেই নিজে দগ্ধে মরেছি !  তুইতো জানিস আমাদের অবস্থা! তার উপর মায়ের শরীর আজকাল খুব খারাপ যাচ্ছে ! কি ভাবে চলবে বল? বোনটা তো মাকে দেখছে কিন্তু আমাকে তো কিছু একটা করতেই হবে? তা না হলে চলবে কি করে? তাই মা যেটা করতো মানে বাবার দেখানো পথে - কলকাতাতে সেই সব্জী কারবার! তার মানে তুই এখন কলকাতা থেকে ফিরছিস?
জগা বললো হ্যাঁর রে, এই এখন সোজা বাড়ি যাবো, তারপর স্নানটান সেরে মার কাছে একটু বসবো; দুটো কথা বলবো, গল্প করে মায়ের হাতে টাকাপয়সা দিয়ে বোন যা বানিয়েছে, তার কিছুটা মুখে দিয়ে শুয়ে পড়বো! কাল আবার ভোরভোর উঠে তৈরী  হয়ে প্রথম গাড়িটা ধরতে হবে রে! এখন যাই তাহলে? এই বলে জগা চলে গেল!

কিছুদিন পর হাটে একদিন রমা আর রমার মার সাথে রাকেশের দেখা হয়, যখন ওরা ডাক্তারখানা  থেকে ফিরছিল! তখaখোনা বাবা তোমাদের জানাশোনা কোন বিশস্ত আত্মীয়র বাড়ি রমার জন্য একটা কাজ! আমার মেয়ে বলে বলছিনা রমা আমার খু্ব সুলক্ষণা, সমস্ত কাজ ও পারবে, আর জানতো বাবা - এখন দিনকাল যা পড়েছে! ভাঙা ঘরে গরিব সোমত্ত মেয়ে রাখার কি জ্বালা ? ছেলেটা আবার সবসময় বাড়ি আসতে পারেনা! রাকেশ নির্বাক হয়ে সব কথা শুনে যখন রমার দিকে তাকাল তখন রমার অব্যক্ত চোখমুখ যেন সদ্য ফোটা ফুলের কুঁড়ি থেকে একটা পূর্ণাঙ্গ ফুল তার শোভিত সুগন্ধযুক্ত পাপড়ি বাতাসে মেলে দিয়ে নিসাড়ে নিস্তব্ধে নির্জনে একা দাঁড়িয়ে আছে সূর্যের প্রতিক্ষায় অথবা কোন দেবতার চরণতলে ঠাঁই পাবার মনরথে নতুবা বাসরশয্যায় নিষ্পেষিত আরসব অন্য ফুলের মত দলিত হওয়ার দুর্ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচার বা উদ্ধরণের পথ চেয়ে!

রাকেশ সেই মুহুর্তে কিছু না বললেও মনে মনে কথাটা যে তাকে বেশ নাড়িয়ে দিয়েছে সেটা সে বিলক্ষণ টের পেয়েছে! তাই একটু স্মৃত হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ভালোবাসা ও কুশলবিনিময় করে রমা আর রমার মাকে একটু এগিয়ে দিয়ে চলে এলো! রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক চিন্তা করে পরেরদিন সকালে মা দিদিমার কাছে কথাটা বললো! তখন মা বললো হ্যাঁ ; হতে পারে, তবে রমা কি করবে ? করবে মানে? আলবাত করবে। ওর মা তো ওর সামনেই আমাকে বলেছিলো আর ওর তাতে সায়ও ছিলো! সে ঠিক আছে; তুমি আগে বলো কার কাছে? কে তোমাকে কাজের মেয়ের কথা বলেছে? তখন মা বললো আমাকে নয় তোর দিদিমাকে বলেছে নতুনকা! কারন তোর কাকির নাকি একটা ছেলে হয়েছে তাই! দিদিমাকে রাকেশ জিজ্ঞাসা করে কিগো দিদিমা? মা যা বলছে সব ঠিক?  দিদিমা বললো হ্যাঁ, ওদের অন্য সব কাজ করার লোক আছে, শুধু একজন ভালো বিশস্ত মেয়ে চাই যার কাছে বাচছা ছেলেটাকে রেখে তোর কাকি চাকরি যেতে পারে! আর তুইতো জানিস যে তোর কাকা ব্যবসার কাজে সারাদিনই বাড়ি থাকেনা, সে কখন আসে আর কখন যায় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই! আড়াইটে মানুষের সংসার, কলকাতার মত জায়গায় পাকা সুন্দর ঘরবাড়ি, সমস্তরকম সুয়োগ সুবিধা, হাতের কাছেই সব, পয়সা ওয়ালা! রমা ওখানে কাজ করলে ওর ভালোই হবে!

পরদিন সকালের প্রাতরাশ সেরে টিউশানি পড়িয়ে জগার বাড়ি! উঠানে গিয়ে দেখলো জগার মা মাটির দালানে একটা খেজুর চাটাইতে পা খেলিয়ে বসে আছে! পাশে একটা জলের জগ ও কিছু ঔষধ-পত্র! আর রমা উঠানের এক পাশে মাটির উনুনে আধো শুকনো ডালপালা ও পাতা জ্বাল দিয়ে সম্ভবত ভাত রান্না করছে ! আর তার থেকে বার হওয়া ধোঁয়া এবং মাথার উপর প্রখর সূর্যকিরণে নাজেহাল! উনুনে বসানো মাটির উত্তপ্ত কালো হাঁড়িটাতে ফুটন্ত ভাতের ফ্যান উত্থলে পড়ছে তার শরীরের দিকে আর হাঁড়িটার গা-বেয়ে উনুনের চারপাশে! মাটির দেওয়াল আর টালির চালের বাড়িটার একদিকের অংশ ধ্বসে গেছে! পূর্বে দু-কামড়া বিশিষ্ট ঘর দালান এখন কেবলমাত্র  এক-কামড়া! সামান্য কিছু পাশের ঘরটার অবশিষ্ট রয়েছে, তাও আবার কোনমতে!
জগার মা রাকেশকে দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে একটা তালপাতার চেটাই দিয়ে বসতে বললো! আর রমাকে হেঁকে বললো দেখরে পোড়ারমুখী কে এসেছে! রাকেশ জগার মাকে আশস্ত করে যখন রমার চোখের দিকে তাকাল তখন রমার চোখদুটো টকটকে লাল আর জলে ভর্তি! যেন তপ্ত আগুন আর ধোঁয়ায় ঘেরা জীবন বাস্তবতার এক জলন্ত লাভার আস্তরণ !
রমা উনানে বসানো ভাতের হাঁড়িটাতে সরা দিয়ে মুখটা ঢেকে একগুচ্ছ তেলকস্টানি কাপড় দিয়ে ধরে কেটোতে ফ্যান ঝরাতে দিয়ে রাকেশের কাছে এসে বললো - জল খাবে? এই বলে সে একটা কাঁচের গ্লাস নিয়ে কলসী থেকে জল গড়াতে গড়াতে বললো - আচ্ছা রাকেশদা তা কি মনে করে এই গরিবের বাড়িতে তোমার পদধূলি পড়লো? কথাটার মধ্যে একটা তির্যকতা রাকেশ বেশ অনুভব করলো! তারপর একটু হাসি মুখ করে বললো - না মানে মাসিমা তোর জন্য একটা কাজের খোঁজখবর নিতে বলেছিলো, তাই সেই খবরটা দিতে এলাম! রমা জলের গ্লাসটা রাকেশকে দিয়ে উনানের জ্বালানি গুলো একটু সরিয়ে দিতে গেল! মাসিমা জিজ্ঞাসা করলো- কি কাজ, কোথায় যেতে হবে, কি করতে হবে, কেমন তারা, রাকেশদের পরিচিত কিনা!  ঠিক সেই সময় আবার সেই তির্যক শ্লেষ যুক্ত কথা রমার - তা রাকেশদা তুমি আমার ব্যাপারে খুব ভাবো তাই না? এই বলে একটা উপহাসের হাসি হেসে মায়ের পাশে এসে বসলো! রাকেশ মনে মনে চিন্তা করছে রমা অভিমানে কথাগুলো বলছে? নাকি রাগে? কিন্তু কিসের রাগ, কিসের অভিমান ? রাকেশ তো জ্ঞানত অজ্ঞানত এমন কোন কাজই করেনি বা এমন কিছু বলেনি যা রমাকে হার্ট করবে?  বা বন্ধু জগার কাছে এবং সর্বোপরি নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাবে? হঠাৎ রাকেশের টনকনড়ে রমার তালপাতার পাখার বাতাসে! একি করছো? না, একদম না রমা, আমাকে বাতাস করতে হবেনা, আমি কি কুটুম নাকি? আমার খারাপ লাগছে, লজ্জা করছে! মাসিমা মানে রমার মা বললো একটু করুকনা বাবা,  তুমি এতোখানি এসেছ! আর রমা সঙ্গে সঙ্গে বললো - বাপরে বাপ, আচ্ছা রাকেশদা তুমিও লজ্জা পাও? তুমিনা পুরুষ মানুষ! রাকেশ আবারও বিদ্ধ হলো রমার কথায়! তারপর বললো - কাজের কথা সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে! সব শুনে মাসিমা আশ্বস্ত হয়ে বললো - কবে যেতে হবে বাবা? রাকেশ বললো - মাসিমা আপনার শরীর এখন কেমন?  মানে রমা চলে গেলে বাড়ির কাজকর্ম, রান্নাবান্না কে করবে? আপনি একা পারবেন তো? জগা কিছু মনে করবেনা? ও এসব জানে তো? মাসিমা তখন বললো - ওইতো তোমাকে বলতে বলেছিলো! রাকেশ ভাবল যাক্ নিশ্চিন্ত হওয়া গেল!  তাহলে আগামীকাল আপনাদের মোড়ে রমা সকাল নটার সময় দাঁড়াবে! আমি দিদিমাকে নিয়ে আসবো!  ওকে দিদিমা নিয়ে যাবে আর কত কি মাইনা দেবে দিদিমা রমার সামনেই ঠিকঠাক করে দিয়ে আসবে! এতোক্ষন রমা সব শুনছিলো কিন্তু যেই দিদিমা নিয়ে যাবে বলেছে রাকেশ ও দুড়ুম করে বলে বসলো - না আমি যাবনা, তুমি দিয়ে এলে তবেই যাব! রাকেশ বুঝিয়ে বললো যে - কাকা-কাকিমার সাথে দিদিমার কথা হয়েছে আর দিদিমা গেলে কথাবার্তা সব ঠিকঠাক হবে, আর হ্যাঁ ওখানে কোন অসুবিধা হবেনা আমি দিদিমাকে সব বুঝিয়ে বলেদেবো! এই বলে রাকেশ উঠে পড়ে রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে! রমা কিছুটা এগিয়ে এলো রাকেশের পিছনে পিছনে এক আকাশ বুকে আনমনে মেঘের মতো!

এরপর বিভিন্ন সময়ে রাকেশ কখনো জগাকে কখনো মাসিমাকে খবর দেয় যে রমা ভালো আছে, যেটা সে মা দিদিমাদের মুখে শুনেছে! আবার কখনোবা জগার মা রাকেশের বাড়ি এসে মা দিদিমাদের সঙ্গে দেখা করে খোঁজখবর নিয়ে গেছে!
এভাবেই চলে যাচ্ছিলো দিন, জগা অনেকটা ভারমুক্ত হয়ে তার কাজকারবার সামলাচ্ছিল আর জগার মা আগের মত হাটেবাজারে যাচ্ছিলো! 

একদিন রাকেশদের বাড়ি নিমন্ত্রণ এলো অন্নপ্রাশনের! নিমন্ত্রণ পত্রে রাকেশ দেখল কলকাতার ওই কাকা-কাকির নাম! অন্নপ্রাশনের দিন সকাল সকাল রাকেশ বাড়ির সকলের সাথে রওনা দিলো কলকাতায় কাকার বাড়ি! বিশাল আয়োজন, রাকেশদেরকে দেখে রমার সেকি খুশি! রমার চোখ মুখ কথাবার্তায় তার পরিষ্কার ঝলক অনুভব করা যায় খুব সহজে! দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে এক এক করে আত্মীয়রা চলে যাচ্ছে! রাকেশ তার মা দিদিমাদের সাথে খাওয়াদাওয়া সেরে দোতলার একটা ঘরে সবে গিয়ে বসেছে একটু বিশ্রাম নেবে বলে,  ঠিক তখনই রমা এসে বললো - কিগো তোমরা এসিটাও চালাওনি? এদের পয়সায় খাবে কে? ওই তো এক রত্ন "সবে ধন নীলমণি"! মা রমাকে কাছে ডেকে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলো - কিরে রমা, এরা কেমন? তোর অসুবিধা হচ্ছে না তো? সঙ্গে সঙ্গে রমার মুখের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল !  রমাও যেন এমনই একটা কথার সম্মুখীন হতে চাইছিল! মায়ের প্রশ্নের উত্তরে কাঁচুমাচু হয়ে বললো - মাসিমা, এরা খুবই বাজে লোক, মন- ভালোবাসা বলে এদের কিছুই নেই।! শুধুই টাকা চেনে ! আর বিশেষ করে কাকিটা, খুব ফালতু, সবসময় উল্টাপাল্টা বলে, বিনা কারনে খিটখিট করে !  তোমরা হয়তো জানোইনা ; আমি আসার পর কাকি অন্যসব কাজের লোকদের ছাড়িয়ে দিয়েছে ! তাও নাহয় সয়ে নেওয়া যায়, আমি গরিব ঘরের মেয়ে, কাজকে ভয় পাইনা কিন্তু কাকি এতোটাই সন্দিগ্ধ ও বাজে প্রকৃতির যে কাকার সাথে আমার....! রমার দুচোখ বেয়ে অশ্রুজল নদীর প্রবাহের মত দুগাল বেয়ে টপটপ করে ঝর্ণার মত নীচে পরছে আর ডুকরে ডুকরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে এই কথা গুলো বলতে বলতে!  রাকেশ রমার অবস্থা ও কথাবার্তা শুনে ভিতরে ভিতরে ভীষণ রাগ ও ঘৃণায় উত্তেজিত হতে থাকলো  তার এই জঘন্য আত্মীয় কাকা কাকির ওপর! মা রমাকে আবার জিজ্ঞেস করলো - তা তোর কাকা কিছু বলেনি তোর কাকিকে? তখন রমা বললো - না না, উনিতো কাকির সাথে তেমন কথাই বলেনা, আর বললেও পারবে নাকি কাকির সাথে? একটা বৌ এর গোলাম, ভেড়া! দিদিমা তখন একটু উত্তেজিত হয়ে দাবড়ি দিয়ে রমাকে বললো - চুপ কর মাগী, সবাই শুনতে পাবে! রমা তৎক্ষণাৎ একটা হিংস্র বাঘিনীর মত গর্জে উঠে বললো - শুনতে পেলে শুনবে, আমি কি কারোর দেখে ভয় পাই নাকি? গতরে খাটি তার বিনিময়ে পারিশ্রমিক পাই, দেখো দিদা,মাসিমা, আমি আর এখানে কাজ করবোনা !  আমি বাড়ি চলে যাব তোমাদের সাথে, ও রাকেশদা তুমি আমাকে আজই তোমাদের সাথে নিয়ে চল! যত সময় গড়াচ্ছে রমা ততোই  জাপটে ধরছে আর এটাই স্বাভাবিক! কাকির একটা ডাকেও রমা সাড়া দিচ্ছেনা! সবকিছু দেখেশুনে রাগে গরগর করতে করতে রাকেশ দিদিমাকে বললো - দিদিমা তুমি এখুনি কাকা কাকির সাথে কথা বলো যে রমা আর কাজ করবেনা, ও আমাদের সাথে বাড়ি ফিরে যাবে! ওর যা কিছু আছে তা হিসাব করে দিয়ে দিতে! আমাকে যদি বলতে হয় তাহলে এই অনুষ্ঠান বাড়িতে একটা তুলকালাম কাণ্ড হয়ে যাবে কিন্তু! রাকেশের মা রাকেশকে শান্ত করে, সঙ্গে রমাও! দিদিমা ধীর পদক্ষেপে চলে গেল কথা বলতে! তার কিছুক্ষণ পরেই কাকি ছুটে আসে! দিদিমাও আসে পেছন পেছন! কাকি সবার সামনে রমাকে বলে - বাবা কি মেয়েরে তুই, কাজ করবিনা তা সেটা বললেই পারতিস! তা-বলে এমন খারাপ খারাপ কথাগুলো তুই এঁদেরকে বলতে পারলি? হ্যাঁ, আমি তোকে এক দুবার রাগের বশে উল্টোপাল্টা কথা বলেছি!  আর কোন্ বাড়িতে একটু আধটু এমনটা হয়না বল্? রমা তখন বিচ্ছিরি একটা ভঙ্গিমা করে বললো - ও- এদের সামনে এখন ভালো-মানুষ সাজা হচ্ছে তাইনা? আমি কি বুঝিনা - সব্বাইকে তো তাড়িয়ে দিয়েছো, এখন আমি চলে গেলে কে দেখবে? লোক পাবেনা বুঝলে? তোমার যা মুখের ছিড়ি, কেউই আসবেনা, আর আসলেও টিকবেনা, নিজেকে পাল্টাও! এবার কাকি একটু রেগে উত্তেজিত হয়ে বললো - জানেন মাসিমা, একদিন অফিস থেকে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে দেখি ছেলেটা আমার অন্য ঘরে একা একা খেলছে আর ও-; ওর কাকার ঘরে...! কি-? কি- বলতে চাইছো তুমি? আমি কাকার সাথে ফষ্টিনষ্টি করছিলাম? রমা বললো! পুরোটা তো তুমি দেখনি? তাহলে সন্দেহের বশে ভেবে নিলে? আর তুমি তোমার বরকে কিছু বললেনা কেন? 
এ ওকে দোষ দেয় তো ও তাকে দোষ দেয়! শেষে রাকেশ বললো - দেখো কাকি,  যা হচ্ছে তা খুবই খারাপ, তারচেয়ে বরং তুমি অন্য কোন লোক দেখে নাও! রমার পাওনাগণ্ডা যাকিছু আছে দিয়ে দাও, ও আমাদেরই সাথে চলে যাবে! আমি চাইনা এটা নিয়ে কোন খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক, লোকহাসাহাসি হোক!আর সম্পর্কটা না ভেঙে যাক্!  রাকেশের মাও রাকেশের কথায় সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল! রমাও যেন আশ্বস্ত হলো! এমতাবস্থায় কাকি দিদিমার হাতটা ধরে বললো - ঘরেতে অনুষ্ঠান চলছে, এতো লোকজন আত্মীয়স্বজন আসছে আমি একা কি ভাবে সব সামলাবো? তাই ও যদি চলে যেতেই চায় যাক্, তবে আজ নয়, দু-একদিন পর!  কাজকর্ম গুলো মিটে গেলে!  আর তোমরাও একটা দুটো দিন থেকে যাও, কতদিন পর সবাই এলে, আবার কবে আসবে তার ঠিক নেই, রমাকে নিয়ে এক সঙ্গে যেও! রাকেশ বললো - না না, আমরা থাকবো না, আমি আর মা চলে যাবো, দিদিমা থাকে থাক্! কাকি তখন মাকে  অনুনয়বিনয় করতে থাকলো! রাকেশও দেখলো মার থাকার ইচ্ছা আছে, তাই জোর না করে মা দিদিমাকে রেখে নিজে চলে এলো!

বাড়ি চলে আসার দুদিনের মাথায় হঠাৎ রাকেশের মামি, মামার সঙ্গে বাড়ির কাজকর্ম নিয়ে একটু বচসায় জড়িয়ে পড়ে! রাকেশ মনে মনে চিন্তা করে, সত্যি তো - মা দিদিমাদের এতোদিনে ফিরে পরার কথা!  তাহলে? কোন কিছু আবার হলো নাকি? এইসব সাত-পাঁচ ভেবে অস্থির হয়ে পড়লো রাকেশ! পরদিন সকালে রাকেশের চঞ্চল মন কি করবে, চিন্তায় ছটপট করছে, এমন সময় মা দিদিমা বাড়িতে এসে হাজির হলো! রাকেশ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো! দুপুর বেলা খাওয়াদাওয়ার পর রাকেশ মা দিদিমাকে জিজ্ঞেস করলো - তারপর, ওদিকের কি খবর? রমা চলে এসেছে তো তোমাদের সাথে? মা বললো - ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তবেই আমরা এলাম! যাকগে একটা ঝর মাথা থেকে নামলো! আর তুইও যেন এসবের মধ্যে আর থাকিসনা বাবা! রাকেশ তখন বললো - তুমি তোমার মাকেও সেটা বলো!

এই বলে রাকেশ চলে গেল! পরেরদিন বৈকালে হাটে যাবার পথে রমার সাথে দেখা হলো রাকেশের! তখন রমা বাড়ি ফিরছিল! রাকেশ রমাকে কিছু বলার আগেই রমা একগাল হেসে বললো - কিগো রাকেশদা, ভালো আছো? রাকেশ বললো - হ্যাঁ, তোর খবর কি? বাড়ির সবাই ভালতো? রমা বললো - হ্যাঁ, সবাই ভালোই আছে !  মা সব্জী নিয়ে হাটে গিয়েছে, আমিও গিয়েছিলাম মাকে সাহায্য করতে, তা সন্ধ্যা হয়ে আসছে তাই মা বললো ঘরে গিয়ে আলোটা জ্বেলে সন্ধ্যে দিয়ে আসতে !  দাদাও বোধহয় আজ আসবেনা !  আমাকে আবার অন্ধকারে এই পথেই আসতে হবে হাটে !  তুমি একটু যাবে আমার সাথে? রাকেশ পড়লো প্রচণ্ড ধর্ম-সঙ্কটে! রমা বললো - ও রাকেশদা অতো কি ভাবছ? আমার সঙ্গে এই ভরসন্ধ্যা বেলায় গেলে তোমার সম্মানে লাগবে? রাকেশ বললো - না - ঠিক তা নয় - তুই এক কাজ কর, এখন তুই বাড়িতে গিয়ে কাজ সেরে নে, তারপর তুই যখন আবার হাটে আসবি, দেখবি তোর কোন ভয় নেই, আমি তোর আশেপাশে কোথাও না কোথাও থাকবো! রমা যেন রাকেশের এই কথাটায় খুব আহত হলো, তারপর বিষাক্ত সাপিনীর মত ফোঁস করে বলে  উঠলো - আমি কি ভীতু? আমাকে সাহস যোগাতে এসো না! এই বলে মুখটা বাঁকিয়ে চলে গেল! রাকেশ ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে রমার চলে যাওয়া দেখতে থাকলো!
এভাবেই চলে যাচ্ছিলো দিন, মাঝে দু-একবার জগার সাথে দেখা হয়েছিল রাকেশের, কথাবার্তা বলে মনে হয়েছিল রাকেশের যে - জগারা আগের থেকে ভালোই আছে, মানে জগার ব্যবসা আগের চাইতে এখন বেশ ভদ্রস্থ জায়গায় কিন্তু জগার একটাই চিন্তা, সেটা রমা! জগাকে পাড়ার সবাই খুব ভালোবাসে আবার একটু ভয়ও করে, সঙ্গে রমাও!

একদিন রাকেশ শুনলো যে জগা তার বোন রমাকে খুবই বকাঝকা করেছে এমনকি মারধোরও পর্যন্ত করেছে! জগার মা বেচারি কেঁদে ব্যাকুল,  রাকেশের সাথে দেখা হলেই হাত ধরে কান্নাকাটি করতো! রাকেশ বুঝিয়েশুঝিয়ে, জগার সাথে কথা বলবো বলে ঘরে পাঠিয়ে দিতো! এমতাবস্থায় জগার সাথে প্রায় প্রতিদিনই রাকেশের দেখা হতে থাকলো!  রাকেশ একদিন জগাকে জিজ্ঞাসা করলো - কিরে শরীর ঠিকঠাক আছেতো? কলকাতাতে আজকাল বড় যাচ্ছিস না যে? নাকি ব্যবসার কিছু ক্ষতি হলো? জগা একটু উদাসীনতার সঙ্গে উত্তর দিলো - না-রে,  তা নয়, থাক্ ওসব কথা, চল চা খাবি? এড়িয়ে গেল জগা, সেটা রাকেশ বেশ বুঝতে পারলো!

পরেরদিন সকালে পাড়ার ছেলেরা রাস্তার মোড়ে গ্রামের কালীপূজার চাঁদা তুলবে বলে তোড়জোড় করছে! রাকেশ তখন বাজার করে বাড়ি ফিরছিল! মোড়ের মাথায় একটা Calvert তে জগা তখন বসে! রাকেশ একটু দাঁড়ালো তারপর জগাকে বললো - কি রে বসে আছিস? চল একজাগায় ঘুরে আসি! তখন জগা বললো - তোর বাজারটার কি হবে? রাকেশ বললো - ওটা বাড়িতে রেখেই চলে যাব! তখন ছেলেরা এসে রাকেশ জগাকে ঘিরে ধরে বললো - দাদা, আমাদের সাথে একটু চাঁদা তুলে দাওনা? জগা তখন বললো - রাকেশ তুই যা, বাজারটা রেখে আয়, আমি এখানেই আছি! রাকেশ বাজারটা রাখতে বাড়ি চলে গেল! সবে বাড়িতে পৌঁছে বাজারটা রেখে হাতটা ধুচ্ছে এমন সময় খবর পেল হাটের মোড়ে চাঁদা তুলছিলো যারা তাদের একজনকে একটা লরি চাপা দিয়ে পালিয়ে গেছে! শুনেই রাকেশের বুকটা ধক করে চমকে উঠলো! সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার দিকে ছুটল রাকেশ! ছুটে যেতে যেতে লোকমুখে শুনতে পায় যে জগা Accident হয়েছে তখন রাকেশ আরও জোরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে থাকে! যখন গিয়ে হাটের মোড়ে পৌঁছল তখন লোকে- লোকারণ্য রাস্তাময়! ভিড়ে থিকথিক করছে হাটের মোড়!  রাকেশ ভিড় সরিয়ে এগোতে থাকে! সেইসময় কয়েকজন বলে - জগাকে হাসপাতালে নিয়ে চলে গেছে তবে খুব খারাপ অবস্থা!  একজন রাকেশকে বললো - তুমি চলে যাবার পর জগাদা আমাদের সাথেই ছিলো কিন্তু একটা লরি আসছে দেখে যখন সবাই রাস্তার ওপর গেল তখন জগাদা সব্বাইকে রাস্তা থেকে নিচে নেমে যেতে বললো!  তারপর নিজেই রাস্তার মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে একহাত তুলে নাড়তে থাকলো গাড়িটা থামানোর জন্য! গাড়িটার গতিও কিছুটা কম হলো, কাছাকাছি এসে হঠাৎ গাড়িটা গতি বাড়িয়ে দিলো! জগাদা তখন নিজেকে বাঁচাতে পাশে সরে গেলেও গাড়িটা ওনাকেই যেন ধাওয়া করে পেটের ওপর দিয়ে চলে যায় তীর বেগে! আমারা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে জগাদাকে তোলবার আগেই ওনি নিজে থেকে ওঠে বসে জল খেতে চায় আর ভাঙাভাঙা কথায় বলে ওর প্যান্টের বেল্টটা খুলে দিতে ! সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় এক Ambassador Car তে করে নন্টে, কেলে, শ্যামদারা মহকুমা Hospital তে নিয়ে চলে যায়! জানো তো রাকেশদা, মনে হয় জগাদা বাঁচবেনা! এরই মধ্যে দুঃসংবাদটা পেয়ে রমা আর রমার মা কাঁদতে কাঁদতে আসছে! সবাই ওদের শান্তনা দেবার চেষ্টা করছে! কিন্তু মা তো -; সে এক করুণ দৃশ্য ! সবার চোখে জল! 

আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে এলো! একে-একে পাখিরা ফিরছে তাদের বাসায় সবাই যে যার! দিনের শেষ রশ্মিপাতে ডুবন্ত সূর্য! সূর্যাস্তের গোধূলি আভা সবার মুখে পড়ছে! আর তাতে করে উপস্থিত সবারই মুখমণ্ডলে একটা আলাদা যতি ফুটে উঠেছে! থমথমে আর উৎকণ্ঠার পরিবেশভেদ করে শ্যাম এসে কাঁচুমাচু গম্ভীর ভাবে বললো - জগা আর নেই! হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যেই --- শেষ কথাটা আর সে বলতে না পেরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে ! আর সেই মুহুর্তেই জগার মা অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে কেঁদে উঠে অঞ্জান হয়ে যায়! দেখতে দেখতে সবার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে ! সবাই মিলে ধরাধরি করে মাসিমার মাথায় জল ঢেলে পাখার বাতাস করে ঞ্জান ফেরায়! জগার শেষকৃত্য পরদিন শেষ হয়! গোটা গ্রামে নেমে আসে শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ! থমথমে নিঝুম নিস্তব্ধতা যেন গিলে খেয়েছে আস্ত একটা গ্রাম তথা গ্রামে বসবাসকারী সমস্ত মানুষজনকে! আর তার মধ্যে মাঝে মাঝে একটাই আওয়াজ দূর হতে কানে ভেসে আসে - ও -আমার - জগারে ---- তুই কোথায় গেলি - রে ---! 

অস্বাভাবিক ভাবে জগার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে! রমা তখন একটা পালহীন দাঁড়হীন মাঝিহীন এক নৌকা! অথৈজলে দিকভ্রান্ত একটা জলযান! সবাই সহমর্মিতা সহানুভূতি দুদিন অবশ্য দেখিয়েছিল কিন্তু তারপর?
চলতে তো তাকে হবেই! বাঁচতে তো হবেই তাকে! আর সেই সঙ্গে মাকেও দেখতে হবে! সেই মুহুর্তে রাকেশই ছিলো রমার কাছে একমাত্র উপায়! যার ওপর সে চোখ বন্ধ করে নির্ভর করতে পারে বিশ্বাস করতে পারে !  রমা করলোও তাই! আস্তে আস্তে সে রাকেশকে যথাসম্ভব আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করলো! আর রাকেশ ঠিক ততোধিক দূরে সরে যেতে থাকলো অপবাদের ভয়ে! আর তার ফলে রমা ডুবে যেতে লাগলো গভীর থেকে গভীরতম অন্ধকারে! যেখান থেকে ফিরে আসা যায় না, দেখা যায় না আলোর পথ! সেদিন রাকেশ সাহস করে এগিয়ে যেতে না পারার কারনে নিজেই সারা জীবন অনুশোচনার আগুনে ভিতরে ভিতরে পুড়তে থাকে শেষ হতে থাকে ! রাকেশ নিজেরই চোখের সামনে হারিয়ে যেতে দেখে রমাকে! না এটা রাকেশ মানে না আজও! সে ভাবে এর জন্য সে নিজেই অপরাধী! তাই আজও সে নিঃসঙ্গ একা আর সঙ্গে রমার স্মৃতি কুড়েকুড়ে দংশন করে বারবার! যেন বলে - আমার এই অবস্থার জন্য কেবলই রাকেশ - তুমিই দায়ী!  তুমি একটা ভীতু, কাপুরুষ,আমার অপরাধী! অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত তাকেই যে করতেই হবে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ।।

=====০০=====

সুবিনয় হালদার (দৌলত পুর, পোষ্ট - দিঘীড়পাড় বাজার, থানা -ফলতা, জেলা - দঃ ২৪ পরগণা,  পিন্ নম্বর - ৭৪৩৫০৩,  দূরভাষ - ৯৬৩৫৫৭৬৪১২)

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.