শংকর লাল সরকারের ছোটগল্প- পরম প্রণয়
পরম প্রণয়
শংকর লাল সরকার
কিছুতেই ঘুম আসছে না। খালি চোখে জল এসে যাচ্ছিল। কি করবে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না তৃণা। চোখ বন্ধ করলেই অনলের মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওর চোখ দুটো মনে পড়ছে। কেবলই মনে হচ্ছিল অনল তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। যেন কিছু বলতে চায়। এভাবে যে অনলের সামনে পড়ে যাবে ভাবতে পারেনি ও। মনে প্রাণে তৃণা চেয়েছিল, অনলের সামনে যেন ওকে পড়তে না হয় আর কোনদিন। কিন্তু ঠিক সেটাই হল। অনল যে পুরীতে আছে সেটা ও জানত না। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে বেসিনের কলটা খুলে চোখেমুখে ভালো করে জল দিল তৃণা। আয়নায় নিজের দিকে তাকাল। ফরসা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে। কপালের সিঁদুরের টিপটা খানিকটা মুছে গিয়েছে। তৃণা বুঝতে পারছে শরীর বেয়ে একটা কান্না উঠে আসার চেষ্টা করছে। চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সংযত করল তৃণা। ঋষি জানতে পারলে খুব বাজে ব্যাপার হবে।
ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই তৃণার ভালো লাগত অনলকে। মানে কিছু কিছু জিনিষ হয়না, মানুষ বোঝে এতে বিপদ বাড়তে পারে কিন্তু তাও এড়াতে পারে না? এটাও সেরকমই ছিল। প্রচণ্ড একটা আকর্ষন বলে ওরা দুজনে কেবলই কাছাকাছি এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন থেকে কমনরুম, ক্লাসরুম থেকে ল্যাবরেটরি সর্বত্র ওরা ছিল একে অন্যের পরিপূরক। প্রেম এমন নিঃশব্দে এসে মেরে ফেলে যে , মানুষ নিজেও বুঝতে পারেনা কখন সে আর নেই।
সকালবেলা পুরীতে পৌছে কোনরকমে হোটেলের ঘরে মালপত্র রেখেই তৃণা ছুটে গিয়েছিল সাগর সৈকতে। দুটো ছেলে মেয়ে ঘনিষ্টভাবে বালির উপরেই বসেছিল। মেয়েটির মাথায় শোলার টুপি। ছেলেটির খালি গা। তৃণা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল সমুদ্রের আরও কাছাকাছি। জলের কাছাকাছি এসে ঢালু বালির উপরে দিয়ে ঢেউয়ের দিকে দ্রুত চলতে লাগল ওর দুটো পা। যতদূর চোখ যায় মুক্ত দিগন্ত, অন্তহীন জলরাশি। একটা গাংচিল উড়ে যাচ্ছে দূরে। খুব বেশিবার ও সমুদ্র দেখেনি। তাই এবারে এসেছে সমুদ্র স্নানের ইচ্ছে নিয়ে। ঢেউতে নিজেকে ভাসিয়ে দুলে উঠতে লাগল জলের তোড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। নোনাজলে শরীর ভিজিয়ে দুহাতে যেন সমুদ্রকে আলিঙ্গন করল। সাঁতার না শিখেও কি করে যে সমুদ্রকে এত নিবিড় করে জড়িয়ে ধরতে হয়। হায় কত কিছু যে অবচেতনে থেকে যায় সমুদ্রের অতল গভীরতার মতো, মনের অজানায়। ভিজে চুড়িদার পরে বালিয়াড়ি দিয়ে একটু এগিয়ে দেখতে গেল ঋষি আর তিতলি হোটেল থেকে বেরিয়েছে কিনা। ওর চোখ দুটো খুজছিল ঋষিকে কিন্তু তখনই চোখাচুখি হয়ে গেল অনলের সঙ্গে।
তৃণার চোখদুটো গেঁথে গিয়েছিল অনলের দৃষ্টিতে। 'তৃণা! বেড়াতে এসেছিস?' কতকাল পরে কানে এসেছিল অনলের গমগমে গলা। আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল তৃণার ভিতরটা। চোখ সরিয়ে নেবার মুহুর্তে বুঝেছিল অনল স্থির দৃষ্টিতে ওর মাথার সিঁথির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সমুদ্রের বাতাসে অনলের মাথার চুলগুলো উড়ছিল। বাসি দাড়িতে জল চিকচিক করছে। শার্টের দুটো বোতাম খোলা। বুকের রোম দেখা যাচ্ছে। তৃণা কতদিন ওই রোমশ বুকে পাগলের মতো চুমু খেয়েছে। তোর বর কোথায়? অনলের গলা কি কেঁপে গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে তৃণা কোনরকমে উচ্চারন করল, ঋষি হোটেলের ঘরে আছে।
'তোর বউ' কথা আটকে গেল তৃণার। অনলের মুখের আলো যেন নিভে গেল, বলল বিয়ে করিনি। তৃণার শরীর কেমন করে উঠল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ওর বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগল। তৃণা ভাবল কেন এমন হল? অনলের সঙ্গে ব্রেকআপের পর ঋষির সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে চার বছর হতে চলল। অনলকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তৃণা প্রায় ছুটেই চলে গেল বালিয়াড়ি পার হয়ে হোটেলের দিকে। বুঝতে পারছিল পিছনে অনল একদৃষ্টে ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে।
চাঁদের আলোয় বেলাভূমি রূপালি হয়ে আছে। খাওয়ার পর জ্যোৎস্না মাখা বালিতে পা ডুবিয়ে তৃণা যেন কোন গোপন প্রেমিকের কাছে যাচ্ছে। অনেকটা পিছনে ঋষি আর তিতলি। অন্তহীন ঢেউ উঠছে আর দুলে দুলে অবিরাম অনন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। যতদূর চোখ যায়, দিগন্তজোড়া এই দৃশ্যের সামনে দাঁড়ালে মনে হয় এই জীবনে কারুর কাছে কোন কিছু প্রমান করার নেই। দিগন্ত বিস্তৃত এই অসীমের সামনে দাঁড়ালে সমস্ত মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে কত তুচ্ছ বলে মনে হয়।
চাঁদের আলোয় ভাসতে ভাসতে অনলের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হল ওদের। তৃণাই ঋষির সঙ্গে অনলের পরিচয় করিয়ে দিল। কেমন আছিস? সংসার কেমন চলছে? এমনই টুকরো টাকরা কথায় গড়িয়ে যায় বেশ কিছুটা সময়। চলে যাবার আগে তৃণা একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল অনলের দিকে। যা ঋষি অনুভব করল না, তিতলি যা বুঝল না, তা হল তৃণা আর অনলের চোখের ভাষা, যা শুধু তারা দুজনেই পড়তে পারছে সমুদ্রের গা বেয়ে নেমে আসা চাঁদের আলোয়। ঐভাষা মুখের কথার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। অনলের চোখ তৃণার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। শব্দের অতীত এক স্পর্শ! হাজার হাজার বছর ধরে যা গ্রন্থিবিহীনভাবে বেঁধে রেখেছে প্রেম-বদ্ধ নারী পুরুষকে। ঢেউএর পর ঢেউ পায়ের কাছে এসে ভেঙে পড়তে লাগল। যেন সমুদ্রই তৃণার প্রণয়ী। আসলে একটা ঢেউ আর একটা ঢেউকে সমানে মুছে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াই জীবনের পরম প্রণয়।
---------------