Click the image to explore all Offers

অভিষেক দত্তের ছোটগল্প- ঠিক স্বপ্নের মত


 

ঠিক স্বপ্নের মত

 অভিষেক দত্ত 

 

 তুই কি তাহলে আমার কোন কোথায় শুনবি না কৌশিক ? নিজের মোবাইলটা টেবিলের ওপর ফেলে দিয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে প্রশ্নটা করে সুগত। 

স্থিরদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে কৌশিক বলে, উত্তরটা তোকে অনেকবার দিয়েছি – একই কথা বারবার বলতে আমারও ভালো লাগে না। 
- তুই কি বুঝতে পারছিস না কি সুযোগ আমরা হেলায় নষ্ট করছি ! তোর একবার মনে হয় না এ থেকে আমাদের একটা ফায়দা তোলা উচিত !
- যখন সুযোগ ছিল না তখন আমরা একসাথে স্ট্রাগল করেছি, আর তার জোরেই এখানে এসে পৌঁছেছি। আজ হঠাৎ সেসব বাদ দিয়ে, স্ট্রাগল ছাড়াই… 
- হ্যাং য়োর স্ট্রাগল ! গ্লেনমার্ক ফার্মার টেন্ডারটা… 
- ওটা ভরদ্বাজ কেমিক্যালস পাবে।
- এল ওয়ানটা তোর যখন জানা আছে তাহলে আমরা সেটা কেন পাবো না মিস্টার কৌশিক ভট্টাচারিয়া, চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্নটা করে সুগত। 
- কারণ সেটা পার্ট অফ দি ফেয়ার গেম নয় তাই।
আই সি, এই বলে বিশাল জানলার কাছে উঠে গিয়ে বাইর দেখতে থাকে সুগত।আর কৌশিক শান্তভাবে গ্লেনমার্ক ফার্মার টেন্ডার সাবমিশনের ফাইলটা রেডি করতে থাকে।
বছরখানেক ধরে কৌশিকের সাথে এই ব্যাপারটা ঘটছে।প্রথমে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছিল, তারপর মাথা ঠান্ডা করে কলকাতার সবচেয়ে নামকরা মনোস্তত্ববিদের সঙ্গে দেখা করে।মামুলি কয়েকটা প্রশ্ন করে ডক্টর ঘোষ সরাসরি সমস্যার কথা জানতে চান। আধঘন্টা কৌশিকের বিবরণ শোনার পরে চোখ থেকে দামী চশমাটা খুলে সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করেন, মিস্টার ভট্টাচার্য তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আগামী এক মাস যা যা ঘটবে বা ঘটতে চলেছে সেটা আপনি গত একমাসে রাত্রিবেলা ঘুমের মধ্যে ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছেন এবং সে সবই আপনার মনে থাকে।
- হ্যাঁ         
- ইন ডিটেল?
- ইন ডিটেল।
- মেটিকিউলাসলি ?
- হ্যাঁ
- আজকের ঘটনাটা?
- হ্যাঁ
- মনে আছে ?
আবারও সম্মতিসূচক উত্তর দেয় কৌশিক।
আশ্চর্য, চশমাটা পড়ে নিয়ে হাতের কাছে থাকা একটা পেপারওয়েটকে আপনমনে ঘোরাতে ঘোরাতে ডক্টর ঘোষ বলে চলেন, অর্থাৎ আপনি আজ থেকে ঠিক তিরিশ দিন আগে ডিনার শেষ করে শুতে গেলেন, ঘুমিয়ে পড়লেন, ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আপনি আজকের ঘটনাগুলো ঠিক যেরকমভাবে ঘটছে পুরোপুরি দেখতে পেলেন, তাই তো !
- ঠিক তাই 
- অর্থাৎ আপনি আজকে এখানে এই চেম্বারে আসবেন, আমি একটা নীল রঙের বুশশার্ট পড়ে বসে থাকবো, আপনার কথা শুনে প্রথমে চশমা খুলবো আর তারপর আবার সেটা পড়ে নিয়ে পেপারওয়েট ঘোরাতে থাকবো ?
- এবং সেটা হাত ফস্কে ছিটকে আপনা পায়ের কাছে পড়বে, তারপর ড্রপ খেয়ে কোণের চেয়ারের তলায় ঢুকে যাবে। 
হুঁ, চমকে ওঠেন ডক্টর ঘোষ, আর তারপরেই পেপারওয়েটটা ওনার হাত ফস্কে পড়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা শব্দ করে ড্রপ খেয়ে ঢুকে যায় কোণের চেয়ারটার তলায়।
নিজের দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাসের ডক্টর ঘোষ সঙ্গেই উচ্চারণ করেন, আনবিলিভেবল! 
এক্ষুণি আপনার একটা ফোন আসছে, শান্ত স্বরে বলে চলে কৌশিক, তাতে আপনার অনেকদিনের আটকে থাকা কোন সমস্যা মেটার খবর পাবেন।
বলতে বলতেই ডক্টর ঘোষের ফোন থেকে সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসে। অবিশ্বাসের ভঙ্গীতেই ফোনটা ধরেন তিনি। কিন্তু ও প্রান্তের কথাগুলো শুনতে শুনতে ওনার চোখে আনন্দ, বিস্ময় সব একসাথে খেলা করে যেতে থাকে। তারপর উত্তেজিত গলায় বলে ওঠেন, কাল পরশুর মধ্যেই সবকিছু রেডি করে ফেলতে হবে, হাতে একদম সময় নেই। তারপর ফোনটা সুইচ অফ করে বলেন, পৃথা, মানে আমার একমাত্র মেয়ে একটা রিসার্চ টিমের মেম্বার। ওদের টিমটা কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করার অফার পায়। কিন্তু ইউজিসি এতদিন এ ব্যাপারে কোন পারমিশন দিচ্ছিল না। অনেক চেষ্টার পর, আজই পারমিশন পাওয়া গেছে, পৃথাদের সামনের সপ্তাহেই কেম্ব্রিজ যেতে হবে। 
এক নিশ্বাসে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কথা একজন সদ্য পরিচিতকে জানিয়ে দিয়ে একটু বিড়ম্বিত বোধ করেন ডক্টর ঘোষ। সেটা ঢাকা দেবার জন্যে শেফার্স কলমটা বের করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলেন, মিস্টার ভট্টাচার্য আপনার সমস্যার কোন সমাধান আমার কাছে তো নেইই, আমার ধারণা পৃথিবীর কোন সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছেই নেই। একটা মাইল্ড ডোজের ট্রাঙ্কুলাইজার লিখে দিলাম যাতে আপনার ঘুমের কোন ব্যাঘাত না হয়। বাই দি ওয়ে, উড য়ু মাইন্ড ইফ আই… 
- অবশ্যই মনে করবো ডক্টর ঘোষ, যদি আপনি আমার এই কেসটা কোন সাইকোলজিক্যাল ম্যাগাজিনে রেফার করেন। কারণ তাতে কাজের থেকে অকাজ বেশী হবে। ভারতবর্ষে বাবাজী, স্বামীজী আর হুজুগে মানুষ যে কম নেই আশা করি সেটা আপনার ভালো করেই জানা আছে।
নিরুপায় ভঙ্গিতে কাঁধদুটো ঝাঁকান ডক্টর ঘোষ।   
চেম্বার থেকে কৌশিক যখন গাড়ী চালিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হল তখন রাত প্রায়  সন্ধ্যে সাতটা।  চলতে চলতে পুরোন দিনের কথা মনে ভিড় করে আসে।কলেজ থেকে পাশ করে বেরোবার পরেই সুগতর সাথে পার্টনারশিপে ব্যবসাটা শুরু করেছিল। প্রায় পাঁচ বছর প্রচণ্ড পরিশ্রম করার পরে পায়ের তলায় কিছুটা জমি পাওয়া গেল। আরো বছর পাঁচেক লাগলো ব্যবসাটাকে ভদ্রস্থ একটা জায়গায় পৌঁছে দিতে। দুজেনেরই তিন কূলে কেউ নেই, আর ব্যবসার পিছনে সময় দিতে গিয়ে এখনো কেউ সংসার করে উঠতে পারেনি। কিন্তু বছর দুয়েক হল সুগত কেমন যেন ক্ষেপে উঠেছে। এগিয়ে চলার নেশায় সবকিছুকে এক লহমায় দূরে ফেলে দিয়েছে। টাকা পেতে হবে - অনেক অনেক টাকা - যা দিয়ে এ পৃথিবীর সমস্ত কাঙ্খিত বস্তুকে নিমেষের মধ্যে কিনে ফেলা যাবে। তাতে যদি নিজেকে ধ্বংসও করে দিতে হয় তাতেও কুছ পরোয়া নেহি। কিন্তু সবকিছু এক্ষুনি হাতের মুঠোয় পেতে হবে। সবাইকে ঠেলে টপকে দখল করতে হবে সাফল্যের শীর্ষচূড়াটাকে। এমনি হলে ভালো, না হলে ছলে, বলে, কৌশলে, কোন রকম নীতি নিয়মের তোয়াক্কা না করে। গাড়ী, বাড়ী, ফার্ম হাউস, ক্লাবে মহার্ঘ্য ডিনার পার্টির আয়োজক - পেজ থ্রী আলো করা এক ব্যক্তি, যার পিছনে গোটা দুনিয়া ছুটে চলেছে। কৌশিক অনেকবার চেষ্টা করেছে সুগতর মাথা থেকে এই পাগলামী ভাবনা তাড়াতে চেয়েছে। কিন্তু কোন রকম সুরাহা হয়নি। উল্টে আরও বেড়েছে। ইষ্টমন্ত্রের মত সর্বক্ষণ জপ করে চলেছে আই উইল গো টু দ্যা টপ, দ্যা টপ, দ্যা টপ। ওপরে উঠতে চাওয়াটা দূষণীয় নয় কিন্তু শর্টকাট রাস্তাতে চললে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা আছে বৈকি। আর কৌশিক একমাত্র স্ট্রাগলে বিশ্বাস রাখে - শর্টকাট তার দুচক্ষের বিষ। এখানেই দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করেছে। এরমধ্যে একদিন ঘটনাচক্রে সুগত কৌশিকের স্বপ্ন দেখার এই বিশেষ ব্যাপারটা জেনে ফেলে। প্রথমদিকে ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল - কিন্তু কৌশিকই ভুলটা করে। ছেলেমানুষের মত নিজের বাহাদুরি দেখতে গিয়ে গিয়ে সুগতকে পরপর তিনদিন শেয়ার মার্কেটের ক্লোসিং রেট আগাম জানিয়ে দিয়েছিল।কিন্তু ব্যাপারটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাওয়ার পরেই সুগতর চোখে অবিশ্বাস আর লালসা একসাথে দেখতে পেয়ে চমকে উঠেছিল। বারবার নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল। কেন এই সস্তা ছেলেমানুষিটা করতে গেল ও! কেন! কেন! কেন!   
ডাক্তার ঘোষের সঙ্গে দেখা করে আসার পরে কৌশিক ওর এই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সুগত ব্যাপারটাকে এত সহজে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। কেন ব্যাপারটাকে ব্যবসায় কাজে লাগিয়ে আরও বেশি রোজগারের ব্যবস্থা করা হবে না তা নিয়ে কৌশিকের সঙ্গে নিয়মিতভাবে তর্কাতর্কি চালাচ্ছে - বিশেষ করে গ্লেনমার্ক ফার্মার টেন্ডারটা নিয়ে রোজই বাদানুবাদ চরমে উঠছে। অথচ কৌশিক সুগতকে কিছুতেই মুখ ফুটে বলে ইঠতে পারছে না যে এক মাসে মধ্যেই ওরা সোজা পথে তিন তিনটে কোটি টাকার টেন্ডার পেতে চলেছে। 
হতাশ হয়ে ব্যাপারটাকে একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছে কৌশিক। সুগতও আজকাল তাকে এড়িয়ে চলে। অফিসে আসা আগের থেকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছ, ফলে কৌশিকের ওপরেই পুরো ব্যবসা চালানো দায়িত্ব পড়েছে।  
সন্ধ্যের দিকে হাতের কাজগুলো যখন শেষ করছিল ঠিক তখনই সুগতর ফোনটা এলো।  কৌশিক কথা বলার সাথে সাথেই ও প্রান্ত থেকে সুগতর সেই কলেজ জীবনের উচ্ছল প্রাণভরা আওয়াজ কানে এলো। 
- জানি খুব রেগে আছিস আমার ওপরে…
- হঠাৎ এ প্রসঙ্গ?
- আরে ব্যবসা চালাতে গেলে একটু খিটিমিটি কি পার্টনারদের মধ্যে লাগতে পারে না! আফটার অল আমরা তো বাঙ্গালী রে ভাই ! 
- ঠিক 
- প্লিজ, ব্যাপারটা মিটমাট করে নেওয়া যেতে পারে না ? 
- যায় তো… 
- তাহলে চলে যায় আমার ফ্ল্যাটে - একটা রয়েল স্যালুট অনেকদিন ধরে পড়ে রয়েছে!
- আমি যে ড্রিংক করে ড্রাইভ করি না তা তো তুই ভালো করেই জানিস সুগত… 
- হোপলেস! আচ্ছা নির্ভেজাল কফির আড্ডাই না হয় দেব। আশা করি তাতে তোর কোন আপত্তি নেই। 
- না নেই 
- তাহলে চলে যায়
- আসছি 
ফোনটা কেটে দেয় সুগত। মন খারাপ হয়ে যায় কৌশিকের। তারপর কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে আলমারিতে তুলে চাবি দিয়ে নিজের ব্রিফকেস থেকে পার্কার ফাউন্টেন পেন আর দামী স্টেশনারি বার করে নেয়। কাগজ কলমের ব্যাপারে বরাবরই সে খুব শৌখিন। তারপর পরিপাটি হাতের লেখায় একটা চিঠি লেখে। চিঠিটাকে খামবন্দি করে বুকপকেটে রেখে দিয়ে ব্রিফকেস নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। 
দরজাটা খুলে দিয়েই সুগত হই হই করে ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বড়ো ড্রইংরুমে বসায়।  তারপর বিশাল ট্রেতে করে কফি স্ন্যাক্স নিয়ে আসে।অবিকল একই রকম দেখতে কফি মগ দুটো দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে এটা সেই দুটোই না?
- হ্যাঁ, হ্যান্ডলুম এক্সপোতে স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রির ষ্টল থেকে তুই কিনে দিয়েছিলি আমাদের। মানে তখন জয়িতার সঙ্গে আমার ব্যাপারটা চলছিল, তুই ঠাট্টা করে বলেছিলি প্রীতি ও শুভেচ্ছা সহ দুই চাতালকে। 
- ছাড় ওসব কথা
- হ্যাঁ, এই নে তোর কফি। আচ্ছা তুই কি ব্যাপারটা নিয়ে সত্যিই… 
সুগত, কৌশিক এবার ঠান্ডা গলায় বলে, তুই ব্যাপারটাকে আবার খুঁচিয়ে তুলবি না এই বিশ্বাস নিয়েই কিন্তু আমি ওখানে এসেছি। আর আমার শরীরটাও আজ বিশেষ ভালো নেই। জ্বর জ্বর লাগছে। তোর কাছে প্যারাসিটামল হবে ?
- নিয়ে আসছি 
একটু পরেই সুগত ওষুধ নিয়ে ফিরে আসে।তারপর দুজনে চুপচাপ কফি খেতে থাকে। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। সাউন্ডবক্সের পিনটা তুলে নেওয়ার ফলে রেকর্ডটা শুধু শুধুই ঘুরে চলেছে, কোন আওয়াজ নেই।  
মিনিট দশেক পরে কৌশিক উঠে দাঁড়িয়ে বলে, শরীরটা বিশেষ ভালো লাগছে না রে সুগত, আজ চলি। বাই দ্য ওয়ে, এই চিঠিটা পড়ে দেখিস। 
কি আছে ওতে, তোর জ্ঞানবাণী, সৌগতর মধ্যমে থেকে আবার সেই কুটিল,লোভী মুখটা উঁকি দিচ্ছে, মুখে চির পরিচিত ব্যাঙ্গের হাসি। 
- না, তোর ভালোর জন্যই কিছু কথা লেখা আছে - পড়লে তোরই উপকার হত। 
- পড়ব'খন, এত তাড়া কিসের! তা তোর কি শরীর খারাপ লাগছে ?
- হ্যাঁ, হঠাৎই একটা অস্বস্তি 
মুখে একটা ক্রুর হাসি এনে সুগত বলে, ঠিক আছে আজ আর তোকে আটকাবো না। 
- চলি, ভালো থাকিস।
কৌশিক চলে যেতে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সুগত কিছুক্ষণ পাগলের মত হাসে। অনেকদিনের একটা সমস্যা থেকে আজ মুক্তি পেল সে। কৌশিকটা অবশ্য চিরকালের বোকা, তবুও যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিকঠিক ভাবে ঘটছে, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছিল না।শেষমেশ সবকিছু  প্ল্যানমাফিকই হয়েছে। এবারে ব্যাপারটা সেলিব্রেট করা যাক। ফোনে একটা বড় ডিনারের অর্ডার দেয়। তারপর টিভিটা চালিয়ে সোফায় বেশ আয়েস করে বসে। এখন প্রায় আটটা বাজে, আর আধঘন্টার মধ্যেই পুরোপুরি কাজ শুরু হয়ে যাবে। টিভির পর্দা জুড়ে স্বল্পবসনা, লাস্যময়ীরা নানারকম শারীরিক বিভঙ্গ তুলে মায়াবী জগতের হাতছানি দিচ্ছে - সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই একটু নেশা করার ইচ্ছে হল। একটু পরেই রয়্যাল স্যালুটের বোতল, সোডা, ফ্রায়েড কাজু, গ্লাস, বরফ ভর্তি কাঁচের ট্রে, টং এসব সাজিয়ে নিয়ে বসে পড়ে। নেশার ব্যাপারে সুগত চিরকালই বেহিসেবী - ইতিমধ্যেই ফ্ল্যাটে মহার্ঘ্য পানীয় ভর্তি একটা সেলার বানিয়ে ফেলেছে। 
যত্ন করে প্রথম পেগটা বানিয়ে আয়েশ করে খেতে থাকে।পানীয়টা পেটে না গিয়ে সরাসরি যেন মস্তিষ্কে চলে যাচ্ছে আর সারা শরীর জুড়ে বেশ একটা আরামদায়ক আচ্ছন্নভাব নেমে আসছে। চোখ বুজে ঝিমঝিমে আবেশ ভাবটা উপভোগ করতে থাকে সুগত, তারপর কয়েকটা ফ্রায়েড কাজু চিবোতে চিবোতে পরের পেগটা বানায়।সিগেরেটের জন্য বুকপকেটে হাত দিতে গিয়ে কৌশিকের রেখে যাওয়া খামটায় হাত পড়ে - সেটা হাতে নিয়ে চিঠিটা বার করে। তারপর আরও কয়েকটা কাজু মুখে চালান করে দিয়ে হুইস্কি ভর্তি গ্লাসটা তুলে নেয়।দৃষ্টিটা বারেবারে ঘোলাটে হয়ে আসছে কেন! বোধহয় হুইস্কির জন্য। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে চিঠিটা পড়তে থাকে।
সুগত,
আমি কোনোদিন ধারণাও করতে পারিনি লোভ তোকে এতটা অধঃপাতে পাঠাবে। যাইহোক, একটা ব্যাপার তোকে বলা হয়নি, আমার মধ্যে অন্য ধরণের আরও বেশ কিছু ক্ষমতা ডেভেলপ করেছে - যেমন টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স এইসব। দূরের কোন ঘটনা, বিশেষত সেটা যদি আমার সংক্রান্ত হয়, সেটা আমি চাক্ষুষ দেখতে পাই, সশরীরে সেখানে উপস্থিত না থেকেও। কেন আমার মধ্যে এইসব ক্ষমতা দেখা দিচ্ছে সে সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা নেই, বোধহয় এ ক্ষমতা কোন ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার না করার জন্যেই। সে যাই হোক, দিন পনেরো আগে তুই যখন সাপ্লায়ারদের সঙ্গে দেখা করার নাম করে দণ্ডকারণ্যে গেছিলি সেটা আমি আগেই জানতে পেরেছিলাম। আরও জানতে পেরেছিলাম ওখানকার কয়েকজন আদিবাসীর কাছ থেকে মোটা টাকার বিনিময়ে ওদের নিজস্ব বিষ সংগ্রহ করেছিস। এই বিষের ব্যাপারে এখনকার মেডিকেল সায়েন্স কিছুই প্রায় জানে না। আমাকে সরিয়ে দিয়ে ব্যবসাটা নিজের দখলে করার প্ল্যানটা তোর মাথায় অনেকদিন ধরেই এসেছে, শুধু সুযোগের অপেক্ষা করছিলি। টাকা দিয়ে পুলিশকেও ম্যানেজ করে ফেলেছিস, যাতে তোর দিকে কোনরকম ভাবেই কোনও প্রশ্ন না ওঠে। অবশেষে এই কফি খাওনোর অছিলায় তুই যে সেটা আমার ওপরে অ্যাপ্লাই করবি সেটা আজ দুপুরবেলা অফিস বসেই জেনে গেছিলাম।তা সত্ত্বেও তোর বাড়ীতে আমি গেছিলাম ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত না করার জন্য। যখন তুই বিষ মেশানো কফি আমাকে দিলি তখনও কিছু বলিনি। শুধু ওষুধ আনানোর অছিলায় কয়েক সেকেন্ডের জন্যে তোকে সরিয়ে দিয়ে কফির কাপ দুটো পাল্টাপাল্টি করে দিয়েছিলাম। কারণ আমার বিশ্বাস আত্মরক্ষা করার অধিকার সবারই আছে। নিজের হাতে বিষ মেশানো কফিটা তুই যখন নিজেই খাচ্ছিলি তখন অনেকবার তোকে সাবধান করে দিতে ইচ্ছে হয়েছে। মাসখানেক আগে স্বপ্নে যখন এই দৃশ্যটা দেখি তখন কিছুতেই বুঝতে পারি নি হঠাৎই কেন আমি কফির কাপ পাল্টে দিতে গেলাম, সেটা বুঝেছি দিন পনেরো আগে। তোকে আমি এখনও ভীষণ ভালোবাসি সুগত, সেই জন্য বারবার তোকে চিঠিটা পড়ার কথা বলছি। যদি তুই ঘটনাটা জেনে থাকিস তাহলে এক্ষুণি তোর ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবি - আমার ধারণা পাম্প করে স্টম্যাক ওয়াশ করে দিলে হয়তো এ বিষ থেকে বেঁচে যাওয়া সম্ভব।
বিশ্বাস কর অন্তত একবারের জন্যে হলেও আমি চাই স্বপ্নে যেটা দেখেছি বাস্তবে সেটা না ঘটে অন্য কিছু ঘটুক।
           ইতি কৌশিক       
      
--------- 
 
 
ঠিকানা: ১১/২/১, বেলেঘাটা মেন্ রোড, কলকাতা - ১০

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.