স্বপনের স্বপ্ন
রাত এগারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট। ট্রেন এখনও স্টেশনে ঢোকেনি। যাক, ট্রেনটা পেয়ে যাব ভেবে স্বস্তি হল স্বপনের। কাল সকাল দশটায় ইন্টারভিউ, এই ট্রেনটা না পেলে কি যে হতো- ভেবে মনে মনে ভয় পেয়ে গেল স্বপন। মনে মনে মা কালীর নাম করে প্ল্যাটফর্মের একটা ফাঁকা বসার জায়গা দেখে বসে পড়ল। সামনে কোলের উপর ব্যাগটা রেখে মনটাকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলো সে ।এখন রাত ১১টা ৪০ বাজে, প্ল্যাটফর্মের মাইকে এনাউন্স হলো এক্ষুনি ট্রেন এক নম্বর প্লাটফর্মে আসছে। আরেকবার ভালো করে ব্যাগের কাগজপত্র গুলোকে দেখে নিয়ে ব্যাগটাকে টেনে নিয়ে বসল যেন মনে হয় ব্যাগের মধ্যে ওর লক্ষ লক্ষ টাকা আছে ।এই ট্রেনটা প্রায় প্রত্যেকদিনই লেট করে, আজকেও এই ট্রেনটা লেট করে স্টেশনে ঢুকলো যখন, তখন প্রায় রাত এগারোটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। স্বপন আগে থেকে টিকিট রিজার্ভেশন করিয়ে রেখেছিল, নিজের টিকিটের নাম্বার মিলিয়ে সে বসে পড়লো নিজের সিটে।
এখন গ্রীষ্মকাল, বাইরে প্রচন্ড গরম।জানালার কাঁচটাকে ভালো করে উপরে তুলে এঁটে বাইরের দিকে চেয়ে বসে রইল স্বপন। কী অসম্ভব পরিশ্রম করেছে সে আজ সারাদিন, অসহ্য ক্লান্তি তার শরীরে,তবুও ঘুম আসছে না তার। রাত্রির পরিষ্কার আকাশ, তারারাও ঝিকমিক করছে; মনে হচ্ছে তারারাও তার দিকে চেয়ে আছে আর হেসে হেসে বলছে আমরাও তোমার মত সারাদিন রাত্রি জ্বলছি তবুও আমাদের বিরাম নেই জ্বলার। তুমিও তো আমাদের বন্ধু, আমাদের সাথী। স্বপন যখন এইসব ভাবছিল তখন ট্রেনটা একটা প্রবল বিকট আওয়াজ করে একটা পুল পেরিয়ে গেল, হঠাৎ যেন নিজের সম্বিত ফিরে পেল সে। সারাদিন সাইকেল করে তার হাত-পা গুলোতে অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে, একটু আরাম করে হাত-পা গুলোকে ছড়িয়ে দেবার জন্য পায়ের কেটস্ গুলো খুলে নিজের সিটের উপর একটু এলিয়ে পড়ল সে।
শরীরটাকে একটু এলিয়ে দিতেই সমস্ত চিন্তারা ভন ভন করে তার মাথার চারদিকে ঘুরতে লাগল, যেমন করে মাছিরা মিষ্টির চারদিকে ঘোরে । মনে পড়ে গেল মায়ের মুখ, যে মাকে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন কাঁদতে দেখেছে; এমন একটা দিন তার যায়নি যখন মা-বাবার ঝগড়া শুনে তার ঘুম ভাঙেনি। এক চিলতে ঘর, উপরে এসব্যাস্টসের ছাউনি। দুটি কুঠুরি, একটিতে সে নিজে আর অন্যটিতে তার বাবা। আর মায়ের কথা বলতে গেলে বুকটা কেঁপে ওঠে তার।তার মা এক চিলতে বারান্দায় কাটিয়েছে দিনের পর দিন। দিনের বেশিরভাগ সময় তার বাইরে কেটে যায় পরের ঘরে টিউশন পরিয়ে, তাই মায়ের করুণ মুখটা বেশিক্ষণ দেখতে হয় না । যতটুকু সময় ঘরে থাকে ওই নিজের ছোট্ট কুঠুরিতে কাটিয়ে দেয় বই পড়ে।
ভাবনা গুলো কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে তার, কেবলই মনে পড়ছে যদি কাল ইন্টারভিউটা ভাল হয় তাহলে মায়ের কান্না ভরা মুখটা আর দেখতে হবে না। আমাদের মত অর্থহীন লোকেদের কাছে সুখ মানে অর্থ, চাকরিটা পেলে মুঠো মুঠো সুখ কিনতে পাওয়া যাবে তখন আর সুখের হবে না। আমাদের ঘরে সুখ মানে অর্থ, অর্থ মানে সুখ- বারবার নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকে স্বপন। তাকে যেন কিছু একটা পেয়ে বসেছে ,কিছুতেই সে স্থির থাকতে পারছেনা। ট্রেন ছুটে চলেছে একটার পর একটা স্টেশন পেরিয়ে। রাতের ট্রেন গুলোর একটা সুবিধা এই যে বাইরের চারপাশটা দেখতে পাওয়া যায় না, নইলে কি যে হতো স্বপনের। বাইরের জগতটা এখন কেমন যেন অসহ্য হয়ে গেছে তার কাছে।কাউকে তার আর ভালো লাগে না,অথচ একটা সময় কত আড্ডা, বন্ধুদের সঙ্গে কত তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে । যে কোন একটা বিষয় নিয়ে তুমুল আলোচনা তাকে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তুলেছিল বন্ধুদের আড্ডায়, একদিন সে আড্ডায় না গেলে আড্ডাটা তেমন জমত না বলে বন্ধুরা মাঝে মাঝে অভিযোগ করতো তার কাছে ।
মনে পড়ে গেল মনীষাও মাঝে মাঝে এমন অভিযোগ করত - তুমি না কথা বললে কেমন যেন অসাড় হয়ে যায় পৃথিবীটা। ইদানিং সেও খুব কম কথা বলত তার সাথে, কথা বলতে ভালো লাগতো না তার। মনীষাকেও সে তো কম কথা দেয়নি! একটা ভালো চাকরি পেলেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান, তুমি আর আমি আর আমাদের সুখী সংসার; মনে মনে কল্পনা করে রেখেছিল সে। সমস্ত কল্পনাকে বাস্তবে রূপ তাকে দিতেই হবে, এরকমভাবে আর চলতে পারে না। সে মনে মনে আরেকবার বিড় বিড় করে বলে ফেলল- মনীষা, লক্ষ্মীটি আমার কথা শোনো। মাইনের প্রথম টাকাটা দিয়ে তোমায় একটা নীল রঙের শাড়ি কিনে দেবো হ্যা, নীল রঙের শাড়িতে তোমাকে মানায় ভালো। মনে পড়ে গেল নীল রং খুব প্রিয় ছিল স্বপনের ।বাইরের আকাশের দিকে তাকাতেই তার দুচোখ জলে ভরে উঠলো, রাতের পরিষ্কার আকাশ এখন ঝকঝকে নীল। চাঁদ উঠে চকচক করছে বাইরেটা। নিঃঝুম,নিস্তব্ধ পরিবেশ কিন্তু তার মন কিছুতেই কেন শান্ত হতে পারছে না, অসম্ভব ক্লান্তিও তার দুচোখে ঘুম এনে দিতে পারছে না কেন? সারারাত কী এভাবেই কাটাতে হবে? পারছে না সে, পারছে না- কিছুতেই আর হার মানাতে পারছে না তার মনকে! মনের সঙ্গে এক অসম্ভব লড়াই চলছে তার।
এইসব হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে স্বপন তার দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলো না কিছুতেই। মনে হচ্ছিল তার এই চাকরি পাওয়াটা একান্তই দরকার। যদি এই চাকরিটা সে না পায় তাহলে আবার সেই মায়ের বিষণ্ন মুখ, বাবা-মার ঝগড়া, মনীষার বিরক্তিকর মুখ - ভাবতে ভাবতেই একটা প্রবল বিকট আওয়াজ...
পরদিন খবরের কাগজের শিরোনাম মেদিনীপুরের শালবনির কাছে গোদাপিয়াশোল স্টেশনের কাছে ট্রেনের উপর মাওবাদী হামলা, ট্রেন উল্টে মৃত অন্ততপক্ষে ৩৫ জন। রাজ্য সরকার দুর্ঘটনায় মৃতের পরিবার পিছু দুই লক্ষ টাকা অনুদান ঘোষণা করেছে আর রেলের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে পরিবার পিছু ৫ লক্ষ টাকা। সেদিনের সংবাদপত্রে ঘটনাস্থলেই মৃতদের যে লিস্ট প্রকাশিত হয়েছে সেখানে আরও অনেকের সঙ্গে আছে স্বপনেরও নাম।
স্বপন, যে স্বপ্ন দেখত একটা সরকারি চাকরির,যে স্বপ্ন দেখত মুঠো মুঠো অর্থ রোজগার করার - সে এখন রাজ্য সরকার ও রেলের তরফে মোট সাত লক্ষ টাকার মালিক। যে ছেলেটা জীবিত অবস্থায় কোনদিন এত অর্থ এনে দিতে পারেনি তার পরিবারে,সে নিজের জীবন দিয়ে অনেক অনেক টাকা এনে দিতে পেরেছে। যে ছেলেটা জীবিত অবস্থায় মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি, সে অন্তত মরে গিয়েও তার পরিবারে একটু 'সুখ' এনে দিতে পেরেছে।
--------------
শিবপ্রসাদ গরাই
পোস্ট ও জেলা বাঁকুড়া
মোবাইল নাম্বার 9563778295