ছোটগল্প ।। বুদ্ধির জানলা ।। সুদর্শন মণ্ডল
বুদ্ধির জানলা
সুদর্শন মণ্ডল
অর্ক আমার সহপাঠি ।এ বছর আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষা দেব। আসলে সহপাঠি হলেও আমরা সব সময়ের বন্ধু। যদি বলেন কেমন বন্ধু? তা হলে বলি, অনেকটা জুতোর মতো। একটা ছিঁড়ে গেলে যেমন আরেকটা অচল হয়ে যায় ঠিক তেমন ওকে দেখতে না পেলে আমিও ভেজা মুড়ির মতো চুপসে যাই। আমার বন্ধু বলে বলছি না । ও সব সময় একটু উদাস প্রকৃতির । কখন যে কি বলে, আর কি করে ও নিজেই জানে না । এখন স্কুল বন্ধ বলে সারাদিন বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে । কারোর বাড়ি গিয়ে যে একটু বসে গল্প-আড্ডা দেব তার উপায় নেই । আত্মীয় স্বজনের বাড়ি গেলে তাঁরা এমন কটমট দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তাতে মনেহচ্ছে যেন আমাদের গপ করে গিলে খাবে।নোবেল করোনা ভাইরাস প্যাকেটে করে নিয়ে এসেছি তাঁদের দেবার জন্য।
আজকাল করোনা আবহে শহরটা একেবারে টমেটোর মতো হয়ে যাচ্ছে । প্রথমে শুনলাম শহরটা গ্রিন, তারপর শুনি অরেঞ্জ তারপর আবার শুনলাম রেড । এই সব দেখে মনে হছিল আমরা যেন ভিডিও গেম খেলছি । একটা লেভেল পার করছি তো স্ক্রিনে আর একটা লেভেল চলে আসছে নিমেষে।সুশান্ত আমাকে সে দিন ফোন করে বললো, চিন দেশ নাকি সারা বিশ্ব কে মাক্স পড়িয়ে ওদের মতো নাক চ্যাপ্টা বানানোর ষড়যন্ত করছে ।সেই কারনেই আকাশে বাতাসে করোনা ভাসছে।
একা একা থাকতে থাকতে ভাব -ভালোবাসা -হাসি, সব যেন শুকনো আলুর দম হয়ে যাচ্ছে। সে দিন রাস্তায় দেখি পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে অর্ক । আমি দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে বললাম,
"কি রে অর্ক, তুই এখানে !কী ব্যাপার,এই সময় ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? "
"আশ্চর্য !পৃথিবী চব্বিশ ঘন্টা ঘুরছে সে বেলায় দোষ নেই অথচ আমি একটু ঘুরতে বেড়োলেই দোষ !"
অর্কের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম । ওর জামার দিকে তাকিয়ে বললাম,
"তা না হয় হল কিন্তু এই রকম উল্টো জামা পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন শুনি? "
"বাড়িতে থাকতে থাকতে হাত পা সব জং ধরে গেছে ভাই । আর বেশি খাটতে ইচ্ছে করছে না । তাই খাটনির মাত্রাটা একটু কমালাম আরকি। "
"খাটনি !"
"হাঁ, খাটনি । মানে আজকে উল্টো জামা পড়লাম, কাল যখন এটা ছাড়বো সোজা হয়ে যাবে। আগামীদিন যখন এটাকে আবার পড়বো তখন তোরা জামার সোজা দিকটা দেখতে পাবি । ব্যাস, আমাকে আর এক্সট্রা লেবার দিতে হলো না ।"
"তারমানে তুই জামা ধুস না বল । সেই জন্য তোর গা দিয়ে কেমন মোষ মোষ গন্ধ বার হয়।"
গরুর মতো চোখ দুটো বড় বড় করে আর্ক বলল,
"ও সব ফালতু কথা যতই বল চাঁদু, একটা কথা ভালো করে ভাববে, আমি মৃতব্যায়ী হতে পারি কিন্তু কৃপণ নয় । তা ছাড়া আমি সরকারের কত টাকা প্রফিট করে দিচ্ছি সে হিসাব রাখিস? "
"প্রফিট? "ভুরু কুঁচকে বললাম ।
"হ্যা, প্রফিট "পকেট থেকে হাত বারকরে আঙ্গুল নাড়িয়ে অর্ক বলল।
আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে বললাম, "কি ভাবে? "
-"কি ভাবে আবার । ধর এক প্যাকেট ছোট্ট সার্ফের দাম দুই টাকা । এই দু টাকা জামার পেছনে খরচ করলাম না, মানে দু টাকা জমলো। "
"হ্যা, ঠিক কথা ।"ঘাড় নেড়ে বললাম ।
অর্ক ঘাড়টা একটু উপরে তুলে আর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "এখন এই টাকা জমে কোথায় গেলো? "
"কোথায় ?"
"সরকারের কাছে! "
"মানে! "ভুরু কুচকে বললাম।
"মানে, এই যে আমি দুই টাকা খরচ না করে টাকাটা বাঁচালাম, এই টাকা দিয়েই তো সরকার মানুষদের দু' টাকা কেজি চাল দিচ্ছে । আর এখন তো ফ্রিতে চাল পাওয়া যাচ্ছে।"হাসি হাসি মুখে অর্ক জবাব দিল।
"তা যাচ্ছে। "
"তা হলে ভাব ,এখন তো আমার জামা কাঁচাই যাবে না । আরে ভাই সরকার তো আমরাই। আমরা না ভাবলে ভাববেটা কে শুনি।"
আমি অর্কের মাথায় একটা গাট্টা মেরে পাশের বট গাছের নিচে বসে পড়লাম। অর্ক মাথায় হাত দিয়ে বলে,
"এটা কি হল !"
"গাট্টা মেরে তোর উর্বর মস্তিষ্কের জানলাটা বন্ধ করে দিলাম। "
"মানে! অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অর্ক।
"আরে বোকা, এই ভাবে দু' টাকা বাঁচানো যায় । কিন্তু সরকারকে সাহায্য করা যায়না । সরকারকে সাহায্য করতে গেলে ট্যাক্স দিতে হয় । বা ত্রাণ তহবিলে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হয় ।"
কিছুক্ষণ থেমে বললাম,
"তবে সরকারকে সাহায্য করার আর একটা উপায় আছে বটে... "
"কি উপায় ভাই? "
"উপায়টা অবশ্য আমার মাথাতে আসেনি , নগেন দা বলছিলো "
"কি বলছিলো, নগেন দা "
"বলছিলো, দেশের ভাড়ার নাকি শুন্য । তাই সকলে মিলে মদ খেয়ে দেশের অর্থ নীতি চাঙ্গা করা উচিত। তাই উঁনি প্রতিদিন দু -বেলা দু বোতল সালটে দেশকে শক্তিশালী করছেন। "
"বলিস কি !হাতি ঘোড়া গেলো তল, মশা বলে কত জল! শেষে কিনা নগেন দা !"
"আবার মাল খেয়ে সে কি গান.... 'লোলা লুলু কেন তোমার বয়স হয় না ষোলো, আমার কোবিড 19."
"আমার তো ভয় করছে রে। দেশের অর্থনীতি সোজা করতে গিয়ে নিজেই না লাট খেয়ে পড়ে থাকে । শেষে সোজা করতে আমাদের না মাঠে নামতে হয় ।"
"না না বেটা যাতে মাতাল, তালে ঠিক। তুই একটা জিনিস খেয়াল করেছিস, মোড়ের মাথার দোকানে মাতাল মাল কিনছে আর পুলিশ গার্ড দিচ্ছে ।"
"ছাড় ওসব কথা। চল ফুটবল খেলে আসি চল।"
"এক দম না । এই সময় খেলতে গেলে ফুটবলের ফুট মানে ঠ্যাং ভেঙ্গে বল বানিয়ে দেবে পুলিশে । এখন যে যার বাড়িতে বসেই খেলতে হবে। "
"চল, তা হলে একটু লুডুই খেলি তোর বাড়ি গিয়ে । ভর দুপুরে কেমন যেন খিদে খিদে পাচ্ছে । আমার আবার খালি পেটে ভালো বুদ্ধি খোলে না ।"
অর্কের কথা মেনে ওকে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাড়ি ফিরে দেখি মা করাইতে খাসির মাংস রান্না করছে । অপূর্ব তার গন্ধ ছাড়াচ্ছে বাতাসে । জিভের জলটা সুড়ুৎ করে টেনে ঢোক গিলে নিলো অর্ক।
সুদর্শন মণ্ডল
মদনপুর, নদিয়া
ফোন-9333121851/8293195177
ঋণ স্বীকার, ছবি- ইন্টারনেট