Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক উপন্যাস।। সোনালী দিনের উপাখ্যান - পর্ব ১২।। দেবব্রত ঘোষ মলয়

সোনালী দিনের উপাখ্যান পর্ব- ১২

 
 
দেবব্রত ঘোষ মলয়

পূর্বকথন

বাঁকুড়া স্টেশনে কৌস্তভ রাজকুমারকে নিতে আসে। হোস্টেলে পৌঁছে সুপার ও বন্ধুদের কাছে সব ঘটনার বিবরণ দেয় ও। রাতে শুয়ে শুয়ে গল্প হয় কৌস্তভের সঙ্গে। জানতে পারে কৌস্তভের দিদিরা ওই ভয়াল ভূমিকম্পের সময় আন্দামানেই ছিল। এরপর ...

পর্ব - ১২

 "গল্পটার নাম সত্যবান, বাবার ডায়েরির একদম প্রথমেই এই গল্পটা আছে" - নীল মলাটের ডায়রিটার প্রথম পাতা খুলে বলে রাজু।
"ইন্টারেস্টিং" - বলে কৌস্তভ। দুই বন্ধু দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর হোস্টেল লাগোয়া একচিলতে বাগানের উত্তর দিকের বড় আমগাছটার নীচে সিমেন্টের বাঁধানো বেদিতে বসে গল্প করছিল। ছুটির দিনগুলোয় এটা ওদের প্রিয় আড্ডাস্থল।কথায় কথায় রাজু বাবার ডাইরির কথা বলে কৌস্তভকে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও কৌস্তভ ছোট থেকেই সাহিত্যপ্রেমী। সে আগ্রহের সঙ্গে বলে - তাহলে মেসোমশাইয়ের যে কোন একটা লেখা পড়ে শোনা  রাজু। রাজু ডাইরির প্রথম গল্পটাই পড়তে শুরু করে।

সত্যবান

(সত্যি ঘটনা অবলম্বনে একটি ছোট গল্প)

মাঝে মাঝেই রিসেপসনের মেয়েটি পেশেন্টদের নাম ধরে ডাকছে। বাতানুকূল প্যাথলজি সেন্টারটির রিসেপসনের সামনে রাখা ভিজিটরদের সোফায় অপেক্ষা করতে করতে রোগা একহারা মিষ্টি মুখের কর্মব্যস্ত মেয়েটিকে একদৃষ্টে দেখতে থাকে চন্দ্রিল।
চন্দ্রিল বসু। একটি বহুজাতিক সংস্থার ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট-এর উঁচু পদে কর্মরত। স্ত্রী ও দুই বালকপুত্রকে নিয়ে জমজমাট সংসার। স্ত্রী সুপর্ণা একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রিন্সিপাল। দুই পুত্র সুহান আর বিহান ওই স্কুলেরই স্ট্যান্ডার্ড থ্রি আর ফোরের স্টুডেন্ট। বালিগঞ্জের অভিজাত এলাকায় নিজস্ব ডুপ্লেক্স। বেশ দিন কাটছিল ওদের। সুখে এবং সাচ্ছন্দে।

তাল কাটল গত মাসের মাঝামাঝি। হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ে সুপর্ণা। প্রথমে সুপর্ণার কাকার ছেলে ডক্টর সুমিত পাল-এর কাছেই দেখানো হয়। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেও শারীরিক অসুবিধার কোন উন্নতি না হওয়ায় সুমিত রেফার করেন তাঁর স্যার প্রফেসর অখিল খাসনবিশের কাছে। তিনি বাইপাসের এক কর্পোরেট হসপিটালে ভর্তি করে নেন সুপর্ণাকে। গতকাল তিনি গম্ভীর মুখে চন্দ্রিলকে নিজের সাততলার চেম্বারে ডেকে বলেন, মিসেস বসুর কয়েকটি টেস্ট করতে দেওয়া হয়েছে। উদ্বিগ্ন চন্দ্রিল জানতে চায় - কেমন আছে ও? পেশাদারি স্বরে প্রফেসর বলেন - মিস্টার বসু, আজকাল চিকিৎসাবিজ্ঞান যেমন উন্নতি করেছে, তেমনই জটিল হয়েছে হয়েছে রোগের গতিপ্রকৃতি। আগামীকাল আপনি পাশের বিল্ডিংয়ে আমাদের ল্যাব থেকে রিপোর্ট গুলো নিয়ে আসুন আমার কাছে।

এখন হসপিটালে যাওয়াটা একটা ঝকমারী। গত ছয় মাসে বদলে গিয়েছে মানুষের জীবন। টানা লক ডাউনের পর এখন আনলক চলছে। বাচ্ছাদের স্কুল বন্ধ। চন্দ্রিলের বাবা নেই। মা অনিমাদেবীর কাছে দুই ছেলেকে রেখে সাতসকালে ব্রেকফাস্ট করে নিজেই ড্রাইভ করে চলে এসেছে এই হসপিটাল কমপ্লেক্সে।

মিসেস সুপর্ণা বসু -
রিসেপসনের মেয়েটির কাছে দ্রুতপদে এগিয়ে যায় চন্দ্রিল। গম্ভীর মুখে হাতে একটি খাম ধরিয়ে মেয়েটি বলে - রিপোর্ট নিয়ে সেভেন্থ ফ্লোরে প্রফেসর খাসনবিশের চেম্বারে চলে যান স্যার।

এরপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু তা চন্দ্রিলের জীবনে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতোই। প্রফেসর জানান সুপর্ণার দুটি কিডনিই বিকল। এখুনি ডায়ালিসিস করতে হবে। মাস খানেকের মধ্যে কিডনি রিপ্লেসমেন্ট করাই পেসেন্টকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়। উইশ ইউ গুড লাক মিস্টার বসু। 
প্রথমে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রিল। স্নানঘরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তারপর মাল্টিন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ-এর পেশাদারি দক্ষতায় সামলে নেয় নিজেকে। সিদ্ধান্ত নেয় পরবর্তী পদক্ষেপের।
সুপর্ণা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছে হসপিটাল জীবন। চন্দ্রিল রোজ আসে বিকেলে মরুদ্যান হয়ে। শুধু ছেলে দুটোকে কাছে না পাবার যন্ত্রনা পাষান হয়ে চেপে বসে বুকে।
সুপর্ণা হসপিটাল থেকেই অনুমতি আদায় করে ডায়রি লেখার। মাঝে মাঝে লেখে তার মনের কথা। আজ সকালেই তার ডায়রির খোলা পাতায় লেখাগুলি পড়ে ফেলে চন্ড্রিল।


নীল বলে ডাকি আমি চন্দ্রিলকে। আমাদের বিয়ের প্রথম দিকের ঘটনা। দিল্লি থেকে PHD করছিল ও।
শেষ হতে তখন বাকি তিন মাস। আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা। ও আমাকে ছেড়ে গেল না। আমাদের পুত্রসন্তান হল, ওর PHD হল না।
এর তিন বছর পর রিসার্চের সুবাদে ও সুযোগ পায় বিদেশ যাবার। আমি তখন ওকালতি পড়ছি। আমি ওকে বলি, আমি LLB কমপ্লিট করতে চাই।  ও বিদেশ যাওয়া বাতিল করল, আমি ওকালতি কমপ্লিট করলাম।
সব সময়ে আমার খাবার পর ও খেত, যাতে আমার কম না হয়। আমি খুব ভাগ্যবান এরকম মানুষকে আমার জীবনসঙ্গী পেয়েছি।
গতকাল ও আমাকে জানায় আমার দুটি কিডনি বিকল। আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই, ভেঙে পড়ি। ও আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে ওর একটা কিডনি ও আমাকে দেবে। আমি তীব্র আপত্তি করি। ও শুধু একটা কথাই বলে - "তুমি আমাকে দুটো চারটি কিডনি দিয়েছো (আমাদের দুই ছেলের কথা বলে ও) আর আমি তোমাকে একটা কিডনি দিতে পারব না ... ... ...

চন্দ্ৰিলের দু চোখ জলে ভরে যায়। 

গল্প পড়া শেষ করে রাজু। নিমগ্ন শ্রোতা কৌস্তভ কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। তারপর বলে - এ তো অসাধারণ লেখা রাজু। আমি ডাইরির সব লেখা পড়ব। মেসোমশাইয়ের এই অমূল্য সৃষ্টি যাতে প্রকাশ পায় সে উদ্যোগ তো আমাদেরই নিতে হবে রাজু।
মাথা নেড়ে সায় দেয় রাজকুমার। তার চোখ দূর দিগন্তে .. সেখানে নীল আকাশের বুকে ডানা মেলে উড়ে চলেছে একটা চিল, নিঃসঙ্গ ...

ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.