দুই পৃথিবী
উবু উবাব
হঠাৎ লোডশেডিং হওয়াতে ল্যাপটপ থেকে মাথাটা তুললাম। সবে এপ্রিল মাসের শুরু কিন্তু গরম প্রচণ্ড রকমের পরেছে। দুপুরে খাবার খেয়ে লেখা নিয়ে বসেছিলাম, তখনই কারেন্টটা গেল। হ্যা আমি লিখি, লিখি মানে আমি একজন সাহিত্যিক। পত্রিকা, ম্যাগাজিন , ই পত্রিকা আরও অনেক জায়গায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, বেশ নামও করেছি। এর সাথে বাজারে কয়েকটা বই ও প্রকাশিত হয়েছে, আর তার থেকে যে আমার আয় ও ভালো হয়েছে, সেটা আমার এই নতুন ফ্ল্যাট দেখে বোঝাই যায়। বাড়িটা নিলাম আমার ওয়াইফ অন্তরার কথায়। ও একটা স্কুলে পড়ায়। বিয়ে হয়েছে আমার আট বছর হল। আপাতত বাড়িতে আমি একা, অন্তরা স্কুলের একটা ইভেন্টের জন্য দিল্লি গেছে। এই সময় একা একা থেকে লেখা ভালই এগোচ্ছে। আমার লেখা মূলত সামাজিক হয়। লেখার মধ্যে যতটা সম্ভব বাস্তবতা রাখি। তাতে সাধারণ এক বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দ হতাশা সাফল্য ব্যর্থতা সবই আমার কলমে ফুটে ওঠে। আপাতত একটা ম্যাগাজিনের জন্য একটা ভ্রমন কাহিনী লিখছি। একটা দ্বিমাসিক ম্যাগাজিনে ভাগে ভাগে তা প্রকাশিত হচ্ছে। তার কাজ ই করছিলাম।
বিকেল হয়ে যেতেও কারেন্ট যখন এল না, তখন একটু সান্ধ্য ভ্রমণ করতে বেরোলাম। রাস্তায় নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটছি অমনি একজন ভদ্রলোক আমাকে ডাকলেন। বাদিক থেকে নিজের নামটা একজন অচেনা গলায় শুনে সেইদিকে তাকালাম। আমার মতনই বয়স হবে।
- "নমস্কার, আপনি সাহিত্যিক দেবাঞ্জন গোস্বামী তো!"
- "হ্যা, কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনলাম না"
- " না চেনার ই কথা। আমি আপনার এক গুণমুগ্ধ ভক্ত। আপনার সব লেখা ই আমার পড়া। আপনার লেখা দক্ষিণের জানালা আমার ভীষণ প্রিয়। আহা প্রত্যেকটি চরিত্র কি নিপুণ ভাবে সাজিয়েছেন আর গড়ে তুলেছেন। লাবনীর চরিত্রটি আহা । একদম যাকে বলে আনপুটডাউনেবল।"
-"আচ্ছা আচ্ছা",
একটু হেসে বললাম, " খুব খুশি হলাম আপনার বইটি ভালো লেগেছে শুনে। অসংখ্য ধন্যবাদ"।
লেখাটা এই বছরই বেরহয় তৃণভূমি পত্রিকায়। রিভিউ মিক্সড এসেছিল। অর্থাৎ কারুর ভালো লেগেছে আবার কারুর লাগেনি। তাই সামনাসামনি কেউ প্রশংসা করছে শুনে বেশ ভালো লাগল। - "বলছি যদি কিছু মনে না করেন দু মিনিট বসে কথা বলা যায়?"
ভদ্রলোকের এই আবদারে আমি চারিদিকটা একটু পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। চেনা মুখ ও অনেক আছে। যাই হোক নাম যতই হোক মুখ চিনে কেউ এগিয়ে এসে কথা বলতে চাইছে এরকম আগে হয়নি । সুতরাং বেশ ভালোই লাগল। মনে মনে ভাবলাম সিনেমার হিরোদের মতন আমার ও ভক্ত।
বললাম , "চলুন বসি" , বলে আমিই সামনের পার্কের একটি বেঞ্চ দেখালাম।
- "আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাব! আপনি বসুন না" , বলে ভদ্রলোক নিজে ও বসলেন। আমিও বসলাম, "ঠিক আছে কোন ব্যাপার না। আপনি বলুন না!"
-" বলছি আপনি প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বা মাল্টিভার্স সম্পর্কে কি ধারণা রাখেন?"
- " অনেক থিওরি আছে শুনেছি। আমরা একা নই। আমাদের মতন আরেকটা পৃথিবী আছে, তাতে হয়ত আমার মতন ই কেউ বাস করছে, আর এই মুহূর্তে অন্য কিছু কাজ করছে। তবে এখন ও সেগুলি কল্পবিজ্ঞানের খাতেই পরে। আপনি তো আমার ভক্ত তাহলে নিশ্চই জানেন , আমি বাস্তব জীবন নিয়ে লিখি। কল্পনা, কল্পবিজ্ঞান, রূপকথা এইসব আমার সাব্জেক্ট না। সুতরাং কোনোদিনও এইসব প্যারালাল বিশ্ব বা এই সব সাইন্স ফিকশন নিয়ে সেইরকম মাথা ঘামাইনি"
- "আজ্ঞে হ্যা নিশ্চই। কিন্তু ধরুন আমি যদি বলি , আপনি যাকে কল্পনা ভাবছেন সেটি আসলে বাস্তব। আমার আপনার অজান্তেই সেটি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে থাকে!" - " হতে পারে কিন্তু আপনি এই বিষয় আমার সাথে আলোচনা করে কোনো ফল পাবেন না" - " আচ্ছা এই যে আমি আপনাকে ডেকে আপনার সাথে বসে দুটো কথা বলছি এটি আপনার কিছু অস্বাভাবিক লাগছে কি?" , ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
-"কাল্পনিক নয় এইটুকু বলতে পারি। আবার পুরোপুরি স্বাভাবিক ও বলা যায়না। আমার এক ভক্ত আমাকে ডেকে আমার সাথে কথা বলছে এই দৃশ্য তো সব সময় ঘটেনা!" - " আপনাকে আমার নামটা বললে হয়ত ভালো হবে। আমি পিনাকী মল্লিক" একটু সামনের দিকে একটা বাচ্চা দোলনায় খেলছিল সেইদিকে তাকিয়েছিলাম। নামটা শুনে ভদ্রলোকের দিকে আবার তাকালাম। নামটা আমার চেনা ই। আমার এক উপন্যাসের এক চরিত্রের নাম এটি। কিন্তু তাতে কি! এই নাম কি আর কোথাও হবেনা নাকি?
বললাম, -" কেন বলুন তো? নাম শুনে কি চেনা উচিত!"
- " আজ্ঞে সর্বরীর সংসার? আপনার লেখা উপন্যাস। তাতে শর্বরীর হাসবেন্ড পিনাকী!" -" তো আপনি কি বলছেন শুধু আপনার নাম ওই চরিত্রের সাথে মিলে গেছে বলে আপনাকে আমার চেনা উচিত? একটু ঘুরে দেখুন কত পিনাকী কত শর্বরী পাবেন।
" আজ্ঞে নাম ঠিক মিলতে পারে। সব কিছুই কি?
- " সব কিছু বলতে আপনি কি বলতে চাইছেন!"
- " বেশ আপনাকে খুলেই বলি। আমার অনুরোধ আমার পুর কথা আগে প্লিজ শুনবেন"
যদিও জানতাম কিছু অবান্তর গল্প বানিয়ে বলবে তবু কোন ক্ষতি নেই ভেবেই বললাম," বলুন শুনি। সংক্ষেপে বললে একটু ভাল হয়"
"নিশ্চই। যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বলছি। আমি এই জগতের বাসিন্দা নই। মানে আমি এক অন্য পৃথিবীর মানুষ। যাকে আমি আপনি সবাই কল্পবিজ্ঞানের জগতে প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বলে থাকি। অবাস্তব শুনতে লাগলেও এটাই সত্যি । কিভাবে এখানে এলাম তা আমি আপনাকে বলতে পারব না , কিন্তু এটুকু বলতে পারি আমার আর আপনার জীবন এক অদ্ভুত শুতো দিয়ে বাঁধা। আমার জীবনের যা ঘটনা তা সব আপনি ই নির্ধারণ করেন। আপনার লেখা সর্বরীর সংসার উপন্যাসের যা ঘটনা তা সব আমার জীবনে ওই পৃথিবীতে বাস্তবে ঘটে"
আমি একটু বিরক্ত হলাম। বললাম , "আপনার কি মাথা খারাপ? দেখুন এইসব উদ্ভব চিন্তা মাথায় যখন এসেছে এগুল লিখে ফেলুন না! কল্পবিজ্ঞান পড়ার অনেক লোক পাবেন। গল্পটা ও তো বেশ!"
- "আজ্ঞে কল্পনা নয়। আর হ্যা আমিও লিখি। আমার জগতে আমিও একজন লেখক অপনার মতনই। সর্বরী , কল্পনা, আমি, পল্টু, দিশা এরা সবাই আমার জীবনের রক্ত মাংসের মানুষ। আর তাদের নিয়ে আপনি যা লিখছেন সব বাস্তবে ঘটছে। আমার সাথে সর্বরীর ঝগড়া, কল্পনার সাথে আমার সম্পর্ক সবই বাস্তব ওই জগতে। বলতে পারেন আপনিই একরকম ঈশ্বর ওই জগতের আপনি যা চান তাই ঘটে সেখানে। তাই আপনার কাছে কিছু আর্জি বা আবদার নিয়ে এসেছি। তাছাড়া এরপর আপনিও আমার কাছে কিছু আবদার রাখতে পারেন। ওই যে বললাম আমিও লিখি। আমি ওই জগতে যা লিখি তা সব এখানে আপনার জীবনে ঘটে বা ঘটবে বিভূ বাবু !"
বিভূ এই নামটা শুনে অবাক হলাম। এই নাম আমাকে আমার ওয়াইফ ডাকে মাঝে সাঝে । আর কারুর জানার কথা না। তবে কি সে ই? এইরকম খারাপ একটা তামাশা খেলা হচ্ছে নাকি! একটু রূঢ় হয়ে তাকে কিছু বলার আগেই সে আবার বলল , " না না আপনার স্ত্রী আমাকে ওই নামটা বলেননি। তাছাড়া আপনার জীবনের বাকি অন্য ঘটনাও যা আর কারুর জানার কথা নয় , সেগুল ও আমার জানা। জানা কারণ আমিই তা লিখেছি"
প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছিলাম এবং সময়ের অপব্যবহার বলে মনে হচ্ছিল অথচ কিছু বলতে পারছিলাম না তাকে। ভদ্রলোক বলতে থাকলেন, " এই যেমন ধরুন এক বছর আগে আমদপুরে আপনি রাস্তায় হাটতে হাটতে একটি পাঁচশো টাকার নোট কুড়িয়ে পান তারপর…"
"আপনি এটা জানলেন কি করে?" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। এই ঘটনা অন্তরা কেও বলিনি। বলার প্রয়জন হয়নি। কিছু খাবার কিনে রাস্তার কুকুর দের খাইয়েছিলাম কিছুদিন ধরে।
- " ওই টাকা দিয়ে অন্তরার জন্য একটা সুন্দর শান্তিনিকেতনের ব্যাগ কেনার কথা শুরুতে লিখেছিলাম। পরে বদলে ফেলি" । আশ্চর্য! আমার এবারে আকাশ থেকে পরার অবস্থা। টাকা কুড়িয়ে পাওয়ার কথা বা কুকুর কে খেতে দেওয়ার কথা কেউ দেখে থাকতে পারে কিন্তু আমি মনে মনে কি ভেবেছিলাম সেটা এই ভদ্রলোক জানলেন কি করে!
- "আমার একটা অনুরোধ রাখবেন দেবাঞ্জন বাবু!" , ভদ্রলোকের গলায় এবারে একটা কাতর অনুরোধ শোনা গেল। এতক্ষনে তার প্রতি কৌতূহল আরেকটু বেড়েছে।
বললাম , "বলুন"
-" আমি কলকাতা ছেড়ে চাকরি করতে যেতে চাইনা দেবাঞ্জন বাবু! আমার ছেলে মেয়েদের কাছে ফিরিয়ে নিন না!"
সর্বরীর সংসারের এই লেখাটা এখন ও ছাপা হয়নি। একটা সিরিজ ই লিখছিলাম। দুটি খন্ড লেখা হয়েছে। পিনাকীর কল্পনার শহরে চাকরি হবার ঘটনা এখনও আমার ল্যাপটপে শুধু লিখে রেখেছি। প্রুফরিডের জন্য পাবলিশার কে পাঠিয়েছিলাম। তারা নিশ্চই লোকজন কে বলে বেড়াবেন না গল্প। আগের দুটি বই তো ভালোই বিক্রি হয়েছিল। এবারে তাহলে আগে থেকে গল্প বলে … - " কি ভাবছেন! আপনার কাছে আমার এটা অনুরোধই শুধু! ঠিক আছে আপনাকে একটা জিনিস দিয়ে যাচ্ছি" বলে ভদ্রলোক তার ব্যাগ থেকে একটি নীল খাতা বের করলেন। এরপর সেটি আমাকে ধরিয়ে বললেন , " এইটা একুশে জুন রাত এগারোটায় খুলে পড়বেন। তার আগে না। আমার অনুরোধটা প্লিজ রাখবেন। এখন আমি চলি"
তাকে আটকাবার জোর আমি সঞ্চয় করতে পারলাম না। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর খাতাটা খুলে দেখার অল্প কৌতুহল জন্মালেও তা দমন করলাম। নাহ দেখি না দুই মাসের মতন ই তো অপেক্ষা। তারপর নাহয় খুলব। আপাতত বাড়ি গিয়ে দুটো কাজ করতে হবে। প্রথম প্রকাশক কে ফোন করে জানতে হবে তারা সর্বরীর সংসারের নতুন স্ক্রিপ্টটা পড়েছেন কিনা। পরেরটা অন্তরা কে ফোন করে আজ বিকেলের গোটা ঘটনা জানানো।
বাড়ি ফিরে প্রকাশক কে ফোন করলাম। জানতে চাইলাম আমার লেখাটি পড়েছেন কি না। কিছু বদল লাগবে কি না!
ফোন থেকে উত্তর এল, " না দেবাঞ্জন বাবু। আপনার লেখাটা একদমই পড়া হয়নি। আসলে আমরা একটা অন্য প্রজেক্ট নিয়ে খুব ব্যাস্ত। একটা গোয়েন্দা সংকলন তৈরি করছি তার জন্য লেখা জোগাড় করে পড়তে হচ্ছে। যদি কিছু মনে না করেন আপনার লেখাটা এক দুই মাস বাদে পড়ে যদি কাজ শুরু করি?"
- "কোনো তাড়াহুড়া নেই। কিন্তু বলছিলাম আপনার অজান্তে কি কেউ মেল খুলে লেখা পড়ে ফেলতে পারে?"
- "একদমই না আপনি তো অনেক দিন ধরেই আমাদের লেখা পাঠান। আজ এরকম কথা চিন্তা করছেন কেন?"
- " নানা এমনি জিজ্ঞাসা করলাম"
- "আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন দেবাঞ্জন বাবু। আপনার লেখা ঠিকই আছে" প্রকাশক কে আর বিকালের কথা বললাম না। টেবিলের উপর ল্যাপটপটা রাখা। তার পাশেই নীল খাতাটা রেখেছিলাম। সেটা হাতে নিলাম। একটু হাতে নাড়াচাড়া করে তারপর মোবাইলটা নিয়ে অন্তরার নম্বরটায় কল করলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম পুর ঘটনাই জানাব। কিন্তু পরে ঠিক করলাম নীল খাতার কথাটা চেপে যাই। যা ভাবনা তাই করলাম। নীল খাতা বাদে সমস্ত ঘটনা অন্তরাকে জানালাম।
অন্তরা বলল, "বেশ ইন্টারেস্টিং কিন্ত ব্যাপারটা কি বলো! এটা কিন্তু একটা ডিভাইন ইন্টারভেনশন ও হতে পারে। ভগবানের ইচ্ছা তুমি এবারে একটা সাইন্স ফিকশন মার্কা গল্প লেখ। বুঝলেন স্যার?"
- "ধুর ওইসব লিখতে গেলে আমার হয়ত এক লাইন ও বেরোবে না ! বাদ দাও। পাবলিশার্স কে ফোন করে জেনে নিলাম ওদের থেকে কোথাও লেখা চলে যায়নি। তাছাড়া ঠিক ই আউটলুকে ওরা মেল পড়লে রিসিভ এলার্ট আসবে। সেসব আসেনি"
- "আচ্ছা আচ্ছা। এসব ছাড়। কিন্তু একটা কথা বল আমার জন্য ব্যাগটা কবে আনবে!" - "কি ব্যাগ?"
- "শান্তিনিকেতনের ব্যাগ! যেই টাকায় তুমি কুকুরের খাবার খাওয়ালে! যাই হোক কাজটা ভালোই করেছিলে। আই এম ইম্প্রেসেড"
- "ওহ হাহা নেব পরেরবার গেলে"
অন্তরা দিল্লি থেকে ফিরল সেই উইকেন্ডে। তারপর অনেক কাজ লেখালেখি আর দৈনন্দিন জীবনের কাজ কর্মে মিশে গেলাম। উইকলি লেখাটাও সঙ্গে চালিয়ে গেলাম।
তারিখটা একুশে জুন। এই দুই আড়াই মাসে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। অনেক ভালো খারাপ মিশিয়ে কেটেছে এই দিনগুলি। তবে আজ এক বিশেষ দিন। এক দারুন ভালো খবরের সাক্ষাৎ হলাম। অন্তরা আর আমার প্রথম সন্তান আস্তে চলেছে। সারাদিন বাইরে ঘুরে খাওয়া দাওয়া করে এই আনন্দ উদযাপন করলাম। রাতে ঘরে ফিরে অন্তরা শুয়েপরার পর ল্যাপটপটা অন করে লিখতে গিয়ে তারিখটা চোখে পরল। আজ ই তো সেই নীল খাতাটা খুলে পড়ার কথা! এতদিন সব কিছুর মাঝে নিজেকে বিরত রেখেছিলাম ওই খাতার লেখা পড়ার থেকে। খুলে পাতা গুল উল্টোলাম। বেশ সুন্দর হাতের লেখা। ভাবলাম আর যাই হোক লোকটা নিজে লিখে থাকলে তার হাতের লেখার প্রশংসা করতেই হয়। সরিয়ে একদম শেষের পাতাটা খুলে পড়তে শুরু করলাম। দেখি একুশে জুন ই কেন আমাকে লেখাটা পড়তে বলল।
"আজ অনেকদিন বাদে একটা অসাধারণ দিন কাটাল , দেবাঞ্জন। একটি বেশ নামকরা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে অন্তরার সব প্রিয় চাইনিজ ডিশ খেয়ে এল" লেখাগুল পড়তে পড়তে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। বিস্বাস হচ্ছিলনা আমার। আজ তো আমিও অন্তরার সাথে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। এরপরের লাইন গুল পড়ে আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। তাতে অন্তরার প্রেগন্যান্সির কথা লেখা আছে। এসব কি ! কি করে সম্ভব? এরপর আগের সব পাতা গুল ও পড়লাম। এক একটা পাতার লেখা আমার বিস্ময় আরও বাড়িয়ে তুলল। এপ্রিল মাসের সেই দিনের পর থেকে যেইসব উললেকযোগ্য ঘটনা আমার বা আমার পার্শবর্তী কারুর জীবনে ঘটেছে প্রত্যেকটি সেই খাতায় লেখা। অন্তরার স্কুলের রিপোর্টকার্ড হারানো, ওর নতুন চাকরি, আমার অসুখ ওর চাকরি ছাড়া সব। একবার নয় দুবার নয় বার বার প্রায় গভীর রাত পর্যন্ত লেখা গুল পড়ে চললাম। যা যা লেখা তা সব ই ঘটেছে এই কদিনে। আর শুধু তাই নয় সবার নাম তারিখ হুবহু এক।
রাতে আর অন্তরা কে ঘুম থেকে তুললাম না। সকালে উঠে তাকে সমস্ত কথা বলতে আর ডাইরিটা দেখাতে তার অবস্থা ও আমার মতন ই হল। সে বলল , " কিভাবে দেখা করল জানো! মানে তুমিও তো পার সেরকম!" সেই দিন বিকালে অকস্বাত দেখা হয়েগিয়েছিল ভদ্রলোকের সাথে। ভাবলাম একুশে জুন তারিখটা যখন সে ই লিখেছে তাহলে হয়ত এবারে নিজেই আবার দেখা করতে আসবে কয়েকদিনের মধ্যে। তা সেগুড়েবালি। একদিন দুদিন তিনদিন চারদিন পাঁচদিনের দিন আর সহ্য হল না। কিভাবে তার সাথে দেখা করব তা নিয়ে ভাবতে থাকলাম। ইন্টারনেট ঘেঁটে প্যারালাল ওয়ার্ল্ড , আইনস্টাইন রোজেন ব্রিজ , কৃষ্ণগহ্বর আরও অনেক কল্পবিজ্ঞানের তথ্য পড়ে চললাম যদি কিছু সূত্র পাওয়া যায়। এমন কি পুরানে এর কিছু তথ্য আছে কিনা তার ও খোঁজ করলাম, কিছু লাভ হল না। আসা যখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম , সেরকম এক সময় নিজের ল্যাপটপটা খুলে মেল চেক করতে গিয়ে সেন্ট বক্সে একটা মেল চোখে পড়ল । সর্বরীর সংসার তৃতীয়। মেলের সাথে যুক্ত ফাইলটা খুলে পড়লাম, আর সাথেই অনুমান করলাম কি ঘটেছে। ওয়ার্ড ফাইলের চার নম্বর পাতার শুরুতে আমিই লিখেছিলাম, এবারের বর্ষায় পিনাকী এক জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। যখন টাকা পয়সার এত টানাটানি তখনই এই অসুস্থতার কারনে চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দেয়। তাড়াতাড়ি লেখাটা বদলে ফেলি। পিনাকী কে সুস্থ হতেই হবে। তাকে আমার সাথে দেখা করতেই হবে। এরপর আর বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ঠিক দুই দিন বাদে তার সাথে আবার দেখা। সেই বিকাল বেলা। অন্তরা তখনও স্কুল থেকে ফেরেনি। ভদ্রলোক আসার কিছু মিনিট আগেই কারেন্টটা চলে গেল। দরজায় টোকা পরতে কী হোল থেকে তাকে দেখে দরজা খুললাম। আজ ঘরে বসেই কথা হবে।
সে দেওয়ালে টাঙানো , তিব্বটি এক পোর্ট্রেট দেখে বলল , " বাহ ভালোই মানিয়েছে। কল্পনার থেকে বাস্তবে আরও ভালো লাগছে"
আমি তাকে বললাম, " আপনার আসার অনেকদিন অপেক্ষা করলাম পিনাকী বাবু" "এখন নিশ্চই বুঝে গেছেন কেন আস্তে পারছিলাম না। অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সুস্থ করে তুলবার জন্য"
- "কি যে বলেন! ধন্যবাদ তো আমার আপনাকে দেওয়া উচিত। কদিন বাদে আমার সন্তান আস্তে চলেছে! দাঁড়ান মিষ্টি তো নেই এখন, অন্তত একটু শরবত খান ।"
শরবত নিয়ে এসে আবার বসলাম। সে বলল , " আমি আমার পুর আবদার বলার আগে আপনার কিছু চাহিদা থাকলে বলতে পারেন, দেবাঞ্জন বাবু। যা চাইবেন তাই লিখব আমি" অনেক্ষন ধরে ভাবলাম আমি। অনেক কিছু চাইবার কথা আগেও ভেবে রেখেছিলাম আমি। অন্তরাও কিছু বলে রেখেছিল। কিন্তু তাও তখন ওইখানে লোকটার সামনে বসে সেইসব বৈষয়িক আবদার বলতে একটু মুখে আটকে গেল। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম, "নাহ পিনাকী বাবু থাক। আপনি আমার জীবনে অনেকটা ভগবানের মতন। আমি অতটা গভীর ঈশ্বর বিশ্বাসী না কিন্তু এটুকু জানি আপনার ভূমিকা অনেকটা সেইরকমই। যা ই প্রার্থনা করব, তাই পেয়ে যাব। আমি সেটা চাইনা। আমার এই যে জীবনের অজানা আনন্দ, দুঃখ কষ্ট ঝামেলা সব নিয়ে চলতেই ভালো লাগে। আমার কোন আবদার নেই পিনাকী বাবু। তাছাড়া একজন লেখক হয়ে আরেকটা লেখক তার বইতে কি লিখবে সেটা আমি বলে দেব, সেই মানুষ আমি নই। তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার আবদার গুলি বলে যান আমি সেগুল নিশ্চই রাখব" পিনাকী বাবু উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে বললেন, " আমাকে একটু আলিঙ্গন করবেন? আর কিছু চাইনা। ঠিকই বলেছেন দেবাঞ্জন বাবু, জীবন কে জীবন বানায় তার অনিসচয়তা, সর্ব সুখ না" আমি তার সাথে হাত মিলিয়ে আলিঙ্গন করলাম। যাওয়ার আগে সে বলল , " যাওয়ার আগে শেষ অনুরোধ টুকু রাখবেন? আপনার বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে দুয়ার্স এর একটা অংশ আছে বোধহয়। সেটা কোনো ভাবে এখন বদলে ফেলতে পারবেন?খুব উপকার হয়। অন্তত আমি যাতে সেই ঘটনা চিরকালের মতন ভুলে যেতে পারি!" আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। সে উঠে চলে গেল।
-------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
---------------
ঠিকানা - পি-১০০, লক্ষ্মী নারায়ণ রোড, দম দম ক্যান্টনমেন্ট, কলকাতা-৭০০০৬৫
ফোন - ৮১০৬৯৪৩৫০৯
daarun hoyechhe
উত্তরমুছুন