মাঝেরহাট লোকাল টা বিকেল সাড়ে চারটায় ধরলে, তাও ভিড়টা একটু কম থাকে। বিরাটি স্টেশনে নামার সময় ধস্তধস্তি করতে হয় না। মহিলাদের কম্পার্টমেন্টে বেশ আলাপ হয়ে গেছে অনেকের সাথে। ওহ! আমার পরিচয় দিই সবাইকে।আমি ফেরিওয়ালি কাম বিজনেস উইম্যান। যেহুতু আমার কোনো ঝাঁ চকচকে দোকান নেই, তাই আপামর জনতা আমাকে ফেরিওয়ালি বলে। আমার বর আমাকে গ্র্যাজুয়েট হতে সাহায্য করেছে, তাই একটু হলেও নিজেকে সন্মান দিতে শিখেছি। সেই বেআইনি ভাবে ১৫ বছর বয়েসে,বাবা গেঞ্জি কারখানার এক শ্রমিকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। সবাই বলেছিল বর যা বলবে তাই করবি। ফুলশয্যার রাতে কত ভয় আমার। হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে দেবতা পেলাম।
জানতে পারলাম উনি ডিসটেন্স এ মাস্টার ডিগ্রী পড়ছেন। বারো ভাই বোন, বাবা,মা, পিসিকে নিয়ে সংসার চালাতে আমার বাবার থেকে অনেক পণ নিয়ে বিয়ে করেছেন। শুনে খুব রাগ হলো।আমি কি বিক্রি করার জিনিস? এরা কি মানুষ? শুনেছি লেখা পড়া জানা মেয়েরা দেয় এই সব বরে দের জেলে ঢুকিয়ে।
আমায় ভুল প্রমাণ করে ,ওনার ভিতরের দেবতা তুল্য মানুষটা প্রকট হয়ে বলে উঠলো
'জানি তোমার সাথে অন্যায় হয়েছে। কিন্তু অভাবের সংসারে আমার কাছে আর কোনো রাস্তা ছিলোনা। পণ নেওয়া আইনত দণ্ডনীয়। আমাকে ক্ষমা করে দিও।'
আমি ত হাঁ হয়ে দেখছি ওনাকে। পুরুষ হয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইছে।
'তোমার কি স্বপ্ন আছে বলো? আমি সর্বস্ব দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করবো'।
মাধ্যমিক দেওয়ার বড়ো সাধ ছিল আমার। মুখ ফুটে বলতেই ,আজ আমার সার্টিফিকেটের সংখ্যা গ্র্যাজুয়েট অবধি এসেছে। চাকরি আমি করতেই পারতাম, কিন্তু আমার স্বামীর কাপড়ের বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্নকে সত্যি করার দায়িত্ব তো আমারও। কারখানা থেকে যেদিন ছুটি পায়,সেদিন হাতিবাগান স্টল দেয়। বাকি দিন গুলো এই মাঝেরহাট লোকেল, দত্ত পুকুর লোকাল, মাতৃভুমি লোকালে আমি শাড়ী,সালোয়ার,কুর্তি, ছেলেদের গেন্জি বিক্রি করি।আমার পরিশ্রম জলে যায়নি।
অফিস ফেরত দিদিরা প্রায়শই আমার থেকে জিনিস কেনে। বেশি বিক্রি হয় দুর্গা পূজার আগে আগে। কারোর বিয়ে বাড়ি পড়লে, মা লক্ষ্মী আমার উপরে কৃপা করেন। আমার বাজার যাতে মার না যায় ,তাই ইমিটেশনের গয়নাও তুলি দিদিদের জন্য।
এরমই একটি দিনে,এক নতুন দিদি উঠেছেন। ট্রেজারী তে চাকরি করেন। মাঝে মাঝে এই দিদিদের দেখলে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে মনের ভেতর প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু যেই ওকে ভাবি, তখন আর স্বার্থপর হতে পারিনা। ওর পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত আমার। ও চাপায় নি।কোনদিন চাপায় নি। আমাকে মানুষ মনে করেছে।আমার ইচ্ছাকে সন্মান দিয়েছে। কটা মেয়ে পায় এ সম্পদ?
এক-দুদিন পরে ঐ দিদির সাথে আলাপ হলো। তবে আজ অবধি কিছু নিলনা।
বর্ষাকালে ব্যবসা মন্দা যায়। তাও চেষ্টা করতে থাকি। প্রচণ্ড বর্ষার একটি দিনে ঠিক করলাম মঝেরহাট লোকাল ধরে বাড়ি ফিরে যাবো। আপ-ডাউন করব না।
সেদিন ঐ দিদি আসেনি। বাকি দিদিদের কাছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার জিনিস না কেনার কারণটা জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরটা আমাকে একটি শিক্ষা দিলো।
দিদির স্বামী স্কুলের টিচার,তবে দিদির কোনো স্বাধীনতা নেই। গরীব বাড়ির মেয়ে বলে উঠতে বসতে কথা শুনতে হয়। তাই দুটি সন্তান, সংসার, চাকরি নিয়ে সে হিমসিম খায়। মা-বাবার একটি মাত্র সন্তান। বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য হাজার কষ্ট হলেও চাকরি টা ছাড়তে পারে না।
তার স্বামী মনে করেন, বিয়ে হোয়ে গেলে,বেশি 'বাবা,বাবা' নাকি করতে নেই। নিজের জন্য দুটো জিনিস কিনলে, শ্বশুর বাড়িতে চায়ের টেবিলে,দুপুরে ভাত খাওয়ার টেবিলে, রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত, গান্ধীজির ছবি আঁকা ও আরবী আই অনুমোদিত কাগজটিকে,সন্মান করার প্রণালী, ইণ ল'জরা, শেখাতেই থাকেন।
এই ঘটনা তে আমি অন্তত এটা জানলাম যে পতি মানেই পরমেশ্বর নয়। পতি দেবতার মতন কাজ করলে ,তাকে ঈশ্বরের আসনে বসাতে কোনো দ্বিধা হয়না।আগে ভাবতাম আমার বরটা ঐ বস্তিতে সবার থেকে পড়াশুনো বেশি জানে বলেই একটু অন্যরকম। কিন্তু দেখছি শুধু পড়াশুনো দিয়ে বিবেক বুদ্ধি জন্মায় না।ওটা ঈশ্বরের দান।
------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
ঈশ্বরের দান খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনছোট বড় অণুগল্পটি অসাধারণ।