Click the image to explore all Offers

গল্প ।। উদ্ভাবনী উৎস ।। পারিজাত ব্যানার্জী

উদ্ভাবনী উৎস

পারিজাত ব্যানার্জী 

   

 "পৌলমা, তাহলে সে কথাই রইল।"
খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে হাসে পৌলমা। তারপর আলতো করে ঘাড় নেড়ে বলে ওঠে, "বেশ!"

***

নাহ, আমার এই গল্পটা এখানেই ঠিক শুরু নয়। শুরু ওর সাথে আমার এই কথোপকথন হওয়ার ঠিক তিন বছর সাত মাস তেরো দিন আগে যখন পৌলমা, মানে ধরা যেতে পারে আমাদের এই গল্পের একমাত্র নায়িকা নিজের ডিগ্রীদের মোটা ফাইলটা কোনোরকমে গুছিয়ে নিয়ে হাজির হয়েছিল আমার এ বাড়ির দোরগোড়ায়। তবে সে কথায়ও যাওয়ার আগে এই মেয়েটিকে আমাদের আরও ভালোভাবে একটু জেনে বুঝে শুনে নেওয়া বোধহয় উচিত, না শুধু গল্পের খাতিরেই নয়, একটি আদ্যোপান্ত চরিত্রের মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করানোর তাগিদেই। মুখ্য ভূমিকায় যে মুখটি বারবার ভেসে উঠবে আমাদের চোখের সামনে, তার সঙ্গে এক অঙ্গে গা না ভাসাতে পারলে এই উদ্ভাবনীর বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের আর করবার কিছুই থাকবে না।

তা যাকগে, যে কথা বলছিলাম। তা পৌলমাকে আমি চিনি, উম, প্রায় বছর আষ্টেক হল। আমাদের এই বেথুয়ানগর কলেজে সচরাচর কোনও মেয়েকে তার আগে পদার্থবিদ্যা নিয়ে অনার্স নিতে দেখিনি। না, মানে, আমি ঠিক মেয়েদের ছোট করছিনা, তবে, আমাদের দেশে বিশেষ করে এই শহরতলি অঞ্চলের মেয়েদের একেবারে নিজের চোখে দেখা, বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করতে উৎসাহ কেউ দেয়না। হয় ইংরাজি, নয়তো ইতিহাস বা খুব বেশী হলে জুলজি, বোটানি - ব্যস, এতেই তারা সন্তুষ্ট। কোনরকমে কিছু একটা পাশ দিয়েই তারপর বিয়ের পিঁড়ি নাতো সরকারি পরীক্ষা দিয়ে একটা চাকরি বা শিক্ষিকা, টিউশানি,এইসব। আমাদের এই সাধারণের দেশের মেয়েদেরও খুব সাধারণই চাহিদা কিনা। তা, তাদেরই বা দোষ দিই কি করে বলুন? আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই যেখানে মেয়েদের ঠিক কোন কোন বিষয় পারদর্শী হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করে রেখে দিয়েছে বরাবর, "ও বাবা, অঙ্ক, ফিজিক্স...এসব আবার মেয়েরা পারে নাকি! তার চেয়ে হাতের কাজ শিখুক রান্না শিখুক বরং" বুঝিয়ে এসেছে আপামর বাঙালিজাতি সবসময় নিজেকে, সেখানে ছোট ছোট মেয়েগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিটাই যে ছেলেগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবে এতে আর আশ্চর্যের কি।

বাদ দিন। যা বলছিলাম, আমাদের পৌলমা কিন্তু বরাবরই এইসব নিয়মরীতি থেকে বিপরীতধর্মী পথেই হেঁটেছে। তিন বড় বড় দাদা আছে ওর।অনেকটাই বড় তারা বোনের থেকে। তাদের সাথে তাই ঠিকমত সখ্যতা কতখানি গড়ে উঠেছে কোনোদিন বা তার চেষ্টা কেউ কোনোদিন করেছে কিনা, সত্যি আমার জানা নেই। মেয়েটির মা ভাগ্যও খারাপ। তার জন্মানোর সময়েই মারা যান তিনি। বাবাও ব্যস্ত মানুষ। বড় রাস্তার মোড়ে বিশাল একটা গাড়ির শোরুম রয়েছে তাঁদের। তার সাথে পুরনো ভিন্টেজ গাড়ির মেরামতি, কেনাবেচা - এসবও চলে। মানে, বলতে চাইছি, সেরকম কারও আদর ভালবাসা মেখে যেহেতু বড় হয়নি আমাদের পৌলমা, তাই বাদবাকি আর পাঁচজন মেয়ের থেকে সে স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ আলাদা একজন, স্বতন্ত্র হয়ে উঠে থাকবে, তাই না? তবু তাই বলে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে কলেজে আমার পদার্থবিদ্যার ক্লাসে টুপ করে কিন্তু মেয়েটির তেমন সহজে আবার ঝরে পড়ার কথাও নয়। বাপের দেখবেন, টাকা পয়সা থাকলে ছেলেগুলোরই পড়াশোনা হয়না, তো - কিন্তু, ওই যে, আগেই বললাম, পৌলমা অন্য ধাতুতে গড়া। তার কাছে বিজ্ঞানের থেকে বড় ভালোবাসাই বলুন বা জেদ বা ইচ্ছে বা হুজুগ, তাদের স্থান আগেও ছিল না, হলপ করে বলতে পারি, আজও নেই।

মেয়েটাকে যে খুব ডাকাবুকো মার্কা দেখতে শুনতে, তেমনও কিন্তু নয়। সাধারণ চেহারা। গায়ের রঙ একটু চাপাই হবে, কোমর অবধি একটা লম্বা সরু বিনুনি। আজকালকার মেয়েরা তো কত ধরণের জামাকাপড় ও পরে। পৌলমাকে কিন্তু সবসময় দেখেছি খুব সাধারণ সুতির শাড়িই পরতে, সব জায়গায়। কান গলা খালি, চোখে মুখে কোথাও রূপচর্চা বা মেক আপের কোনও প্রলেপও নেই। কিন্তু ধরুন, কোনও নতুন কিছু থিওরি নিয়ে ক্লাসে আলোচনা হচ্ছে, বা কোনও অ্যানালিসিস কি কিছু নিয়ে কোনও অলটারনেটিভ খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে, হঠাৎ করে দেখতাম, এই সাধারণ পৌলমাই কিরকম যেন নিমেষের মধ্যে দপ করে জ্বলে উঠত।
 ওর তখনকার চোখের ঔজ্জ্বল্য আর  ব্যক্তিত্বের প্রকাশের নিরিখেই মনে হতো যেন আলাদা করে প্রতিটি পরীক্ষায় দশ নম্বর বেশী দিব্যি দিয়ে দেওয়া যায়।

হ্যাঁ, আমার এই সারা জীবনব্যাপী শিক্ষকতার ফলে পৌলমার মতো কম ভাল ছেলেপুলে তো দেখিনি, কিন্তু তফাতটা আসলে বোধহয় ছিল অন্য জায়গায়। পৌলমা শুধু মেধাবী নয়। ও বিজ্ঞানটাকে ভালবেসে নিজের জীবনের প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গ হিসেবে ধারণ করে নিতে পেরেছে। সেখানে বাদবাকিরা পড়াশোনা করেছে প্রতিযোগিতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে। এখন তো আবার দেখি সারাজীবন সায়েন্স পড়ে অনেকেই আবার এমবিএ করে বড় বিদেশী কম্পানিতে কোনও হনু হয়ে তেল সাবান বেচছে। না, মানে, করতেই পারে, তবে তার জন্য বিজ্ঞান বা কলা - কোনটাই আগে পড়ার মানে কি তাই না?

সত্যি, আমি বড্ড সরে যাচ্ছি মূল গল্প থেকে তাই না? আসলে এসব সাহিত্য টাহিত্য লেখার তেমন অভ্যাস নেই তো আগে। তাই কথায় কথায় এরকম বেলাইন আমি প্রায়ই হয়ে যাই। ভুল ত্রুটি একটু মার্জনা করে হলেও লেখাটা ধৈর্য ধরে একটু পড়ে নেবেন কেমন? আসলে, পৌলমাকে নিয়ে আমার না লিখলেও নয় জানেন। এভাবে  যে আমার কোনও ছাত্রী আমার জীবনের পটভূমিকাটাই পালটে দিতে পারে কোনোদিন, স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

তো যা বলছিলাম। পৌলমা আমাদের কলেজের সবথেকে মেধাবী ছাত্রী। কোনোদিন তেমন প্রথম না হলেও (যেটা আমার কাছে বরাবরই ভীষণ আশ্চর্যের ঠেকেছে, মনে হয়েছে, ইচ্ছে করে বুঝি ফাঁকি দিয়ে গেল মেয়েটা, কিন্তু কাকে?) মাস্টার্স এর ফাইনালে শুধু কলেজ নয়, বেথুয়ানগর শহর নয়, গোটা পশ্চিম বঙ্গের প্রথম দশজনের মধ্যে ও অনায়াসেই নাম তুলে নেয় নিজের। এরপর ওকে নিয়ে আমার আশা বেড়ে গিয়েছিল ঠিকই। ভেবেছিলাম, বাকিদের মতো ও ও বুঝি এবার বিদেশে পাড়ি জমিয়ে পিএইচডি করার পথে এগোবে। স্কলারশিপ তো পাবেই  পৌলমা। আর না হলেও বাবার যা পয়সা, তাতে এ মেয়ের ভারতবর্ষ থেকে ব্রেন ড্রেন হওয়া আর আটকায় কে। ভুল ভাঙল একদিন সাতসকালে, আমার তেতলা বাড়ির দোরগোড়ায় ঘনঘন বেলের কর্কশ আওয়াজে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠায় অবশেষে। হ্যাঁ, এখান থেকেই ভণিতা ছেড়ে আমার আসল গল্প শুরু।

***** 




বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে একাই থাকি আমি আমার এই এতো বড় পৈত্রিক বাড়িটাতে। চুয়াল্লিশ বছর বয়স থেকেই তার উপর আবার আরথারাইটিস ধরেছে পায়ে। তাই দোতলার শোওয়ার ঘর থেকে নামতে ওইদিনও সময় লেগেছিল বইকি। এতো সাত সকালে কার এতো তাড়া, ভাবতে ভাবতেই সামান্য বিরক্ত হয়েই দরজাটা খুলেছিলাম। হয় দুধ-ওয়ালা রামকিঙ্কর হবে, নয় কাজের মাসি সাবিত্রী, এই ভাবছিলাম। সামনের বাড়িতে একটা মাতালও থাকে, গজেন তার দুই বখাটে বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে... ওদের কারও বদমাইশি কিনা সেটাও মাথায় খেলেছিল একবার। কিন্তু সত্যি বলছি, স্বপ্নেও ভাবিনি, ওইখানে ওইসময় পৌলমা এসে দাঁড়াতে পারে আমার বাড়ির সদর দরজায়। চিরকাল দেখে আসা শান্ত বুদ্ধিমতী মেয়েটিকে ওই একবারই সারা জীবনে বড় দিশেহারা লেগেছিল আমার। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম একেবারে।

থতমত খেয়েই জিজ্ঞাসা করেছিলাম মনে আছে, "আরে, ত-তুমি? এতো সকালে? তা আমার বাড়ির ঠিকানাটা ...?"

সারা মুখমণ্ডলে ঘামের একটা আস্তরণ জমেছিল পৌলমার। সেটা বাঁ হাতের চেটো দিয়ে সামান্য মুছে নিয়ে আমার কথার খেই ধরেই বলে উঠেছিল সে, "হ্যাঁ, ওই ক্লাসের অনির্বাণ তো এ পাড়াতেই থাকে জানতাম। ওর কাছ থেকেই জোগাড় করলাম আপনার বাড়ির এই ঠিকানাটা। আর এই পাড়াতে তো এতো পুরনো এতো বড় বাড়ি আপনারই আছে। অসুবিধে হয়নি তেমন। আসলে স্যার, আমার একটা চাকরির বড় দরকার। এখনই। হরিহরকাকাই পাঠালেন আমায় আপনার কাছে। বললেন, আপনার উদ্ভাবনী রিসার্চ সেন্টারে কিছু না কিছু ঠিক জুটে যাবে আমার।"

পৌলমাকে আপাদমস্তক দেখলাম এবার আমি ভালো করে। হাতে গোলাপি রঙের একটা বাঁধানো ফাইল ধরা। মেয়েটার ঠিক পিছনেই ওর হালকা নীল রঙের শাড়ির আড়াল থেকে উঁকি মারছে একটা ঢাউস সুটকেস। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কোনরকমে একটা ঢোঁক গিলে বলতে পেড়েছিলাম শেষমেশ বেশ মনে আছে, "হরিহর? কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা! ভিতরে এসো আগে। একটু বসো। জিরিয়ে নাও।"
 
বলতে দ্বিধা নেই আজ আর, পাঁচ বছর ধরে পৌলমা আমার কলেজেই পড়াশোনা করলেও সেইদিন বুঝলাম প্রথমবার, কলেজের সীমিত জানাশোনার প্রেক্ষাপটে কাউকেই পুরোপুরি চেনা আসলে কখনই যায় না। আমার লাল বড় মেহগনি কাঠের কারুকাজ করা সোফাটায় বসে সামান্য জল খেয়ে এরপর ওর বলা সমস্ত কথা আমার আজও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জমে রয়েছে মনের অন্দরমহলে। 
আমার সারা জীবনের যাবতীয় শিক্ষার চেয়েও যার মূল্য ব্যাপ্তিতে অনেক বৃহৎ হলেও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেইদিন সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়েই আমিও তাই অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিলাম আমার উদ্ভাবনী রিসার্চ সেন্টর ও সংগ্রহশালার দায়িত্ব যদি কাউকে কোনোদিন বিশ্বাস করে দিতেই হয়, তবে তা এই স্ফুলিঙ্গটিকেই।
 সেদিনের ওর পুরো কথাটা আমার এখানে মনে হয় পৌলমার নিজের জবানীতেই নথিবদ্ধ হওয়া ভালো, ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। মানবতার উত্থানের জন্যই।

****

ছোটবেলা থেকেই আমি বুঝতাম, আর পাঁচজন আমার বয়সী ছেলে মেয়ের থেকেই আমি ভীষণ ভাবে আলাদা। আমার বাড়ির সামনের পার্কটায় কম বাচ্চা তো আসত না। খুব খুঁটিয়ে তখন থেকেই পর্যবেক্ষণ করতে শিখেছিলাম আমি। তবু, ওই বাকিদের সঙ্গে আমার তফাতটা যে ঠিক কোথায়, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না। আমাদের নিজের বাড়িতে জ্ঞানত কোনও মহিলা বা মেয়েকে আমি দেখিনি। থাকার মধ্যে আছেন শুধু আমার, মানে যাকে ওই আর কি, বাবা বলি, তিনি, আর তিন দাদা, যারা কেউই কোনোদিন বিয়ে করেননি, করবেনও না। আর আছেন আমার হরিহরকাকা, যিনিই মোটামুটি ভাবে সামলে রেখেছেন আমাদের পুরো বাড়িটা আর তার সদস্যদের। আমি একরকমভাবে তাঁরই কোলে পিঠে বড় হয়েছি বলা যায়। আমার দাদাদের সঙ্গে সেরকম কোনও সম্পর্কই প্রায় নেই আমার। তাঁরা তিনজনেই আমার থেকে বয়সে অনেকটাই বর। সবচেয়ে যিনি ছোট, মৃণালদা, তা, তিনিও, হ্যাঁ, প্রায়, আঠারো উনিশ বছরের বড় তো হবেনই আমার থেকে। সারাদিন তিনজনেই ব্যবসা নিয়েই পরে রয়েছেন। বাড়িতে শুধু আসেন রাতের বেলা, খেতে আর শুতে। আর বাবা, হ্যাঁ, তিনি বাড়িতেই থাকতেন পুরো সময়টা ঠিকই, তাঁর নিজের কাজের একটা আলাদা জায়গা ছিল আমাদের বড়বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট একটা বাগান ঘেরা বাংলোয়। সেখানে তাঁর অনুমতি ছাড়া আর সকলের যাওয়ার নিষেধ ছিল। তাই তাঁকেও খাবার টেবিল ছাড়া আর খুব একটা পেতাম না আমি। এই পুরো আয়োজনটার মধ্যে যে কোনও অসঙ্গতি আছে, তাই জানতাম না অনেকদিন অবধি। জানেন, সারা বাড়িতে কোথাও আমার মায়ের একটা ছবিও ছিল না। 'মা' জিনিসটা যে ঠিক কি, সেটাই জানতাম না যদি কোনোদিন হরিহরকাকা আমায় না বোঝাতেন আর বলতেন মনে রাখতে সব সময়। কাকার কাছেই শুনেছিলাম আমায় জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে আমার মা। কিন্তু এটা পরে অন্য কাউকে বললেই সে বা তারা যেভাবে 'আহা উহু' করে, বা করত, আমি কেন বুঝতাম না, সেইরকম কষ্টটা কিছুতেই অনুভব করতে পারতাম না। আমার মনের মধ্যে না বুঝেই একটা থিওরি খাড়া করেছিলাম অবশ্য, একটা কিছু মেশিন থাকে যাকে সবাই 'মা' বলে - তা সেই মেশিনটার কিছু যান্ত্রিক গোলযোগে তা বিগড়ে গিয়ে থাকবে, বা হয়তো expiry ডেট পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ব্যবহার করার ধকল সহ্য করতে না পেরে সেটা বিগড়ে যায় আমার জন্মের পর, এতে কষ্ট পেয়ে কি হবে, আরেকটা বানিয়ে নিলেই হল! ঘটনার গুরুত্বটাই ধরতে পারতাম না কিছুতেই।

কিন্তু সমস্যাটা যে এই ছোট ছোট না বুঝতে পারাগুলোর থেকেও অনেক বেশী তা বুঝলাম ক্লাস ফাইভে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর। তার আগে অবধি বাড়িতেই আমার সমস্ত পড়াশোনা চলছিল হরিহর কাকার কাছে।

স্কুলে গিয়ে বাকি আরও দশজনের সাথে প্রথম সরাসরি মেলামেশা করে বুঝলাম আমার মধ্যে কোনোরকম কোনও আবেগের অভিব্যক্তি বলেই কিছু তৈরি হয়নি কখনও। আমার হাসি, কান্না, রাগ, অভিমান - কিছুই ভিতর থেকে আসে না। হ্যাঁ, অনুকরণ করে খুব তাড়াতাড়ি আমি বাইরের বহিঃপ্রকাশটা তুলে ফেলতে পারি ঠিকই কোনও না কোনও রেফারেন্স পয়েন্ট ধরে, তবে ব্যস, ওইটুকুই। কিছুতেই সেটা আমার স্বাভাবিক ছন্দে কোনোরকম কোনও নাড়া দেয় না। আমি যেন চলাফেরা করতে পারা একটা পাথর। আমার কোনও বাসনা জাগে না।

অবশ্য পড়াশোনা করতে বরাবরই আমার ভীষণ আগ্রহ। ওই একটা জায়গায় সবচেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করি আমি। নানান বিষয়ে জানতে বুঝতে অন্য অনেকের থেকে আমার আগ্রহ বেশী। খুব তাড়াতাড়ি আত্মস্থও করে নিতে পারি সব। বাড়িতে থাকাকালীনই যা শিখেছিলাম, স্কুলে গিয়ে তার চেয়ে আলাদা বা নতুন কিছু শিখলাম না। অদ্ভুত লাগত, একই জানা জিনিসগুলো বাকিরা রোজ পড়ে কেন, আর তাদের একঘেয়ে ওইসব পড়ানোই বা হয় কেন? মনে আছে এরকমই একদিন ভীষণ বিরক্ত হয়েই বাবাকে খাওয়ার টেবিলে বসেই বলে ফেলেছিলাম, "আমি আর কাল থেকে স্কুলে যাবো না।"

স্পষ্ট মনে আছে, হরিহর কাকা সবাইকে তখন রোজকার মতো খাবার পরিবেশন করছিলেন। সচরাচর টেবিলে খেতে বসে কেউ কথা বলত না কাজের কথা ছাড়া। তাই কিছুটা চমকে গিয়েই তাঁর হাতে ধরা গরম ঝোলের বাটিটা আরেকটু হলে হাত ফসকে পরে যাচ্ছিল। কোনমতে সামলে নিয়ে সব ভুলে তাকালেন আমার দিকে। ইশারায় বোধহয় চুপ করতেও বলেছিলেন, কিন্তু যা হওয়ার ততক্ষণে তো হয়েই গিয়েছিল, তাই না?

আমার তিন দাদাও খাওয়া থামিয়ে এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল। শুধু সবচেয়ে শান্ত ছিলেন বাবা। এরপর সেদিন আর কেউ কোনও কথা বলেনি। নির্বিঘ্নেই শেষ হয়েছিল খাওয়াদাওয়া। হাত ধোওয়ার পর বুঝলাম, সব ঠিক নেই। যদিও খুব শান্ত গলাতেই বাবা আমার কাছে এসে আমায় তাঁর সঙ্গে বাগানবাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন, তবু সবটাই যে ভীষণ অস্বাভাবিক, সেটা বুঝে নিতে খুব একটা দেরি হয়নি আমার। তবু, যেহেতু ভয় নামক কোনও আবেগ চট করে কাজ করে না আমার, তাই কিছু না বলেই আমি ওনার সঙ্গে গিয়ে দাঁড়ালাম ওনার অতি সাধে গড়ে তোলা নিভৃত সেই গবেষণাগারে।

দোতলা ছোট্ট বাড়িটা। লক্ষ্য করে সেই প্রথম দেখেছিলাম, কেমন ভাবে বাগানের সাথে ক্যামোফ্লাজ করে মিশিয়ে তৈরি বাংলোটা। বাড়িটার মাথার উপর সবুজ লতানে গাছের ছাউনি, এমনকি দেওয়ালের রঙগুলোও হালকা সবুজ ও বাদামীর মিশ্রণে গড়া। বাড়িটায় ঢুকতেই নীচের তলায় বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। আর কেমিস্ট্রি ল্যাবের মতো সার দিয়ে সাজানো প্রচুর বিকার ও রঙবেরঙের মিক্সচার। কিছু না ভেবেই ফস করে প্রশ্ন করে বসেছিলাম, "এইখানে কি হয়? আমাদের গাড়ির ব্যবসার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।"

হেসেছিলেন বাবা। মাথায় আমার সেই প্রথম হাত রেখে বলেছিলেন, "তুমি বুদ্ধিমতী। ঠিকই ধরেছো, ওই ব্যবসা আমাদের পৈতৃক। তাই টেনে যাচ্ছি। আর ওটা জনসমক্ষে চলতে থাকলে আমাদের এতো প্রতিপত্তি নিয়ে কারও কোনও প্রশ্নও থাকবে না। বলতে পারো, সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যই আমাদের ওই ব্যবসা। ছেলেদের ব্যস্ত রাখতেও তো কিছু একটা চাই, তাই ভাবলাম চলুক না, ক্ষতি কি?"

এরপর আর বেশী কিছু বললেন না বাবা। সোজা আমার হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়েই উপরের তলায় চলে গেলেন। একটা কুচকুচে কালো রঙের ঘরের মধ্যিখানে সেখানে রাখা ছিল একটা ছোট্ট চেয়ার। কোনও ঘরের যে কেউ অমন কালো রঙ করতে পারে, তার আগে আমার ধারণাতেই আসেনি কোনোদিন। যেন সমস্ত আলো শুষে নিচ্ছে সেই কালচে দেওয়ালগুলো। বাবা আমার হাত ধরে ঘরের মাঝে রাখা ওই লাল চেয়ারটায় বসিয়ে দিয়ে সব আলো নিভিয়ে দিলেন হঠাৎ করে। শুধু ফ্ল্যাশলাইটের মতো ঝকঝকে একটা আলো এসে পড়ল আমার মুখে। আর সেই আলোর তীব্রতায় আমি যেন সাময়িক ভাবে পুরো অন্ধ হয়ে গেলাম। আমাদের জীবনের সাথে এই আলোর সূত্র যে কতখানি জরিয়ে পেঁচিয়ে আছে, সেইদিন প্রথম টের পেয়েছিলাম। আর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বড় হয়ে এই আলোকে চিনতে বুঝতেই আমি পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ব। তবেই হয়তো পারব এই অন্ধকারকে চিরতরে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে কোনোরকম কারও সাহায্য ছাড়াই।

বাবার সমস্ত কথা ভেসে আসছিল যেন বহুদূর থেকে কোনও লাউড স্পিকারের মাধ্যমে। কিন্তু ওনাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কোথাও। জানিনা, সেই সময় আমার প্রথম কখনও ভয় করেছিল কিনা, তবে এইটুকু বুঝেছিলাম, এসব যা ঘটছে, তা আর অন্য কারও সাথে হয় না। হওয়া উচিতও না।

সে রাতে প্রথম যেন আমার বাবা আমায় চেনার চেষ্টা করছিলেন তাঁর নানা ধরণের প্রশ্নের মাধ্যমে। দৈনন্দিন জীবনের সাথে এতটা ব্যতিক্রম এর আগে কখনও হয়নি আমার। অবাক লেগেছিল। কোনও সন্তানকে তার বাবা এইসব জিজ্ঞাসাও কখনও আদৌ করে কি?
-"কখন ঘুমাতে যাও?"
-"সকালে উঠে সূর্য বা পাখি দেখলে কি ভাবো? কেমন অনুভূতি হয়?"
-"তোমায় কেউ তিরস্কার করলে কি করতে ইচ্ছে হয়?" ইত্যাদি। না, 'স্কুল যেতে কেন চাইছি না, এ বিষয়ে সেদিন বাবা আমায় কোনও প্রশ্ন করেননি। সব শেষে শুধু জানতে চেয়েছিলেন, "তোমার আমায় বিষয় কি ধারণা? কখনও মনে হয়েছে কি আমি কে,কি, কেন?"

খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিলাম, "নাহ, তেমন কিছু তো না। হরিহর কাকা বলেন তুমি আমার বাবা - আমার জন্মদাতা। তোমার সম্মান করতে হবে তাই - এটুকুই। আলাদা করে তো কিছু সেরকম ভাবিনি।"

কিছুক্ষণ এরপর সব চুপচাপ। টুঁ শব্দটি নেই। আমি এদিক ওদিক তাকাতে থাকি যেকোনো শব্দের আশায়। ওরকম পরিস্থিতিতে কোনোরকম পিন পড়ার শব্দও মন কে নাড়া দেয়। তবে সেদিন পিন পড়েনি। বেশ কিছুক্ষণ পর শুধু ভেসে এসেছিল দীর্ঘশ্বাস। "হুম, বুঝলাম। আর ঠিক এই কারণেই, তোমার স্কুল পছন্দ না হলেও তোমায় ওখানে যেতে হবে। পড়াশোনা নিয়ে ভেবোনা। শুধু অন্যদের ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবে, দেখবে, বুঝবে তাদের হাবভাব। জানার চেষ্টা করবে তারা কেমন করে পৃথিবীটাকে দেখে। চেষ্টা করবে বোঝার তার কতটা তুমি নিতে পারছ। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা। আমি জানি হরিহর তোমায় যা শেখায়, শিখিয়েছে বা ভবিষ্যতে শেখাবে, তাতে কোনদিনই তুমি ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হবে না। কিন্তু আমি চাই না তা হোক। তাই আজকের পর থেকে তোমার দায়িত্ব প্রশ্নপত্র পেলেই তার সব উত্তর না দেওয়া। হয় ছেড়ে আসবে, নয়তো ভুল করবে কোথাও কোথাও। নাতো অহেতুক সবার নজর তোমার উপর পড়বে। আমি তা চাই না।"

-"কিন্তু হরিহর কাকা যে মিথ্যেকে প্রশ্রয় দিতে মানা করতে বলে! এটা মিথ্যে না?"

-"না। এটাকে আত্মরক্ষা বলে। মনে রাখবে, কেমন? আর তাছাড়া এ বাড়িতে প্রশ্ন করার বা কোনও মতামত জানানোর অধিকার শুধু আমার। হরিহর নিশ্চয়ই এটাও তোমায় শিখিয়েছে, তাই না?"

বাবার কথার অন্যথা এরপর আমি করিনি। যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি তা পালন করতে। তাতেও অনেকসময় যদিও স্কুলে প্রথম হওয়া আটকাতে পারিনি। না চাইতেও অনেককিছু তো হয়। হরিহর কাকা যে সত্যিটাকে আঁকড়ে বাঁচতে শিখিয়েছেন ছোটবেলায়,তাকেও বা পুরোটা ভুলে যেতাম কি করে? চোখের সামনে প্রশ্নপত্র আসলেই উত্তর খোঁজার চেষ্টায় অনেক সময় নিজের ভুলে বুঁদ হয়ে গেছি। সামলাতে পারিনি। কখনও প্রথম হয়ে গেছি ক্লাসে, কখনও স্কুলে, কখনও আবার গোটা জেলায়, বা এইবার যেমন হল, পুরো রাজ্যে সপ্তম হলাম।

সময় সময় ফেরত যেতে হয়েছে আমায় ওই কালো ঘরে নিত্য নতুন পরীক্ষা দিতে। এই একটা জায়গাতেই আমার উত্তর দেওয়ার কোনও উৎসাহ থাকত না লক্ষ্য করলাম। ভয় কাকে বলে না জানলেও প্রতিবার ওই অন্ধকারে থেকে বেরোলেই মনে হতো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। অজানা কোনও তীব্র আবেগ আমাকে যেন ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে যেত একেবারে। পরের দিকে এমন হল, আমি ওই বাংলো-বাড়িটা থেকে বেড়িয়েই হরহর করে বমি করে দিতাম। কিছুতেই সামলাতে পারতাম না। হরিহর কাকা উৎকণ্ঠিত হয়ে পরে বিড়বিড় করতেন খালি, "না না, লক্ষণ তো ভালো নয়। এভাবে তোকে তোর মায়ের মতো চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখতে আমি কিছুতেই পারব না।"

কলেজে ভর্তি হওয়ার পর অবস্থার যদিও কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। নিজের ইচ্ছেদের প্রাধান্য দেওয়ার সেই আমার শুরু। নিজের পছন্দের বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা শুরু করলাম। ডুবে গেলাম এইসবেই। কলেজের পাশাপাশি পৃথিবীর বাদবাকি বড় বড় যা যা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, প্রতিটা জায়গা থেকে নানা ভাবে সমস্ত সিলেবাস জোগাড় করে সব জেনে ফেললাম। বাড়িতে নিজের ঘরেই ছোটখাটো একটা গবেষণাগারও খুললাম নিজের অনুসন্ধিৎসু মনের সব প্রশ্ন সন্ধানের উদ্দামতায়। বাবার কাছে ব্যাপারটা পুরোপুরি চেপে গেলাম। হরিহর কাকাই মানা করলেন। এবার ইচ্ছে ছিল পাশ করে পুরদমে গবেষণার কাজে মন দেবো। কিন্তু এতসব করেও শেষ রক্ষা আর হল কই? বাবা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে বসলেন আমায় কিছু না জানিয়েই। তাই, একরকম বাধ্য হয়েই পালিয়ে এসেছি আমি আপনার কাছে স্যার!

****

পৌলমার কাছে এতটা একনাগাড়ে শোনার পর মনে আছে সেদিন সকালটাই কেমন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল আমার চোখের সামনে। বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিলাম আমি। পৌলমাও দেখছিলাম চোখ বন্ধ করে জিরিয়ে নিচ্ছে সামান্য। অবশেষে বেলা বাড়ার সাথে সাথে ঘরের ঠিক মাঝখানটায় গোল করে রোদ্দুর এসে পরায় বুঝেছিলাম এবার কিছু একটা বলতেই হবে আমায়। অনেক ভেবে শব্দ কটাকে সাজিয়ে যত্ন করে রেখেছিলাম ওর সামনে। "আমি বুঝতে পারছি মা তোমার ভিতরে কি চলছে। সত্যিই পুরোটাই ভীষণ অদ্ভুত। কিন্তু পৌলমা, যাই হোক, উনি তোমার বাবা। ওনার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলো। তুমি এখন স্বাবলম্বী। তোমার অমতে উনি জোর করে কিছু করতে পারেন না। তোমার মেধার এই সমাজে কতখানি প্রয়োজন, আমার বিশ্বাস ওনাকে ঠিক করে বোঝালে নিশ্চয়ই বুঝবেন উনি। যতই অন্যরকম হোন না কেন, উনিও তো বিজ্ঞানী।"

মাথা নেড়েছিল পৌলমা। "আপনি ভুল করছেন স্যার। আমার বাবা সমাজের নয়, নিজের ভালোটুকুই শুধু দেখে এসেছেন বরাবর। আর বাকি রইল বাবা মেয়ের সম্পর্ক? আসলে কতকটা অভ্যাসেই এখনও ওনাকে বাবা বলে ডেকে চলেছি আমি। এবার বোধহয় থামা দরকার।"

ওর গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে আমি বাধ্য হয়েছিলাম শিহরিত হতে। চমকে উঠে বলেছিলাম, "মানে?"

হেসেছিল পৌলমা। ক্লান্তির হাসি। বেদনার। দুঃখের। সব হারানোর সে হাসি। অথচ মেয়েটা যে বলল, ওর মধ্যে কোনও আবেগ কাজ করে না? "মানে, হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমার জিন আর ডি এন এ তৈরি করতে ওনার অংশ যতটুকু দরকার তা নেওয়া হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আমার মায়ের দিকের সিন্থেটিক জিন, ডিম্বাণু ও জরায়ুর প্রভাবই আমার মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে বেশী। প্রতিটা জীবনের উৎসই যে মায়েদের শরীর ছুঁয়ে গল্প লেখে, বেড়ে ওঠে তার শরীরের গন্ধ মেখেই, তাই না স্যার?"
 
- "সিন্থেটিক? কি বলছ তুমি?"

- "মানে, আমি পুরোটা মানুষ নই স্যার। বাবা বাদে ওই বাড়ির আর কেউই আমরা প্রকৃত মানুষ নই।


 কৃত্রিম ভাবে বাবার ওই ল্যাবে তৈরি হয়েছিল আমার সিন্থেটিক শরীরের সেই মা, সর্বজয়া। তাঁকে বা হরিহর কাকাকে আপনারা হয়তো রোজকার ভাষায় রোবট বলবেন
 তবে আমার কাছে রোবটের চলতি এই সংজ্ঞাটা ঠিক পরিষ্কার নয়। একই পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছিলেন আমার মা ও হরিহরকাকা। যদি তাঁরা সত্যিকারের আর পাঁচটা রোবটের মতো হতেন, তাহলে তো তাঁদের মধ্যে কোনও আবেগ থাকার কথা নয়। অথচ যতবার আমার মায়ের কথা মুখ ফুটে বলেছেন হরিহর কাকা, নিজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হারানোর যন্ত্রণায় আমি নিজে দেখেছি, কেমন করে চোখে জল এসে গেছে ওনার। কিন্তু আমার মাকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন এই বাবা নামক প্রাণীটি, আমি জন্মানোর সময়ে যাঁর হঠকারিতায় সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যান তিনি - কই, তাঁর মধ্যে তো মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কোনও আবেগ জন্মাতে দেখলাম না কখনও? তার মানে কি আমার মধ্যের এই আবেগহীনতার জন্য দায় শুধু বাবার? জানেন স্যার, বাবা কিন্তু আমার ভালো চেয়ে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করছিলেন না। করছিলেন তাঁর এই বেআইনি গবেষণার পথের আরেকটা ধাপ পেরোতে। এক অর্ধ মানুষের সাথে পুরো মানুষের বিয়ে দিলে কিভাবে তা প্রভাব ফেলতে পারে আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জীবনের উপর সেটা দেখাই ছিল ওনার প্রধান এক্সপেরিমেন্ট এইবারে। হরিহরকাকা আগেভাগে সব জানতে পেরে আমায় বললেন আপনার কাছে চলে আসতে সরাসরি। আপনার আমাকে প্রয়োজন।"

****

প্রায় সাড়ে তিন বছর আগের সেই দিনটা আমার জীবনেও নতুন ভোরের সূত্রপাত করেছে বইকি। সেইদিন থেকে পৌলমা আমার এখানেই থেকে গেছে। একতলায় আমার উদ্ভাবনী সেন্টারের যে সংগ্রহশালা খানা আছে, সেটা এখন পুরোটা ওই দেখাশোনা করে। ভেবে দেখলাম, হরিহরের কথাই ঠিক। আর কতদিন টানতাম বলুন তো এসব একা একা? বয়স হচ্ছে তো! একটা সংগ্রহশালা চালাতে হলে কত দায়িত্ব নিতে হয় জানেন? কতজনের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়? কত জায়গায় ঘুরতে হয়? তার উপর আবার সরকারের গোপন কাজকর্ম এসব। ভরসা করে সবার উপর এর ভার তো আর দেওয়াও যায় না। বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যপার তো একটা থেকেই যায়।

ও হো, দেখেছেন কেমন ভুলো মন আমার? আপনাদের তো বলাই হয়নি, আমার কি নিয়ে এই উদ্ভাবনী রিসার্চ সেন্টার, কিসেরই বা এই সংগ্রহশালা। মানুষের একটু একটু করে হারাতে থাকা মনুষ্যত্বকে নানান স্তরে বিভিন্ন সময়ে থেকে উদ্ধার করে এনে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি কোটিকোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে জোগাড় করা বিভিন্ন তারা, গ্রহ, নক্ষত্র ও ব্ল্যাক-হোল থেকে সংগৃহীত উপাদানের মাধ্যমে। নাহ, আলোর গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে পড়াশোনাটা ভাগ্যিস পৌলমার রপ্ত করা, তাই সুবিধেই হল কিন্তু অনেকটা।

আর, অবশ্যই, হরিহর আগেও আমায় নানাভাবে সাহায্য করেছেন, আজও করছেন। ওনার সঠিক পরিচয় আগে না জানলেও যতটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল আমাদের মধ্যে, আজ তা কমে তো নিই, বরং মাঝে মাঝে মনে হয় বেড়েই গেছে বহুগুণ আমাদের দুটো এই জীবনকে পৌলমা এক সূত্রে গেঁথে দেওয়ায়। আজও আমাদের নানান বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রতিনিয়ত পাশে পাই আমি ওনাকে। যখন পুরোটা চিনতাম না, তখনও প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পৌলমার বাবার গবেষণাগার থেকে চৌর্যবৃত্তি করে প্রায়ই দরকারি নথিপত্র বা রাসায়নিক নিয়ে এসেছেন উনি আমার উদ্ভাবনীর গবেষণার স্বার্থে। ওনার সাহচর্য ছাড়া এই মহাযজ্ঞের পথে কোনদিনই সাহস করে এগোতে পারতাম না আমি।

এই তো কিছুদিন আগে কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি ওনাকে, " আচ্ছা, এই যে দিনে দুপুরে চুরি ডাকাতি করতে হয় আমার জন্য, পৌলমার কাছে যেমন শুনেছি, জানতে পারলে তো আপনাকে ডিসম্যান্টল করতে বেশী সময় লাগবে না ওর বাবার! ভয় করে না? চিন্তা হয় না?"

হেসেছিলেন হরিহর। "আমি মানুষ না হতে পারি, আপনাদের পরিভাষায় যাকে বলে white lie বা সাদা মিথ্যে, তার ভাবনাটা কিন্তু অবশ্যই অনুধাবন করতে পারি সবসময়। জানি, মনুষ্যত্ব বাঁচিয়ে রাখতে আমার এই অবদানকে ইতিহাস কখনই চুরি বলে মনে রাখবে না। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে আমাদের সৃষ্টি করেন ডাক্তারবাবু। আমাদের মানে সর্বজয়াকে, আমাকে। প্রথম দিন থেকেই আমি টের পেতাম উনি মানুষের চামড়ায় শরীরটা মুড়ে রাখলেও মনটার জলাঞ্জলি দিয়েছেন বহুদিন আগেই। কিন্তু তাও ভাবুন, প্রকৃতির কোন খেয়ালে ওনার হাতেই তৈরি হলাম আমরা, যারা যন্ত্র ঠিকই কিন্তু মানবিক। সব জানলেও বুঝলেও আমার অন্য অংশ সর্বজয়াকে আমি বাঁচাতে পারিনি। আসলে প্রথম থেকেই মেয়ে চেয়েছিলেন ডাক্তারবাবু নিজের পরীক্ষা নিরীক্ষার স্বার্থে যে জীবনদায়ী উৎস কেবলমাত্র একটি কন্যা সন্তানই হতে পারে তা তিনি বুঝেছিলেন। শুধু সে শিক্ষা মানুষের হিতে কিকরে ব্যবহার করতে হয় শিখলেন না কিছুতেই। পরপর তিনটে ছেলে হওয়ার পর দীর্ঘদিন গবেষণার ফসল আমাদের এই পৌলমা। যার জন্মানোর স্বার্থে ডাক্তারবাবু কোনোকিছুর চিন্তা না করে বলি দিয়ে দিলেন সর্বজয়াকে, যার যান্ত্রিক সমস্ত সিস্টেম ডিসল্ভ না হলে কিছুতেই কৃত্রিম উপায়ে এভাবে কন্যা সন্তান জন্মাতে পারতোনা। সব তবু ভুলেছিলাম। ভেবেছিলাম পৌলমার মুখ চেয়ে সব ঠিক করে নেবেন উনি। কিন্তু যখন দেখলাম, মেয়েকেও নয়, ওনার যাবতীয় প্রীতি শুধু নিজের প্রতি, বুঝলাম, মনুষ্যত্বকে এভাবে হেলায় হারালে চলবে না। যেকোনো উপায় তার সন্ধান চালিয়ে যেতেই হবে। নিজে ডিসল্ভ হয়ে যাওয়ার ভয় আমার নেই, ভয় একটাই শুধু, এতো করেও শেষ রক্ষা হবে তো? "

"হবে হরিহর কাকা। ভরসা রাখো।" তিন কাপ চা হাতে ঘরে ঢোকে আমাদের আদরের বিদুষী পৌলমা। আর আমি সাধারণ মানুষ হয়ে এই আধা মানুষ আর অমানুষের কাণ্ডকারখানা দেখতে থাকি, আমার উদ্ভাবনী গবেষণার প্রকৃত উৎস সন্ধানের তাড়নায়।

****

- "পৌলমা, তাহলে ও কথাই রইল!"

আজকাল মেয়েটা দেখছি বেশ দুষ্টু হয়ে গেছে। সবকিছুতে আর আগের মতো কাঠ কাঠ করে উত্তর দেয় না। ফিক করে সামান্য হেসেই বলে সে, "বেশ!"

দেখেছেন, আবার বলা হয়নি আসলে আপনাদের,কাল থেকে নতুন একটা কাজে লাগিয়েছি আমি পৌলমাকে। একটা নতুন ঘর গড়ার কাজ। যাতে নিজের মতো করে শুরু করবে ও নতুন আরেক গবেষণা। আমাদের সংগ্রহশালায়  জমা হওয়া মনুষ্যত্বকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলবে নিষ্পাপ নির্লোভ কিছু আনকোরা নতুন প্রকৃত কিছু মানুষ। 
------------

-ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ----------------------- 




=========================================================

Better  Some Tabs. For You

1. 



Samsung Galaxy Tab A 10.1 (10.1 inch, RAM 2GB, ROM 32GB, Wi-Fi-Only), Black

Deal Price: Rs. 12,499.00

Extra 10%  direct off  on SBI Card (20-23 Jan, 2021)

For Details CLICK HERE

2. 


Lenovo Tab M10 HD Tablet (10.1 inch, 2GB, 32GB, Wi-Fi Only) Slate Black

Deal Price: Rs. 9,990.00

Extra 10%  direct off  on SBI Card (20-23 Jan, 2021)

For Details CLICK HERE

3. 

Samsung Galaxy Tab A7 (10.4 inch, RAM 3 GB, ROM 32 GB, Wi-Fi-only), Grey

Deal Price: Rs. 16,999.00

Extra 10%  direct off  on SBI Card (20-23 Jan, 2021)

For Details CLICK HERE

=======================

Click Here To Find More Tabs.

========================

Post a Comment

1 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. অভিনব ভাবনায় সমৃদ্ধ গল্পটি পড়ে খুব ভাল লাগল৷ অসাধারণ লেখা৷

    ReplyDelete