তিতলী
শ্যামল বিশ্বাস
'বাবা, ও বাবা, বাবা' ছোট্ট তিতলীর ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লো পুষ্পেন্দু । সবেমাত্র ঘুমটা এসেছিলো তার । চোখ কচলাতে কচলাতে হাই তুলে ঘাড় ঘোরাতেই দেখে তিতলী অঝোরে কেঁদে চলেছে । দেওয়াল ঘড়ির আচম্বিক কর্কশ ধ্বনি রাত দুটোর উপস্থিতি জানিয়ে দিলো । কি হলো মা তোর এতো রাতে, কাঁদছিস কেনো ? কি হয়েছে বল, পেটে ব্যাথা করছে ? না বাবা, ঘুম আসছেনা, ভয় করছে খুব । দূর বোকা আমি তো তোর কাছেই আছি, ভয় কিসের । এইতো সবে ঘুমোলি, এর মধ্যেই ঘুম ভেঙে গেলো । আচ্ছা আয় আমাকে জড়িয়ে ধর, আমি আর একটা তোকে গল্প শোনাচ্ছি, বলতে বলতে ছোট্ট তিতলীর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো ।
এবার হটাৎ তিতলী খুব শান্ত হয়ে গেলো, বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো বাবা 'মা' কি জিনিস গো । জানো বাবা আমার ইস্কুলের সায়ন এর একটা মা আছে, দোয়েল এরও আছে, করবীরও আছে, আমার নেই কেনো 'মা' । স্কুল ছুটি হলে ওদের মতন আমি কেনো 'মা' বলে ডাকতে পারিনা । ওদের 'মা' দের দেখলে জানো আমার খুব কষ্ট হয় । কত্ত আদর করে ওদের, কত্ত ভালোবাসে । আমার মা কোথায় বাবা । ওদের মতন আমারও একটা 'মা' চাই ।
ডুকরে কেঁদে উঠলো পুষ্পেন্দু । কান্নার আওয়াজ আবার তিতলীর কানে না যায় তাই বালিশ এ মুখ গুঁজে নিলো । কি উত্তর দেবে পাঁচ বছরের ছোট্ট তিতলীকে ।
কোনোরকমে ভাঙা ভাঙা ধরা গলায় বললো তোর 'মা' তো স্টার হয়ে আছে। কাল সন্ধ্যার আকাশে তোর 'মা' কে দেখাবো কেমন ।
-না না না, ঠিক না, তুমি মিথ্যে বলছো, মানুষ স্টার হয় না কখনো । আমার একটা 'মা' চাই বাবা। আমার 'মা' এনে দাও।" উপায় না দেখে অবশেষে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো "আচ্ছা এনে দেবো । এখন ঘুমাতো দেখি ।
এই তিতলীকে নিয়েই পুষ্পেন্দুর পৃথিবী । ছোট্ট বেলায় মা কে হারিয়েছে পুষ্পেন্দু, তারপর বাবাকেও বছর তিনেকের ব্যবধানে । বড়মামীর লাথি ঝ্যাঁটা আর বড়মামার লুকিয়ে স্নেহ আদরেই বড়ো হয়েছে পুষ্পেন্দু । বাড়ি ভাড়ার টাকা আর একটা মুদিখানা দোকান এর ইনকামেই স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটছিলো বেশ । তারপর বড়োমামাও যখন চলে গেলেন আবার নিজের বাড়িতে ফিরে আসে । তারপর তনুশ্রী কে বিয়ে ।কিন্তু তনুশ্রী তার আগের প্রেমিককে ভুলতে পারেনি। বিয়ের দু বছরের মাথায় বেবী পেটে আসার পরেও না । যেদিন তিতলী জন্ম নেয় তার দু তিনদিন পরেই তনুশ্রী তার প্রেমিকের হাত ধরে চলে যায় । তারপর থেকেই তিতলী আর পুষ্পেন্দু ।
আজকাল তিতলী যেনো কেমন শান্ত হয়ে যাচ্ছে । এই বয়সে বাচ্চারা যখন বাড়ি শুদ্ধু হুলুস্থূলুস করে বেড়াচ্ছে, তিতলী যেনো কেমন চুপচাপ । মাঝে মাঝেই রাতে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ছে । অঝোরে কাঁদছে, তবে আর বাবাকে সে ডাকেনা । সে বুঝে গেছে এই শিশু বয়সেই বাবা তার এই আবদার রাখবেনা না । জানে বাবা আমার সবকিছু । বাবা আমার গাড়ী, ঘোড়া, পুতুল সব । আমার বাবা সবার চেয়ে ভালো বাবা । আমায় খাইয়ে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়, গল্প শোনায়, স্কুল নিয়ে যায়, স্কুল থেকে নিয়ে আসে, ঘুরতে নিয়ে যায়, ভিডিও গেম খেলে । ব্যাথা পেলে কান্নাও করে বাবা । আমার বাবা সব পারে শুধু পারবেনা 'মা' আনতে ।
মাস তিনেকের মধ্যেই তিতলী বিছানা নিয়ে নিলো । রক্তশূন্যতার অসুখ গ্রাস করলো ছোট্ট তিতলী কে । অনেক ডাক্তার বদ্যি সবই হলো । পুষ্পেন্দু পাগলের মতো এদিক ওদিক করেছে । কোনো বড়ো ডাক্তার বাদ দেয়নি । ভেলোর - ব্যাঙ্গালরু কিছুই বাদ রাখেনি । ওর তো শুধু বাঁচার একটাই সম্বল ওর তিতলী । কিছুতেই হাল ছাড়বেনা পুষ্পেন্দু । নিজের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করে যাবে ।
অবশেষে হেরে গেলো পুষ্পেন্দু । ডাক্তার সব আশা ছেড়ে দিলো । না পারলো না তিতলী কে সুস্থ করে তুলতে । বিকেল তিনটে দশ, তিতলী আর নেই । সন্ধ্যার আকাশে স্টার হয়ে 'মা' কে খুজঁবে বাবার কথা মতন । আবার পুষ্পেন্দু কে একা করে দিলো বিধাতা কোন জন্মের কোন অপরাধে ।
--------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
শ্যামল বিশ্বাস
শিবতলা স্ত্রীট,ভদ্রকালী
উত্তরপাড়া, হুগলী
পচিম বঙ্গ 712232
8617265073
8481999780