অন্য মন (দ্বিতীয় পর্ব)
সুপ্তা আঢ্য
অভি আজ সকাল থেকেই বেশ অন্য মুডে - - - তিতাসকে রেডি করা, নন্দিনীকে অল্পবিস্তর সাহায্য করা---সবকিছুতেই এগিয়ে আসছিল ও। যদিও নন্দিনী এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে ভাবে "কী হবে এই হঠাৎ ভালোবাসার?" গতরাতের অভিমানের কালো ছায়া ওর মনে শ্রাবনের কালো মেঘ ঘনিয়েছে। "কী হয়েছে নন্দিনী? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?"
ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসি এনে নন্দিনী বলল" আমার শরীরের খবর রাখো তুমি? "
যে হাসি দেখে একদিন ওর প্রিয়ার মন পড়ে নিত অভি - - - - আজ সেই হাসিতে বিষাদের ছায়া চোখ এড়িয়ে গেল ওর" এভাবে কথা বলছ কেন? আমার এত পরিশ্রম কার জন্য? এত কিছুর পরেও তোমার খেয়াল রাখি না - - এটা বোলো না।"
"তাই - - -! তাহলে তো ভালোই, নিজেই বুঝে নাও কী হয়েছে আমার।"
"দেখো নন্দিনী - - - এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা আমার শুনতে ইচ্ছে করে না। একটু শান্তি রাখতে পারো না - - - মাঝে মাঝে তো সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে পারো? আগে তো তুমি এরকম ছিলে না? "
" আগে কখনও ভাবিইনি - - - এভাবে অবহেলিত হতে হবে। "
" তাই - - - - বেশ তবে তাই হোক। থাকো তুমি তোমার ইগো নিয়ে। "কথাগুলো বলে উত্তেজিত হয়ে অফিসে বেরিয়ে যায় অভি।
অভি বেরিয়ে যেতেই সম্বিত ফিরল নন্দিনীর" ও বুঝবে না জেনেও কেন নিজেকে খোলা পাতার মতো মেলে দিলাম ওর সামনে? ওর এই বদলে যাওয়াটা বুঝতে পারলেও মানতে বড়ো কষ্ট হয়।"এসব ভাবতে ভাবতে অভির ঘরে ঢুকে যা দেখল তাতে রাগের বদলে চিন্তা শুরু হল ওর "লাঞ্চ বক্স নিয়ে যায়নি - - - বাইরের খাবার তো ও খেতেই পারে না। আর প্রেশারের ওষুধটাও খায়নি---"
এতক্ষণের অভিমানের বদলে একরাশ দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরতেই পাগলের মত ফোন করতে লাগল অভিকে। কিন্তু ফোনটা বেজে বেজে ক্লান্ত হতে হতে একসময় বন্ধ হয়ে গেল। অভিমানে মনের জানালাগুলো বন্ধ করে দিলেও ওর শীতল হয়ে যাওয়া ভালোবাসা একটু উষ্ণতার জন্য ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া হাতটা এখনও বাড়িয়ে রেখেছে অভির উষ্ণ হাতের অপেক্ষায় ।অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে অভিকে মেসেজ পাঠায় "ফোনটা রিসিভ না করো, ঠিক আছে - - - কিছু খাওনি, সময়মতো খেয়ে নিও আর তোমার ব্যাগের একেবারে ভিতরের দিকে ওষুধের একটা স্ট্রিপ রাখা আছে, ওটা নিয়ে নিও।"
এরমধ্যে ফোনটা কেঁপে উঠতেই ইনবক্স চেক করতে দেখল"মেঘের পর বৃষ্টি এসে সব খারাপকে ধুয়ে মুছে দিয়েছে। মন খারাপ কোরো না বন্ধু - - - অভিমান ভালোবাসাকে আরও ভালোবেসে বেঁধে রাখে। "
আজ ভালোলাগার বদলে বিরক্ত হয়ে লিখেই ফেলল" মেঘ - বৃষ্টি - - - এসব কথা জানলেন কী করে আপনি? আমার সব খবর রাখেন, অথচ নিজেকে আড়ালে রেখেছেন - - - আপনি কে? পরিচয় দেন না, কেমন বন্ধু আপনি? "
" ধৈর্য্যং রহু - - - - ধৈর্য্যং রহু - - -আর একটু অপেক্ষা করলে না হয়। বন্ধু বলে একবার যখন স্বীকার করেই নিয়েছ - - - তখন চেষ্টা করেও মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে কী----মনের কাছে উত্তরটা জেনে নিও অবসর মতো। "
নন্দিনীর বলা শেষের কথাগুলো যেন আগুনের হলকার মতো পুড়িয়ে দিচ্ছিল অভিকে। দুহাতের আঁজলা ভরে নন্দিনীকে দিয়েছে ও----তারপরও! ওঃ---আর ভাবতে পারছে না অভি। অফিসে পৌঁছে অনেকগুলো মিটিং আর ক্লায়েণ্টদের সাথে ডিল করতে করতে মনটা কিছুটা হাল্কা হলেও আগুনটা একেবারে কিছুতেই নিভছিল না। কাজের চাপ একটু কমতেই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল নন্দিনীর অনেকগুলো মিসডকল--- সাথে বোধহয় নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য একটা মেসেজ।নিজের মনেই তির্যক হাসি হেসে ভাবল "তোমার মেসেজটা পড়ব না, নন্দিনী। তুমি বদলে গেছো - - - - যে বদলটা আর কোনোদিনও বদলাবে না।"
ওনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর মনটা হাল্কা হলেও আজ আর অফিসে যেতে ইচ্ছে করছিল না নন্দিনীর।ঠিক করল, অভির অপেক্ষায় সারাদিন ধরে নিজেকে সাজাবে ও। অভির ফটোটা হাতে নিয়ে ভাবল" তুমি ঠিকই বলেছ, ছোট ছোট কথায় আজকাল বড্ড রিঅ্যাক্ট করে ফেলি। সরি অভি। "
ক্লান্ত দুপুরে ফোন করে অলসতা ভাগ করে নেওয়ার বদলে কয়েকটা কেজো কথা বলে কিছু শোনার অপেক্ষা না করেই ফোনটা রেখে দেয় অভি । ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ শুনে হতাশা ওকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাবার আগেই খোলা হাওয়ার বার্তা এল" কাছে তার রই, তবুও ব্যথা যে রয় পরানে।" লাইনটা পড়ে কিছু ভাবার আগেই সাদা স্ক্রিনের ওপর অন্ধকারের রঙে আলোর বিন্দু দেখা গেল "নিজের পুরনো 'আমি' টাকে খোঁজো ম্যাডাম - - - - ওই অমূল্য 'আমি' কে অবহেলায় হারিয়ে যেতে দিও না - - - - সর্বহারার কষ্ট তোমার ওই ফুলের মত নরম, পবিত্র মন সহ্য করতে পারবে না" সাধারণ কথার অসাধারণ গভীরতা আজ বড়ো ভাবিয়ে তুলল ওকে। আরও গভীরে ডুবে যাওয়ার আগেই তিতাস এসে হঠাৎ পাওয়া আনন্দে আদরে, অত্যাচারে ভরিয়ে দেয় ওর মামণিকে। "মামণি, আজ তোমার ছুটি? আমার স্কুল ছুটি দেয়নি তো? ওই পচা স্কুলে আমি আর যাব না। কাল থেকে তোমার সাথে যাব। ঠিক আছে তো?"
মেয়ের কথায় হেসে ওকে কোলে বসিয়ে বলল "আজ আমি আমার ছোট্ট সোনার সাথে থাকব বলে ছুটি নিয়েছি। চল, আজ আমরা একসাথে খেয়ে দুষ্টু রাক্ষস আর রাজকন্যার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ব। কী, মজা হবে না? "
সারাটা বিকেল - সন্ধ্যে মেয়ের সাথে খেলতে খেলতে অভির অপেক্ষায় প্রহর গোনা নন্দিনীর অপেক্ষার প্রহর আজ বড় বেশি দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। প্রায় রাত নটার সময় অফিস থেকে ফিরে নন্দিনীর সারাদিনের অপেক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে তিতাসের সাথে খেলায় মত্ত হয়ে গেল অভি। বেশ কিছুক্ষণ অভির কাছাকাছি থেকেও কোনো সাড়া না পেয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
"জানো বাবাই, আজ মামণি আমাকে দুষ্টু রাক্ষস আর রাজকন্যার গল্প শোনাবে বলে অফিস যায়নি।"
"তাই নাকি, এটাতো বেশ ভাল কথা। কিন্তু আমি তো গল্পটা শুনিনি। আমার প্রিন্সেস কী আমাকে শোনাবে রাক্ষসটার কী হলো?"
নিজের ঘরে বসে ওদের হাসির আওয়াজ কানে আসছিল নন্দিনীর ।কিন্তু ওর উপস্থিতি আজ ব্রাত্য ওদের কাছে। অভির এহেন ব্যবহারে নতুন করে আহত হবার আগেই বন্ধুর বলা কথাগুলো হৃদয়ের প্রতিটি কোণে অনুরণিত হতে লাগলো ওর। নিজের অজান্তেই পুরোনো, প্রায় হারিয়ে যাওয়া 'আমি' টাকে ফিরে পাওয়ার পথের সন্ধানে মনের অলি-গলিতে ঘুরতে লাগল ও।
আজও আবার রাতটা নিদ্রাবিহীন নন্দিনীর ।পুরোনো 'নন্দিনীকে' হারিয়ে ফেলা সহজ হলেও ফেরার পথের সন্ধান পাওয়া যে এত কঠিন - - - - সেটা ভেবে ভীষণ অবাক হলো ও"সত্যিই কি পুরোনো 'আমি' অধরাই রয়ে যাবে?" শ্রাবনের কালো মেঘে ঢাকা রাতের আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ঘন অন্ধকারে ঘেরা পুরোনো সত্ত্বাকে খুঁজে পেতে গভীর আত্মবিশ্লেষণে মগ্ন হলো ও।
নন্দিনীর মনের মেঘের ফাঁক দিয়ে প্রভাতী সূর্যের আশা জাগানো প্রথম আলোর আভা দেখা গেলেও তার সাথে মুখোমুখি দেখা হয়নি এখনও। কিন্তু বাইরের আকাশ - - - সকাল থেকেই মুখ ভার করে আছে - - - মনে হচ্ছে অনেক কষ্টে চোখের জলকে বাঁধভাঙা হতে দেয়নি।
সকাল থেকে অভি তিতাসকে নিয়েই মেতে আছে।তিতাসের সাথে একসাথেই বেরিয়ে গেল ও। গতদিনের ঘটনার পর থেকে অভি একটু বেশীই চুপচাপ হয়ে গেছে----এখন নন্দিনী শুধুই থার্ড পার্সন - - - শুধুই কী আজ নাকি মোহের বশে এতদিন নিজেই নিজেকে ফার্স্ট পার্সন ভাবত? কে জানে - - -? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সব কাজ সেরে অফিসে বেরোনোর জন্য তৈরী হওয়ার আগে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল শ্রাবনের বৃষ্টিভেজা বাতাসের গন্ধ নিয়ে একরত্তি ফোনটা ওর অপেক্ষায় অধীর হয়ে উঠেছে "বৃষ্টিধোয়া সকালের উজ্জ্বলতা সারাদিন ঘিরে থাকুক তোমাকে। আচ্ছা, তোমার কখনও নিজেকে অন্যভাবে দেখতে ইচ্ছে করে না! এরকম একটা দিনে মেঘলা রঙের শাড়ী, সাথে লম্বা হাতের লাল ব্লাউজ, বাঁকানো দুই ধনুকের মাঝে বড়ো লাল টিপ, ঘাড়ের কাছে হাতখোঁপা আর সিঁথিতে আগুনরঙা সিঁদুরে মেঘপরী সাজতে ইচ্ছে করে না তোমার? আমার এই ইচ্ছেটাকে নিজের ইচ্ছের রঙে মিশিয়ে মেঘলা দিনের মেঘপরী সাজবে বন্ধু ?"
" তাতে আপনার লাভ? আর আমিই বা আপনার কথা শুনব কেন? "
" আমি পুরোনো নন্দিনীকে নতুন রূপে ফিরিয়ে আনতে চাই। আর সব চাওয়া তো লাভ-লোকসানের হিসেব কষে হয় না। আমার নাহয় লোকসানের পাল্লাটাই ভারী হোক। তুমি কিন্তু আজ ঘন শ্রাবনের মেঘপরী হতে ভুলো না। "
" বেশ, মেনে নিলাম। কিন্তু আপনার মেঘপরী দর্শন হবে কীভাবে? "
" এতদিনে এটাও বুঝলে না সখী - - - - আমার দুচোখ প্রতিমুহুর্তে তোমায় ছুঁয়ে থাকে। "
কথা না বাড়িয়ে বন্ধুর ইচ্ছেতে আলমারি খুলে মেঘলা রঙের ঢাকাই শাড়িতে অতি যত্নে নিজেকে সাজালো নন্দিনী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকদিন পর নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল ও" একেই তো খুঁজছিলাম মনের অলিতে গলিতে - - - এ তো সেই হারিয়ে যাওয়া 'আমি'। ইস্ - - - - অভি থাকলে বেশ হতো! তবে এই কৃতিত্বের অধিকারীকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে।"
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অদম্য কৌতুহলে অসতর্ক ভঙ্গিতে সতর্কতার সাথে চারিদিক দেখতে লাগলো - - - যদি দেখতে পায় - - -! কিন্তু কোথায় - - - - কোনো চোখই তো সেই চোখ বলে মনে হল না ওর।
অফিসে ঢুকতেই সবাই হইহই করে উঠল ওকে দেখে" "আরে নন্দিনীদি, আপনি যে এতটা সুন্দর,আজ সেজে না এলে তো জানতেই পারতাম না। "
রিয়ার কথার রেশ ধরে বন্যা বলল" রিয়া ঠিকই বলেছে রে...... তোর ওই উতল হাওয়ার শেষের আলুথালু চেহারাটার নীচে এই সুন্দরী নন্দিনীর কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম আমরা। "
সকলের প্রশংসা শুনে নিজের কেবিনে ঢুকতেই আরও একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। টেবিলের কোণে অযত্নে পড়ে থাকা ফুলদানীটাও আজ ওরই মতো নতুন সাজে সেজেছে। একগোছা অমলতাস ফুল নিজের সৌন্দর্য্যের উজ্জ্বলতায় রঙহীন ফুলদানী আর ওর বিবর্ণ হয়ে আসা মনটাকে এক অদ্ভূত ভালোবাসার রঙে রঙীন করে তুলেছে। ফুলগুলোর কাছে যেতেই একটা হাল্কা অথচ মিষ্টি সুবাস ভেসে এল। ধীর পায়ে চেয়ারে বসতেই ব্যাগের ভিতর থেকে ফোন নিজের দায়িত্ব পালন করে বন্ধুর আগমনের খবর দিল "রাস্তায়, অফিসে - - - খুঁজে পেলে আমাকে? আমি যে 'রক্তকরবীর' নন্দিনীর সেই 'রাজা', যাকে চোখে দেখা যায় না....... শুধুই অনুভব করা যায়।তবে আজ কিন্তু সত্যিই তুমি মেঘলা দেশের রানী। তোমার এই ছবি সারাজীবনের সম্পদ হয়ে রইল আমার মনের ক্যানভাসে।"
"আমার না বলা কথা, চোখের ভাষা - - - - সব তো আপনি বোঝেন! এটা বোঝেন না, আমিও আপনাকে দেখতে চাই, জানতে চাই। "
" জানি তো। নিজের অন্তরে আমাকে খোঁজো সখী, ঠিক খুঁজে পাবে।তুমি তো আমার গোপন প্রাণের একলা মনের সাথী - - - - ।ফুলদানীর নীচে একটা চিঠি পাবে, সময়মতো পড়ে নিও। ইচ্ছে হলে উত্তর দিও। "
" কী অদ্ভূত রে বাবা - - - - আমি যে সকলের মাঝে ওকে খুঁজে ফিরছিলাম, সেটাও জেনে গেছে। "বিরক্তি আর কৌতুহল মিলেমিশে এক অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছিল ওর।বারবার অবাধ্য হবার কথা ভেবেও এক অজানা আকর্ষণে আর পুরোনো 'আমি' কে নতুন করে ফিরে পাবার লোভে বাধ্য মেয়ের মতো ওর সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিল নন্দিনী। ফুলদানীটা তুলে চিঠিটা খুলতেই চাঁপা ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে এল "সব ফুলের রূপ থাকলেও গন্ধ থাকে না - - - - - আর যার দুটোই থাকে তার নাম থাকে না। কিন্তু 'অমলতাস' ফুলের রূপ আর নামে বাকী না পাওয়াটুকু ঢেকে যায়। নিজের রঙে চারপাশ সোনার বরণ আভায় ভরিয়ে রাখে আমার প্রিয় অমলতাস। নিজেতে মগ্ন হও বন্ধু - - - - দেখবে আমার অমলতাসের মতোই তোমার দীপ্তির উজ্জ্বলতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে তোমার পরশে থাকা সবকিছু।
ক্রমশঃ----------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট