পূর্বকথন
গ্রামের বাজারে বড়মামার সঙ্গে যায় মনন। শেতলার দোকানে খাবার খায়, আড্ডা জমে। বাড়ি এসে জলখাবার খেয়ে ঝিনটির সঙ্গে যায় আমবাগানে। সেখানে ঝিনটির আদর আর ভালবাসায় স্নাত হয় মনন।
পর্ব - ১৭
আমবাগানের এই অনেকটা ভিতরে লোক চলাচল খুবই কম। নির্জন এই প্রকৃতির মাঝে ঝিনটির দুহাতে ধরা মননের মুখ। তার ফিসফিস করে বলা কথা কটি মননের মনে তীব্র আবেগ সৃষ্টি করে। সে গভীর ভালোবাসার সঙ্গে তাকায় ঝিনটির সুন্দর চোখের দিকে, একহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে আর নিজের মুখ নামিয়ে আনে ঝিনটির বুকের মাঝে। ঝিনটি বাধা দেয় না। সে চোখ বুজিয়ে ধীরে ধীরে বিলি কেটে দেয় মননের একমাথা ঝাঁকড়া চুলে। ঝিনটির নরম বুকের সুগন্ধ পাগল করে দেয় মননকে। সে পাগলের মত চুমু খেতে থাকে তাকে আর অস্ফুটে বলতে থাকে - আমি আজ শপথ করছি, জীবনে যতই দুর্ভোগ আসুক, যতই বিপত্তি আসুক আজ থেকে তোর সমস্ত ভার আমার।
পৃথিবীর সব প্রেমই আবেগের তীব্র মুহূর্তে জন্ম দেয় অনেক প্রতিজ্ঞার। কিন্তু জীবন যতই বয়ে চলে নিজের গতিতে, ততই আবেগ স্তিমিত হতে থাকে আর বাস্তব গ্রাস করে যৌথ জীবনকে। ঝিনটি তার অবচেতনে জানে যে কথা। মেয়েটি এই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সময়ে ধানসিঁড়ি গ্রামের বাইরের জগৎ অল্পই দেখেছে, কিন্তু তার বাবার কাছে পাওয়া বই পড়ার নেশা তাকে অন্য আর পাঁচজন তার বয়সী ছেলেমেয়ের থেকে অনেক পরিণত করেছে। এর উপর জীবনে সে পেয়েছে উপর্যুপরি আঘাত। তাই সে জানে, তাকে এখন প্রস্তুত হতে হবে নিজেকে তৈরি করার জন্য, মানুষ করার জন্য।
ধীরে ধীরে মননের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ঝিনটি। তারপর বলে ওঠে - চল মনদা, তোমাকে বাগবাবার মন্দির দেখিয়ে আনি।
গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি বড় মাঠ। সেখানে খুব প্রাচীন এক কালীমন্দির। তার জরাজীর্ণ দশা। আগেকার ছোট ছোট ইঁটে গাঁথা দেওয়ালের ফাঁকে ফাঁকে মাথা চাড়া দিয়েছে বট, অশ্বথ গাছের চারা। মন্দিরের আধা অন্ধকার অভ্যন্তরে একটি প্রাচীন ভিজে ভিজে বেদী, তাতে জবাফুলের মালা। কাঠের খুব প্রাচীন দরজায় তালা দেওয়া। সেই দরজার মাঝে অল্প ফাঁক, সেখান দিয়েই ভিতরে উঁকি দেয় তারা। ঝিনটি বলে প্রণাম কর মনদা।
মন্দিরের সামনে প্রশস্ত দালান যেখানে পুজোর সময়ে ভক্ত সমাগম হয়। তারও জরাজীর্ণ দশা। তার একপাশে মস্ত হাঁড়িকাঠ। টকটকে লাল সিঁদুর মাখানো। ঝিনটি বলে - বাবা বলতেন এ মন্দির দুশো বছরের পুরনো। এখানে ডাকাতরা ডাকাতি সেরে এসে পুজো দিত, লুন্ঠিত সামগ্রী ভাগ বাটোয়ারা করত আর নরবলি দিত।
মনন আনমনে ভাবতে থাকে সেই সময়ের কথা। তার চোখে ভেসে ওঠে গল্পে পড়া রঘু ডাকাতের কথা।
মন্দিরের দক্ষিণ দিকে এক বিশাল বটগাছ। তার গোড়ায় মস্ত বাঁধানো চাতাল। আর গুঁড়ি খুব মোটা। সে গুঁড়িতেও সিঁদুর লেপ্টে আছে, একটা ধুতি জড়ানো তাতে। গুঁড়ির চারিদিকে প্রচুর ছোট ছোট লাল মাটির বাঘ। মনন জানতে চায় কি এগুলো।
ঝিনটি বলে - ভক্তরা বিয়ের পর সন্তান কামনায় এইগুলি মানত করে। এই বেদিতে অধিষ্ঠান করেন বাগবাবা।
মনন এই ঠাকুরের নাম শোনেনি। সে জানতে চায় - সন্তান কামনায় পোড়া মাটির বাঘ কেন?
ঝিনটি তার বাবা ও গ্রামের প্রাচীন মানুষদের কাছে যা শুনেছে, তাই বলতে শুরু করে।
ক্রমশঃ----------