বাইপাস সার্জারি।
প্রথম শুনেই শরীরের ভেতর দিয়ে কেমন একটা হিমেল স্রোত বয়ে গিয়েছিল। মাথাটা বিনা কারণে ঝিমঝিম করে উঠেছিল। দিবাকর বসুর আজ হার্ট অপারেশন। বাইপাস সার্জারি। এই সাতষট্টি বছর বয়সে একবারের জন্যেও যে-মানুষটাকে হাসপাতালমুখো হতে হয়নি, তাকেই কিনা আজ একেবারে সটান অপারেশনের টেবিলে শুয়ে পড়তে হবে!
রোগটা ধরা পড়েছিল মাসখানেক আগে। এমনিতে দিবাকরবাবু বেশ শক্ত-সমর্থ। মজবুত শরীর। প্রথমদিকে তাই দিবাকরবাবু রোগটাকে তেমন আমল দেননি। অথচ কোথা থেকে কি হয়ে গেল! দিবাকরবাবু ক্রমে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকেন। ভয়ানক টেন্সড দেখা্চ্ছে তাঁকে।
বীণাপাণি আশ্বস্ত করে বললেন, "অত ভাবছো কেন…আমি বরং একবার ফোন করে খোকনকে সব জানাই…তুমি রাগ করতে পারবে না কিন্তু…বাপ অসুস্থ শুনলে খোকন কি আর চুপ করে বসে থাকতে পারবে? তুমি দেখো, ও ঠিক আসবে…আবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে!"
খোকন…খোকন!
দিবাকরবাবুর অসুস্থ বুকের ভেতরটা আবার যেন মোচড় দিয়ে উঠল। খোকন! তাঁদের একমাত্র ছেলে খোকন। ছোটবেলায় কি দস্যিটাই না ছিল! কিন্তু পড়াশুনোয় একেবারে চৌকস। ধাপে ধাপে জীবনের সব সিঁড়ি বেয়ে এখন সে সফলতার চূড়ান্ত শীর্ষে। সেদিনের সেই খোকন কিনা এখন কলকাতার এক বড় নামকরা বেসরকারী হাসপাতালের হার্ট-সার্জেন ডাঃ রাকেশ বসু। একসময় গর্বে দিবাকর আর বীণাপাণি বুক গর্বে ফুলে উঠতো। কিন্তু মানুষের সুখ তো আর চিরস্থায়ী নয়। বিয়ে-থা করে একদিন নতুন ফ্ল্যাটে চলে গেল ওরা। অভিমানে, অপমানে দিবাকর আর বীণাপাণি ভেবেছিলেন, আর কোনো সম্পর্কই রাখবেন না ছেলের সংগে। হলোই বা একমাত্র ছেলে! তাই বলে….
শেষপর্যন্ত খোকন ওরফে ডাঃ রাকেশ বসু এলেন বাবাকে দেখতে। এতদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়েও বাবা-মা বহুকষ্টে তাঁদের আবেগ সংযত করলেন।
সব দেখে-টেখে, না, ছেলে নয়, বিখ্যাত হার্ট-সার্জেন ডাঃ রাকেশ বসুই তাঁর অকৃত্রিম আবেগহীন ডাক্তারি গলায় নিদান দিলেন, "অপারেশন করতে হবে। বাইপাস-সার্জারি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এক কাজ কর…কালই সকাল দশটার মধ্যে তুমি আমার হসপিটালে চলে এসো, অ্যাডমিশন করিয়ে দেবো। তারপর সবকিছু চেকাপ-টেকাপ করিয়ে পরশুদিন অপারেশন।"
আজ সেই দিন। আজ অপারেশন। নিজের ছেলের হাতে অপারেশন। দিবাকর বাবুর পার্কের বন্ধুরা সব শুনে একবার বলেছিল, "তোমার আর চিন্তা কি! নিজের ছেলের হাতে অপারেশন…মিছেই ভেবে মরছো…"
আসার সময় বীণাপাণিও বলেছিল, চিন্তা কোরো না তো…খোকন আছে না! সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো…"
তবু কেন যে চিন্তা যাচ্ছে না! সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ভয় আর চিন্তাও ততই দিবাকরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। মাঝেমাঝে একটা নিষিদ্ধ চিন্তা্ এসেও তাঁর মনটা বিষাক্ত করে দিচ্ছে। আচ্ছা, এমনকি হতে পারে যে, এই রোগটা হয়তো আদৌ অপারেশনের কেসই নয়। খোকন জেনেবুঝেই অসহায় বাপকে অপারেশনের টেবিলে এনে শুইয়ে দিয়েছে। একটা সেকেন্ড ওপিনিয়ন নেওয়ার সুযোগও দেয়নি। এর মধ্যে কি কোনো অভিসন্ধি আছে? খোকনের মতলবটা কী?
সময় হয়ে গেছে। দিবাকরবাবুকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন রুমে। অন্তিম মুহূর্ত। অপারেশন টেবিলে শুয়ে দিবাকরবাবু হঠাৎ ডাক্তার-ছেলের হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলির পাঁঠার মতো মিনমিন করে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো কাতর গলায় বললেন, "খোকন রে, ভালো করে ধৈর্য ধরে ভেবেচিন্তে অপারেশনটা করিসা বাবা! জানিস তো, এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া তোর মায়ের আর কেউ নেই! তোর অপারেশনের সামান্য ভুলে যদি আমার ভালোমন্দ কিছু হয়ে যায়, তোর মা কিন্তু তখন তোদের ফ্ল্যাটে এসেই থাকতে শুরু করে দেবে…এই বলে দিলাম!"
বাইপাস সার্জারি হান্ড্রেড পারসেন্ট সাকসেসফুল।
ডাক্তার হিসেবে ছেলের সার্জারি তো বটেই, পেশেন্ট হিসেবে দিবাকরবাবুর বাইপাস-সার্জারিও দারুণভাবে সফল।
_________________
মুক্তি দাশ
১৩৫, অঘোর সরণী,
রাজপুর,
কলকাতা-৭০০১৪৯
মোবাইল/হোয়াটসঅ্যাপ : ৯৮৩০৪১৩১২২