Click the image to explore all Offers

গল্প।। হয়তো তোমারি জন্য ।। অর্ঘ্যদীপ দাস ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;







                                                            ১


ইভানের বয়স তখন ১৯ ছুঁই ছুঁই , এক নামি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ইলেক্ট্রনিক্সের প্রথম বিভাগের ছাত্র সে। একটা নামি কলেজে চান্স পেয়ে বেশ খুশি ও। আর হবে নাই বা কেন , এক সাদামাঠা মধ্যবিত্ত বাড়ির সন্তান ও। সারাদিনই স্কুল ,পড়াশুনা , আর পরিবার নিয়েই কাটিয়ে এসেছে। পড়াশুনাই ছিল ওর ধ্যানজ্ঞান। বন্ধু খুব বিশেষ ছিল না , কাছের বন্ধু বলতে একজনই ছিল সে হল প্রণয়। তার সাথেই সবধরণের গল্প করতো ও। প্রণয় সদ্য প্রেমে ছেঁকা খেয়েছে। তাকে দেখেই প্রেমের প্রতি সমস্ত রকম মোহ চলে গেছে ইভানের। অবশ্য এসব বিষয় কোনোদিনই খুব একটা ভাবেনি সে। ইভান মনে করে বেশ তো জীবন কাটছে ,ফালতু পিছুটান রাখার কোনো মানেই হয় না,একদম বিরক্তিকর। এই নিয়ে অনেকবার বুঝিয়েওছে প্রণয়কে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।  প্রণয় তো বলেই দেয় "এসব তোর বোধগম্য হবে না , সুতরাং তুই জ্ঞান দিতে আসিস না।" এখন নিজেই ভুগছে। 


কলেজে এসেও খুব বেশি বন্ধু হয়নি তার। সারাদিন পড়াশুনার মধ্যে থাকতে থাকতে সত্যি বলতে বন্ধু বানানোর খুব বেশি প্রয়োজনও মনে করেনি। তবে হ্যা কলেজে একজনের সাথে বন্ধুত্ব করার খুব ইচ্ছা আছে তার।  অবশ্য সে তার ক্লাসে পড়ে না।  এমনকি তার নাম পর্যন্ত ইভান জানে না , কিন্তু কলেজে যাওয়া আসার পথে তাকে দেখে অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে তার সাথে। মেয়েটাকে দেখে বেশ ভালোই লাগতো তার। কথা বললে মন্দ হত না। কিন্তু সাহস করে কোনোদিনও কথা বলতে যায়নি। কি জানি যদি কিছু ভাবে। এক এক সময় তো ইভান ভাবে তবে কি মেয়েটাকে ভালোলাগছে নাকি তার ? কিন্তু তারপরই ভাবে দূর! কি সব ভাবছে সে। এমনিতে প্রেমের বিপক্ষে সে। কিন্তু কেন জানি না ইভান মেয়েটার প্রতি একটা অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করে। 



সকালের ক্লাসটা বেশ দেরি করে শেষ হল ঐরোশির। এর পরের ক্লাস আবার একটু পরেই শুরু হবে। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে বলে , কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে ,স্নান করে ব্রেকফাস্ট না খেয়েই বেরিয়ে গেছিল। এখন এই অল্প টাইম এ বাইরে বেরিয়ে কিছু খেয়ে আসলে ভালো হয়। পরের ক্লাস শুরু ১১ টা থেকে , মাঝে কিছুক্ষুণ সময় আছে।  ওর রুমমেট তনুজা কে বলতে ও রাজি হয়ে গেল ওর সাথে বেরোতে। কলেজে গেটের বাইরেই খাবার দোকান আছে। ওখানে গিয়ে কিছু খেয়ে নিলেই হবে।তনুজা কে নিয়ে ও বেরিয়ে গেল খাবারের দোকানের দিকে। রাস্তা পার হয়েই সামনের দোকানে গিয়ে দুটো ম্যাগির অর্ডার দিয়ে সামনে রাখা চেয়ারে বসলো ওরা দুজন।  


একটু দূরে দাড়িয়ে চা খাচ্ছিল ইভান। দুজন মেয়ে এসে সামনের চেয়ারে বসতেই ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল ওর। চোখ আটকাল কারণ ওই মেয়েদুটোর মধ্যে ওই একজনকেই ও সেদিনের পর থেকে চেয়েছে কথা বলতে। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে। কি অপূর্ব সুন্দর দেখতে ওকে। উচ্চতা খুব বেশি না। গায়ের রং খুব উজ্জ্বল। আজ ভিজে খোলা কোকড়ানো চুলে আর নীল সালোয়ার কামিজ পড়ে ওকে যেন আরো আকর্ষনীয় লাগছে। ওকে দেখলেই ইভানের বুকে যেন ঢেউ খেলে ওঠে। 


একটু পরেই ওরা খেয়ে দোকানে টাকা মিটিয়ে কলেজের দিকে চলে গেল। ইভানও চায়ের কাপটা ফেলে কলেজের দিকে যেতে লাগলো। পরের ক্লাসটা শুরু হল বলে। 


 

দেখতে দেখতে বছর চারেক কেটে গেছে। সেমিস্টারের আর প্রজেক্টের চাপ সামলে তেমন বিশেষ কাজে মন দিতে পারেনি ইভান। ইতিমধ্যে বেশ একটা নামি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে , বেশ মোটা স্যালারি।  এই জন্য ইভানের সাথে সাথে তার পরিবারও বেশ খুশি। আজ কলেজের শেষ দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৬ তম  সমাবর্তন অনুষ্টান। আজ সকলের সামনে স্টেজে উঠে তাকে ডিগ্রি সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। ওই জন্যই রেডি হচ্ছিল ইভান। 


এদিকে পুরো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সর্বাধিক সিজিপিএ পেয়ে  গোল্ড মেডেল পাবে ঐরোশি। এতদিনের খাটাখাটনি আজ সফল। কিন্তু একদিকে যেমন খুশি অন্যদিকে একটা কারণে মনখারাপ ভীড় হয়ে আসছে। কারণটা অবশ্য ঐরোশির অজানা না,তবু কাউকে বলবে না সে।  বারবার তাড়া দিতে লাগলো তনুজাকে হলরুমে যাওয়ার জন্য।


হলরুমে স্বর্ণপদক নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করা ইভান তার পরের রো তে বসা মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠলো। আরে একেই তো এতদিন ধরে খুঁজছে। প্রায় বছর তিনেক দেখেনি তাকে। কলেজের যাওয়ার পথেও দেখা মেলেনি তার। কারনে অকারণে বহুবার লেডিস হোস্টেলের সামনে দিয়ে গেছে , কিন্তু কোনোবারই দেখা পায়নি। আগে খেলার মাঠে দু একবার দেখা পেয়েছে। কিন্তু না, অবশেষে এসব ভুলেই গেছিলো এতদিনে। 


সেদিন প্রথমবার ইভান জানতে পারলো মেয়েটির নাম ঐরোশি বসাক। নীল সালোয়ার, হাতে সার্টিফিকেট ,ও ভাজ করা কমলা রব ,পিঠে ছড়ানো চুল , চোখে কাজল এসব দেখে ইভান যেন হারিয়ে গেছিল নিজের মধ্যে। সম্ভিত ফিরে পেল ওর প্রণয়ের ডাকে , কিরে ভাই যা তোর নাম ডাকছে যে। আজ সমাবর্তন অনুষ্টানে ওর অনুরোধে প্রণয় ও এসেছে। এতদিন পর প্রণয়ের দেখা পেয়েও মনের মধ্যে একটুও উদ্দীপনা নেই। শুধু বলল "হ্যা, যাচ্ছি" 

 


সমাবর্তন অনুষ্টান শেষে প্রণয়কে নিয়ে বেরিয়ে গেল হলরুমের বাইরে। প্রণয়ের সাথে হাটতে হাটতে চোখে পড়লো একটু দূরে ঐরোশি দাঁড়িয়ে আছে। ফোনে কারুর সাথে কথা বলছে।

 প্রণয়কে বলল "তুই দাঁড়া , আমি একটু আসছি " .

 "আজ ঐরোশিকে মনের কথাটা বলতেই হবে " মনে মনে একপ্রকার সংকল্প করে নিল।  তারপর ঐরোশির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। 


ঐরোশি ওকে দেখতে পেয়ে ফোন রেখে বলল " হ্যা আপনি মানে তুমি কিছু বলবে " 


 ইভান একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল "কংগ্রাচুলেশন , গোল্ড মেডেল পেলে। খুব সুন্দর "


ঐরোশি শুধু বলল "ধন্যবাদ" 


ইভান একটু  থেমে বলল "একটা কথা আছে , একটু পার্সোন্যাল "


ঐরোশি বলল "কি ব্যাপার , তুমি বলতে পারো। যদি বলতে অসুবিধা না থাকে "


একটু ইতস্তত করে ইভান এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল ওর মনের কথা। বলা ভালো কেউ যেন ওর থেকে বলিয়ে নিল। 


ঐরোশি একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে। তারপর মাথা নামিয়ে আগের মতোই বসে রইলো। 

এবার ইভান বুঝতে পারলো না সে কি করবে। কিছুক্ষুণ নিঃশব্দে কাটালো দুজনে। শেষে নিরাবতা ভাঙলো ঐরোশি , মুখ তুলে ইভানের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল "একটু একা থাকতে দেবে প্লিজ। মনটা ঠিক ভালো লাগছে না"


অগত্যা ইভান ফিরে যেতে বাধ্য হল। 


সেদিনের মত প্রণয়কে সাথে নিয়ে রুমে ফিরলো ইভান। প্রতিদিনের মত বাড়িতে ফোন করে মাকে সার্টিফিকেট পাওয়ার কথাটা জানালো। বাড়িতে খুশির বন্যা বইছে। তারপর প্রণয়কে সাথে নিয়ে সেলিব্রেট করলো কিছুক্ষুণ। আজ ওর খুশিতে প্রণয়ও বেশ খুশি। রাতে শোবার সময় হঠাৎ মনে পড়লো ঐরোশির কথা। প্রথম কথাবার্তা যেন কেমন একটা অগোছালো হয়ে গেল। এমন না হলেই ভালো হত। ইভানের মনে হল ঐরোশিকে একা ফেলে আসাটা উচিত হয়নি। মন খারাপের কথাটা জানা উচিত ছিল। ফোন নম্বর বা বাড়ির ঠিকানা কিছুই জানা হল না। কিন্তু কিসের অধিকারেই বা থাকতো সে? যখন সে নিজেই চলে যেতে বলল…


এসব ভেবে মনটা আনচান করতে লাগলো তার। প্রণয় বলে "কেউ ছেড়ে যাবার ব্যথা নাকি অন্যরকম।"    

  

ভাবলো একবার প্রণয়কে বলবে কথাটা।  

নাহঃ থাক, না হয় পরেই বলবে। কাল বাড়ি যাবার আগে একবার ঐরোশির সাথে দেখা হলে ভালো হয়। এসব ভেবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো ও। 



কাজের সূত্রে ইভান আমেরিকা থাকে। আজ প্রায় পাক্কা তিন বছর পর দেশে ফিরছে ও। কোলকাতাতেই পোস্টিং পড়েছে এখন। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে ঐরোশির সাথে একমাত্র সাক্ষতের।  তারপর অনেক চেষ্টা করেও ওকে খুঁজে পায়নি।এই তিন বছরে প্রায় প্রতি সময় ঐরোশির কথা মনে হয়েছে। আজ  কলকাতা ফিরে ঐরোশির খোঁজ করতেই হবে। মনে মনে ভাবলো কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়লে সে ঐরোশির কাছে ভালোবাসার প্রস্তাব রাখবে। বেজায় উৎফুল্ল আজ ইভান। ঐরোশি তাকে ফিরিয়ে দিলে হাসি মুখে ফিরে আসবে।


কলকাতা ফিরেই তাই ইভান খুঁজতে লাগলো ঐরোশিকে। কিন্তু কোনো ফোন নম্বর বা বাড়ি কোথায় তাও জানার সুযোগ হয়নি। হঠাৎ মনে পড়লো ওর বন্ধু তনুজা র নম্বর আছে ওর কাছে। দুজনের বাড়ি একইদিকে হওয়ায় ওর নম্বর নিয়েছিল। নম্বর চেঞ্জ না করলে একবার ফোন করে দেখা যায়। ফোন করতেই বারদুয়েক রিং হয়ে কেটে গেল।  যা তবে কি ঐরোশিকে আর কোনোদিনও পাবে না।  কিন্তু একটু পর রিং হবার জন্যে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো তনুজা তাকে কল করেছে। 


ফোনটা ধরতে ওপাশ থেকে ভেসে এল একটা কথা "হ্যালো ,কে বলছেন ?"


ইভান বলল "আমি ইভান। চিনতে পারছিস ?"


তনুজা বলল "ও হ্যা বুঝেছি , বল কেমন আছিস ? হঠাৎ এতদিন পর কল ?"


ইভান  বলল "একটা দরকারে কল করেছি।  তোর বন্ধু ঐরোশির নম্বরটা দিতে পারবি। বা ওর বাড়ি কোথায় সেটা বললেও হবে "


তনুজা একটু চুপ থেকে বলল "তুই কি কলকাতা আছিস? একবার দেখা করতে পারবি। ফোনে সব বলা যাবে না। "


ইভান বলল "হ্যা আমি কলকাতা  ফিরেছি। বল কবে দেখা করবি"


তনুজা বলল "কাল কলেজ স্ট্রিটে সকাল ১১ টার দিকে "


ইভান বলল "একদম , কাল দেখা করছি "


ফোনটা রেখেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো ও। কালই  ঐরোশির খোঁজ পাওয়া যাবে।    



   

পরদিন বেশ তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল ইভান। সময়ের বেশ আগেই কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছে গেল ও। আজ যেন বেশ উৎফুল্ল লাগছে নিজেকে। কিছুক্ষুণ তনুজার জন্য অপেক্ষা করলো। একটুপরেই দেখা পেল তনুজার।  আজ একাই এসেছে। তনুজাকে দেখতে পেয়ে খুশির সুরে বলল " ঐরোশি কোথায়? ও কেমন আছে ? কি করে এখন? 


ইভানকে প্রশ্ন শুনে হতাশার সুরে বলল "ওর সাথে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। কলেজ শেষের পরই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওকে ফোন করেও পাইনি।"


ইভান করুন সুরে বলল "তবে আমাকে ডাকলি কেন? তুই ওর কোনো খবর জানিস না?"


তনুজা তখন চুপ। নিঃস্তব্দ, নির্বিকারে হয়ে ঘাড় নাড়িয়ে বলল না। তারপর ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল "তোকে ডেকেছি অন্য কারণে। তোকে একটা জিনিস দেবার আছে। ঐরোশি কলেজের শেষ দিন আমাকে একটা ডায়েরি দিয়ে গেছে , আর বলেছে তুই  ফিরে এলে এটা তোকে দিতে। তোর বাইরে কাউকে পড়তে না করেছে। তাই আমিও খুলে দেখিনি কোনোদিন।"  


ইভান বেশ অবাকই হল , ঐরোশি ওর জন্য ডায়েরি দিয়েছে শুনে। ঐরোশি কি করে জানতো ইভান ওর খোঁজ করবে। ইতিমধ্যে তনুজা একটা নীল ডায়েরি তুলে দিল ইভানের হাতে। ইভান কিছু বলতে যাবে কিন্তু তনুজা বলল "আমায় এবার যেতে হবে। ও বলেছে এই ডায়েরির মধ্যে তোর সব প্রশ্নের উত্তর আছে।"


বাড়ি ফিরে দুপুরে শুয়ে সে ডায়েরির প্রথম পাতাটা খুলল।  তারপর পড়তে লাগলো ঐরোশির লেখা ডায়েরিটা।



"কি  মশাই , কি ভাবছো আমি তোমার জন্য ডায়েরি লিখলাম কেন ? এর পেছনে অনেক অজানা উত্তর লুকিয়ে আছে। কিন্তু আফসোস তুমি যখন এই ডায়েরি পড়বে আমি হয়তো ততক্ষুনে চলে গেছি না ফেরার দেশে। তাই আমার মনের কথা এই ডায়েরিতে লিখে গেলাম। আমার বিশ্বাস তুমি ফিরে আসবেই আমার খোঁজে। 


তুমি কলেজের প্রথমদিন থেকে আমাকে দেখলেও আমার নাম কোনোদিনও জাননি। ঠিক তেমনি আমিও তোমার নাম জানিনি। তোমার নাম জেনেছি কলেজের সমাবর্তন অনুষ্টানে গিয়ে। কলেজের প্রথমদিন তোমাকে প্রথমবার দেখি। তারপর আসা যাওয়ার পথে তোমাকে অনেকবার দেখেছি। অনেকবার সামনে আসার চেষ্টাও করেছি কিন্তু সামনে আসতে পারিনি।"


না ফেরার দেশ মানে ঐরোশি কোথায় ? এ হতে পারে না। কেন সে ডায়েরি রেখে গেল।  ইভান আবার চোখ রাখলো ডায়েরির পাতায়। 


"এত উতলা হচ্ছ কেন। অপেক্ষা কর ,সব প্রশ্নের উত্তর পাবে। আমার জীবনের প্রতিটা পদে পদে অপেক্ষাকে সাথে নিয়ে এগিয়েছি। আর তুমি এইটুকু অপেক্ষা করতে পারছো না।  যখন আমি ক্লাস ১২ এ পড়ি তখন আমি বাবাকে হারাই। দিশেহারা হয়ে গেছিলাম। কিভাবে সামলাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আপন বলতে মা বাদে কেউ নেই। ঠিক সেই সময় আমার পাশে দাঁড়ায় তনুজা। ওকে সাথে নিয়ে তৈরী হচ্ছিলাম আগামী যুদ্ধ জয়ের। 


কিন্তু এ যুদ্ধ জেতা বড্ডো কঠিন। জানোতো আব্দুল কালামের একটা উক্তি আছে এন্ড মানে শেষ হয়ে যাওয়া না। এন্ড মানে যে চেষ্টা বিফলে যায় না। তাই নিজের শেষ চেষ্টা করেছিলাম এই যুদ্ধে জয়ী হতে। কারণ ছোট থেকেই আমি বিরল হেমেনজিওব্লাস্টোমা রোগের শিকার। তাও মনের জোরে এতদূর এগিয়েছি। কিন্তু কলেজের ফাইনাল ইয়ারে জানতে পারি আমার হাতে আর সময় বেশি নেই। 


তোমার মনে আছে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের কথা। যেদিন তুমি আমায় তোমার ভালোলাগার কথা বললে। আমি তখন একা থাকতে চেয়েছিলাম। তাই তুমি চলে গেছিলে। তুমি চলে যাবার পর আমি খুব কেঁদেছিলাম। 

তুমি হয়তো এখনো বুঝতে পারছো না আসল কারণ। আসলে যেমন ভাবে তুমি আমায় চেয়েছিলে তেমন ভাবে আমি তোমায় চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি তোমার জীবনে গেলে সম্পর্কটা দীর্ঘজীবন স্থায়িত্ব হত না। তাই সেদিন আমার মনটা বুঝতে দিইনি তোমায়। 


আমি জানি তুমি এখনো আমাকে চাইছো। বিশ্বাস করতে পারছো না আমি নেই।  কিন্তু সত্যি যদি এখনো আমাকে চেয়ে থাকো , তবে আমার দুটো ইচ্ছা পূরণ করো। প্রথম ইচ্ছাটা হয়তো সম্ভব হলেও ,দ্বিতীয় ইচ্ছাপূরণ অবশ্য সময়ই বলবে "


ডায়েরিটা পড়তে পড়তে চোখ বেয়ে জল চলে এল ইভানের। ও ঠিক করলো তনুজাকে কথাটা জানাতে হবে। অবশ্য ঐরোশির প্রথম ইচ্ছা কিছুটা তনুজার ওপর নির্ভর করছে। দুজনে মিলে ঐরোশিকে খুঁজলে কিছু একটা রাস্তা বেরোবেই। 



ঐরোশির খোঁজে দিন রাত প্রায় এক করে ফেলেছিল ইভান। পুলিশের সাহায্য নিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। অবশেষে ওরা ধরেই ঐরোশি সত্যি আর বেঁচে নেই। 


বন্ধুর প্রথম ইচ্ছার কথা জানতে পেরে তনুজা যেমন অবাক হয়েছিল তেমনি খুশিও হয়েছিল কারণ সত্যি সে ইভানকে পছন্দ করতো। তবুও ঐরোশির খোঁজে সে সবরকম সাহায্য করেছিল। যদি ঐরোশি বেঁচে থাকে আর ফিরে আসে তবে সে ইভানকে তার হাতে তুলে দেবে। বন্ধুর ভালোবাসা সে কখনোই ছিনিয়ে নেবে না। 


আকাশের দিকে তাকিয়ে ঐরোশিকে খোঁজার চেষ্টা করছিল ইভান। হয়তো ওই তারাদের ভিড়ে বসে সে তাকে দেখছে এখনো। হঠাৎ হুশ ফিরলো প্রণয়ের ডাকে "চলুন বাবু লগ্ন যে শুরু হবে এখন"


ইভান প্রণয়কে বলল "জানিস ভাই আজ ঐরোশির দুটো ইছার মধ্যে প্রথম ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। ওর ইচ্ছেতেই তনুজাকে বিয়ে করছি। "


প্রণয় বলল "দুটো ইচ্ছা মানে ,ওর  দ্বিতীয় ইচ্ছা কি ?"


ইভান বলল "সে তো আমিও বুঝিনি , কবিতার চার লাইন দিয়ে বলেছে সময়ই এর উত্তর দেবে "


প্রণয় মাথামুণ্ড কিছুই বুঝলো না। শুধু বলল "এখন চল।"


 

দেখতে দেখতে বছর দুয়েক কেটে গেছে ওদের বিয়ের। আজ বাড়িতে খুশির সমাগম। কারণ অনেকদিন বাদে তনুজার মা বাবা এসছে, তাই জন্য তনুজাও বেশ খুশি। রাতে ডিনারের পর বেডরুমে গিয়ে ইভানের হাত ধরে বলল "আচ্ছা তুমি এখনও ঐরশিকে ভালোবাসো?"


ইভান হেসে বলল "তোমার কি মনে হয়।"


তনুজা বলল "জানিনা। তুমি আমার কাছে যতটা দামী, ঐরশি ও ঠিক ততটা। ও যেমন তোমার কাছে না পাওয়া এক অধ্যায় তেমনি আমার কাছে হারিয়ে যাওয়া এক গল্প।"


ইভান জানে ঐরোশি এখনও কতটা মন জুড়ে আছে ওদের। তবু আজকাল ঐরোশি কথা ও শুনতে ভালোবাসে না। তাই ও তনুজাকে বলল শুয়ে পড়তে। 


কিন্তু তনুজা ইভানের হাত ধরে বলল "একটা খবর দেওয়ার আছে তোমায়।" তারপর ইভানের কাঁধে মাথা রেখে সে বলল সে সন্তানসম্ভবা। খুশিতে ইভান জড়িয়ে ধরল তনুজা কে। ওর খুশির বাঁধ যেনো মানছে না।


তনুজা বলল "একটা আবদার করবো, রাখবে?"


ইভান বলল " তোমার সব আবদার রাখবো। তুমি বল"


তনুজা আবদারের সুরে বলল "যদি আমাদের মেয়ে হয় তবে তার নাম রাখবো ঐরোশি। ও নাহক এভাবেই বেঁচে থাকবে আমাদের মধ্যে। "


ইভান চমকে উঠলো কথাটা শুনে। এভাবে তো ভেবে দেখেনি কখনো। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলল "আর যদি ছেলে হয়। তবে ?"


"ধ্যাত তুমি না।" হেসে বলল তনুজা।


১০


নার্সিংহোম করিডোরে বেশ টেনশনের সাথে হাঁটাচলা করছিল ইভান। তনুজা বেশ ক্রিটিকাল কন্ডিশনে ভর্তি হয়েছে । এমনটা হবে ডাক্তার আগেই আশঙ্কা করেছিল। ইভানের সাথে আছে মা, বাবা, আর প্রণয়।


অপারেশন চলতে লাগলো। তারপর মিনিট ৪৫ পর একজন নার্স এসে ইভানের হাতে তুলে দিল এক ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। ইভান বাচ্চাটাকে পরম স্নেহে কোলে তুলে নিয়ে বলল "তনুজা কেমন আছে?"


নার্স বলল "বিপদ কেটে গেছে। উনি এখন ভালই আছেন। এখন ঘুমাচ্ছে। দয়া করে ওনাকে ডিস্টার্ব করবেন না।"


ইভান বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে শুধু বলল "আমার ঐরশি"


১১


প্রায় ৩০ বছর পরে আজ কাঁচা পাকা চুলের ইভানকে দেখে চেনা বেশ কঠিন। ও আর তনুজা মিলে পরম যত্নে বড় করেছে ঐরোশিকে। ওদের মত ঐরশিও একই কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। আজ আবারও  একটা সমাবর্তন অনুষ্ঠান।


৩০ বছর পর নিজেদের কলেজ দেখে বেশ নস্টালজিক হয় পড়েছে ওরা দুজনে। ওপেন থিয়েটারে বসে ওরা ওর মেয়ের সাফল্য নিজেদের চোখে উপভোগ করতে চাইছে। বাদিকের লম্বা লাইনে জনা চারেকের পর দাড়িয়ে আছে তাদের মেয়ে। চারদিকে ছাত্রছাত্রীদের কোলহলে জমায়েত। 


হঠাৎ নিস্তব্দ হল ঘোষণাবাদকের মাইকের শব্দে। "নমস্কার আজ এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানের শুরুতেই ডেকে নেব ইঞ্জিনিয়ারিং সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে গোল্ড মেডেল পাওয়া ,ঐরশি সেনকে , ফ্রম ডিপার্টমেন্ট অফ কম্পিউটার সায়েন্স। তার হাতে গোল্ড মেডেল তুলে দেবে আমাদের প্রিন্সিপাল ডা. রণেন আচার্য্য ।" ঘোষণার সাথে সাথে নীল সালোয়ার, কমলা রব পরিহিত ঐরোশি মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল।


ইভান চোখ বন্ধ করে ছিল। তনুজার ডাকে চোখ মেলে তাকাল ও। প্রাণভরে দেখলো সে তার ঐরোশিকে। ঠিক যেন ৩০ বছর আগের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে ।

ওর মনে পড়লো ডায়েরিতে দ্বিতীয় ইচ্ছার অনুসারে ''শেষের কবিতা'' -র চারটে লাইন।

 

''মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে

পার হয়ে আসিলাম

আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়,

রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়

আমার পুরানো নাম।

ফিরিবার পথ নাহি;

দূর হতে যদি দেখ চাহি

পারিবে না চিনিতে আমায়।

হে বন্ধু, বিদায়।''


সত্যি সময়ই তার দ্বিতীয় ইচ্ছা পূরণ করিয়ে দিল। ইভান চিনতে পেরেছে তার ঐরোশিকে, হয়ত নতুন রূপে, নতুন বেশে।

-------------------------------  


 ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।

        

          


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.