বারান্দায় মলি চুপ করে বসে আছে। গোধূলির ম্লান আলো তার মুখে এসে পরেছে। বাড়ির গেটের পাশের শিউলি ফুলের গাছটায় অনেক কুঁড়ি ধরেছে। কাল সকালে অনেক শিউলি ফুল ফুটবে। পুজো আসছে তো। এখনই তো শিউলি, কাশ ফুলের সমারোহ দেখা যায়। অন্যান্য বছর এই সময় পুজোর আনন্দে মেতে ওঠে মলি। কিন্তু এ বছর.. বড়ই বিষাদময়।
" কি রে, উঠ না। চল না।" মা অনিমা এসে তাড়া লাগায়।
" কোথায় যাব?" অবাক হয়ে মলি জিজ্ঞেস করে।
" আরে তোকে বললাম না সকালে, পুজোর শপিং করতে যাব। " অবাক হয়ে অনিমা বলল।
" দূর, আমার ভালো লাগছে না। তুমি বাবাকে নিয়ে যাও।" একরাশ বিরক্তি নিয়ে মলি বলল।
অনিমা মলির কাছে এসে হাতটা ধরে বলল," কেন মন খারাপ করছিস মা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আয়। "
" আমি ঠিক আছি মা। শুধু লোকজন আর ভালো লাগে না। তুমি বাবাকে নিয়ে যাও।"
এমন সময় মলির বাবা হিতেশ বারান্দায় এসে বলল, " তুই না গেলে আমরা কোথাও যাব না। আমাদের মা দূর্গাই যখন অন্যায়ের সাথে লড়তে পারে না তখন আমাদের আর কিসের পুজো আর কিসের শপিং? "
বাবার কথা শুনে মলির চোখে জল এসে গেল। সে কি করে পুজোর শপিংয়ে যাবে? বাড়ি থেকে বেরোলেই মনে হয় সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গুজুর গুজুর করছে ওর নামে। অথচ ওর কি দোষ ছিল? ও তো ভালোবেসেছিল, বিশ্বাস করেছিল রাহুলকে। অন্যায়ের সাথে সে তো আপষ করেনি। প্রতিবাদ করেছে। ওর সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার চেয়েছে।
রাহুল মলির সহকর্মী। সল্টলেকের আই টি সেক্টরে দুজনেই কর্মরত। দুই বছরের প্রেম। এ বছরই ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত বছর পুজোর সময় হয়ে যাওয়া একটা ঘটনা সব উলোটপালোট করে দিল।
সপ্তমীর দিন রাহুল, রিচা, তন্ময় রকি আর সে, সবাই মিলে রাহুলের গাড়ি করে বিকেল থেকেই ঠাকুর দেখতে শুরু করেছিল। প্যান্ডেলে প্যান্ডেল ঘোরা আর তার সাথে বিয়ার খাওয়া, এই চলছিল। তখন রাত বারোটা হবে। সবাইকে যে যার বাড়িতে ছেড়ে সবশেষে মলিকে বেহালায় তার বাড়ি ছাড়ার কথা। কিন্তু টালিগঞ্জ আসতেই রাহুল বলেছিল," ডার্লিং আজ তোমার বাড়ি ফিরে কাজ নেই।"
মলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল," কেন?"
" কেন আবার কি। আজ সারা রাত আমার সাথে থাকবে তুমি। "
"সারা রাত রাস্তায় রাস্তায়? না বাবা, আমি পারব না।" মলি হেসে বলেছিল।
" রাস্তায় কেন। আমার ফ্ল্যাটে। মা, বাবা কেউ নেই। দুজনে ফুল মস্তি করব।" রাহুল চোখ মটকে বলেছিল।
" কী যা তা বলছ। আর কিছুদিনের মধ্যেই তো বিয়ে। তারপর তো পাকাপাকি ভাবেই তোমার ফ্ল্যাটেই থাকব। ততদিন সবুর করো সোনা।" মলি বলেছিল।
" না। আজ তোমায় যেতেই হবে। তোমায় নিজের করে পাওয়ার জন্য কবে থেকে আশায় বসে আছি। বিয়ে অনেক দেরি। আজ সুযোগ পেয়েছি। আজ তোমার একদম নিজের করে নেব আমি। "
খুব রেগে গেছিল মলি। প্রচন্ড ঝগড়া বেধে যায় দুজনের। গাড়ি থামিয়েছিল জোর করে। নিচে নেমে যখন চলে যেতে চেয়েছিল রাহুল ওর হাত ধরে টানে। ছাড়াতে গেলে, রাহুল ওকে রাস্তার মধ্যেই জড়িয়ে ধরে জোর করে গাড়িতে তুলতে গেছিল। মলি প্রাণপণ বাধা দিয়েছিল।
এমন সময় একটা মারুতি সুজুকি এসে থেমেছিল। সেখান থেকে এক ভদ্রমহিলা নেমে এসে রাহুলকে চার্জ করেছিল। রাহুলের হাত থেকে মলিকে ছাড়াতে গেলে রাহুল রেগে গিয়ে ভদ্রমহিলাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। তারপর গাড়িতে উঠে ভদ্রমহিলার পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় মলি থ মেরে যায়। তারপর ভদ্রমহিলার রক্তাক্ত অবস্থা দেখে একটা ওলা বুক করে সাথে সাথে আর, এস ভি হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। সেখানে ওনাকে ভর্তি করতে হয়। পুলিশ এলে তাদের বলেছিল ওর এক সহকর্মী ওর সাথে অভভ্যতা করছিল বলে উনি তার প্রতিবাদ করলে উনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে গাড়ি চাপা দিয়ে চলে যায়। হ্যাঁ, পুলিশকে সে রাহুলের নাম ধাম সব বলে দিয়েছিল। মলির মনে হয়েছিল রাহুল যা করেছে তার কোনো ক্ষমা হয় না। সে একটা মানুষকে মেরে ফেলতে গেছিল।
রাহুলকে পুলিশ পর দিন গ্রেফতার করে। ওরা কেউই জানত না যে রাস্তায় ওই ঘটনাটা ঘটেছে সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো ছিল আর পুরো ঘটনাটা রেকর্ড হয়েছে। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ দেখে রাহুলের নামে চার্জশিট দাখিল করেছিল। মলি জানতে পারে সেই আহত ভদ্রমহিলা একজন খুব বড় বিখ্যাত ডাক্তার। মিডিয়ায় এই নিয়ে হইচই পড়ে যায়। রাহুলের বাবা মা এসে মলিকে দোষ দিতে থাকে। হবু স্বামীর পাশে না দাঁড়িয়ে একজন অচেনা ভদ্রমহিলার হয়ে বয়ান দেওয়ার জন্য শাপ শাপান্ত করতে থাকে। রাহুলের মা বলেন," আসলে তোমার চরিত্রই ঠিক নেই। অত রাত্রে তুমি বাড়ির বাইরে ছিলে কেন? আর পুলিশ তো বলেছে তুমিও মদ খেয়েছিলে। সব দোষ তোমার। তুমি আমার ছেলেকে ফাঁসিয়েছ।"
মলি যত বলে যে রাহুল জোর করে ওকে ওদের ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে চাইছিল আর সেটা দেখে শতরুপা সেন তাকে বাঁচাতে আসেন, কিছুতেই তারা সেটা বিশ্বাস করেননি । মলির নামে নোংরা অপবাদ দিয়েই যে ক্ষান্ত হয়েছিলেন তা নয় মিডিয়াতে বলেছিলেন যে মদ খেয়ে মলিই নাকি রাহুলকে ওর ফাঁকা ফ্ল্যাটে রাত কাটানোর জন্য জোর করছিল। আর তাতে রাহুল সায় দিচ্ছিল না বলে হাতাহাতি লেগে গেছিল। শতরুপা দেবী তাই দেখে প্রতিবাদ করে রাহুলকে চলে যেতে বলেন। যখন রাহুল গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছিল মলি নাকি শতরুপা দেবীকে গাড়ির সামনে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল রাগে।
চারিদিকে মিডিয়াতে রাহুলের মায়ের বক্তব্য দেখে মলির নামে ঢি ঢি পড়ে গেছিল। আত্মীয় থেকে পাড়া প্রতিবেশী সবাই যা তা কথা বলতে শুরু করেছিল। করল রাহুল অপরাধ আর তার প্রতিবাদ করে মলি দোষী হল। মলি ঘরের বাইরে বেরনো বন্ধ করে দিল। মলির মা বাবা কিন্তু সব সময় মলির পাশে রইল। তারা জানে তাদের মেয়ে কোনো অন্যায় করতে পারে না।
শতরুপা দেবী কিন্তু জবানবন্দিতে সব সত্যিই বলেছিলেন। সেই ভিত্তিতে রাহুলের জেল হয়। রাহুলের বিরুদ্ধে কেস শুরু হয়। কিন্তু রাহুল আর মলির সম্পর্ক নিয়ে রসাল সব গল্প শুরু হয় চারিদিকে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে শতরুপা দেবী মলির পক্ষ নিয়ে মিডিয়াকে এক হাত নেন। বলেন," যে অপরাধ করল তার সমন্ধে আপনারা কিছু বলছেন না। আর যে মেয়েটা তার নিজের সম্ভ্রম বাঁচানোর লড়াই করল তার চরিত্র আপনারা বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন? হোক না সে তার হবু স্বামী, তাই বলে কি যখন তখন তার সাথে শুতে হবে? এ তো এক প্রকার ধর্ষণের চেষ্টাই।"
ব্যাস, মিডিয়া আবার একটা মুখো রোচক বিষয় পেয়ে গেল।
মলি চাকরি ছেড়ে দেয়। নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলে। অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সুস্থ হয়ে শতরুপা দেবী প্রায়ই মলির কাছে আসতেন, ওকে বোঝাতেন। ধীরে ধীরে কয়েকমাস আগে মলি আবার একটা চাকরিতে জয়েন করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে।
টুং টাং কলিং বেলের শব্দে মলি অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এল।
এই সময় কে যে কলিংবেল বাজাল। অনিমা দেবী দরজা খুলে দেখেন, মিসেস রায়, পাড়ার ক্লাবের পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট এবং ক্লাবের আরও কিছু সদস্য।
" আরে দিদি, আপনারা যে। আসুন আসুন।" আপ্যায়ন করে অনিমা।
আওয়াজ শুনে মলি ভাবে আবার নিশ্চয়ই ওর চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে এসেছে ওরা। যেমন কিছুদিন আগে ক্লাবে ওর বিষয় নিয়ে জোর কদমে আলোচনা হত। রাগে গা টা রি রি করে উঠল। খোপাটা বেঁধে নিয়ে বসার ঘরের দিকে এগোল মলি। আজ ছাড়বে না কাউকে। যে অন্যায় সে করেনি তার দায়ভার সে নেবে না।
মলিকে দেখে মিসেস রায় আর ক্লাবের সদস্যরা হইহই করে উঠল। ওদের হাবভাব আর বাবা মার আনন্দোজ্বল মুখ দেখে মলি অবাক হয়ে গেল।
মিসেস রায় ওকে পাশে বসিয়ে বললেন, " মলি, এবার পুজো কমিটির পক্ষ থেকে তোমার কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। তুমি না বোলো না প্লিজ।"
" কী প্রস্তাব? "
" এবারে পুজোর উদ্বোধন তুমি করবে।"
" আমি? কেন?" মলি আকাশ থেকে পড়ল।
" দেবী দূর্গার উদ্বোধন আর এক দূর্গার হাত দিয়ে হবে এবার।" মিসেস রায় বললেন।
" মানে? এসব আপনি কি বলছেন? পাড়ায় তো আমার খুব বদনাম। শুধু পাড়ায় কেন, সব জায়গাতেই তো। আমাকে নিয়ে এই মজাটা করে কি লাভ বলুন তো?. "
" না মা, মজা না। যে মেয়ে নিজের স্বার্থ না দেখে নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষের, হবু স্বামীর অন্যায়ের, নোংরামির প্রতিবাদ করে, তার অপরাধের মদত দেয় না শত চাপেও সে তো দেবী দূর্গারই মত নমস্য। নিজের সন্মান বাঁচাতে হবু স্বামীর সাথেও লড়তে ছাড়োনি তুমি। তোমার এই লড়াইকেই আমরা সন্মান জানাতে চাই। যাতে শুধু মেয়েরা কেন সমস্ত মানুষই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখুক, এই কথাটাই আমরা তোমার হাতে পুজোর উদ্বোধন করে বোঝাতে চাই। আমাদের নিরাশ কোরো না প্লিজ।"
বাবা মার সন্মতি নিয়ে মলি রাজী হল। সবাই আনন্দে হই হই করে উঠল। ওরা চলে গেলে শতরুপা দেবীকে ফোন করে সব জানাল মলি। উনি বললেন, " তাহলে দেখলে তো, সত্যের জয় হবেই। সব কালিমা, মন খারাপ ঝেরে ফেলে এবার পুজোর আনন্দে মেতে ওঠো। তুমি জান তুমি কোনো খারাপ কাজ করোনি, তাহলে কেন সব আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে?"
মলির বুক থেকে এতদিনের জমানো পাথর নেমে গেল। রাহুলের শাস্তি কবে হবে সে জানে না। তবে সে যে ওর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পেরেছে তাতেই ওর শান্তি। কোনো অন্যায়ের কাছে কোনো দিন মাথা নত করবে না সে। একরাশ শিউলি ফুলের গন্ধ যেন ভেসে আসছে। কেমন পুজো পুজো গন্ধ! একরাশ খুশিতে মেতে ওঠার আহ্বান পেল সে।
তাড়াতাড়ি মাকে ডাকল," মা, মা, তাড়াতাড়ি রেডি হও। পুজো এসে গেল যে। চলো। জমিয়ে পুজোর শপিংটা সেরে ফেলি এই বেলা।"
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
----------------------------
পায়েল বিশ্বাস
ঠিকানা-৩/৭/সি, কৈলাস ঘোষ রোড, কলকাতা-৭০০০০৮
দারুণ
উত্তরমুছুনDivai 😘💟