মেয়ের গায়ে জ্বর। স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি চুপচাপ শুয়ে আছে, যে মেয়ে টরটর করে সারা বাড়ি ছুটে বেড়ায় সে চুপ করে শুয়ে। ও
মিসেস রায় বললেন - " ম্যাডাম তুত্তুরির জ্বর। এক চামচ প্যারাসিটামল দিয়েছি।মেয়ে কোলে নিয়ে রিক্সা করে বাড়ি এলাম । একদম নেতিয়ে পড়েছে। ফ্ল্যাটে ডাক্তারের চেম্বার আছে, বিভিন্ন ডাক্তার বসেন। মেডিসিনের কেউ না কেউ বসেই। ঘরে ঢুকে মেয়েকে শুইয়ে ফোন করলাম, বিকেলে নিয়ে যেতে বললো, পাঁচটায়। মেয়েকে পরিষ্কার করে, একটু দুধ কর্ণফ্লেক্স খাওয়ালাম। জ্বর নেই, তবে আবার আসবে। একটু গেল, বললো বমি আসছে। আর দিলাম না।
বিকেলে ডাক্তার দেখালাম, ঠাণ্ডা লেগে জ্বর। রাতে মেয়েকে খাইয়ে নিজে খেয়ে শুতে এলাম।
তুত্তুরি আমার নিজের সন্তান নয়। একমাস বয়সে ওকে নিয়ে আসি। প্রথমবারের আপত্তি ছিল একটু। -"আমরা তো ট্রিটমেন্ট করছি, তুমি ধরেই নিচ্ছ কেন আমাদের সন্তান হবে না"
বিয়ের পাঁচ বছরেও কেউ এলো না।
খুব খালি ছিল কোলটা। আমার সব ঠিক ছিল, প্রবালের অসুবিধা ছিল, সেটার ট্রিটমেন্ট ও করছিল।
তূত্তুরির মা মারা যায় ওকে জন্ম দিতে গিয়ে, ওর বাবা ওকে হাসপাতালে রেখে যায়, ডাক্তার আমাদের পরিচিত ছিলেন, আইনের ঝামেলা উনি সামলেছেন। দত্তক নিতে অসুবিধা হয় নি। এতো ছোট অবস্থায় ওকে আনি যে ও আমার গর্ভজাত সন্তান নয় সেটা কখনোই মনে হয় নি। প্রবাল শুরু থেকেই ব্যাপারটা পছন্দ করে নি।
মেয়ের দরকারি জিনিসপত্র আনতো, তবে সেভাবে ভালোবাসে নি। চাপা অশান্তি একটা শুরু হলো।
আমি ঝামেলা এড়াতে মেয়ে নিয়ে প্রান্তিকে পোস্টিং নিলাম। আমার স্কুলের নতুন ব্রাঞ্চে। এখানে আসার জন্য আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হে মিস্ট্রেস পোস্ট পাওয়া হয়ে গেল।
রাতে আর জ্বর আসে নি। সকালে দেখলাম একটু চাঙ্গা, মেয়ে পরিষ্কার করিয়ে খাইয়ে খাবার, ওষুধ, কিছু জামাকাপড়,জল সব নিয়ে মিসেস সেন কে দিয়ে এলাম তুত্তুরিকে। বলে এলাম, "স্কুল না করতে চাইলে থাক, ও শুয়ে থাকুক" আয়া মেয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি স্কুলে গেলেও মন পড়ে থাকলো মেয়েটার দিকে। মাঝে মাঝে প্রবাল আসে, আমিও তাই, একটা শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন চলে। ও বলে- "একটা অন্যের মেয়ে নিয়ে তোমার বাড়াবাড়ি, এরপরে আমাদের হলে তখন এটাকে কি করবে?"
আমার কথা-"জন্ম না দিলেও ও আমার সন্তান"। বুঝতে পারি প্রবাল আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের সন্তানের। আমি সাড়া দেই জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে। তাই সম্পর্ক টা টিঁকে আছে।
শিশুতো স্নেহ বোঝে, আমার সাড়ে তিন বছরের মেয়েও খুব বাবার কাছে ঘেঁসে না। এলে কাছে যায়, "বাবাই আবাল আব্বে" যাবার সময় বলে। এখানে একজন মহিলা ছোট বাচ্চাদের স্কুল চালান, দু'বছর থেকে স্কুল যাওয়া অব্ধি, দুই একটা বাচ্চা তার পরেও থাকে। ঐখানে তিন্নি থাকে। মহিলা কেয়ারিং, ওনার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড়ো ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে, ছোট মেয়ে ডাক্তার কলকাতায় আছে, ইন্টার্ণশিপ করছে। ঝাড়া হাত পা।
মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর আসছে আবার। এক ডোজ প্যারাসেটিমল দিলাম। কাল স্কুলে পরীক্ষার মিটিং আছে, যেতেই হবে। এই সময় খুব অসহায় লাগে। প্রবাল যদি একটু সহযোগিতা করতো! কি হয় নিজের সন্তান না হলে? আমি মা হয়ে তো ওকে এনেছি। মাতৃত্ব উপভোগ, অনুভব সবটাই মায়ের, পিতৃত্ব তো জন্মানোর পর। এতো ইগো ছেলেদের হয়! ঘুম আসছে না । ফোন বাজছে, প্রবালের ফোন ।
-"হ্যালো"
-"ঘুমাও নি?"
-"না ঘুমাই নি"
-"কেমন আছ?"
একটু ভেবে বললাম
-"তিন্নির জ্বর এসেছে"
-"কখন ? কবে থেকে?" ভুল শুনলাম কি? গলায় একটু যেন উৎকণ্ঠা দেখলাম।
-"আজ স্কুল থেকে এসে দেখলাম"
-"ডাক্তার আছে ওখানে?"
-"হ্যাঁ , নীচেই বসে এই বাড়ির"
-"কি বললো?"
-"সীজন চেঞ্জ, ঠাণ্ডা লেগেছে, মক্স কিড দিয়েছে"
-"কি করছে এখন?"
-"জ্বর এসেছে আবার, ওষুধ দিয়েছি, ঘুমোচ্ছে"
-" দেখ আবার, ওখানের ডাক্তার, কলকাতা হলে অনেক ডাক্তার, কি ওখানে পড়ে আছো! একটু প্যাকেজ বেশি, আর পোস্ট উঠেছে। এর জন্য কলকাতা ছাড়ার মানে হয় না!"
কিছু বললাম না, তারপরে কথা ঘোরালাম
-"তুমি এতো রাতে ফোন করলে?"
-"আমার ও ঘুম পাচ্ছে না, শোনো কাল স্কুলে যেও না, জ্বর না কমলে গাড়ি করে চলে এসো কলকাতা"
এবার হেসে ফেললাম -"বাচ্চাদের এরকম হয়, ভয়ের কিছু নেই, আমার কাল মিটিং আছে, যেতে হবে"
-"একদিন পিছিয়ে দাও পিউ, মেয়েটাকে অন্যের হাতে রেখে চলে যাবে?"
-"পরশু শনিবার, ছুটি, অতো চিন্তা কোরো না, সেরকম হলে শনিবার কলকাতা চলে যাবো, তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়ো"
চুপ করে থাকলো , তারপরে বললো -" হ্যাঁ, গুড নাইট"
আমার ঘুম এলো না, সাড়ে তিন বছরের দেড় বছর প্রবালের কাছে ছিলাম, তিন্নী ভুগেছে, আমি ছুটি নিয়েছি, ও সঙ্গে গেছে ডাক্তার দেখাতে, ওষুধ এনে দিয়েছে। এতো উৎকণ্ঠা দেখি নি।
রাতে আর জ্বর আসে নি। সকালে দেখলাম একটু চাঙ্গা, মেয়ে পরিষ্কার করিয়ে খাইয়ে খাবার, ওষুধ, কিছু জামাকাপড়,জল সব নিয়ে মিসেস সেন কে দিয়ে এলাম তুত্তুরিকে। বলে এলাম, "স্কুল না করতে চাইলে থাক, ও শুয়ে থাকুক" আয়া মেয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি স্কুলে গেলেও মন পড়ে থাকলো মেয়েটার দিকে।
তুত্তুরির স্কুল ৯টা থেকে বারোটা, আমার ১০ টা থেকে ৩টে। ওকে স্কুলে দিয়ে বাড়ি এসে শাড়ি পরে খেয়ে স্কুলে যাই।
আজ ওকে দেরী করে মিসেস সেনের কাছে রাখলাম, তারপরে সোজা স্কুলে। মন খারাপ লাগছিল, আজ সত্যি ছুটি নেওয়া যাবে না। হেডমিস্ট্রেস কে বললাম-"মেয়ের জ্বর, মিটিং শেষ হ়লেই আজ চলে যাবো।" মাথা নেড়ে বললেন-"তাহলে টিফিনের পরেই মিটিং ডেকে নেবো।" আশ্বস্ত হলাম। মেয়ের স্কুলে মাঝে একবার ফোন করলাম, জ্বর নেই বললেন।
মিটিং শেষ হতে হতে দুটো বেজে গেল। রিক্সা পেয়ে মেয়ের স্কুলে গেলাম। মিসেস সেন বললেন -"প্রত্যাশাকে ওর বাবা এসে নিয়ে গেছেন।" আমি অবাক, প্রবাল কখন এলো, আজকে তো আসে না কখনও, এলেও রাতে আসে। অবাক হয়ে বাড়িতে ফিরলাম। একটা তিনতলা বাড়ির দোতলায় দুটো ঘর নিয়ে আমি থাকি, স্কুল থেকে জোগাড় করে দিয়েছিল। দরজা টানলে খুলে গেল, দেখি মেয়ে ঘুমাচ্ছে আর পাশে প্রবাল শুয়ে আছে। ঘরে ঢুকতেই বললো-"জ্বর নেই, ভাত খেয়েছে"
-"কি দিয়ে ভাত খেলো?"
-"ডাল আর ডিমভাজা, খুব বিরক্ত করে খেতে, আমার গল্পের ঝুলি শেষ। ওষুধ দেই নি, ঘুমিয়ে আছে, উঠলে তুমি দিও।"
টেবিলে দেখলাম ডাল আর অমলেট করে রাখা।
-"কিসে আসলে?"
-"বিশ্বভারতী।"
-"তারমানে ভোরবেলা, কখন ঢুকেছ?"
-"তোমার বেরোবার আগেই আসবার চেষ্টা করেছি, এসে দেখলাম তুমি বেরিয়ে গেছ,ভাগ্যিস চাবিটা ছিল। চেঞ্জ করে এসো, খিদে পেয়েছে।"
-"সেতো পাবেই,ফোন করনি কেন?"
কিছু বললো না। এসে আলু ভেজে নিলাম, স্যালাড কেটে খেতে বসলাম। মেয়েকে একটা চুমু খেয়ে খেতে এলো।
আমার রাগটা ছিল, জিজ্ঞেস করলাম-"তুমি হঠাৎ? তোমার তো এমাসে ভিজিট দেওয়া হয়ে গেছে।"
অদ্ভুত ভাবে হেসে বললো-"মেয়ের বাবার নাম তো আমার লেখো, ওর শরীর খারাপ, তুমি থাকবে না, এসে কি ভুল করলাম? বায়োলজিক্যাল বাবা মা আমরা কেউ না, তাহলে একথা কেন? হ্যাঁ আমার সময় লেগেছে, তবে একটা বাচ্চা কে ভালবাসবো না? "
-"আগে তো এটা ভাবতে না?"
-"আমি মানুষ তো? ও আমাদের প্রথম বাবা মা ডেকেছে, বললাম তো, আমার খারাপ লাগে,ওকে মিস করি, কে জানে ও ছাড়া আর কেউ বাবা ডাকবে কি না! আসলে প্রথমে মনে হত ও আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আমি বাবা হতে পারি নি। যখন ওকে নিয়ে চলে এলে তখন থেকেই খারাপ লাগতো, কেউ তো বাবা বলে, এই ডাকটা তো ওর থেকে শুনলাম, ও না হলে, কখনও এই ডাক শুনতাম কি?"
তাকিয়ে দেখলাম চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। পিঠে হাত রেখে বললাম-"এখন থেকে মাসে তিনবার তুমি আসবে আর একবার আমি যাবো।"
বুকের মধ্যে এঁটো মুখ গুঁজে দিয়ে বললো-" আমি কিভাবে আছি একবার ও ভেবেছো?"
পরের দিন তুত্তুরি ফিট, দিব্বি বাপের পিঠে বসে হ্যাট ঘোড়া করছে, খেলছে, আমার কথা মনেই নেই যেন। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো। এখন বাবা মেয়ের এতো ভাব হয়ে গেল?
বিচিত্র মানুষের মন। একটু মনখারাপ হয়ে গেল, আমার সম্পূর্ণ অধিকার চলে গেল মেয়ের ওপর থেকে। মায়ের মনেও কি হিংসা থাকে? আমি তো এটাই এতোদিন চাইতাম, এটা নিয়েই মতো লড়াই, তাহলে কি লড়াই শেষ হয়ে গেল বলে এতো ফাঁকা লাগছে??
--------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
----------
সুস্মিতা চক্রবর্তী
দমদম ক্যান্টনমেন্ট
Phone 9903813156