গল্প।। বিবাহ বহির্ভুত।। অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায় ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;
অবশেষে বিয়েটা ভেঙেই গেল সৌরভ আর ঋতুপর্ণার । এই নিয়ে তিনবার । সৌরভকে সতর্ক করেছিল ঋতুপর্ণা | প্রিয়াঙ্কার সাথে যেন সে কোনো রকম সম্পর্ক না রাখে । প্রতিবারই কথা দেয় সৌরভ । আবার কথার খেলাপও করে সে । ঋতুপর্ণার একটাই কথা প্রিয়াঙ্কার কি এমন আছে যা তার নেই । তার চেয়েও বড় কথা কোনো মেয়েই চাইবে না যে তার স্বামী অন্য্ মহিলার সাথে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখে । এটা আত্ম সম্মানের প্রশ্ন । আজকে সে যদি অন্য কোনো পুরুষের সাথে এই রকম সম্পর্ক রাখতো তাহলে সৌরভ কি পারতো সেটা মেনে নিতে ?
স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে একটু অপরাধী অপরাধী মুখ করে সৌরভ বলতো , আর হবে না , তুমি দেখে নিও । এই আমি তোমাকে ছুঁয়ে বলছি । কিন্তু দু দিন যেতে না যেতেই সে কথা ভুলে যেত সৌরভ । আবার যেত প্রিয়াঙ্কার কাছে । অনেক সহ্য করেছে ঋতুপর্ণা । তার ওপর তাদের একমাত্র ছেলে ঋতম বড় হচ্ছে । রোজ রোজ চিৎকার , চেঁচামিচি আর ভালো লাগে না । ঋতম জানতে চায় । বলে , মা , কী হয়েছে ? তুমি কাঁদছো কেন ? বাবি তোমায় মেরেছে ? আমাকে বলতে হয় , না বাবা, কিছু হয় নি । ছেলের কাছে রোজ রোজ মিথ্যে কথা বলতে পারবো না ।
হয়ে গেল ব্রেক আপ । ছেলেকে নিয়ে চলে গেল ঋতুপর্ণা । আর কিছু করার নেই সৌরভের । আইনের নির্দেশ । মানতে সে বাধ্য । মেনে নিল । প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো । দীর্ঘ দিনের অভ্যাস । এত বড় বাড়ি একদম ফাঁকা হয়ে গেল । সমস্ত বাড়ি জুড়ে ঋতুর অস্তিত্ব । খুব খারাপ করলো সে । অথচ তার আর ঋতুর ভালোবাসার বিয়ে । সেই কলেজ জীবন থেকে একে অপরকে ভালোবাসে । কলেজ জীবন শেষ করে ঋতু খুব ভালো চাকরি পেয়েছিল । অসাধারন স্টুডেন্ট তার ওপর দেখতে শুনতে ভালো । সৌরভ তখনও চাকরি পায় নি । ঋতুর বিয়ের কথা শুরু হয়েছে তার বাড়িতে । কিন্তু সে কিছুতেই অন্য কোনো ছেলে কে বিয়ে করবে না ।
রাগ করে ওর বাবা বলেছিলেন , একটা বেকার ছেলেকে বিয়ে করবি । ওর তো কোনো মুরোদ নেই । তোকে খাওয়াবে কি ভাবে ?ঋতুর স্পষ্ট জবাব , কেন , আমি তো চাকরি করি । মাইনেও ভালো পাই । আমাদের দুজনের ভালোভাবে চলে যাবে ।
তাহলে আমাদের কি হবে ? জানতে চেয়েছিলেন ঋতুর মা ।
ঋতু বলেছিল , সে চিন্তা আমার আছে , মা । আমি তোমাদের একমাত্র সন্তান । তোমরা আমাকে বড় করেছ। মানুষ করেছ । এখন আমার দায়িত্ব তোমাদের দেখা । সে তো আমি দেখবোই । যাকেই বিয়ে করি না কেন , এটা থাকবে আমার একমাত্র শর্ত । কিন্তু সৌরভকেই আমি বিয়ে করবো ।
বাড়ির অমতেই বিয়ে হয়ে গেল দুজনের । বিয়ের পর প্রথম মাসের টাকা দিতে গেছিল ঋতুপর্ণা । নেয় নি তার বাবা |
বললেন , রেখে দে । আমার আর তোর মার শ্রাদ্ধে লাগবে । তোর টাকা নেওয়ার আগে যেন আমাদের মৃত্যু হয় ।
কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছিল ঋতুপর্ণা । এরপর চাকরি পায় সৌরভ । আর তার ঠিক পরে পরেই জন্ম হয় ঋতমের । নিজের থেকেই চাকরি ছেড়ে দিল ঋতুপর্ণা । বলল , এখন তুমি বাইরে সামলাবে আর আমি ঘর সামলাবো ।
সৌরভ ফিজিও থেরাপিস্ট । পেশেন্টের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তার কাজ । প্রতিদিন রাত্রে কোম্পানি মেল্ করে দেয় পরেরদিন সে কোথায় কোথায় ভিজিট করবে । রাতে বাড়ি ফিরে দিনের কাজের পুরো রিপোর্ট সে পাঠিয়ে দেয় অন লাইনে । তার ঘন্টা খানেক বাদে আসে পরের দিনের কাজের শিডিউল । এইভাবেই সে একদিন ভিজিট করতে যায় বড়লোকের একমাত্র মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ভাদুড়ীকে । গাড়ি চালাতে গিয়ে একসিডেন্ট করেছে । বন্ধুদের সাথে পার্টি করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরছিল । নিজেই চালাচ্ছিল গাড়ি । সেদিন এলকোহলের মাত্রাটা একটু বেশি হয়েছিল । বাইরের ফুরফুরে হাওয়ায় বুজে আসছিল দুই চোখ । ঠিক সেই সময়ে বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা একটা টাটা সুমোর সাথে মুখোমুখি সংঘাত । প্রাণে বাঁচলেও ডান দিকটা পরে গেছে । ডাক্তারের নির্দেশেই একজন ফিজিও থেরাপিস্ট প্রয়োজন । প্রিয়াঙ্কার বাবা যোগাযোগ করেন ওই কোম্পানির সাথে । তারা পাঠায় সৌরভ কে । বলতে গেলে সৌরভের হাতের গুনে খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে প্রিয়াঙ্কা ।
প্রিয়াঙ্কা ভালোবেসে ফেলে সৌরভ কে । সৌরভের হাতের ছোঁয়া কাঁপন ধরায় তার শরীরে । হরিণীর মত ছটফট করতে থাকে ভেতরে ভেতরে । এক সময় সুস্থ হয়ে ওঠে সে । ততদিনে সৌরভের মিষ্টি ব্যবহারে সে হয়ে উঠেছে ওই বাড়ির সকলের প্রিয় পাত্র । সময় পেলেই সে দেখা করতে যায় । প্রথম দিকে চাকরির কড়া নিয়ম অনুযায়ী সৌরভ প্রিয়াঙ্কাকে একজন পেশেন্ট ছাড়া অন্য কিছু ভাবতো না । দিন যত এগিয়েছে , প্রিয়াঙ্কা যত সুস্থ হয়েছে , তাদের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে । প্রিয়াঙ্কার অমোঘ টানে সে ছুটে ছুটে যায় । ঋতুপর্ণা এসব ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামাতো না । এটা সৌরভের চাকরির জায়গা । কিন্তু ক্রমান্বয়ে ব্যাপারটা আর সেই জায়গায় থাকলো না । বিশ্বাসের অমর্যাদা করলো সৌরভ । ঋতুপর্ণাকে গোপন করে মিশতো প্রিয়াঙ্কার সাথে । অনেক বার নিষেধ করেছে । কিন্তু সৌরভ নাচার । তারই পরিণতি বিচ্ছেদ ।
বিবাহ বিচ্ছেদের দিন পনেরো বাদে সৌরভের ডাক পড়লো প্রিয়াঙ্কাদের বাড়িতে । প্রিয়াঙ্কার বাবা এবং মা সরাসরি জানালো যে প্রিয়াঙ্কা সৌরভকে বিয়ে করতে চায় । তাদের কোনো আপত্তি নেই । সৌরভকে তারাও পছন্দ করে । সৌরভ বিবাহিত বলে এতদিন তারা কিছু বলেন নি । আজ যখন সে একা তাদের দুজনের বিয়ে হওয়াতে কোনো আইনি বাধা থাকলো না । তারা সৌরভের মত জানতে চাইলেন । সৌরভ রাজি । হয়ে গেল সৌরভ আর প্রিয়াঙ্কার বিয়ে । ঋতুপর্ণা সবই শুনেছে । সবই জেনেছে । সকলের অজান্তে চোখের জল ফেলেছে । ভেতরে ভেতরে সে আজও ভালোবাসে সৌরভকে । তার সৌরভ আজ অন্যের হয়ে গেল । এ তার চরম পরাজয় । নারী হিসাবে লজ্বারও বটে ।
কিন্তু বিয়েটা সুখের হলো না । মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানসিকতায় বিত্তশালী বাবার একমাত্র মেয়ে প্রিয়াঙ্কার নাগাল পেল না সে । দুজনের মানসিকতার আকাশ -পাতাল পার্থক্য । প্রিয়াঙ্কা যে উশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত , সৌরভ সেখানে ব্রাত্য । তার ভালো লাগে না ওই সব নাচ গান আর মদ্যপান । সে অনুভব করলো এ জগৎ তার নয় । অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে সে । প্রাচুর্য কাকে বলে তা ছিল সৌরভের অজ্ঞাত । কী ভাবে জানবে ? বন্ধুরাও সব তারই শ্রেণী ভুক্ত । বড্ড ভুল হয়ে গেছে । অপরাধ করেছে ঋতুপর্ণার কাছে । তাকে ভালোবেসে ঋতু চলে এসে ছিল নিজের বাবা মা কে ছেড়ে । বেকার সৌরভকে বিয়ে করতে । প্রাণ দিয়ে সে ভালোবাসতো সৌরভকে । প্রতিদানে সে চরম অপমান করেছে ঋতুকে । তার শাস্তি পাওয়াই উচিত । যে পুরুষ সংযমী নয় , স্ত্রী থাকতেও পর নারীর মোহে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে সে আর যাই হোক ভালো মানুষ কখনোই নয় ।
বিয়ের বছর খানেক বাদে একদিন সৌরভ এল ঋতুপর্ণর সাথে দেখা করতে । সৌজন্য মূলক সাক্ষাৎকার ভাবলে ভুল হবে । এই আসার পেছনে সৌরভের অন্য একটা অংক আছে । বিয়ে করে বুঝতে পেরেছে যে প্রিয়াঙ্কা তার জন্য তার পূর্বের জীবন ছাড়তে পারবে না । নাচ গান পার্টি মদ মাতলামি বয় ফ্রেন্ড সব আগের মতনই । তার একটাই অনুরোধ ঋতু যেন মাঝে মধ্যে তাকে এই বাড়িতে আসার অনুমতি দেয় । সাময়িক মান অভিমানের পালা কেটে যেতেই পুরনো প্রেম টগবগিয়ে উঠলো ঋতুপর্ণার মনে । কি রকম যেন রিনরিন করে উঠলো সমস্ত শরীর । সে রাজি হয়ে গেল ।
এরপর থেকে মাঝে মধ্যেই সৌরভ আসতো । দুজনে গল্প করতো । ছেলেকে নিয়ে খেলা , বেড়ানো সবই আগের মতন । ঋতুপর্ণা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি । তার কেন জানি না মনে হলো ' জয়ী আমি আজ ' । পুরনো তিক্ততা ভুলে আপন করে নিল সৌরভকে । অধিকার , দায় - দায়িত্ব কোনো কিছুর আর তার প্রয়োজন নেই । এভাবেই আসুক সৌরভ । এভাবে তাকে পেলেও সে খুশি । আইন তাদের আলাদা করলেও শরীর এবং মন দুজনের এখনো এক বিন্দুতে বাঁধা । সমস্ত সঙ্কোচ কাটিয়ে ঋতুপর্ণা নিজের বিছানায় নিয়ে গেল সৌরভ কে । আবার আগের জীবন । একসাথে এক বিছানায় । একে অপরকে ভরিয়ে দিতে লাগলো ভালোবাসায় । বিচ্ছেদের পরে প্রেম যেন দ্বিগুন বেড়ে গেছে । এখন আর কোনো লুকোচুরি নেই , ঝগড়া নেই , বিবাদ নেই , সন্দেহ নেই শুধুই ভালোবাসা ।
___________