Click the image to explore all Offers

গল্প।। প্রতিশোধ।। তনিমা সাহা ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;




 
আমি ম্যাইকেল ডিভিয়ার...পেশায়… সে নাহয় উহ্য থাক, খাঁটি নীল রক্ত আমার। আজ বহু বছর ধরে আমি  বার্মা মানে বর্তমান মায়েনমায়ের এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। বিচ্ছিন্ন দ্বীপেই কেন থাকি...হমমম্...বলতে পারো জনসমাগম আমার ঠিক পছন্দ না। বেশী লোকজন, কোলাহল থাকলে আমার শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। আমার নির্জনতাই বেশী পছন্দের। রাতের নিস্তব্ধতা কথা বলে আমার সঙ্গে।  কত রাতকথা আমার কানের কাছে কিচকিচ করে তবে বেশীরভাগই কথার বদলে থাকে নৈঃশাব্দিক চিৎকার।

আমার কাছে এক শতাধিক বছর পুরোনো বার্মিজ টিকের পালঙ্ক আছে। গাঢ়ো খয়েরী রঙ তার। পৈত্রিক সম্পত্তিই বলতে পারো। আসলে আমার পূর্বপুরুষরা তো একসময় এই দ্বীপেরই একচেটিয়া রাজা ছিলেন। কী ভাবছো..আমার নামটা তাহলে তো বার্মিজ নয়...তাই তো। আসলে ম্যাইকেল নামটা আমার ছদ্মনাম। হ্যাঁ তো যা বলছিলাম...তখন থেকেই একটা বিশেষ প্রথা ছিল। বছরের এক বিশেষ দিনে আমাদের রাজমহলে উৎসবের আয়োজন করা হতো। দ্বীপের বাইরে থেকেও অনেক লোক আসতো বা বলা ভালো আনানো হতো খাদ্য ও অর্থের লোভ দেখিয়ে। একটু বিশৃঙ্খলার ও সৃষ্টি হতো। যার ফলে সবসময়ই উৎসব শেষে এক/দুজন লোকের খোঁজ পাওয়া যেত না। উৎসবের নিয়ম অনুসারে বংশের ছেলেদের কুড়ি বছর অতিক্রান্ত না হলে এই বিশেষ উৎসবে অংশগ্রহণ করা যাবে না।

তখন আমার কুড়ি বছর। সেবছর উৎসবটা একটু বড়ো করেই করা হয়েছিল। লোক সমাগম ও হয়েছিল বেশী। সেবার অনুষ্ঠান শেষে ছয়জন মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবারই বয়স প্রায় ষোল থেকে আঠারো বছরের মধ্যে। সেই মেয়েদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ফেরৎ পাঠানো হলো। উৎসব শেষে আমি আমার ঘরে ঢুকলাম যেখানে আমার প্রিয় গাঢ়ো খয়েরী রঙয়ের বার্মা টিকের পালঙ্কের উপর মুখ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সেই হারিয়ে যাওয়া ছয়জন মেয়ের একজন রয়েছে। আর বাকি পাঁচজন রয়েছে আমার বংশের অন্যান্য পুরুষদের ঘরে তাদের বার্মা টিকের পালঙ্কে একই অবস্থায় বাঁধা। আমি ধীরপদে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির পরিহিত বস্ত্র ছিড়ে দিয়ে মেয়েটিকে শুইয়ে ভালো পালঙ্কের চারকোনায় দড়ি দিয়ে তার হাত-পা বেঁধে দিলাম। সম্পূর্ণ নগ্ন মেয়েটির ওপর ছড়িয়ে দিলাম তন্ত্রবিদ্ধ কালো গোলাপ। তারপর বেড়িয়ে এলাম ঘর ছেড়ে। আশ্চর্য্য মেয়েটি একফোঁটা আওয়াজও বার করেনি না তো একফোঁটা চোখের জল ফেলেছে। বরং তার চোখে যেন ছিল এক জিঘাংসার আগুন। আমাদের কুলগুরুরা এই পালঙ্কগুলোকে বিশেষ মন্ত্রপুতঃ করে দেন। আমাদের যাবতীয় প্রয়োজন এই পালঙ্কগুলোই মেটায়। অর্থ, খাদ্য..যা চাই...সব দেয় এই পালঙ্কগুলো। এমনকি আমরা নিজেদের বয়েসকেও ধরে রাখতে পারি এই পালঙ্কের প্রভাবের জন্য। বলতে গেলে পালঙ্কটাই আমাদের প্রানভোমরা। আবার আমাদের রক্ষাকবচও। আমাদের পরিবারের সকলেরই প্রানভোমরা তাদের নিজের নিজের পালঙ্কে প্রতিষ্ঠিত করা রয়েছে। ওহো! বলতে ভুলে গেছি আমাদের পরিবারে কিন্তু কোনো মহিলা নেই। সবাই পুরুষ। নিশ্চয়ই ভাবছো তাহলে বংশবৃদ্ধি কি করে হয়? ওই উৎসবে সময় গায়েব হওয়া মেয়েদের মধ্যে যাকে পালঙ্ক উপযুক্ত মনে করে তার সশরীরে বলিতেই আসে আমাদের বংশপ্রদীপ। আমাদের কিচ্ছুটি করতে হয় না। যা করার সব...সব ওই বার্মা টিকের খয়েরী পালঙ্কটাই করে। পরিবর্তে শুধু বছরে একবার এক কুমারী ষোড়শী বা অষ্টাদশী কন্যাকে এই পালঙ্কের উপর শুইয়ে বলি দিতে হয়। পালঙ্ক সেই কন্যার সমস্ত রক্তবিন্দু, শরীরের সমস্ত মাংস নিঃশোষিত করে নেয়। আর পরদিন পালঙ্কের উপর সাজানো থাকে অপার ধনসম্পদ, অপরিমিত খাদ্য এবং যদি সেই কন্যা যোগ্যা থাকে তবে একটি পাঁচ/ছয় বছরের শিশুও থাকে অর্থাৎ আমাদের বংশধর। যুগ যুগ ধরে এই একই নিয়ম চলে আসছে। 

কিন্তু সেইরাতে হঠাৎই আমাদের রাজমহলে আগুন ধরে যায়। একে একে পুড়ে ছাই হতে থাকে আমার পরিবারের সকলের বার্মা টিকের পালঙ্ক আর তার সাথেসাথে পুড়ে ছাই হতে থাকে পরিবারের পুরুষরা। প্রতিটি ঘর থেকে শুধু কাতর চিৎকার ভেসে আসছিল। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে আমার ঘরের দিকে ছুটলাম। ঘরে পৌঁছে দেখি পালঙ্কটা সম্পূর্ণ রক্তমাখা...মেয়েটির চিহ্নমাত্রও কোথাও নেই। অর্থাৎ পালঙ্ক তার ভোগ সেরে নিয়েছে। সেরাতে আমি কী করে জানি বেঁচে গিয়েছিলাম। তারপর থেকে আমি একাই রয়ে গেছি‌। আমি ভিন্ন আর কেউ জীবিত ছিল না। তবে আমার ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকার জন্য পালঙ্কের খিদে তো মেটাতে হবে। তাই বছরে একবার আমি নাম পাল্টে, ভোল পাল্টে দ্বীপের বাইরে যাই এক ষোড়শী বা অষ্টাদশীকে নিয়ে আসি। এই আজকেই একজনকে নিয়ে এলাম।

নিয়মমতো সব বিধি করে মেয়েটাকে পালঙ্কের সাথে বাঁধতে গিয়ে দেখি মেয়েটির হাত বা পা বাঁধার আগেই পিছলে যাচ্ছে। ভারি অবাক হয়ে গেলাম আমি। এমনতো আজ পর্যন্ত কখনোই হয়নি। আমি আবার চেষ্টা করলাম তার হাত-পাগুলোকে পালঙ্কের চারকোনায় বাঁধার জন্য। আবারো একই ঘটনা ঘটলো। আমি বারবার চেষ্টা করতে লাগলাম আর বারংবারই মেয়েটির হাত-পা পিছলে যাচ্ছিল। এবার আমার ভয় করতে শুরু করলো। হঠাৎ রাতের নৈশব্দকে খান খান করে মেয়েটি পৈশাচিক ভঙ্গিতে হেসে উঠলো। মেয়েটি বললো, "সে রাতে তোর বংশপুরুষদের জন্য বেঁচে গিয়েছিলি তুই। আজ তোকে কে রক্ষা করবে….আজ যে তোকে শেষ হতেই হবে...হাঃ হাঃ হাঃ"। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির শরীর এক লেলিহান অগ্নিগোলকে পরিনত হয়ে গেল। আর সেই অগ্নির প্রভাবে জ্বলতে লাগলো আমার সাধের খয়েরী রঙয়ের বার্মা টিকের পালঙ্ক এবং আমার শরীর। প্রানবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার আগে মনে পড়লো কুলগুরুর সতর্কবাণী। "কোনো বিশুদ্ধ রক্তের বালিকা যার পরিবারের আগেও কাউকে বলি দেওয়া হয়েছে এমন কাউকে যেন পালঙ্ককে সমর্পণ না করা হয়। তাতে সর্বনাশ হয়ে সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে"। মনে পড়লো এই সেই মেয়েটি যার চোখে ছিল শুধুই জিঘাংসা। শুনেছিলাম ভারত বলে কোনো একটি জায়গা আছে যেখানে সীতা বলে এক রানীর নাকি নিজদেহকে আগুনে লেলিহান করার ক্ষমতা ছিল। কারন তিনি ছিলেন সৎ,পবিত্র ও নিষ্ঠাবান। তবে...তবে এই মেয়েটিও কী…….। আমার বুক চিরে এক আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো যা রাত্রির নিস্তব্ধতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল।

-----------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট 
 
---------------------------------------------------------------- 
 

লেখনীতে : তনিমা সাহা
 
ঠিকানা : বিদ্যাকূট আবাসন, 
খাদীম কমপ্লেক্স, স্যার রমেশ মিত্র লেইন, নারায়ণপুর, কোলকাতা-১৩৬ 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.