আর ভালো থাকতে পারছে না ছুন্নিপিসি । ঘর জ্বালানো , পাড়া জ্বালানো আধ-দুমড়ো ছেলে-ছোকরাগুলো এমনকি আশপাশের গৃহস্থের মেয়ে বউরা পর্যন্ত আজকাল চৌপ্রহরই পিসিকে বড় অতিষ্ঠ করে মারছে । আর এর মূলে পিসির ঠিক ঘর সুমুখের একটি পেয়ারাগাছ । পিসির বর মন্টুপিসা গাছটির চারা অনেক কাল আগেই পুঁতে ছিলেন । যখন পিসি সবে মাত্র বিশ আর পিসা আঠাশ-ত্রিশ । তা তিনি তো কোন কালেই মরে ভূত হয়ে গেছেন । এখানে ভূত কথার অর্থ অতীত । মেসো মরে যাবার আগে পর্যন্ত গাছটি একটি ফলও বিয়োয় নি । তখন পিসিও বরকে কত খোটা দিয়েছে, তোমার গাছ তোমারই মতো । পিসা এর অর্থ বুঝতো বাঁজা । কিন্তু মন্টু পিসা মরে যাবার পর পরই তার ফলন্ত রূপ নজর কাড়ল পাড়া শুদ্ধ সবার । ফলে যা হয় দিবারাত্র উৎপাত । এ চালে ঢিল ছোঁড়ে তো ও আঁকশি বাড়িয়ে টানে ডাল । মাঝ মাঝে আবার একদিন দল বেঁধে আসে সভ্য মানুষের পূর্ব পুরুষেরা , মুখপোড়া হনুমানেরা । সে আর এক ঝকমারি । চালে হনুমান, উঠোনে হনুমান । আগল ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ার জোগাড় । আর হনুদের উত্তর পুরুষরা তো আছেই রোজের ঝঞ্ঝাট হয়ে ।
একটুও নজর ঘোরানোর উপায় নেই পিসির । মাঝে মাঝে হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে পিসি । দেখি ব্যাটারা কত বাড় বাড়ে । কিন্তু না , তাতে ফল হয় উল্টো । তখন সবাই ভাবে ছিটেল বুড়িটা হয় মরে গেছে বা কোথাও চলে গেছে । পাড়া-পড়শিতে তখন কুশি গুলোকেও বাদ না । পারলে ডাল-পাতাগুলোকেও সাবড়ে দেবার জোগাড় করে ।
তখন পিসিও তার নিজের রূপ ধরে । কিন্তু পিসি যে এত চেষ্টা করে ফলন্ত গাছটাকে রক্ষা করে, তাতে পিসির নিজের লাভ তেমন কিছুই হয় না । কারন পিসির দাঁত বলতে আছে শুধুই দাঁতের দু পাটি মাড়ি । তা দিয়ে ডাঁসা পেয়ারা তো দূর্ অস্ত, পাকা পেয়ারাগুলোও আয়েস করে চিবানো যায় না । আর সে হল রস বোধের ব্যাপার । পিসির এই গাছটির ওপর মায়া অন্য কারণে । এক , গাছটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পিসির মৃত বরের স্মৃতি । দুই , শেষ পর্যন্ত গাছটির ফলন আসে বড় অসময়ে , অথচ তার জন্য কম গঞ্জনা দেয়নি নিজের বরকে । পিসি নিজের ব্যক্তিগত অভাব অভিযোগও গাছের নাম করে কত দিন উগরে দিয়েছে বরের ওপর । পত্নীনিষ্ট মন্টু পিসা পিসিকে কিন্তু তার জন্য কোন দিনও আঁচড়টি পর্যন্ত কাটে নি , কিচ্ছুটি বলেও নি । পিসি যে সেই কোন ছোট্টবেলাটি থেকে মন্টু পিসার ঘর সামলাচ্ছে তাতেই মানুষটা বড্ড কৃতার্থ ছিল কিনা । অথচ মানুষটা ছুন্নিপিসির আনন্দের জন্য, একটু সুখের জন্য কম কিছু করেনি এবং মুখে চব্বিশ ঘন্টার গোঁসা নিয়েও তাই পিসার ওপর পিসির কর্তীগিরিও কম ছিল না । জানতোই তো মানুষটা তার প্রতি কতটা নরম । এই নরম মানুষটাই পিসির কত বড় শক্ত একটা অবলম্বন ছিল , দিন থাকতে পিসি কেন যে বুঝতে পারলো না । আজ এই একটাই পিসির বেঁচে থাকার আফশোস ।
পিসি এমনিতে ভালোই থাকতো । কিন্তু পিসির নিজের বোনেরা বা ভাই-ভাজরা যখন সময় সময় ওদের ছানাপানাদের নিয়ে আসতো আর কুঁড়িপানা মুখগুলো কদিন সারা ঘর দোর উঠোন মুখর করে তুলে হঠাৎ করে চলে যেত । দিন কয়েক খুব মন মরা হয়ে থাকতো পিসি । যেন কত রাগ নিয়ে আছে । তখন পিসা খুব নজরে নজরে রাখতো পিসিকে । পিসির মন ভালো করার খুব চেষ্টা করতো । পিসি তখন কথায় কথায় পিসার ওপর রাম খাপ্পা । পান থেকে একটু চুন খসলেই ঝামটা দিয়ে বলতো ভাল্ লাগেনা ঘাটের মরা এ সংসারে থাকতে । একদিন যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাবো ।
পিসা মজা করে পিসিকে তখন বলতো তোমার বোচকা-বুচকিগুলো বইবার জন্য অন্তত এই বীরপুরুষটাকে সঙ্গে নিও । তা না হলে এ হতভাগা আবার এই বয়সে কোথায় বউ খুঁজতে ঘুরে মরবে?
আজো ভোর থাকতে ওঠা পিসির স্বভাব । একদিন ভোরের প্রথম আলো যখন জানলার গরাদ সরিয়ে মন্টু পিসার মুখের ওপর পারতো পিসি সারাদিনের সব রাগ দুঃখ ভুলে মানুষটার মুখের চেয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে পেতে চেষ্টা করতো এত দরদী একটা মানুষের ঠিক কোনখানটাতে অন্ধকার ! যা পিসির লক্ষ্যে আসে না । তখন নিজেকেই বড্ড অপরাধী মনে হোত পিসির ।
এই পিয়ারাগাছটার বুড়ি বয়সের ফলন পিসিকে পিসির সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে । তাই পিসির বড় মায়া এই গাছটার প্রতি আর কষ্ট বড় অসময়ে চলে যাওয়া আমাদের মন্টু পিসার জন্য । কেন যে পিসি সারাক্ষণই শুধু মানুষটাকে খিটির খিটির করে মরল ।
যদি কিছুটা দরদ বুঝতো মানুষটার ! হয়তো পিসির সব মুশকিলের আসান ঐ মানুষটার কাছেই ছিল ।
পিসি এখন একটা জীবন্ত মিউজিয়ামের মত ।
মিউজিয়ামে যেমন সাজানো থাকে বিগত দিনের মূর্ত বিমূর্ত সব স্মৃতি , পিসিও তা-ই । হুবহু একটা পুরোনো দিনের সংগ্রহশালা । সারাদিন এই সংগ্রহশালাটিরই কেয়ারটেকারও আবার পিসি নিজেই । আসলে আজকাল পিসির তো আর আপন বলে কেউ নেই ।
পিসির বোনেরা আজ পিসির মতই বুড়ি-থুরি । পিসি তবুও কিছুটা ডাঁটো আছে এখনো । তারা এখন তাদের ছেলে-বউদের সব গলগ্রহও । এ ঠেলে তো ও ধরে, ও ঠেলে তো এ ধরে । মা বলে কথা , ফেলতেও পারে না । আর ভাইরাও সব কেমন যেন যবুথবু , নড়বে-চড়বে কী । তাদের গাঁটে বাত , কোমরে ব্যাধি । নিজেদের বাত-ব্যাধিতেই তারা অতিষ্ঠ ।
আর যে চাঁদপানা মুখ কচিকাঁচাগুলো একদিন তাদের প্রাণ-ভ্রমরা ছিল তারা তো এখন সব হোমরাচোমরা এক একটা আস্ত পুরুষ মানুষ । আর পিসির বোনের সেই কচি মেয়েটা যে ছিল ভাইদের একমাত্র চম্পা বোন । সে জলপরী তো এখন রীতিমত জাঁদরেল ঘরণী ।
ঘর-বর-পোলা পান সব মিলিয়ে তার তো ভরভরন্ত অবস্থা । সারা দিনমান তাদের কত কত কাজ । নিজেদের বাপ-মায়েদেরই খেয়াল রাখার ফুরসত তারা পায় না তো কে কোথাকার কোন পিসি ! পিসি বেঁচে-বর্তে আছে না মরে-হেজে গেছে তারই খোঁজ রাখে না । পিসি এ সব নিয়ে আর অভিমান করে না । কেন করবে ! তাদের তো পিসি দশ মাস ধরে পেটে ধরে নি । কালেভদ্রে পিসি বাড়ি ঘুরতে এলে পিসি অপার স্নেহ মমতায় নিজেরই পেটের সন্তান ভেবেই একটু আধটু আদর যত্নআত্তি করেছে এই যা । কিন্তু তাতে কী ! এতটুকু কী আর আজীবন মনে রাখার মত কিছু ?
পিসি তবু সবার ভালো চায় । দিবারাত্র ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, ঠাকুর সবাইকে ভালো রেখো ।
আর নিজের অজান্তেই আশা করে কাজ ফুরলে পিসিকে মনে করে নিশ্চয়ই একদিন দল বেঁধে আসবে সবাই তাদের ছুন্নিপিসির ঘর দোর উঠোনের তল-মাটি ওপর-মাটি সব একাকার করে দিতে ।
এই একটি মাত্র আশা নিয়েই পিসি কথায় কথায় আর পাঁচটা বুড়োবুড়ির মত মরণ চায় না । সদাসর্বদা জীবন চায় । পিসির যা কিছু নিজের সবটুকু আঁকড়ে থেকেই পিসি বেঁচে থাকতে চায় । পিসির ভিটেমাটির একটি কণাও পিসি তাই কারোর কাছেই দান-খয়রাতও করতে চায় না , খোয়াতেও চায় না ।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
ঠিকানা : 35 P Road , Netajighar , Howrah -711108
মো: 7044587565