বিজ্ঞপ্তি
লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫
নভেম্বর ২১, ২০২৪
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ছোট্ট একটা জনপদ মীরগঞ্জ | সেখানেই একটা ছোট একতলা টালির বাড়িতে টুসুরা থাকে | টুসু সূর্যাস্তের সময় মাঝে মাঝে পদ্মানদীর পশে ঘন্টাঘাটে বসে থাকে | এদিকটা বড় কেউ আসে না | অন্যদিন সূয্যি ডোবার আগে পদ্মা নদীর এইখানটাতে বসে থাকতে তার বড়ো ভালো লাগে - কিন্তু আজ তার মনটা ভালো নেই | আজ তার কলেজের বন্ধুরা দোলের রঙ খেলা এবং তার পর সন্ধেবেলার পিকনিকের প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করছিল | টুসু তাদেরকে আমি থাকতে পারবো না রে বলে সরে পড়েছে - যদিও টুসু জানে এই অজুহাতটা তাকে দিতেই হতো | তার বাবা লোকাল ট্রেনে গামছা , রুমাল ইত্যাদি বেচে , কিন্তু করোনার জন্য সমস্তকিছু লকডাউন ছিল | তারপরে ধীরেধীরে ট্রেন চালু হলেও ট্রেনে তার বাবার মতো সেলসম্যানরা এখনো রেলে ওঠার অনুমতি পাই নি | জমানো টাকা যা ছিল তা প্রায় শেষের দিকে | সামান্য জমিজমার শাকসবজি দিয়ে কোনোভাবে টুসুদের দৈনিক গ্রাসাচ্ছদনটা চলে যায় | ঠাকুমার ওষুধ , তার আর তার ভাইবোনদের অনলাইন ক্লাসের জন্য ইন্টারনেট কানেকশান , স্মার্টফোন সব কিনতে গিয়ে টুসুর বাবাকে হয়তো কারোর কাছ থেকে ধারই করতে হয়েছে ! যদিও এসবকথা তার বাবা তাদেরকে জানায় না | সুতরাং এতো অভাবের মধ্যে পিকনিক , দোলের রঙ এসবের জন্য আরো পাঁচশো টাকার চাপ সে আর তার বাবাকে দেবে না !
হটাৎ সে শোনে এক উদাত্ত কণ্ঠস্বর - "কি ভাবছো ?" চমকে উঠে টুসু মুখ ফিরিয়ে দেখে এক ভারী চমৎকার দেখতে কৃষ্ণবর্ণ যুবক | টুসু একটু বিরক্ত হয় | আজকাল কিছু লোকের একলা মেয়েকে বিরক্ত করার স্বভাব হয়েছে - কিন্তু পরমুহূর্তেই সে ভাবে একে তো সে কোনোদিন মীরগঞ্জে দেখেনি | তাই সে উল্টে জিজ্ঞাসা করে -"আপনি ? আপনাকে তো এখানে কোনোদিন দেখিনি !" যুবকটি একটু হেসে বলে -"আমি এখানে থাকি না - ঘুরতে ঘুরতে তোমাদের জায়গাতে এসে পড়লাম | নদীর ধারটা ভালো লাগলো | এসে দেখি তুমি নীরবে কাঁদছো !" অন্যসময় হলে একজন অপরিচিত মানুষের তাকে নিয়ে এতো কথা বলার জন্য টুসু বিরক্ত হতো | কিন্তু সে এই যুবকটির মুখের দিকে তাকিয়ে তার বিরক্তি হারিয়ে ফেলে - যুবকের হাসিটা বড়ো মিষ্টি , মুখটা ভীষণ মায়াময় | তার হাসি দেখলে নিজের দুঃখ যেন ভুলে থাকা যায় !
সে ধীরেধীরে যুবকের কাছে নিজেকে উন্মোচিত করে - বলে ফেলে তার দুঃখের কাহিনী ! বলতে বলতে টুসু নিজেই অবাক হয়ে যায় যে একদম অপরিচিতের কাছে কিভাবে তার একান্ত বেদনার ঝুলি সে উপুড় করে দিতে পারছে ! যুবকটি যেন জাদু জানে ! সে ফাঁকে ফাঁকে দুএকটা কথা বলে আস্তে আস্তে টুসুর মনের ভিতর থেকে সমস্ত কথা টেনে বের করে নেয় |
টুসু বলতে থাকে -" করোনার জন্য আমার বাবার বিক্রিবাটা সব বন্ধ | ঠাকুমার শরীর ভালো নয় | আমি বড়বোন | আমার পরে ছোট বোন আর ভাই আছে কখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা কেউ জানে না - তাই নিজের আনন্দের জন্য টাকা চাইতে বিবেকে বাধছে ! এখন আমাদের কাছে পাঁচশো টাকাও অনেক !"
যুবকটি গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে -"আমাকে একটু সময় দেবে ? যদি কিছু করতে পারি ..” টুসু চমকে তাকায় - এতক্ষনের ভারী নরম সহানুভূতিশীল কণ্ঠটা কেমন যেন অন্যরকম শোনাচ্ছে |
ধীরেধীরে আঁধার নেমে আসে |
" চলো এবার তোমাকে বাড়ির দিকে এগিয়ে দি ! "
"আমি একা চলে যেতে পারবো |"
"তবুও চলো " - যুবকটি মৃদু হেসে বলে | আবার যেন তার স্বরে আগের নরমভাব ফিরে এসেছে |
"তোমার নামটাই তো জানা হলো না " - টুসু জিজ্ঞেস করে | কখন সে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে তাসে নিজেই খেয়াল করলো না |
"আমার নাম - ঘনশ্যাম | দেখোনা কালো দেখতে বলে আমার এরকম নাম !" আবার হেসে ওঠে যুবকটি | এরকম মনভালো করা হাসি টুসু আগে কখনো শোনেনি |
টুসু লজ্জাতে বলতে পারেনা কালো হলেও তার মতো সুন্দর মানুষ সে কমই দেখেছে |
সে তার বাড়ি থেকে একটু দূরে ঘনশ্যামকে বলে -"এখান থেকে আমি একা যেতে পারবো |"
টুসু ভাবে কেউ আবার তার সঙ্গে একজন অপরিচিত যুবককে দেখলে আপত্তিকর কথা বলতে ছাড়বে না |
"ঠিক আছে - আমি তবে আসি |"
টুসু আচমকা বলে ওঠে -" কাল আসবে নদীর ধারে ?"
ঘনশ্যাম আবার একটু হেসে বলে ওঠে -" তুমি চাইলে আসবো !"
টুসুর মনটা এখন অনেক হালকা - সে বলে -" এস তাহলে - কাল এমনিতেই আমি আমার বন্ধুদের এড়িয়ে নদীর ধরে বসে থাকবো | এদিকটা বড় কেউ আসে না - ঘাটটাও দেখছো তো কেমন ভাঙাচোরা | সাপখোপের ভয়ে সবাই জায়গাটা এড়িয়ে চলে | বাড়িতে থাকলে কেউ হয়তো জোর করে টেনে নিয়ে যেত ..."
ঘনশ্যাম বলে ওঠে -"তাহলে তুমি দোলের দিনটা একাএকা কাটাবে ঠিক করেছো ?"
টুসু এবার হেসে ফেলে বলে -"কেন তুমি আসবে বললে যে!"
আলো থাকলে ঘনশ্যাম লক্ষ্য করতো টুসুর গালদুটি লাল হয়ে গেছে |
বাড়ি ফেরার সময় তার সোনালীদির সাথে দেখা হয়ে যায় ! সাইকেল চালিয়ে আসছিলো - "কিরে টুসু একলা একলা কোথা থেকে আসছিস ?"
টুসু মুখ ফস্কে বলে ফেলে "একলা ?"
" হ্যাঁ - দেখলাম দূর থেকে হাত পা নাচাতে নাচাতে হাঁটছিস | একাএকা বকবক , না বকবক না; গান করছিস - নাটকের রিহার্সাল করছিস নাকি ?" সোনালী হেসে উঠে বলে |
টুসু ভাবে ডার্ক ড্রেস তার উপর কালো গায়ের রং – ঘনশ্যামকে মনে হয় সোনালীদি দেখতে পায় নি | একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে : দেখলে পাড়াতে সবাইকে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে বলতো, , অবশ্যই কিছুটা রঙ চড়িয়ে |
মা বাবার কানে গেলে আবার আরেক বিড়ম্বনা !
পরের দিন টুসুর বেরোতে বেরোতে একটু দেরি হয়ে যায় | সে নদীর ধারে এসে দেখে ফাঁকা | পদ্মাতে এইসময় জল বড় কম - মাঝনদীর চরটা ভেসে উঠেছে |
টুসু ভাবে ঘনশ্যাম কি এসে অপেক্ষা করে করে চলে গেছে ? টুসু ভাবে উঠে পড়বে কিনা - মনটা তার আবার বিষন্ন হয়ে ওঠে | এমন সময় দেখে ঘনশ্যাম এসে পড়েছে | টুসু বলে - " তুমি কি হাওয়াতে ভেসে চলো নাকি ? কালও কোনো আওয়াজ পাই নি - আজও পেলাম না | যাইহোক হ্যাপি হোলি - শ্যাম | তোমার নামটা একটু ছোট করে নিলাম !"
"ছোট করলেও তোমার কোনো ভুল হয়নি টুসু - শ্যামও আমার আরেকটা নাম | অনেকেই আমাকে শ্যাম বলে ডাকে | কিন্তু দোলের দিন মুখ গোমড়া করে থাকতে নেই !" এই বলে সে টুসুর কপালে গোলাপি আবির লাগিয়ে দিলো | টুসু চুপ করে থাকে |
শ্যাম বলে ওঠে - " টুসু ওই নদীর মাঝে চরটাতে যাবে নৌকা করে ?"
যুবকটি যেন জাদু জানে - মন্ত্রমুগ্ধের মতো টুসু ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দেয় |
একদিনের অপরিচিতর যে প্রস্তাবে টুসুর কেন যেকোনো মেয়েরই না করা উচিত ছিল , তা যেন মনেই থাকেনা টুসুর | অথবা ওর জায়গাতে যে কেউই থাকলে হয়তো সম্মোহিত হয়ে পড়তো ওরই মতন |
শ্যাম হাঁক পাড়ে "মাঝি " অমনি টুসু দেখতে পায় একটি মাঝি তার ডিঙি নৌকা নিয়ে এগিয়ে আসছে তীরের দিকে | টুসু অবাক হয়ে ভাবে মাঝিটা যেন জল ফুঁড়ে উঠে এলো .... সে তো এই একটু আগে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল | কোনো নৌকাই তো দেখতে পায় নি !
মাঝি পাড়ে নৌকা ভেড়ালে শ্যাম টুসুর হাত ধরে নৌকাতে উঠতে সাহায্য করে | ঈশান কোণে মেঘ জমেছে , কোথায় একটা মন্দিরের ঘন্টা দূর থেকে বেজে উঠলো |
শ্যাম তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা মাউথঅর্গান বের করে তাতে একটা অচেনা অথচ ভারী মিষ্টি সুর বাজাতে থাকে | নদীর মধ্যে এলোমেলো জোলো হাওয়া , তার সাথে দাঁড়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর মাউথঅর্গানের সুর মিলেমিশে এক মায়াবী জগতের সৃষ্টি করে | একসময় ওরা নদীর মাঝে জেগে থাকা চরে গিয়ে পৌঁছায় | টুসুর হাত ধরে চরটাতে শ্যাম নিয়ে আসে - চারদিকে মাঝারি ঝোপ আর ঘাস | দূরে একটা গরু চরে বেড়াচ্ছে |
ঈশান কোণের থেকে মেঘ এখন সারা আকাশ ঢেকে ফেলেছে | মাঝে মাঝে আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত বিদ্যুতের ঝলক - টুসু বলে "এসময় তো এরকম মেঘ করে না "
শ্যাম উত্তর দেয় -"সবকিছু যদি পরিকল্পনামাফিকই সবসময় ঘটতে থাকে - তাহলে হয়তো জীবনের মজাটাই নষ্ট হয়ে যায় !"
হটাৎ কড়কড় শব্দে কাছেই একটা বাজ পড়ে |
টুসু ভয়ে জড়িয়ে ধরে শ্যামকে | বাজের শব্দে তার বড় ভয় ! কোথা থেকে যেন বেজে ওঠে "গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে - মধুরও মধুরও বংশী বাজে " গানটা |
এই গানটা কি শ্যামের মোবাইলের থেকে বাজছে ?
হটাৎ বড় বড় ফোঁটাতে বৃষ্টি নামে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে - যেন পেঁজা তুলোর মতো টুসুর সর্বাঙ্গে কেযেন শীতল পরশ বুলিয়ে দিতে থাকে |
আবার একটা বাজ পড়ে |
শ্যামের সাথে মিশে যেতে যেতে টুসু লক্ষ্য করে চারপাশে যেন প্রচুর জোনাকি উড়ছে | জোনাকির আলোতে একটা মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে | কখন যেন টুসু শ্যামের সাথে দুলে দুলে গানটার সাথে নাচতে শুরু করে | চারদিকে ছায়ার মতো জোড়ায় জোড়ায় আরো কিছু অবয়বও ওদের সাথে নাচতে থাকে | পড়ন্ত গোধূলির শেষ আলোতে টুসু দেখতে পায় চারদিকে আবির উড়ছে - লাল , গোলাপি , হলুদ - অনেকটা টিভিতে দেখা শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসবের মতো | টুসু শ্যামের কাঁধে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করে "আমি কি স্বপ্ন দেখছি ?"
শ্যাম রহস্যময় ভাবে হেসে উত্তর দেয় - " তুমি কেন ভাবতে পারছো না এটা সত্যি আর রোজ যেগুলো দেখো বা করো সেগুলোই আসলে স্বপ্ন | আসলেই তুমি হয়তো আদি অনন্তকাল ধরে আমার সাথে এখানেই রয়েছো !"
বৃষ্টির জোর আরো বাড়তে থাকে |
খুব কাছেই আরেকটা বাজ পড়ে | চকিতে বাজের আলোতে টুসু দেখে শ্যামের হাতে মাউথঅর্গানের বদলে বাঁশি | ওর সাজপোশাকেরও কিরকম যেন রকমফের হয়েছে | শ্যামের খালি গায়ে একটা উত্তরীয় - গলায় মালা | চারপাশে একটা নীলাভ মায়াবী আলো ! চারপাশে ওদেরই মতো যুবক যুবতীরা জোড়ায় জোড়ায় দ্রুতলয়ে নৃত্য করেছে ভারী মিষ্টি এক সুরের সাথে ! এতো লোক কখন এলো ? টুসু জ্ঞান হারিয়ে ঘনশ্যামের গায়ে এলিয়ে পড়ে - চেতন-অবচেতনের সীমানার মাঝে সে বুঝতে পারে এক সুখের সাগরে সে তলিয়ে যাচ্ছে !
টুসুর জ্ঞান ফেরে ওর বোন খুশির ডাকে | " দিদি - এই দিদি আর কত ঘুমাবি ? রাতে এসে কিছু না খেয়ে সেই যে শুয়েছিস?"
টুসু অবাক হয়ে বলে -"কাল রাতে ?"
খুশি :"হ্যাঁ , কাল রাতে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে এলি ..বললি বন্ধুদের সাথে খেয়ে নিয়েছিস, খিদে নেই | সব ভুলে গেলি ! কোথায় গেছিলি দোলের দিন বলনা রে ?"
টুসু বলে "যা আর পাকামো করতে হবে না | আমি আসছি "
টুসু বালিশ তুলতে গিয়ে দেখে বালিশের নিচে একটা ময়ূরের পালক আর ছোট্ট একটা বাঁশি |
টুসুর চোখ জলে ভরে ওঠে আর এটা দুঃখের অশ্রু নয় এটা আনন্দাশ্রু কেননা সে বোঝে সে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম দোলউৎসব কাল কাটিয়ে এসেছে |
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
Address
বাসন্তী মন্ডল
23/1 Churaman Chowdhury Lane
Berhampore, Murshidabad, WB
Near BSNL Office, YMA Ground
PIN - 742101
Contact Number -+91-9986042644 (WhatsApp is also same number)
Thanks and Regards,
Avik