গল্প।। ভয়াল দ্বীপের মানুষখেকো ।। সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;
দু'দিন দু'রাতের ভ্রমণে সুন্দরবন । কৈখালি থেকে একটা ছোট লঞ্চ ভাড়া করে অমিতরা অফিসের আট কলিগ ভ্রমণে বেরিয়েছে । সঙ্গে লঞ্চের চালক আর তার সাগরেদ । রান্নার ঠাকুর আর তার সহকারী । রান্নার সমস্ত মালপত্র , জল , আনাজপাতি , মাংস কিনে নিয়েছে জামতলা বাজার থেকে । বন দপ্তরের পারমিশন শেষে মাতলার বুক চিরে এগিয়ে চলেছে তাদের জলযান । গন্তব্য কলস দ্বীপ ।
দুপুর দুটো নাগাদ লাঞ্চ শেষ হয় । ভাত ডাল বেগুনি আর চিকেনকারি । হাসি-ঠাট্টায় মশগুল সবাই । লঞ্চ নদীর জল কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে । আজ কলস দ্বীপের কাছে লঞ্চে নদীবক্ষে তাদের রাত্রিবাস । কাল সকালে কলস দ্বীপে প্রবেশ ।
তখন বিকেল চারটেও বাজেনি । হঠাৎ চারদিকের আলো কেমন যেন কমতে শুরু করে । এত তাড়াতাড়ি তো সন্ধ্যে হয় না ! অবাক হয়ে তারা চালকের কাছে জানতে চায় ব্যাপারটা । প্রথমে তো সে কিছু বলতেই চায় না । তবে মুখটা বেশ গম্ভীর চালকটার । সাগরেদটার মুখেও ভয়ের ছায়া !
অমিতরা বেশ ঘাবড়ে যায় ব্যাপারটা দেখে ।
অনেক অনুরোধের পর চালক যা জানায় তা শুনে অমিতদের সুন্দরবন ভ্রমণের নেশা একেবারেই ছুটে পালায় । চালক বলে ," একটু আগে রেডিওর খবরে জেনেছি গত দু'দিন আগে যে সাইক্লোনটা অন্ধ্রপ্রদেশ-তামিলনাড়ুর দিকে যাচ্ছিল তা দিক ও গতি বদলে সুন্দরবন উপকূলে ছুটে আসছে । গতি খুব বেশি । সজোরে ধাক্কা মারবে সুন্দরবনে ।"
অমিতের কলিগ রবি রেগে যায় । বলে ," তুমি সব জেনেও এমন দুর্যোগে আমাদের নিয়ে এলে কেন ?"
চালক বলে ," স্যার , আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এখানে কিছু হবার কথা ছিল না । তাই তো ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট পারমিশন দিল । তেমন জানলে ওরাই তো আটকাতো । খবরটা এই সবে এলো । আর এখন এসেই বা কী হবে !"
রবি বলে ," তাহলে কি হবে এখন ! ফিরে যাই চলো ।"
চালক বলে ," পাঁচ-ছ ঘন্টা চলে এসেছি । এতটা পথ ফেরার সময় নেই আর । কোথাও নোঙ্গর করে সময়টা পার করতে হবে । সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ধাক্কা মারবে ঝড় ।"
অমিত বলে ," তাহলে কোনো দ্বীপ দেখে ভেড়াও । ডাঙ্গায় আমরা নিরাপদ থাকবো ।"
এত ভয়ের পরিবেশেও হেসে ফেলে চালক । বলে ," স্যার , এখানে পুরো এরিয়া জুড়ে বাঘের আস্তানা । সবকটা দ্বীপই কোর এরিয়ায় । সংরক্ষিত বনাঞ্চল । ডাঙ্গায় বাঘ , জলে কুমির-কামট । তার উপর এই সাইক্লোন । ভয় পাবেন । তাই তো বলতে চাইনি । কপালে থাকলে , বনবিবি-দক্ষিণরায় কৃপা করলে তবেই ফেরা । নয়তো সবাই হারিয়ে যাবো । কোথায় , তা কেউ জানতে পারবে না কোনদিন !"
ভয়ে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা অমিতদের । কি ভেবে এসেছিল আর কি ঘটবে ভেবে সবার মাথা ঘুরতে থাকে । মৃত্যুর ভয়াল লেলিহান শিখা যেন জ্বলতে থাকে সবার চোখে। সবাই খুব কাছ থেকে দেখতে পায় আসন্ন মৃত্যুকে ।
সময় যত এগোতে থাকে আকাশ-বাতাস ততোই বদলাতে থাকে । এরা সবাই শহরের মানুষ । কলকাতার ফ্ল্যাটে বসে অনেক ঝড় দেখেছে । ছবি তুলেছে । ফেসবুকে দিয়েছে । কিন্তু জল-জঙ্গলে অসহায় হয়ে মৃত্যুর হাতছানির মধ্যে ঝড় দেখেনি । দেখেনি তার রুদ্ররূপ । গা-ছমছম পরিবেশ লঞ্চের ভিতর-বাহির সর্বত্র ।
সন্ধ্যের অনেক আগেই সন্ধ্যে হয়ে যায় আজ । বাতাসবিহীন প্রকৃতি আবাহন করতে থাকে ঝড়ের । ওরা সবাই লঞ্চের উপর থেকে নেমে এসেছে চালকের কথামতো । এমনকি তার সাগরেদটাও । বাচ্ছা ছেলেটা ভয়ে খুব কাঁদছে । মনে হয় এমন মৃত্যুভয় আগে সে কখনও পায়নি ।
অমিতদেরও খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু কান্না আসছে না । যা আসছে তা মৃত্যুভয় । এমন ভয় আগে কখনও পায়নি ওরা ।
সাড়ে সাতটা নাগাদ হঠাৎ করে শোঁ শোঁ আওয়াজ শুরু হয় । ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে । একটু পরে খুব কাছে চলে আসে আওয়াজটা । প্রবল বেগে দুলতে থাকে তাদের লঞ্চ । তারা এখন কলস দ্বীপের পাশে মাঝ নদীতে নোঙ্গর করে আছে । পাড়ের কাছে নোঙ্গর করেনি বাঘের ভয়ে । আশপাশে আরও চারটে লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে মাঝ নদীতে তাদের লঞ্চের মতো ।
শোঁ শোঁ আওয়াজটা আসছে কাছে । প্রচন্ড দুলছে লঞ্চগুলো । হাওয়ার দাপাদাপিতে লঞ্চের ভিতর থেকে তারে ঝোলানো জামাকাপড় উড়ে চলে যাচ্ছে জানলার ফাঁক দিয়ে । আবার কিছুক্ষণ সব শান্ত । স্তব্ধ । দু'চার মিনিট পর আবার ফিরে আসছে সেই আওয়াজ । আবার চলছে হাওয়ার তান্ডব । পাশের লঞ্চগুলো থেকে ভেসে আসছে নারী আর বাচ্ছাদের কণ্ঠের কান্নার শব্দ । অমিতদের লঞ্চের চালকের সাগরেদটাও কাঁদছে খুব । কিন্তু কে কাকে স্বান্তনা দেবে !
ঘন্টাখানেক ধরে চলছে এমন তান্ডব । প্রতি মুহূর্তে গেল গেল রব । হঠাৎ জোরে বিদ্যুতের ঝলকানি । সঙ্গে আকাশ ফাটিয়ে বজ্রপাতের ধ্বনি । বিদ্যুতের ঝলকানিতে বাইরে দৃষ্টি যায় অমিতের । আশপাশে দাঁড়ানো লঞ্চগুলো আর নেই । সবগুলো কী ডুবে গেল ! খুব কষ্ট হয় অমিতের । কানে ভাসে নারী আর বাচ্ছাদের সেই আকুল কান্না । হে ভগবান , সব শেষ করে দিলি ! দু'পাশের ঘন জঙ্গলও আর দেখা যাচ্ছে না । চারদিকে শুধু জল আর জল । সেই জলে মোচার খোলার মতো ভেসে চলছে তাদের লঞ্চ । কিন্তু নোঙ্গর করা ছিল তো লঞ্চটা । তাহলে কী নোঙ্গর ছিঁড়ে গেছে !
হঠাৎ চালক নিচে নেমে আসে । বলে ," ঝড় থেমে গেছে মনে হচ্ছে । হাওয়ার গতি এখন অনেক কম । মনে হয় আমরা বেঁচে গেলাম । এটা ভাল খবর । সঙ্গে কিন্তু একটা খারাপ খবরও আছে ।"
অমিত আর তার বন্ধুরা বেঁচে যাবার খবরে হাফ ছেড়ে বাঁচে । ব্যাটারিতে জ্বলা মৃদু এল ই ডি ল্যাম্পের আলোয় সবার মুখ বেশ উজ্জ্বল বলে মনে হয় লঞ্চ চালকের । তার সাগরেদটা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে । সে বলে ," অতো ভয় কি রে ! জল-জঙ্গলকে যখন পেটের ভাত মেনেছিস তখন তো ভয় থাকার কথা নয় । এ যে অনিশ্চিত জীবন তা তো তুই জানিস । আজ আছি তো কাল ফুড়ুৎ । যদি বলিস তো ফিরে তোকে কোনো হোটেলের কাজে ঢুকিয়ে দেব । বেঁচে থাকবি । কিন্তু জীবনে রোমাঞ্চ থাকবে না ।"
ছেলেটা বলে ," না কাকু । এই ঠিক আছি । আজ থেকে সব ভয় কেটে গেছে । আর কাঁদবো না আমি ।"
রবি বলে ," তা ড্রাইভার ভাই , ভাল খবরটা তো দিয়ে দিলে । বেঁচে থাকবো আমরা । এবার খারাপ খবরটা দাও । দেখি কেমন খারাপ খবর !"
চালক বলে ," স্যার , খবরটা সত্যি খুব খারাপ । ঝড়ের দাপটে ইঞ্জিনে ভূতে ধরেছে । বন্ধ হচ্ছে না । যতক্ষণ ইঞ্জিনে তেল থাকবে চলবে । শেষ হলে বন্ধ হবে । কিন্তু এটা তেমন সমস্যা নয় । পাম্প করে তেল বের করে নিলে বন্ধ হয়ে যাবে । কিন্তু তারপর যদি স্টার্ট না নেয় ! এছাড়া কম্পাস কাজ করছে না । আমরা এখন বার-দরিয়ায় এটা বুঝতে পারছি । কিন্তু ডাঙা থেকে কতদূর তা বুঝতে পারছি না !"
অমিত বলে ," বার-দরিয়া ! সেটা কি ?"
চালক বলে ," বার-দরিয়া মানে বঙ্গোপসাগর । আমরা নদী ছেড়ে এখন সাগরে ভাসছি । এই জায়গাটা ভারত বাংলাদেশ না অন্য কোথাও তা বুঝতে পারছি না !"
সবাই সমস্বরে বলে ," মানে ! কী হবে এবার !"
চালক বলে ," সবাই এখন থেকে খাবার-দাবার ও জল একটু কম খাবেন । দু'দিনের ব্যবস্থা করা আছে । আরও যদি দু'দিন চালানো যায় । তারপর উপরওয়ালা ভরসা । যা কপালে আছে তাই হবে !"
হতাশায় ডুবে যায় সবাই । বেঁচে থাকার আনন্দটা যেন এক লহমায় উবে যায় ।
দেখতে দেখতে সাগরে মোচার খোলার মতো ভাসতে ভাসতে কেটে যায় দুটো দিন । অর্ধাহারে সবারই শরীর দুর্বল হতে থাকে । শুধু শুয়ে বসে একরাশ হতাশায় ডুবে যাওয়া । জলে ভেসে ভেসে সময় কাটে অজানা ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে । আর জঠর জ্বালা ধরালে একমুঠো নিয়ম রক্ষা !
তৃতীয় দিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই বাইরে দৃষ্টি যায় রবির । চিৎকার করে সবাইকে ডাকে । একটা দ্বীপের কাছে আটকে আছে তাদের লঞ্চ । সবাই ঘুমচোখে হুড়মুড় করে উঠে পড়ে । তাইতো ! এ যে ডাঙা । গাছপালাও দেখা যাচ্ছে । তাহলে অবশেষে তারা ডাঙার সন্ধান পেল । এবার বেঁচে যাবে সব্বাই । তাড়াহুড়ো করে নামতে চায় । কিন্তু চালক নারাজ ।
শত অনুরোধ সত্ত্বেও চালকের কথা শুনতে চায় না কেউ । এমনকি তার সাগরেদটাও । ঝুপ ঝাপ করে লাফিয়ে নেমে পড়ে ডাঙায় । তারপর উপরের গাছপালার দিকে উঠতে থাকে । লঞ্চে থেকে যায় শুধু চালক আর অমিত । ওরা উপরে উঠে প্রাণের আনন্দে নাচতে থাকে । যেন ওরা সত্যি সত্যি বেঁচে গেছে মৃত্যুর করাল ছায়া থেকে । হাত নাড়াতে থাকে লঞ্চের দিকে । ডাকতে থাকে অমিত আর চালককে ।
কিন্তু এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পায় না । হঠাৎ বাঁশের বল্লম হাতে অদ্ভুত পোশাক পরা কিছু আদিম জঙ্গলের মানুষ ঘিরে ধরে তাদের । টেনে নিয়ে যেতে থাকে জঙ্গলের ভিতর । ওরা লঞ্চের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আর্ত চিৎকার করে । কিন্তু সেই চিৎকার পৌঁছয় না লঞ্চে । কিন্তু অমিতরা বুঝতে পারে কি ঘটে গেল তাদের সহযাত্রীদের সঙ্গে ।
অমিত নামতে চায় নিচে । কিন্তু চালক আটকায় । বলে ," স্যার , ওনাদের আগেই মানা করলাম । কেউ শুনলো না । এমনকি আমার পুঁচকে বিশুটাও । কিছু না ভেবে , কোনো কথা না শুনে হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন ওনারা । এরা হয়তো নরখাদক । ওদের ঠিক খেয়ে ফেলবে । আপনি আর নিচে নামবেন না এখন । দেখলেন না এদিকে দেখেও এলো না লোকগুলো । তার মানে এই লঞ্চকে ভয় পায় ওরা । রাতের অন্ধকারে নেমে দেখবো । এখন এই লঞ্চেই থাকি । এখানে বিপদ হবে না মনে হচ্ছে । আপনার বন্ধুদের আর আমার বিশুটার কপালে যা আছে ঘটবে । এখন দুটো চাল-ডাল ফুটিয়ে শরীরে দিই । তারপর একটু ঘুমিয়ে নিই । ওদের সঙ্গে লড়তে গেলে শরীরে ক্ষমতা দরকার । রাতে গিয়ে খুঁজবো । যদি বেঁচে থাকে উদ্ধারের একটা চেষ্টা করবো । তাড়াহুড়ো করে কোনো হটকারী সিদ্ধান্ত নিলে আবার ভুল হবে ওদের মতো ।"
অমিতের মনে ধরে চালকের কথাগুলো । ঠিকই বলেছে । জেনেশুনে কেন নরখাদকের খাদ্য হবে । । রাতেই চেষ্টা করা যাবে । সত্যিই তো , ক'দিনের অর্ধাহারে আর দুশ্চিন্তায় শরীর ও মন দুর্বল হয়ে পড়েছে । তাই দু'জনে দু'মুঠো ফুটিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে লঞ্চে । এখানে তাদের বিপদ নেই । সেই আশাতেই অঘোর ঘুমে ঢলে পড়ে অমিত । চোখ খোলে চালকের ডাকে ।
চালক বলে ," চা করেছি স্যার । খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি চলুন । সন্ধ্যে হয়ে গেছে । চারপাশ অন্ধকার । এখন আমাদের কেউ দেখতে পাবে না ।"
দু'জনে দুটো ছোট টর্চ হাতে করে নিচে নামে লঞ্চ থেকে । এগিয়ে চলে গাছপালা ভেদ করে অজানা পথের সন্ধানে । যেখানে তাদের সহযাত্রীরা , বন্ধুরা আটকা পড়ে আছে । হয়তো বেঁচেও আছে কোনো অজানা কারাগারে । একটু পরেই হয়তো তাদের জীবন্ত দেহগুলো কেটে কুটে অজানা অচেনা অসভ্য মানুষদের খাদ্যের জন্য রেডি হবে । তার আগেই জীবন্ত উদ্ধার করতে হবে তাদের ।
সামনে লঞ্চের চালক পিছনে অমিত । হাঁটতে থাকে তারা । মাঝে মধ্যে টর্চ জ্বালে । যত এগোয় জঙ্গল ততো গভীর হতে থাকে । বারবার পা আটকায় কাঁটাঝোপ , লতাগুল্মে । চালক হাতে করে মাংস কাটার ছুরিটা নিয়ে এসেছে বুদ্ধি করে । তা দিয়েই পথ পরিষ্কার করে ওরা এগিয়ে চলে ।
একটু দূর থেকে একটা ঢোলের মতো কিছুর আওয়াজ ভেসে আসছে । ওরা সেই শব্দ অনুসরণ করে চলতে থাকে । চালক ফিসফিস করে বলে ," স্যার , যা ভেবেছি তা ঠিক । এইসব অসভ্য মানুষরা তাদের দেবতার সামনে নরবলি দেয় । তারপর তার মাংস খায় । মশাল জ্বেলে বাজনা বাজিয়ে দেবতার পুজো করে । এক এক দিন একজন করে বলি দেবে । আজ হয়তো কাউকে দিয়ে ফেলেছে । কিন্তু কিভাবে ওদের উদ্ধার করবো বুঝতে পারছি না ! আমরা যদি ধরা পড়ি আমাদেরও একই হাল হবে । এটা যে কোন দেশ তাই তো বুঝতে পারছি না !"
অমিত বলে ," অতো চিন্তা করে লাভ নেই ভাই । কিছু একটা চেষ্টা তো করতে হবে । না হলে সারাজীবন আফসোস করতে হবে । শুধু ভাবছি , আসার সময় যদি নিজের লাইসেন্স পিস্তলটা সঙ্গে আনতাম । বস ভয় দেখিয়ে দিলেন । বললেন , পিস্তল নিয়ে গেলে বাজেয়াপ্ত করে নেবে । সুন্দরবন সংরক্ষিত বন । তাইতো নিলাম না । কিন্তু এখন ভাবছি আনলেই হতো । এই আদিম অসভ্য মানুষগুলো আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুটলে খুব ভয় পায় ।"
চালক বলে ," চিন্তা করবেন না । আমার কাছে আছে । লোড করা আছে । আমাদের কাছে রাখতে হয় জলদস্যুদের প্রতিরোধের জন্য । লাইসেন্সও আছে ।" ---- এই বলে ছোট্ট যন্ত্রটা পকেট থেকে বের করে ।
হাতে নেয় অমিত । বলে ," এটা আমার কাছে থাক । আমার খুব ভাল নিশানা । আগে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পেতাম । একবারেই লক্ষভেদ । একটা গুলিও বেকার যাবে না ।"
চালক বলে ," ঠিক আছে স্যার । ওটা আপনার কাছেই থাক । আমরা বোধ হয় খুব কাছে চলে এসেছি । আওয়াজ বেশ জোরে শোনাচ্ছে । আর সামনের আকাশেও আলো বেশ জোরালো হয়েছে । এটা আগুনের আলো । লোকগুলো মশাল জ্বেলেছে মনে হয় ।"
ওরা এবার পৌঁছে যায় অকুস্থলের কাছে । জোরালো আগুনের আভা । বাজনা বাজছে । সঙ্গে অজানা ভাষায় সমবেত কণ্ঠস্বর । অনেকটা সুর করে মন্ত্রপাঠের মতো ।
চালক বলে ," দেখছেন তো স্যার । আমার ভাবনা কেমন মিলে যাচ্ছে ।"
অমিত বলে ," পাঁচ মিনিট এখানে একটু জিরোই । শরীর আর চলছে না । জল এনেছ সাথে ?"
চালক একটা ছোট্ট জলের বোতল বের করে দেয় পকেট থেকে । দু'ঢোক খেয়ে ফেরত দেয় অমিত । বলে ," তুমিও একটু খেয়ে নাও । শরীর-মনে এখন অনেক জোর লাগবে । ক'টা বাজে বলতে পারো । আমার হাতঘড়িটা চলছে না । আর মোবাইলটাও লঞ্চে রেখে এসেছি । চার্জ নেই ।"
চালক বলে ," দশটা হবে । সন্ধ্যে থেকে তো তিন-চার ঘণ্টা হাঁটলাম । কিন্তু স্যার , এবার আমরা কী করবো একটু ঠিক করে নিলে হতো ।"
অমিত বলে ," আগে একটু আড়াল থেকে দেখে সব ব্যাপারটা বুঝে নিই । আমাদের লোকেরা কোথায় আছে । কিভাবে আছে । ওরা কি করেছে ওদের সাথে । তারপর পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত ।"
কিছুক্ষণ পরে ওরা উঠে পড়ে । এগিয়ে চলে নির্দিষ্ট স্থানে ।
দেখে , বড় বড় গাছের মাঝে কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করা । সেখানে মাটি দিয়ে তৈরি একটা উঁচু বেদীর উপর এক ভয়ঙ্কর শরীরের মানুষ বসে আছে । নিম্নাঙ্গে লতাপাতা জড়ানো । উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত । এক হাতে বাঁশের তৈরি বল্লম । কপালে লাল তিলক । একটু দূরে একটা বড় গর্তে আগুন জ্বলছে । আর তাতেই আশপাশ আলোকিত । মশালের ব্যবহার এরা বোধ হয় জানে না । গর্তের চারপাশ ঘিরে আগুনের সঙ্গে দূরত্ব রেখে একদল আদিম উলঙ্গপ্রায় মানুষ । তারা নাচছে । অদ্ভুত সুর করে অজানা ভাষায় গান গাইছে । ওদের কাছ থেকে একটু দূরে বামপাশে দুটো মোটা গাছে লঞ্চের যাত্রীরা বন্য লতাপাতা দিয়ে বাঁধা । অবাক হয়ে ভয়াল আর অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আদিম অসভ্য মানুষদের কর্মকান্ড দেখছে ।
হঠাৎ লঞ্চের চালক ককিয়ে উঠতেই অমিত তার মুখ চেপে ধরে । বলে ," এমন চিৎকার করতে যাচ্ছিলে কেন ? ধরা পড়ে যাবো তো !"
মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিতেই চালক বলে ," আমার বিশুটাকে মেরে ফেলেছে স্যার । ওকেই মনে হয় প্রথম বলি দিলো । দেখুন বেদীর পাশটায় ।"
অমিত দেখে । সত্যিই তো ! ছেলেটাকে রাজার পাশে শুইয়ে রেখেছে উলঙ্গ করে । গলায় ধারালো অস্ত্রের রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে । ওই রক্তের তিলক পড়েছে রাজা আর তার সাগরেদরা । খুব কষ্ট হয় অমিতের । ঝড়ের সময় লঞ্চে ছেলেটার কান্না শুনেছে । দেখেছে তার বেঁচে থাকার আকুতি । আর তাকেই সবার আগে মেরে ফেললো এই অসভ্য লোকগুলো । এবার নিশ্চয়ই ওর মাংস খাবে । না , আর ভাবতে পারে না অমিত । রাগে তার শরীরের রক্ত ফুটতে থাকে । সে চালককে বলে ," আর তো কিছু করার নেই । তোমার বিশুকে ফেরানোর উপায়ও নেই । কিন্তু এবার এদের আঘাত করতে হবে । বাঁচাতে হবে আমাদের সহযাত্রীদের । আমি রাজটার বুক নিশানা করে গুলি করছি । তেমন হলে দলের দু'একটাকেও করবো । ওরা ভয়ে ছত্রখান হবে । তুমি সোজা গাছ দুটোর কাছে গিয়ে ছুরি দিয়ে ওদের বাঁধন কাটবে । তারপর সবাইকে নিয়ে ছুটবে লঞ্চের দিকে । আমি বিশুর বডিটা কাঁধে ফেলে তোমাদের পিছনে ছুটবো । হাতে পিস্তল তাগ করা থাকবে । ওরা এগিয়ে এলেই গুলি করবো ।"
কথা মতো কাজ শুরু হয় । প্রথম গুলিতেই রাজা ধরাশায়ী । ভয়ে লাফালাফি শুরু করে দেয় আদিম-অসভ্যগুলো । অমিতের দ্বিতীয় গুলি ছোটে ওদের উদ্দেশ্য করে । একজনের মাথায় লাগে । মানুষগুলো ভয়ে যে যেদিকে পারে ছুটতে থাকে । চালক ছোটে যাত্রীদের মুক্ত করতে । ছুরি দিয়ে ওদের বাঁধন কেটে ফেলে চোখের পলকে । তারপর সবাই ছুটে চলে লঞ্চের দিকে ।
এদিকে বিশুর কাছে এসে অবাক হয় অমিত । বিশুকে এরা মারেনি । গলায় গায়ে রক্তের মতো কোনো রঙ লাগিয়েছিল । তবে সে এখন অজ্ঞান । হয়তো কিছু খাইয়ে দিয়েছে । পরে বলি দেবে ।
অমিত বেদীর পাশ থেকে বিশুকে ঘাড়ে তুলে আর একহাতে পিস্তল উঁচিয়ে বন্ধুদের পিছনে ছুটতে থাকে ।
পনেরো-ষোল বছরের একটা ছেলেকে ঘাড়ে করে ছোটা যে কতো কষ্টের তা বেশ বুঝতে পারে অমিত । কিছুক্ষণ ছোটার পর সবাই লঞ্চের কাছে এসে পৌঁছয় । অমিতের সহযাত্রীরা সবাই উঠে পড়েছে লঞ্চে । অমিত লঞ্চের কাছে পৌঁছতেই চালক ও অন্যরা ওর ঘাড় থেকে বিশুকে চাগিয়ে লঞ্চে তুলে নেয় । তারপর অমিতকেও ।
সবাই অক্ষত । শুধু বিশু অচেতন । আর অমিত প্রায় শক্তিহীন মানুষ বহন করার কারণে । এতো কষ্টের মাঝেও সবাই খুব খুশি । বারবার ধন্যবাদ দেয় অমিত ও চালককে । আর দুঃখ প্রকাশ করে তাদের কথা না শোনার জন্য ।
কিন্তু এই আনন্দ বেশিক্ষণ বজায় থাকে না । অন্ধকারে দ্বীপের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তির এসে পড়তে থাকে তাদের লঞ্চে । সবাই তাড়াহুড়ো করে লঞ্চের খোলের মধ্যে ঢোকে । আর সেখানে মাথা গুঁজে তেল ঢেলে ইঞ্জিনকে স্টার্ট করতে চেষ্টা করে চালক ।
বেশ কয়েকবার হ্যান্ডেল পাকানোর পর ঘড় ঘড় করে স্টার্ট হয়ে যায় ইঞ্জিন । আর ইঞ্জিনের সেই শব্দে জ্ঞান ফিরে আসে বিশুর । অবাক চোখে সে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে সবাইকে । যেন জীবন ফিরে পেয়ে অবাক হয়েছে সে । চালক বিশুর ঝাঁকড়া চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলে ," অবাক হতে হবে না । তুই বেঁচে আছিস । সবাই বেঁচে আছে । রাক্ষসদের ডেরা থেকে সবাই ফিরে এসেছে অক্ষত শরীরে । আর ইঞ্জিনটাও চলতে শুরু করেছে আবার । তবে ওরা এখনও পিছু ছাড়েনি । তির ছুঁড়ছে । আমাদের এক্ষুনি এই জায়গা ছেড়ে পালাতে হবে । আমি সাবধানে উপরে যাচ্ছি । এখান থেকে কেউ বেরুবেন না । দেখি কম্পাসটা ঠিক হয়েছে কিনা । তাহলে স্টিয়ারিংয়ে বসে পালাতে চেষ্টা করবো এখান থেকে । বিশু তুই ইঞ্জিনটা দেখ । এবার হয়তো সত্যি সত্যিই ফিরতে পারবো যে যার ঘরে ।"
বিশু মুখে কিছু বলে না । উঠে বসে । তারপর এগিয়ে যায় ইঞ্জিনের পাশে । যেখানে বসে আগে সে স্টার্ট দিত এই ইঞ্জিনটা ।
…………………..
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
…………………..
সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, বহরু, জয়নগর, দক্ষিণ 24 পরগণা ।