ছোটগল্প।। ভাগ্যের পরিহাস।। সুতপা ব্যানার্জী (রায়) ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;
প্রতিমা লেডিস হস্টেলে নিজের জিনিস গুছোতে গুছোতে খাট ধরে একবার দাঁড়ায়। মাথাটা যেন কেমন ঘুরছে। আজকাল এটা প্রায়ই হয়, বিষয়টা ওর কম হিমোগ্লোবিন না মনের কারণে..এ বিষয়ে ও নিশ্চিত নয়। এমন করে কাটাতে কাটাতে এখানে তার বছর পাঁচ তো কেটেই গেল। ফেলে আসা জীবনে গলি ঘুঁজিগুলো এখনো ওর মনে হানাদার হয়ে বসে থাকে।
তাই আর নতুন করে কোনো ভালোলাগা কোনো ভালো দিনের কাছে ওর আত্মসমর্পণ করা হয় না। ওর ঋতুতে কেবল গ্রীষ্মের দাবদাহ। বসন্ত আর যেখান দিয়েই পার হোক, ওর আঙিনায় আর আসে না। দীপাঞ্জনের সংসার ছেড়ে অভিমান করে আসার সময় তো আর ভবিষ্যৎ চিন্তা ছিল না, কোথায় যাবে কি করবে এসব না ভেবে এক কাপড়েই চলে এসেছিল। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে,
এককালের প্রিয়জনেদের মুখগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। প্রতিশ্রুতিভরা দিনের স্বপ্ন সাজিয়ে যারা আশেপাশে ছিল তারাও ওকে ভীষণ নির্জনে ফেলে রেখে গেছে। তারপর এ ঘাট ও ঘাট ঠেলে এই
হেমনিকেতন বোর্ডিংয়ের দোতলার কোণের একটা ঘুপছি ঘরে একলাই নিজের দাবীদার ও জিম্মাদার।
অথচ একটা সময় ছিল যখন দীপাঞ্জন মুহূর্তের জন্যও ওকে একা হতে দিত না, প্রতিমার সব..সব মুহূর্ত, ভাল লাগা-খারাপ লাগা সবকিছু দীপাঞ্জন চুরি করে নিয়েছিল। প্রতিমার নিজস্ব জগৎ বলে যেন কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। হারমোনিয়াম টেনে বসে যেই গাইতে শুরু করল" আনন্দধারা বইছে ভূবনে.." অমনি
দীপাঞ্জন বলে উঠত-"একটা আধুনিক হয়ে যাক..ওই যে তোমায় আমায় মিলে বাঁধব যেথা ঘর আমি সেই পথে যাই... ওটা কর।" প্রতিমা বেড়াতে যাবে বলে হয়তো ওর পছন্দের নীল শিফনটা পরবে বলে নিয়েছে, অমনি দীপাঞ্জন ছুটে এসে দুধে-আলতার কাঞ্জিভরম ওর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে হেসে বলত-"এটা পরো, এটাতে তোমায় ভারী সুন্দর দেখায়।" অগত্যা প্রতিমাকে ওই দুধেআলতা কাঞ্জিভরমই পরতে হত।
বিয়ের আগে প্রথম যখন দীপাঞ্জন ওর বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে নিয়ে গেছিল, সেদিন প্রতিমা কেমন করে চুল বাঁধবে সেটা অব্দি দীপাঞ্জন ঠিক করে দিয়েছিল।
প্রতিমা ছিল যেন দীপাঞ্জনের পছন্দের একটা চকচকে পুতুল। সবটুকু অধিকার দিয়ে দীপাঞ্জন এই পুতুলটাকে দখল করেছিল। প্রতিমা তখন বোঝে নি এই দখল করার বোধটা ওকে ভয়ঙ্কর সঙ্কটে ফেলে দেবে। আর কখনও প্রতিমার ব্যক্তিসত্ত্বা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। মাথা তোলার চেষ্টা করলে কী হয় তা দীপাঞ্জনের সঙ্গে বিয়ের দুবছর পর টের পেয়েছিল। যে টের পাওয়া ওদেরকে নির্মম পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। প্রথম ঝামেলাটা শুরু হল প্রতিমার স্কুলে চাকরি করতে যাওয়া নিয়ে।দীপাঞ্জন প্রায়ই বলতে শুরু করল-"তোমার চাকরি করার কী দরকার? আমার রোজগারেই তো দিব্যি হেসে খেলে চলে যায়।"
ইন্ধন জুগিয়েছিল শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের কিছু আত্মীয়পরিজন। " বউ চাকরি করলে তোকে মানবে না, সংসারটা উচ্ছন্নে যাবে।"- এইসব মন্তব্যে দীপাঞ্জনের নিজস্ব অ্যালিবাইগুলো বেড়েই চলল। সাথে কোএড স্কুলের সহশিক্ষকদের নিয়ে তৈরী হওয়া সন্দেহ। স্কুলের কোনো অনুষ্ঠান, এক্সকারশান কোথাও যাওয়া চলবে না। অবস্থাটা একদিন চরমে উঠল, প্রতিমার স্কুলের সহশিক্ষক সোমেনবাবু জরুরী প্রয়োজনে ওদের বাড়ি আসায়। ভদ্রলোক বেরিয়ে যাওয়ার পরে দীপাঞ্জন প্রতিমার গায়ে হাত অব্দি তোলে।অনেক দিনের পুষে রাখা কষ্ট আর সহ্য করতে না পেরে প্রতিমা এক কাপড়ে বাপের বাড়ি চলে যায়।এইসময়েই ঘটে যায় চরম বিপর্যয়। চরম শত্রুতা করে কেউ দীপাঞ্জনের কানে তুলে দেয় প্রতিমা বাপের বাড়িতে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কান পাতলা, ভীতু দীপাঞ্জন ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই না করে ভয়ে, দুঃখে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
প্রতিমা যখন খবর পেয়ে ছুটে আসে তার দীপাঞ্জনের কাছে তখন সব শেষ।উল্টে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে দীপাঞ্জনকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে পাঁচবছর জেলও খাটতে হয়েছে প্রতিমাকে। তারপর বহুচেষ্টার পর ও পুরোনো চাকরিটা ফিরে পায়। বাড়ির সবাই চেষ্টা করেছিল প্রতিমা যাতে সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরে। বাবা-মা মেয়েকে আবার সংসারী করতেও চেয়েছিলেন। সবার সমস্ত চাওয়া এড়িয়ে প্রতিমা এই হস্টেল জীবনই বেছে নিয়েছে। জীবন সম্পর্কে আর কোনো আকাঙ্ক্ষা ওর অবশিষ্ট নেই। দীপাঞ্জন নিজের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিমাকেও মেরে রেখে গেছে। স্মৃতির সঙ্গে দিনাতিপাত করাটাই ওর অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। চাইলেও প্রতিমা বিস্মৃতির স্বর্গদ্বার আর দেখতে পায় না। তাই একলা গেয়ে চলে.."সংসার যবে মন কেড়ে লয়, জাগে না যখন প্রাণ"
-
ছবিঋণ- ইন্টারনেট । -----------------------
ঠিকানা-ফেজ-3, শিল্পকানন, বিধাননগর
Khub bhalo laglo.
উত্তরমুছুন