Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প।। পরম্পরা ।। সুপ্তা আঢ্য


পরম্পরা 


 

 সুপ্তা আঢ্য 



  কুসুমপুর গ্রামের ব্রাহ্মণ জমিদার বিভঞ্জন মুখুজ্যের প্রতাপে এখন বাঘে গরুতে একঘাটে জল না খেলেও পড়তি জমিদারির কিছুটা এখনও আছে। আর তাই বনেদিয়া না, সাবেকিয়া না এগুলোকে আঁকড়ে ধরে শিকড়চ্যুত হয়ে প্রগতিকে বাড়ির সদর দরজার চৌকাঠ পেরোতে দেননি উনি। জমিদার বিভঞ্জন মুখুজ্যের স্ত্রী, তিন পুত্র - পুত্রবধূ, নাতি-নাতনী ঠাকুর, চাকর নিয়ে ভর-ভরন্ত সংসারের একচ্ছত্র আধিপত্য এখন মুখুজ্যে মশাইয়ের স্ত্রী মনোরমা দেবীর ওপর। অশীতিপর জমিদারবাবু এখন সারাদিন আরামকেদারায় শুয়ে থাকেন প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো। আর ষাটোর্দ্ধ স্থূলকায়া মনোরমা দেবী স্বামীর কর্তব্যের দায়ভার মাথায় নিয়ে এক কঠোর অনুশাসনে বেঁধে রেখেছেন সংসারটাকে - - - - নাহলে কর্তা বার্ধক্যে জর্জরিত হওয়ার পরেই কোথায় ভেসে যেত বনেদি পরিবারটা। 
    যে সময়ের কথা বলছি, তখন জমিদারবাবুর তিন ছেলেই নিজ নিজ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হলেও মুখুজ্যে গিন্নীর দোর্দণ্ডপ্রতাপ তদারকিতে ওদের দায়িত্বহীন দিনগুলো ভালোই কাটছিল। এ বাড়ির তিন কর্তা ব্যবসা সামলে দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের সময়টা কাজে লাগাতে বাড়িতে ফিরলেও তিন বধূকে শাশুড়িমায়ের তত্ত্বাবধানে ঘর গেরস্থালি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার কাজ শিখতে হত। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নিশুত রাতের আগে স্বামীসঙ্গের কোনো অনুমতি এবাড়িতে ছিল না। বাড়ির কুচোকাচাদের ঝিয়েদের জিম্মায় রেখে সারাদিন সংসারের খুঁটিনাটিতেই ব্যস্ত থাকা বধূদের দেখে আরামকেদারায় আধশোয়া বিভঞ্জন মুখুজ্যের ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি খেলে যেত - - - মনে পড়ে যেত নিজের বিয়ের প্রথমদিকের দিনগুলোর কথা। সারাদিনের শেষে স্বামীসঙ্গবিহীন বালিকাবধূটি অভিমানে স্বামীর বুকে মুখ লুকোলে যুবক স্বামীটি অন্ধকারেও সতর্ক চোখে চারিদিক দেখে নিয়ে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিত কিশোরী বধূটিকে। আর এখন সেদিনের সেই কিশোরী বধূ আজ গিন্নী হয়ে পুত্রবধূদের একই নিয়মের বেড়াজালে বন্দী রাখতে চান । নিজের শাশুড়ি মায়ের মতোই মনোরমাও মনে করেন - - - বেশী স্বামীসঙ্গ পেলে বাড়ির বউরা ডানা ঝটপটাবে বেশি - - - পোষ মানবে কম। তাই এ বাড়িতে মনোরমার শাশুড়ির আমল থেকে এই এক নিয়মই চলে আসছে----কোনো পরিবর্তন হয় নি - - - কেউ চেয়েছে কিনা সে খবরটা জানা যায়নি। অবশ্য এ বাড়ির এখনকার তিন বউ ওদের শাশুড়ির মতো স্বামী সোহাগিনী কিনা সে খবরে কাজ নেই আমাদের। ওরা তিনজনে স্বামীদের বাদ দিয়ে নিজেদের মতো করে অবশ্য ভালোই থাকে। 
           এবাড়ির ছোটবউ মঞ্জুলা বলে"যাই বলো বড়দি, এ বাড়ির নিয়মগুলো অদ্ভূত হলেও একটা ব্যবস্থা কিন্তু ভালোই।" 
   "কোন নিয়মের কথা বলছিস বলতো?" 
    "এই যে রোজ দুপুরে নিজের ঘরে না থেকে একতলার এই ঘরে বসে গল্পগাছা, সেলাইফোঁড়াই, বইপড়া - - - - এগুলো কিন্তু বেশ ভালো।" 
    "আমায় তো বাপু দুপুরে বিছানা ডাকে শোবার জন্যে, কিন্তু কী আর করব - - - শাশুড়িমায়ের হুকুম তো অমান্য করা যায় না। "
   "সে তুই যাই বলিস না কেন মেজ - - - - আমার তো দুপুরটা এখানেই ভালো লাগে। ঘরে যাওয়া মানেই তো ওনার পিঠ চুলকে দাও, হাতে জলটা এগিয়ে দাও, পানটা ভালো হয় নি---আবার সেজে আনো----অনেক হ্যাপা। তার থেকে এই নিয়মই বেশ। তা তোদের তো আর নতুন বর নয় - - - - এত ঘরে যাবার ছটফটানি কেন রে? "
বড়োজা কনকলতার কথায় বাকী দুজনে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হেসে উঠে একতলায় ওদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। 
   এ বাড়িতে রাত নটার মধ্যে খাবারের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। তিন বউ রান্নাঘরে খাবারের থালা গোছাতে গোছাতে শাশুড়ির গলা শুনতে পেল " তোরা সব্বাই এখানে আছিস যখন - - - একটা কথা বলি।" 
    "কী ব্যাপার মা? কিছু হয়েছে?" 
বড়ো ছেলে ময়ূখরঞ্জনের কথায় হাত ভরা চুড়ি ঝমঝমিয়ে বলে উঠলেন "তেমন কিছু না রে। তবে এবার বাবা তোদের একটা দায়িত্ব নিতে হবে।" 
     মায়ের কথায় ভ্রূযুগলে বিস্ময়ের চিহ্ন এঁকে ছোটছেলে আলোকরঞ্জন বলে উঠল" কোন দায়িত্বের কথা বলছ বলতো? "
  " আরে বাবা আমি স্বর্ণর কথা বলছি। ওর তো গৌরীদানের বয়স হয়ে এল।" শাশুড়িমায়ের কথা কানে আসতেই মেয়েটার সরল মুখের হাসি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই একরাশ বোবা কান্নায় ভরে উঠল বুকের ভেতরটা আর ছলছল করে উঠলো কনকের চোখের কোলটা। বিস্ময়ে হতবাক বাকী দুজনের হাতের কাজ হাতেই রয়ে গেল। 
    "স্বর্ণ তো এখনো ছোটো! ওকে ওর ছেলেবেলাটা উপভোগ করতে দাও ।ষোলো পেরোলেই না হয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে। কী বল তোরা।" 
    ছোটভাইয়ের কথায় সম্মতি জানানোর আগেই মনোরমা দেবী বিস্ময়ে গালে হাত দিয়ে বললেন "তোরা কী কৌলিন্য ঘুচিয়ে একঘরে হতে চাস! আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না - - - স্বর্ণর গৌরীদান হবেই। তোমরা পাত্রের সন্ধান করো। "
   " ওই একরত্তি মেয়ে - - - - শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কী করবে মা? আর তাছাড়া তোমার কথামতো ইস্কুলে না পাঠিয়ে বাড়িতেই পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওটুকু ওকে শেষ করতে দাও। "
  " মেয়েমানুষের পড়াশোনা করে কটা হাতপা গজাবে শুনি? যা পড়েছে তাতেই ঢের হবে। "কথাগুলো বলে আঁচলে চাবির গোছা ঝুলিয়ে চুড়ি ঝমঝমিয়ে রান্নাঘরের সামনে এসে বললেন" কী হলো বড়ো বৌমা----এখনও খাবার রেডি হয়নি? ওরা কতক্ষণ বসে থাকবে। "
  " এই তো যাচ্ছি মা----একটা কথা বলবো ? "
" বলো কী বলবে। "
" বলছি মা----স্বর্ণর বিয়েটা আর ক'বছর পিছিয়ে দিলে হতো না? ও যে বড্ড ছোট - - - -" 
  "এই বয়সে তুমিও এসেছিলে - - - সেটা ভুলে গেলে কী করে বৌমা! "
  " সে জন্যই তো বলছি মা। দয়া করে স্বর্ণকে আর একটু বড়ো হতে দিন। "
  মেজবৌমা সুলগ্নার কথায় ওদের দিকে একঝলক তাকিয়ে গম্ভীর মুখে নিজের জায়গায় বসে রইলেন মনোরমা দেবী। 
  সেদিন রাতে প্রত্যেকটা বন্ধ দরজার আড়ালে এই একটাই আলোচনা। কনক তো শোনার পর থেকে চোখের জল ফেলেই যাচ্ছে----আর স্ত্রীর চোখের জলে অস্থির ময়ূখরঞ্জন থমথমে মুখে পায়চারী করছে সারা ঘরে। নিশীথরঞ্জন আর আলোকরঞ্জনের ঘরেও প্রায় একই অবস্থা। ওদিকে বাড়ির কর্তা সব শুনে গিন্নীকে বললেন "যুগ বদলাচ্ছে গিন্নী - - - - গৌরীদান আর নেই।" 
    "নেই বললেই হল। পাপ পুণ্যি বলে তো একটা কথা আছে নাকি। কুলীন ঘরের গিন্নী হয়ে এই বয়েসে কুল খোয়াবো নাকি গো!" 
    "আর কূল - - - খবরের কাগজ পড়ো গিন্নী - - - এখন গৌরীদান করলে হাতে হাতকড়া পরবে, বুঝলে----।" 
    বিস্মিত মনোরমা দেবী বিস্ফোরিত চোখে গালে হাত দিয়ে বললেন" ওমা---এ কি অলক্ষুণে কথা গো---। তাহলে কী হবে? জাত ধম্মো সব কী জলাঞ্জলি দিতে হবে? "
   " এখন সবাই এই রকম জাত ধম্মো নিয়েই আছে গিন্নী! ছেলেরা যা বলে তাই শোনো, এ নিয়ে আর তর্ক কোরো না। নাও, আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ো।" 
   গারদের ভয়েই হোক আর স্বামীর পরামর্শেই হোক - - - - একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ শুয়ে পড়লেন মনোরমা দেবী ।
   পরের দিন সকালে ছেলেদের পরামর্শে স্বর্ণের বিয়েটা আরও কয়েক বছর পিছিয়ে বাল্যকালটা রক্ষা হলেও মেয়েবেলা পেরোনোর আগে পনেরো বছরেই বিয়েটা হয়ে যায় ওর। পাত্র বছর চব্বিশের - - - - সবে পড়াশোনা শেষ করে পৈতৃক ব্যবসায় পা দিয়েছে। 
    বড়ো নাতনী স্বর্ণলতার পরপরই প্রায় একই বয়স পেরোনোর আগেই বাড়ির বাকি মেয়েদের আর বছর বাইশের মধ্যে সব ছেলেদের বিয়ে দিয়ে সংসারটাকে থিতু করে নিশ্চিন্তে স্বর্গলোকের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন মনোরমা দেবী। বিভঞ্জন মুখুজ্যে অবশ্য তার বহু আগেই পরিবারের সকলের যত্নআত্তির মায়া কাটিয়েছেন। 
   এখন পেল্লায় মুখুজ্যে বাড়ির সবটুকু ভার ময়ূখরঞ্জনের স্ত্রী কনকলতার ওপর। বাবা মা বহুদিন গত হলেও তিন ভাই এবং তাদের পরিবার একসাথে থাকার অভ্যেসটা বদলাতে পারেনি বলেই মুখুজ্যে বাড়ি এখনও একান্নবর্তী পরিবারের তকমাটা বয়ে বেড়াচ্ছে। শাশুড়ির সময়ের কড়া নিয়মের মধ্যে থাকতে থাকতে কখন যে ওই নিয়মগুলোকেই আপন  করে নিয়েছে বুঝতেই পারে নি একসময় নিয়মে অনীহা মঞ্জুলা আর সুলগ্না। কনকের গিন্নীপনায় আর বাকী দুজনের তদারকিতে এ পরিবারের তরণী ভালোই বইছিল। নতুন আসা সদস্যরা ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছেয় - - - - - নিয়মের বেড়াজালে বন্দী ছিল সকলেই। 
   হঠাৎই এক দুপুরে প্রায় কুড়ি বছর আগের মোটামুটি একই ঘটনা ঘটতে চলেছে এই পরিবারটিতে। হালফ্যাশনের চেয়ার টেবিলের বদলে এখনও মাটিতে আসনপিঁড়ি হয়েই খেতে স্বচ্ছন্দ ময়ূখরঞ্জনেরা। একদিন দুপুরে খাবার পরিবেশনের সময় মাথার ঘোমটায় মুখটা আড়াল করে মেজবউ সুলগ্না বলে উঠল "একটা কথা ছিল দাদা---বলব?" 
     "বলো বৌমা----।" 
     "বৌঠান কোথায়?" 
     স্বামীর কথায় মুখটা আরও একটু নামিয়ে সুলগ্না বলল" যদিও এটা দিদিরই বলার কথা----কিন্তু দিদি আমাকেই বলতে বললে। "
    "আঃ নিশীথ - - - - তুই থামবি! বলো বৌমা, তুমি নিঃসংকোচে বলো।" 
     " আসলে দাদা----আমি---- আমি আমাদের শেখরের মেয়ে জয়ির কথা বলছিলাম। "
        "কেন? জয়ির কী হয়েছে মেজ কাকিমা?" 
         "আঃ শেখর! আমরা কথা বলছি তো----এ বাড়ির নিয়ম কী তুমি ভুলে গেছ? "
     মাথা নামিয়ে শেখর বলল" ভুল হয়ে গেছে ছোটকাকাবাবু । "
   " দাদা----এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে জয়ি সবার বড়ো। আর ও এবছর চোদ্দোয় পা দেবে। এবার তো ওকে পাত্রস্থ করার কথা ভাবতে হয় দাদা!" 
     এ কথা শুনে আগের মতোই জয়ির মা কাকীমাদের মুখ ছোট হয়ে গেল। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে বাড়ির বউরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেও মনের কথা মনেই চেপে রেখে খাবার পরিবেশনে মন দিল ওরা আর আলোকরঞ্জন বলে উঠল" বৌঠান - - - এখন জয়ির বিয়েটা কিছুদিন থাক। "
    " কেন ঠাকুরপো?" 
   "আসলে বড়ো বৌদি - - - - এখন আঠারোর আগে বিয়ে দেওয়ার নিয়ম নেই। জয়ি বরং পড়াশোনাটা করুক। আঠারো পেরোলেই আমরা ওর বিয়ের ব্যবস্থা করব।" 
     "কিন্তু ঠাকুরপো - - - অত বড়ো বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলে জল চলবে তো সমাজে আমাদের? জানোই তো কুসুমপুর কত গোঁড়া! "
     "জানি বৌদি - - - আর এখন তো আঠারোয় মেয়েদের বিয়ের বয়স শুরু। তুমি এত চিন্তা কোরো না বৌদি। "
   " মা - - - একটা কথা বলি, আমাদের জয়ি পড়াশোনায় খুব ভালো । ওর বেলায় কি নিয়মের একটু হেরফের করা যায় না? "
     " বড়ো বৌমা - - - তুমি তো চোদ্দোয় এসেছ এ বাড়িতে আর আমাদের মেয়েরাও এই বয়েসেই শ্বশুরঘর গেছে। আর পড়াশোনা বেশি করে কি হবে? ছেলে মানুষ করতে এইটুকুই যথেষ্ট। তুমি রান্নাঘরে যাও। আমরা আছি এখানে। "
 
     বেশ কয়েকমাস পরের কথা----বর্তমান তিন কর্ত্তার চারছেলে শেখর রঞ্জন, শৈলরঞ্জন, প্রমদারঞ্জন আর বিবেকরঞ্জনের মেয়ে জয়ি, বিনি, নীহার আর অপালার বাড়িতে পড়াশোনার বদলে বাড়ির ছেলেদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্কুলে যাওয়া দেখে তিন গিন্নীর একটু আপত্তি থাকলেও কর্ত্তাদের অনুমতিতে তা ধোপে টেকেনি। এখনও সকালবেলা জয়ি-বিনিদের ব্যাগ কাঁধে নিতে দেখলেই নিজের মনে গজগজ করে কনকলতা সুলগ্নারা। 
   এসব পুরোনো নতুনের মিলমিশেল - - - দ্বন্দ্বে একরকম কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। হঠাৎই একদিন ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে এলে দেখা গেল সবাই ফিরলেও জয়ি বাড়িতে ফেরেনি। জয়ির ছায়াসঙ্গী বিনিকে জিজ্ঞেস করতেই ও বলল"বড়দি বোধহয় মিনিদিদির বাড়িতে গেছে। আমাদের বলল আগে চলে আসতে।" 
    এরপর সন্ধ্যে পেরিয়ে অন্ধকার গাঢ় হলেও ঘরের মেয়ে ঘরে না ফিরলে বাড়ির কর্ত্তাদের খবর পাঠিয়ে বাইরের দালানের বারান্দায় বসে কনকলতা বলে উঠলেন "বুঝলে তো ছোটবৌমা - - - মেয়েদের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ইস্কুলে পাঠানোর ফল হাতে হাতে পেলে তো? "
   " এই গ্রামে বাপ চোদ্দো পুরুষের মান - সম্মান জলাঞ্জলি গেল বড়দি!" 
    মান সম্মান নিয়ে পরে ভাবিস ছোটো - - - মেয়েটার কোনো বিপদ হলো না তো? "একথা শুনে জয়ির মা চাঁপা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই  জয়ির কাকীমারা পরস্পরের মুখের দিকে উৎকণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে থাকলে মেজগিন্নি বলে ওঠে "এখন আর কেঁদে কি হবে বাছা---নতুন যুগের নতুন ধারাকে ঘরে আনতে গিয়ে মেয়েকে ঘরের বার করেছ। এখন বোঝো! "
  " যা বলেছ দিদি---মেয়ে হল ঘরে রাখার জিনিস - - - তাকে পরপুরুষে দেখলে তো লোভ করবেই। আর কাঁচা বয়সে ভুলটা বেশী হয় - - - এটা বোধহয় ভুলে গেছিলে!" 
  এসব কথার মাঝে বাড়ির সকলে জয়িকে ছাড়া ফিরে এলে ভয়ে দুশ্চিন্তায় মুখে কথা ফোটে না কারো। কর্ত্তাদের আলোচনায় বাড়ির মেয়েরা এটুকু বুঝতে পারে - - - সারা গাঁয়ে এ নিয়ে কানাঘুসো চলছে। 
" এরপর ওই মেয়ে ফিরলে ওকে পাত্রস্থ করতে পারবে তো শৈল? "
   " কিন্তু জ্যাঠামশাই---- মেয়েটার কি হলো সেটা না জেনেই - - - -" 
    "তুমি থামো শৈল---কুলীন বংশের ছেলে হয়ে এ কথা খান বলো কি করে?" 
    "আলোক - - - - চল আমরা বরং থানার বড়বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করি।" 
    " ও মা----একি কথা---মুখুজ্যে বাড়িতে শেষে পুলিশ! কি হবে রে মেজ---"
   " আঃ----মেলা বকবক কোরো না তো বড়োবউ! পুলিশ তো আসবেই----এবার ওই মেয়ের জন্যে গাঁয়ে আমাদের জল চললে হয়। "
    ময়ূখরঞ্জনের কথায় কনকলতা পরিবারের ভবিষ্যত ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠল আর জয়ির মা কেঁদে উঠল মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কিছুক্ষণের আলোচনার পর ওরা থানায় যাবার জন্যে বাড়ির সদর দরজার চৌকাঠের সামনে আসতেই দেখল মনোরমা দেবীর লালপেড়ে গরদের শাড়িটা পরে সিঁদুরে মাথা রাঙিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জয়ি আর পিছনে পাশের বাড়ির শহরের কলেজে পড়া চাটুজ্জ্যে বাড়ির ছোটছেলে দীপ্তেন্দ্র - - - - হাতে দুগাছি মালা। সিঁদুর আর শাড়িতে বছর চোদ্দোর মেয়েটা একনিমেষে অনেকটাই বড়ো হয়ে একেবারে বালিকা বধূ মনোরমা দেবী হয়ে গেছে । ওই চেহারায় জয়িকে দেখে হঠাৎ করেই বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সকলে আর আধো অন্ধকারের মধ্যেই ভেতর বাড়ি থেকে শাঁখ আর উলুর শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। 
 
 ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।
    
-----------------------------

    
    
    
    
    


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.