ভালো থেকো কৃষ্ণচূড়া
জয়শ্রী ব্যানার্জী চক্রবর্তী
অবশেষে ঠিক হলো দিন, ওদের দেখা করার , ওরা মানে উজানী রায়, মধুজা মিত্র , পলাশী হেমব্রম আর শিরিন সিদ্দিকী। একসাথে পড়ত ওরা বিশ্ব ভারতীতে । বিভাগ ছিল আলাদা আলাদা। কিন্তু ওরা এক ব্যাচ । উজানীর ছিল ইংলিশ , মধুজার মনিপুরী নৃত্য, পলাশীর ইতিহাস , আর শিরিনের বাংলা । চারজনে চার জায়গা থেকে গেছিল , উজানী বর্ধমান , মধুজা কলকাতা, পলাশী পুরুলিয়া আর শিরিন ঢাকা থেকে । এক মেসে এক ঘরের বাসিন্দা ছিল ওরা । চারজনের সখ গুলোও আলাদা ! বর্ধমানের একটি গার্লস স্কুলের ইংলিশ টিচার উজানী প্রকৃতি প্রেমী ও সমাজ সেবী। একটু ছুটি পেলেই সে চলে যায় একা বা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে , বা আশ্রম এর কাজে , জীবন এর গল্প খোঁজে আর সেই অভিজ্ঞতা গুলোতে কলম চালায় সে । কখনো কবিতার ছন্দ কখনো গল্পের আবেশ থাকে তাতে । চিলেকোঠার জানালা পেরিয়ে তার দৃষ্টি আকাশের নীল ঘুড়িতে আটকে যায় ! মন চলে যায় কোন অচিনপুরে , মেঘলা দুপুর গুলো তার বড়ো প্রিয় । বৃষ্টি যেন ডাকে তাকে প্রেমিকের মতো, ঝাপটা দিয়ে আদর করে যায় । কখনো মন শিলং এর রূপকথায় ,কখনো শিলচরের চুপকথায় ,কখনো শিলিগুড়ির উপকথায় ..! সকালের খামে রোদ চিঠি এসে তার ডাক নাম ধরে ডাকে আবার রোদ পড়ে আসা বিকাল তাকে মনে পরিয়ে দেয় কারো কথা । হেমন্তের ঝরা পাতারা মনে করিয়ে দেয় স্মৃতিমেদুর দিনগুলো । কারো চোখের বিছানো শীতলপাটি তে তার ইচ্ছা করে আরাম করে শুয়ে তারাদের সাথে রাত্রি বাস করে । শরৎ এলে রাশি রাশি শিউলি কুড়িয়ে তার পড়ার টেবিলে রাখে! শীত দুপুরে কালো শাল এর ওম মেখে সে বই মেলা থেকে নিয়ে আসা বইয়ে রাখে হলদে পাখির পালক । কখনো একা নিজের মনে কখনও অনুষ্ঠানে সে আবৃত্তি করে ! মধুজার সারা বছর মোটামুটি বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রাম চলে । কলকাতায় তার বাড়িতে নাচের স্কুল মঞ্জুলিকা । সন্ধ্যার অবসরে ছোটো ব্যালকনিতে সে বসে চা নিয়ে । সেখানে ফুটে থাকা ফুল তাকে স্বাগত জানায় । কথা বলে চুপিচুপি ! সে রোজ একটি নির্দিষ্ট তারাকে দ্যাখে । তারাও যেনো একভাবে দ্যাখে তাকে । কোন রূপকথা লিখে চলে দুজনে ! মেয়ে বিহুকে নিয়ে তার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন ।
পলাশী তার পুরুলিয়ার রাঙা গ্রামের একদম কাছাকাছি একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায় । পলাশ ফুলের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে সে ঘ্রাণ নেয় জীবনের । বেশ আছে এক দল শিশুদের নিয়ে । তাদের হাসি কান্নার মাঝে সে নিজেকে খুঁজে পায় । অবসরে মুখোশ করে তাতে রঙ করে। ফুটিয়ে তোলে ছবি ,লতা পাতা গাছ গাছালি রূপকথার । শিরিন থেকে গেছিলো এখানেই। ফিরোজ এর সাথে মেয়ে রিখিয়া কে নিয়ে তার সুখের সংসার । বোলপুরের দিকে মেহেদীপুরে থাকে সে । বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসে তার সাথে গাইতে, এখন রিখিয়ার সাথে সাথে বেশ কিছু মেয়েকে গান শেখায় সে ।
চার জন চার রকম পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিল কিন্তু চার জনের অন্তর মিশে গেছিলো এক আকাশে । সেই প্রথম দিনে উজানী দাঁড়িয়েছিল মেসের কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে । অবাধ্য এলোমেলো চুল চোখে মুখে ,কাজল কালো চোখ আর ছোটো কালো টিপ । নীল শাড়ির আঁচল উড়ছিল বিকাল বেলা়র বাতাসে , হলদে রঙের একটি পাখি টুটুই টুই , টুটুই টুই করে ডাকছিল আর ঘাড় ঘুরিয়ে উজানী কে দেখছিল । এমন সময় একটি নিরীহ গোছের হলুদ চুড়িদার পড়া একটা মেয়ে এদিক ওদিক দেখছিল । উজানী দেখলো তার মুখে চোখে ক্লান্তির ছাপ । কালোর উপরে সুশ্রী মুখ । বললো আমি পলাশী ।পলাশী হেমব্রম। রুম নাম্বার ১২ টা কোনদিকে বলতে পারেন ? কথায় ছিল পুরুলিয়ার টান । উজানী চমকে ওঠে' পলাশী ' ! মনে মনে বলে কে তুমি পলাশী ? এমন সুন্দর নাম তোমার ! ইতিহাস না লাল ফুল এর গুচ্ছ ! মুখে বলে আরে আমিও তো ওই রুমে যাবো । আমিও ওতেই উঠেছি । মেস এর সামনে গেটের গেছে কৃষ্ণচুড়া গাছ যা ওই ১২ নাম্বার রুম এর জানালায় গিয়ে মৃদু হাওয়ায় দুলছে । এর পর একে একে মধুজা আর শিরিন । কলকাতার মধুজা ভীষণ আড্ডাবাজ , , নাচ টা ওর রক্তে । আহামরি সুন্দরী না হলেও ওর স্মার্টনেস ,কথা বলার ভঙ্গি ,সাজগোজ ওকে আকর্ষিত করাতো । শিরিন ছিল শান্ত মেয়েটি। গৌড়িয়া স্নিগ্ধ পল্লিশ্রী মেয়েটি যেন !একরাশ কালো চুল। ঢাকার ধানমণ্ডি তে ওদের বাসা ।সকল কে সম্মান করে কথা বলত ।'জি আপু ''জি ভাইয়া',এক রুম এ ভিনদেশী মেয়েটিকে ওদের ভালই লাগতো । একটু কম কথা বলত ।অনেকদিন অব্দি ওদের তুমি বলতো। ওরা নাকি বন্ধুদের তুমি বলে !শেষে বহু কষ্টে ওর অভ্যাস ছাড়িয়েছে ।মধুজা যেখানে, সেখানে কেউ কথা না বলে থাকতে পারবে না বোধহয় । পলাশী একটু ভয়ে ভয়ে থাকত ভাবত ওর থেকে অনেক বিত্তশালী তিন বন্ধু ওকে কিভাবে নেবে ! আড়ষ্ঠ থাকতো ।খুব পড়ত ,আড্ডা বেশি দিত না । বেশির ভাগ সময় পড়া নিয়ে থাকতো ইতিহাস তথ্য গুলো বার বার মুখস্ত করে মনে করার চেষ্টা করতো । বেশি কিছু খাবার কিনত না ।অন্যদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকত, কিন্তু ভালবাসা বড়ো ছোঁয়াচে !,মানুষ তাতে আক্রান্ত হয় , আর বন্ধুত্বে যদি একটু যত্ন ,পাত্তা বোঝাপড়া থাকে অচিরেই মনের অর্গল গুলো আলগা হয়ে যায় । পলাশীরও হয়েছিল ,একটা চাকরি ওকে পেতেই হবে ! মা বাবা ভাই বোন দের সুখে রাখবে সে ,গ্রামের মানুষ দের জন্য কিছু করবে । সে বেসিক ট্রেনিং নিয়েছে ,তাকে পেতেই হবে চাকরি তার লক্ষ্য স্থির । তার আঁকা আবিষ্কার করে বন্ধুরা খুব প্রশংসা করেছিল ,খুশী হয়েছিল মন তার !আস্তে আস্তে চার হাত এক হয়ে যায় । বের হতো তারা একসাথে তার পর যে যার বিভাগে চলে যেত আবার ক্লাস এর অফ টাইম দেখা করতো ।আড্ডা দিত ।ফিরত একসাথে ।নিজের নিজের বিভাগ এর সহপাঠী দের থেকেও ওরা চারজন একে অপরকে বেশি পছন্দ করত বন্ধুত্বে ।এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন গুলো ...! কখনো ক্যাম্পাস , কখনও কোপাই , মেসবাড়ীর বারান্দা , সোনাঝুরি, কৃষ্ণচূড়া, পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব ,ঝরা পাতা , বই খাতা ..কবিতা ,গান ,নাচ ,আঁকা .... !
সেই সময় পড়তে পড়তে ওরা সবাই সবার বাড়ী গেছিল । প্রথম সবাই গেছিলো উজানী দের বাড়ী বর্ধমানে । উজানীরা বর্ধমান শহরে থাকলেও ওদের আসল বাড়ি ঐদিকেরই একটি গ্রামে । উজানীর বাবা বর্ধমানে রেলে সার্ভিস করতেন । রক্ষনশীল গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে উজানী। জমিদারি বংশ । বাড়িতে রাধামাধব এর নিত্য সেবা ।স্নান সেরে বাড়ীর সকলে ঠাকুর ঘরে আসেন ।পুরোহিত মশায় পুজো করেন । প্রসাদ দেন ।তার পর সকলে জল খাবার খেয়ে যে যার কাজে ।গ্রামের বাড়িতে রোজ প্রায় কুড়ি ত্রিশ জন যেকোনো জাতের গরীব লোক ঠাকুর এর ভোগ খেতে আসে । কিন্তু বাড়িতে এখনো অব্রাহ্মণ এর সাথে বিয়ে চালু হয়নি । যদি কারো মনে প্রেমের মুকুল দোলা লাগতো নীরবে তা ঝরিয়ে দিতে হতো । বাড়ীতে মুরগী নিষিদ্ধ । সাহায্যের জন্য অনেকে আসতো ,খালি হাতে ফিরত না । এ বাড়ীতে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়েরাও পরিবারের ছেলেদের সাথে, কিন্তু মেয়েরা সংসার দেখত । এই ব্যাপারে বাড়ীর কর্তা দের অভিমত ছিল দুজনে চাকরি করলে সংসার এ অবহেলা আসবে । নিতান্ত প্রয়োজন বা যাদের সত্যি দরকার সংসার চালানোর জন্য জব এর ,তাদের ছাড়া বাকিদের জব করার ব্যপারে খুব একটা পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন না । জন্মাষ্টমী আর দোলে এর সময় গ্রামের বাড়ীতে উৎসব হতো আত্মীয় স্বজন রাও আসতেন ।সেবার জন্মাষ্টমী শুক্রবার পড়াতে বাড়তি শনিবার আর রবিবারও ছুটি পেয়ে গেলো ঠিক হলো ওরা উজানী দের বাড়ী যাবে । সমস্যা টা হলো একটু শিরিন কে নিয়ে । ওকে নিয়ে গেলে কেউ কিছু কটাক্ষ করবে কিনা ! উজানী ধরলো মা আর দিদি উজ্জয়িনী কে । সবাই ওই উৎসবে অংশ নেবে শিরিন এখানে থাকবে সেটাও ভালো লাগছে না আবার শিরিন নিজে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে সেটাও বিষয় । মা বললো, দ্যাখ রাই আমার আপত্তি নেই, তোরা একসাথে থাক ,আনন্দ কর কিন্তু মন্দিরে ওঠাস না যদি ঝামেলা হয়, আমাকেই দোষ দেবে সবাই। তাছাড়া শিরিন নিজেও বোধহয় উঠবে না । আর আমি ওকে শ্রী বলে ডাকবো । উজ্জয়িনী ওরফে রাহী বলেছিল তোরা আলাদা ঘরে থাকবি, ঘুরবি ,খাবি , মজা করবি বেশি আত্মীয়দের কাছে যাবার দরকার কি ! তখন উজ্জয়িনী নতুন বিবাহিতা । উজানী বিশ্বভারতী তে ভর্তির কিছু আগে ওর বিয়ে হয় । ওর ছিল ভূগোল। সে বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকেই মাস্টার্স করেছিল । উজানী ওদের সাথেই এসেছিল সেবার বাড়ীর পুজোয় । বর্ধমান স্টেশন থেকে বাস ধরেছিল গ্রামে যাবার । বাড়ীর গাড়ী ইচ্ছে করে নেয় নি ।বাস দিয়ে রাস্তা চেনাবার জন্য । জন্মাষ্টমী এর আগের দিন বিকালে ওরা এসেছিল ।ক্লান্তি যেন এক নিমেষে উধাও হয়ে গেছিলো বাড়িতে এসে । পলাশী মুগ্ধ হয়ে দেখছিল প্রাচীন জমিদার বাড়ির ইতিহাস । কড়িবর্গার বিশাল দোতলা বাড়ী। খড়খড়ি দেওয়া ঝিলিমিলি জানালা । ওপরে নিচে লম্বা বারান্দা । নিচে শরীরের অর্ধেক পাঁচিল তোলা বারান্দায় । উপরেও তাই তবে আড়াআড়ি লম্বা শিক দেওয়া । উঠোন জুড়ে নানা গাছ । মধুজাও খুব খুশী হয়েছিল এমন সুন্দর পরিবেশ দেখে ।গ্রামের নির্মল বাতাস ,মুক্ত আকাশ ,সবুজ গাছ গাছালি , পাখির কূজন তার ইচ্ছা করছিল যেনো সে ময়ূর এর মত নাচে। শিরিন তো অভিভূত পুরো ! ওমা কি সুন্দর সাজানো ওদের মন্দির ! এই এত খাবার ওদের কৃষ্ণ এর জন্য ! মন্দিরের সামনে একটা গুলঞ্চ ফুলের গাছ । বেদি করানো তাতে । ওখান থেকে ওরা দেখছিল সবাই ঠাকুর সেবার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত !মধুজা বোঝায় ওগুলো সব ঠাকুর এর নামে নিবেদন হবে ,তার পর সেটা প্রসাদ রূপে সবাই খাবে । ঠাকুর মন্দিরের সামনে থেকে এক বয়স্কা আত্মীয়া শিরিন কে বলেন ,'তুমি মালা গাঁথতে পারো একটু সাহায্য করবে ? কি নাম তোমার মেয়ে? তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসেন উজানীর মা , ও রাই এর সাথে পড়ে ।পূজোয় এসেছে । দাও আমায় মালা কোনটা গাঁথতে হবে ওরা একটু ঘুরুক । সরে এসে শিরিন কে বলেন ভগবান এর কাছে সবাই সমান সে তুমি যেখান থেকেই ওনাকে ডাকোনা কেনো! ।ফুল তো আগে ঈশ্বর এর চরণে দেবার জন্যই ,তোমার ইচ্ছা হলে তুমি এই গাছের তলায় বেদীতে বসে গাঁথো। আমি নিজে হাতে ও মালা পরিয়ে দেবো ।কিন্তু আমি অশান্তি চাইনা ।কেউ কষ্ট পাক চাইনা পুজোর কিছু নিয়ম নিষ্ঠা থাকে তো ! তুমিও কোনো ব্যাপারে এখানে কষ্ট পেলে আমার সত্যি মন খারাপ করবে !কি জানো আমরা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থে ভগবান কে আলাদা করি, ঈশ্বর হলো মনের শক্তি ,মনের শান্তি! মন শান্ত হয় ।লোভ আসেনা ।শিরিন মালা গাঁথতে বসে ..."কি রে কি করছিস" বলে উজানী ডাকে । শিরিন মুখ তুলে দেখে উজানী রানী রঙের শাড়ী পড়েছে ।কি যে অপূর্ব লাগছে ! উজানী এমনিতেই লম্বা ফর্সা ও বেশ সুন্দরী । গভীর কালো চোখ লম্বা চুল । তার ওপরে সেজেছে । মিষ্টি হাসলো উজানী ।"দিদি এটা পড়তে দিল" ,"তুই চল চেঞ্জ করে নে ।একটু বাকি আছে দেখছি দে আমায় করে দি ।ওরা রেডী হচ্ছে যা তুই । সেবার খুব মজা করেছিল ওরা ।মাঝে মাঝে ওদের দলে যোগ দিতে আসছিল উজ্জয়িনী আর ওর পিসির মেয়ে ও জারতুতো বৌদিরা । তখন মোবাইল এসেছে কিন্তু তাতে পিক তোলা যেতো না । শিরিন এর ও ফোন ছিল বাইরে থাকে বলে ওর বাড়ী থেকে দিয়েছিল । শিরিন পিছনের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল । একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে । শেষ বিকালের আলো আকাশ জুড়ে এদিক থেকে অনেক টা দূর অব্দি দেখা যায় । সারি সারি তালগাছ । এখন পাকা তালের সময় । এদিকে একটা বাঁধানো পুকুর । বাঁধানো ঘাট । ঘাটের চারপাশে গাছ ।কিছু কচুপাতার ঝাড়। রাশি রাশি শুকনো পাতা সিঁড়ি জুড়ে । শান্ত বাতাস ।দুপুরে ওরা বসেছিল ঘাটে ।এক অদ্ভুত মাদকতা সেখানে । রিং হোলো । আম্মির কল। হুঁ বলো !কি করিস ?আম্মি জিজ্ঞেস করে ,এই যে এক দোস্ত এর বাড়ী শিরিন উত্তর দেয় । শাঁখ বাজনের আওয়াজ আসে ক্যান ? পুজো চলসে ?আম্মির প্রশ্ন? জি আম্মি ! কহন গেলি তুই ? মন্দিরে কিন্তু ঢুকবানা বাহিরে থাকবা। তোর আব্বু জানলে রাগারাগি করবেন এহন । না আমি বাহির থেকে দেখতেসি ঢুকি নাই ! পরে কল দিবো ।কেটে দেয় শিরিন । পিছন ফিরে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে শিরিন । উজানী দের কাজের লোক দাড়িয়ে যাকে ওরা বিশু কাকা বলে ডাকছিল ,বললো দিদি মনি পূজো শুরু হবে ।নিচে এসো ।বড়ো বাবু সবাইকে ডাকতে বললেন যে যেখানে আছে তাই ডাকতে এইছি । বলে চলে গেলো ।শিরিন একটু ভাবলো ।বিশু কাকা কি কিছু বুঝলো! কিছু হবে নাতো! ওদের বাড়িতে সব ধর্মের লোক এসে খায় সেটা বাইরের ব্যাপার আর অন্দরমহল এর ব্যাপার হয়তো আলাদা ! এখানে কি আগে কেউ বাইরে থেকে এসে গেছে! না সেই প্রথম । সে গিয়ে দাঁড়ালো মধুজা আর পলাশী কাছে । উজানী বোধহয় ভিতর দালানে । পুজো শুরু হলো । আরতি শুরু হলো ।সব নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন হলো । রাতে তালের লুচি , তাল ফুলুরি , ক্ষীর, পায়েস ,মিষ্টি ,সুজি , মুড়কি , ঝাল আলুমটর ।ওরা এত খেতে পারছিল না । সেদিন গরমও ছিল । রাতেে ওপরের বারান্দায় মাদুর পেড়ে ওরা চারবন্ধু শুয়েছিল । নিঝুুুম রাত ,ঝিঝি পোকার ডাক একটানা , বাতাস ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিল ওদের, ফ্যান এর হওয়ার থেকে সেই হাওয়া ছিল মিষ্টি । ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমীর চাঁদ এ কালো মেঘের ছায়া সুনিবিড় হচ্ছিলো ,ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো রাতে ।মার ডাকে ঘুম জড়ানো চোখে উজানী তাকালো । এই রাই ওঠ! ওঠ! ঘরে শো ।বৃষ্টির ছাট আসছে । তাড়াতাড়ি উঠে বসে উজানী বন্ধুদের তোলে ।মাদুর বালিশ টেবিল ফ্যান নিয়ে ঘরে আসে । এই বাড়ীতে এখনও এসি আসেনি তবে ইনভার্টার আছে তাই ভয় নেই কারেন্ট যাবার । বিছানায় চার জনের একসাথে শোয়া ঘেঁষাঘেঁষি হবে বলে ওরা মেঝেতে মাদুর পাড়লো। ঘুমে চোখ জুড়ে আসছিল ওদের । জানালা গুলো কোনরকমে বন্ধ করে যে যার জায়গায় শুয়ে পড়লো । উজানীর মা ঘরে এলেন । ঘুমন্ত মেয়ে গুলো কে হালকা ঢাকা দিয়ে দিলেন একটু পরে যে শীত করবে ! পরদিন দুপুরে রাধা মাধবের খিচুড়ি ভোগ । সাথে বেগনী , আলুভাজা , বাঁধাকপি , চাটনি ,পাঁপড় ,পায়েস ,বোঁদে। বিকালে উজ্জয়িনী চলে গেলো ওর বরের সাথে দমদম । ওর বর অরুনিম ব্যাংকে জব করে ওখানে । হইচই করে ওরা গ্রাম দেখতে বেরোলো । পুকুরপাড়,জঙ্গল , মাঠ ,রাঙা রাস্তা পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড অব্দি । সেখানে বাজার ।লোক জনের ভীড় । শেষ বিকালের ব্যস্ততা । সন্ধ্যের মধ্যে ওরা ফিরে এলো । ঠাকুর ঘরে প্রদীপ দিচ্ছেন ওর বড়মা । শাঁখ বাজালেন । এক নিস্তব্ধতা যেনো বাড়ির চারদিকে । সকালে ওরা ফিরে যাবে শান্তিনিকেতন । রাতের মেনু হালকা ছিল ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, পেঁয়াজ দিয়ে ডিমের কারি । খেয়ে ঘরে যাবার আগে ডাক পড়লো জেঠুর ঘরে উজানীর । বয়স ৭০ এর উপর ।লম্বা ফর্সা বলিষ্ঠ সৌম্যকান্তি চেহারা । উজানীর বাবা ,মা আর কাকা পরমেশ ছিলেন । তিনভাই এর চেহারায় মিল আছে । অবনীশ রায় গম্ভীর গলায় বললেন তোমায় কয়েকটা কথা বলতে চাই রাই আশা করি তুমি মনে রাখবে । এখন দিন বদলেছে ,পুরোনো অনেক নিয়ম শিথিল হয়ে পড়ছে তবু বংশ গরিমা বলে একটা জিনিষ আছে সেটা মানো তো? উজানী বাবা ও মার দিকে তাকালো । সমরেশ , ও কল্যানী ও তাদের মেয়ের দিকে তাকালেন । তোমার বন্ধু শ্রী যে শিরিন সেটা আমি আগেই জেনেছি, কিন্তু সে আমাদের অতিথি ।রায় পরিবারে আজ অব্দি অতিথির অমর্যাদা কোনোদিন হয় নি ।আশা করবো পরবর্তী কালেও সেটা মানা হবে । একসাথে থাকো , মেশো,পড়াশোনা করছ , এক ঘরে আছো তাও শুনলাম ।সব জায়গায় সবটা নিজের মতো পাওয়া যায়না আমি জানি কিন্তু ওই অব্দি ঠিক আছে , দরকারে সাহায্য করো ,কিন্তু আশা করবো পরিবারের কথা খেয়াল রেখে কোনো অব্রাহ্মণ বা মুসলিম ছেলের সাথে ভবিষ্যতে ....কথাটা শেষ করলেন না অবনীশ রায় । উজানী ঘাড় হেলালো । অবনীশ রায় বললেন ঠিক আছে যাও শুয়ে পড়ো । কাল গাড়ি তোমাদের স্টেশন পৌঁছে দেবে । ফোন আরেকটা এসেছিল উজানীদের জানা নেই , সুদূর ঢাকার ধানমন্ডি থেকে ; .... একসাথে পড়ছো, থাকছো, বাড়িও যাচ্ছ ঠিক আছে কিন্তু যেনো কোনো হিন্দু ছেলের সাথে .... তাহলে কিন্তু আল্লাহ ক্ষমা করবেন না । মেয়ের গলায় আশ্বস্ত হয়ে ফোন কেটে যায় সেবার ।
এর পর চলছিল আগের মতো চলছিল শান্তিনিকেতনী জীবন । ঠিক হয় এবার কলকাতায় মধুজা দের বাড়ী যাওয়া হবে ,গরমে কলকাতা বেড়ানোর মানে হয়না এদিকে পড়ারও চাপ বাড়ছিল ক্লাস মিস করলে হবে না আর এখন যাওয়াও যাবে না ।সুযোগ টা হটাৎ এসে গেছিলো সরস্বতী পুজোর সময়টায় । পলাশী যেতে চাইছিল না ।ওখানে ঘোরা মানে বেশ কিছু টাকা ...! বাবা মা কষ্ট করে তাকে পড়ায় । বন্ধুরা আশ্বস্ত করেছিল আরে আমরা আছিনা ! তোর এত সংকোচ কেনো ?তুই তো চাকরি পাবি সিওর তখন নাহয় শোধ দিবি । প্লিজ পলাশী তোকে ছাড়া আমরা ঘুরবো না । না করতে পারেনি পলাশী আর,সে মনে মনে ঠিক করে চাকরি পেলে একদিন বন্ধুদের সে নিজে খরচা করে বেড়াতে নিয়ে যাবে । ঋণ রাখবে না । মনে মনে মারাংবুরু কে স্মরণ করে ।সেবার হৈ চৈ করে ওরা ঘোরে কলকাতা শহর ।মধুজা এক মাত্র সন্তান বাবা মায়ের ।অনেক স্বাধীনতা পায় সে । সল্টলেকে ওদের ফ্ল্যাট এর দরজা খুলেই সাজানো সরস্বতী এর মুর্তি । উজানীর মনে পড়েছিল , উজানী যখন সেই প্রথম তাদের রাধামাধব বাঁধানো ছবি পড়ার টেবিল রেখে ধূপ দেখাচ্ছিল মধুজা বললো কিরে তুইও করিস পূজো ? কেনো তুই করিস না ? বামপন্থী নাকি ? উজানী ধূপ টা একটা কাঠের ছোট বাহারি ধূপদানী তে গুঁজতে গুঁজতে বললো । আরে না আমিও করি রে তবে সরস্বতীর! বলে ছোট্ট একটা সরস্বতীর মুর্তি বার করে টেবিলে রাখে । হাসলো মধুজা ।আমি তো ইন্দিরা জির ফ্যান । উফ! কি মারাত্বক পার্সোনালিটি !আরও ভালো লাগে তিনি এখনকার ছাত্রী ছিলেন । হুম্ কিন্তু উনি এখন তো নেই ,এখন দলে সেই ..! প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আছেন যে ।আচ্ছা বুঝলাম ।উজানী বেশি কথা বাড়ালো না ।বন্ধুর সাথে ধর্ম আর রাজনীতির আলোচনা বেশি না করায় ভালো । কিজানি যদি প্রভাব পড়ে কারো মনে ! রাজনীতি অনেকেই আবেগে করে । অনেকে আবেগে ভোট দেন । ইন্দিরাজি মারা যাবার পর কংগ্রেস যদি রাজীব গান্ধীর এর বদলে অন্য কাউকে নামতে তাহলে কি এত বিপুল ভাবে জিততো ! কি রে কি ভাবছিস ? মধুজা ওর হাতে আলতো চাপ দিল । মধুজার মা ওর মতোই হাসি খুশি । ওদের ফ্রেশ হতে বলে রান্নাঘরে এগোলেন । লুচি ,ঘুঙনি মিষ্টি খেয়ে ওরা ঘরে আড্ডা দিতে লাগলো । ঠিক হলো কাল সকাল সকাল বেরোনো হবে । পলাশীর এই প্রথম কলকাতা আসা । ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত ছিল সে । সে যদি খারাপ রেজাল্ট করতো পড়াশোনায় এগোতে পারতো না । ভালো রেজাল্ট করেছে বলে আজ এখানে আসা । যত যায় হোক এই পরীক্ষাতেও তাকে ভালো ফল করতেই হবে । তার বেসিক ট্রেনিং নেওয়া আছে । চাকরিতে ঢুকে গেলে আর পড়া হতনা । মনে মনে খুব ইচ্ছা ছিল শান্তিনিকেতনে পড়বে , শেষ হলেই সে চাকরির জন্যে লাগবে । শিরিন ও কলকাতা ঘুরে দ্যাখেনি আগে । এয়ারপোর্ট থেকে সোজা শান্তিনিকেতন গেছিলো । উজানী আগে ঘুরে গেছে বেশ কবার । আত্মীয় দের বাড়ী আছে । এমনিও ঘুরে গেছে । রিসেন্ট দিদি ও দমদমে থাকছে । তার পর দুটো দিন ভিক্টোরিয়া , নন্দন , মোহরকুঞ্জ . মিউজিয়াম , ন্যাশানাল লাইব্রেরী রবীন্দ্রসদন .. এর ইতিহাসের অন্তরালে আরো চারজনের এক দিবসের কাব্য লেখা থাকলো । কলকাতা মানে প্যাসান , কলকাতা মানে ফ্যাশান ! শীতের সেই কোনো এক অবেলায় চারটি মেয়ে ভিক্টোরিয়ার ঘাসে বসে দেখছিল আকাশে একটা প্লেন অনেক দূর থেকে দূরে যেমন মানুষ চলে যায় দূর হতে দূরে যে যার গন্তব্যে বা প্রিয় জনের কাছ থেকে ...ওরাও একদিন হয়তো এমনি দূর হতে দূরে ।যদি হারিয়ে যায় ,যদি কেউ চলে যায় ,যদি না হয় আর দেখা ... ভাবনা টা চমকে গেলো ।একটা লাল বল দুম করে ওদের সামনে পড়লো । বল টা ছুঁড়ে দিলো মধুজা । আদুরে বাচ্চাটি মিষ্টি হাসতে হাসতে বলটা নিয়ে ছুটে ছুটে যাচ্ছিল । উজানীর মনে পড়ছিল রাস্তায় আজ আসার সময় দেখা গোলাপ বেচা ছেলেটির কথা । সে কিছু সাহায্য করতে পারেনি বলে ব্যাপার টা যেন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল তাকে । মধু ডাকলো হাত নেড়ে বাপী ..ই....ই...এদিকে এসো আমাদের একটা ছবি তুলে দাও সূর্যাস্তের সময় । মধুজার মা বললেন এই মধু সূর্যাস্তের ছবি নিস না । ঘরে রাখা ভালো না ।থাক না মা একটা নি ।এই যে মহূর্ত টুকু বিদায় নেবে আর ফিরবে না তার সাক্ষী থাকি চারজনে । ফ্ল্যাশ অন হলো ..!
মধুজাদের বাড়ী যাবার আগে পৌষ মেলায় সেবার ঘুরে ঘুরে মেলা দেখছিল , শিরিনের হটাৎ চোখে পড়ে যায় সবুজ চুড়িতে। সেও নিতে যায় আর একটি ছেলেও , শিরিন সরে আসে ,অন্য খোঁজে । ছেলেটি বলে আপনি নিন আমি অন্য দেখছি , বোনের জন্য নেবো । চয়েস করে দেবেন ? আপনার হাত এর মাপ এই হবে মনে হচ্ছে । শিরিন চয়েস করে দেয় । ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায় তার পর প্রায় দেখা হতে লাগলো এখান ওখান । শিরিন এর মনে তখন পলাশ রাঙা বসন্ত কিন্তু মনের ভিতর অস্বস্তি ।আব্বুর কথা মনে পড়ে ।সে ভাবে না আর ওর কথা মনে করবে না । তার পর একদিন পড়ন্ত বেলায় শিরিন ফিরছিল হেঁটে হেঁটে মেসের দিকে ।মাথায় গোলাপী ওড়না ।গোলাপী চুড়িদার ।একপাশে মোটা বিনুনী । হাতে বাজারের কিছু সামগ্রী, একটা সাইকেল এসে থামলো ,হাই আমি ফিরোজ ! কাছেই থাকি ! ওপাশে শিমূল গুলো যেন সেদিন কোন পুলকে আরো দুলছিল আরো লাল হয়ে ! সেবার ছিল ওদের শান্তিনিকেতনে প্রথম বসন্ত উৎসব।আবীর ,পলাশ শাড়ী চুড়ি ,নাচ গান ,কবিতার মাঝে যেন একদল বসন্তের দূত রঙিন প্রজাপতির মতো পাখনা মেলেছিল ।
পরের বছর গিয়েছিল পলাশ ফুলের সময়ে পলাশী দের লাল মাটির গ্রামে , তখন পলাশ শিমুল এর বাহা উৎসব। বর্ধমান থেকে পুরুলিয়ার বাস ধরেছিল , অনেকটা রাস্তা । দুপাশে গাছের সারি তে আগুন রাঙা পলাশ যেন তার নতুন সাজে সেজে লাজুকলতা প্রেমিকা । নৈঃশব্দ্য চিরে মাঝে মাঝেই খসে পড়ছে পলাশ । যেন নীরবে সমর্পণের প্রতীক্ষায় ! কোনো সূর্যাস্তের সময় প্রেমিক তার প্রিয়াকে পলাশ দিয়ে বলবে আমি কথা রাখবো ! ফিরবো। সূর্যাস্তের সময় মানুষ এর মনে বড়ো মায়া জন্মায় । পৃথিবী ছেড়ে যাবার ,প্রিয় কে ছেড়ে যাবার জন্য বুকের ভিতর দলা পাকানো কষ্ট জমে! এক অন্য অনুভূতি, ত্যাগ এর! কষ্ট দেওয়া সবাইকে ক্ষমা করে দেয় মন ওই সময় । মানুষ বোধ হয় ওই সময় মিথ্যা বলতে পারে না । ওরা যখন পৌঁছলো প্রায় শেষ বিকাল । একটানা অনেকটা রাস্তা এসে প্রত্যেকে ক্লান্ত ! উজানী বেশ কবার বমি করেছে তবে এখন অনেকটা শরীর সুস্থ। বাড়ী ফেরার খুশিতে পলাশী এর মুখ উজ্জ্বল ।সাজানো গোছানো নিকানো নকশা করা গ্রাম একখানা । ডুমুর ডিহা মিষ্টি নাম । দাওয়াতে মাদুর পেড়ে বসলো ওরা ।ঠান্ডা জল ,মিষ্টি , মুড়ি , বেগুনি ।খিদে পেয়েছিল সবার । এদিকে আলো নেই ,তবে এখানে ppsp জল বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠছে । বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে কিছু দিনের মধ্যেই । জায়গা গুলো বাম দখলে, ততদিনে হারিকেন এই ভরসা, মৃদু বাতাস চারদিকে, ওরা মাদুর পেতে উঠোনে বসে গল্প করছে সবার সাথে । উৎসব এর আমেজ । আগামী কাল ওরা ওদের নাচ দেখাবে ।ওদেরও তাল মেলাতে হবে । সরল মানুষ গুলোর আতিথেয়তাতে মুগ্ধ হলো পলাশীর বান্ধবীরা । গরম ভাত , ডাল , আলুসেদ্ধ, ডিম খুব তৃপ্তি করে খেলো । উজানী দের ইচ্ছে করছিল বেশ কদিন থাকে ।কিন্তু ওদের আর্থিক অবস্থা দেখে ওরা সে কথা পলাশী কে বলেনি । পলাশী নিজেদের ভাষায় কিছু কথা বলছিল ওর মায়ের সাথে ।ফিরে এসে শুয়ে পড়লো ওরা ।সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেলো তাড়াতাড়ি ।
পরদিন সকাল থেকেই উৎসব এর সুর ।বাহা ওদের বসন্ত উৎসব এর মতো । ওরা ঘুরে ঘুরে দেখছিল , ওদের তিনজনের ক্যামেরা আছে । মধু পলাশীর এক বোনের কাছে সাঁওতালি নাচ তুলছিল । উজানী আর শিরিন ঘুরে ঘুরে দেখছিল । বিভিন্ন ছবি তুলছিল । এদের গৃহ দেবতা আবগে বোংগা। পুজো স্থল গোবর দিয়ে নিকানো হয় । শাল গাছ কে ঘিরে একটা ছামডা বা ঘর তৈরী হলো ।প্রত্যেকে স্নান সেরে নতুন কাপড় পড়ে নাচতে নাচতে বাজনা বাজিয়ে ওদের পুরোহিত কে আনতে গেলো ।তিনি সবাইকে নতুন ডাল থেকে ফুল দিলেন । নানান বনফুল দিয়ে পুজো হলো ।পূজোর পর আবার সেই ভাবে পুরোহিত কে বাড়ী দিয়ে আসা হলো ।সারাদিন চললো নাচ গান ,সবাই আমন্ত্রিত । ওরাও তাল মেলালো ।ওদের সবাইকে নতুন শাড়ী দিয়েছে পলাশীর মা । ওরা তো ভীষণ খুশী । এমন আন্তরিকতা । মধুজা তো দারুন নাচলো ওদের সাথে ।উজানী অনেক ছবি তুললো । শিরিন গলা মেলালো ওদের সাথে বাহা গানে...'সারজম ইচী মুরুৎ বাহা বাহায়েনা..
বাহা বগা ফাগুন চাঁদো সেটেরনা,
দারেরে মাতদম সারেড়না ,
আতো রে কড়া কুড়িলো রিঝোওয়েনা..!'
পলাশী কে লাল শাড়িতে ওদের গয়নাতে বেশ লাগছিল । ওদের নাচের ছবি তুলছিল উজানী । ওদের মধ্যে একটি ছেলে কে লক্ষ্য করলো পলাশী কে ইশারায় কিছু বললো, কালো , সুঠাম লম্বা চেহারা । পলাশী ও ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো ,পাল্টা ইশারায় জানতে চায়লো কিছু ,নাচ ছেড়ে ওর সাথে কথা বলছিল পলাশী ।হয়তো কেউ আত্মীয় ! উজানীর ক্যামেরা তাদের দিকেও একবার ঘুরেছিল । খেতে বসে শিরিন বললো কিরে পলাশী সেই ছেলেটা কে ছিল তোকে খুব খুশী দেখাচ্ছিলো কথা বলার সময়।আরে ওতো বিরাজ দা। বাইরে থাকে ।এখানে বাড়ী । উৎসবে এসেছে ।আমায় পড়া দেখাতো । হুঁ বুঝলাম খুব তাড়াতাড়ি বোধহয় আরেকবার এখানে অন্য নিমন্ত্রণে আসতে হবে ,বাকি তিন বন্ধু মুচকি হাসলো । পলাশীর গালে পলাশ রঙ ওদের চোখ এড়ালো না ।
ফিরে ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে । দিন রাত অনুশীলনে থাকতো সেই সময় । পরীক্ষার পর লম্বা শ্বাস ! দুদিন ধরে ঘুম ,অলসতা, আড্ডা । ব্যাগ গোছানোর পালা ।যে যার নিজেদের ঘরে ফেরার তাগিদ । ভীষণ মন খারাপ ওদের । নাহ সেই সময় শিরিন দের বাড়ী যাওয়া হয়ে ওঠেনি । উজানী র খুব ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় দেখার , এবার শিরিন কে বাড়ীতে বলতে হবে ।একটু টেনশন লাগছে । ফিরোজ এর জব টা যতদিন না হয় ! আব্বু কি বুঝবে ! ওই খালার দেওর এর ছেলেটা কে যদি ! উফ্ এখানে তার মন লেগে গেছে । পূর্ব পুরুষ এর দেশ এই ভারত আর বর্তমান বাংলাদেশ ।এই দুদেশেই থাক তার অস্তিত্ব । যাবার আগের দিন বিকালে শিরিন ফিরোজ এর কাছে গেলো দেখা করতে ।জানালা দিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছ টাকে দেখছিল উজানী । এখন ফুল আসার সময় নয় । অল্প হাওয়ায় পাতা গুলো দুলছিল । থোকা থোকা ফুল লালে লাল হয়ে থাকে আর টুপটুপ করে ঝরে পরে এই বারান্দায় ,আর নীচে। আবার অন্য কেউ এই ঘরের বাসিন্দা হবে । অন্য কেউ তার মতো রোজ বারান্দায় বসবে ,বই নিয়ে বসবে ।নীল আকাশ এর তারাগুলো আবার গল্প শোনাবে অন্য কাউকে এই খানে এই জানালা দিয়ে । কেউ হয়তো তার এই মতো বই এর ভিতর কৃষ্ণচূড়া রাখবে ।বুকের মতো একটা করে রোজ চিঠি লিখবে কারো জন্য ! সকালে উঠতে হবে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো সবাই । শিরিনের মামা এসেছেন ওকে নিতে ,মধুজা ট্রেন ধরবে,ওর সাথেই শিরিন রাও যাবে । উজানী দের গাড়িতে পলাশী নেমে যাবে বর্ধমান সেখান থেকে বাস এ পুরুলিয়া। ওর বাবা এসেছেন এত জিনিস নিয়ে যেতে একা পারবে না! ঘর শূন্য করে চারজন চলে গেলো আবার দেখা হবে বলে । তার পর যে যার বাড়ীতে নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো কিছুদিন ।ইতিমধ্যে রেজাল্ট ও বেরিয়ে গেছে । উজানী বি এড এর প্রস্তুতি নিচ্ছে । সেদিন সকালে হটাৎ স্কুটিতে ফেরার সময় পড়ে গিয়ে হাতে পায়ে হাঁটুতে জখম হলো সে ,রক্তা রক্তি কাণ্ড ! কল্যানী মেয়ের রক্ত দেখে দিশেহারা । পাশের বাড়ী তে নতুন এক প্রতিবেশী এসেছে । ছেলেটি কে দুই একবার দেখেছে হালকা, গৃহ প্রবেশের সময় ।শুনেছে সে ডাক্তার । কাল যেন মনে হলো ও এসেছে বাড়ী ওকে কি একবার ডাকবে হাঁটুতে টা বড়ো কাপড়ের টুকরো দিয়ে জড়িয়ে ছুটলেন পাশের বাড়ী । ডোর বেল বাজালেন। বাড়ীর মালকিন দরজা খুললেন দিদি আপনার ছেলে কি বাড়ী এসেছে ? হ্যা কিন্তু কেন কি হয়েছে ? আমার মেয়ে স্কুটি থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে অনেকটা কেটে গেছে , কি করবো বুঝতে পারছিনা ।যদি ওর সাহায্য পেতাম রাই এর বাবা তো বাড়িতে নেই ! আচ্ছা আচ্ছা দেখছি ও পুজোয়,এখনই হয়ে যাবে ,বলতে বলতে মুখ ফেরাতেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো ধুতি পরিহিত ,খালি গা ,তাতে ধবধবে পৈতে সুপুরুষ , সুঠাম ,লম্বা চেহারা চশমা পড়া একটি ছেলে।সেই মুহুর্তেও কল্যাণীর মনে হলো সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গ দর্শন হলো যেন! ব্যাক্তিত্বময় মুখ ও বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুখানি, টিকালো নাক !মহিলা বললেন অগ্নি একবার যা তাড়াতাড়ি ওনার সাথে ।ওনার মেয়ের স্কুটি থেকে পড়ে গিয়ে লেগেছে , কেউ নেই বাড়ীতে । আপনি চলুন কাকীমা আমি যাচ্ছি জিনিস নিয়ে । মিনিট দশের মধ্যেই অগ্নি হাজির হল উজানী দের বাড়ী । খুব দ্রুত পোশাক বদলেছে । টি শার্ট আর ট্রাউজার ।এসে দ্রুত উজানীর মাকে গরম জল করতে বলে তুলো বার করলো চুড়িদার এর প্যান্ট হাঁটুর কাছ থেকে ফালা হয়ে ছিঁড়ে গেছে অগ্নি ওর পা টা ধরলো ,বড়ো কাপড়ের টুকরো হাঁটুতে জড়ানো ছিল রক্তে ভিজে গেছে । দর দর করে রক্ত পড়ছে , তুলো দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করতেে লাগলো , তালুতে উজানীর গোড়ালি টা ধরে অগ্নি বেশ খানিকটা প্যান্টের অংশ ছিঁড়ে দিলো কারণ ওর অসুবিধা হচ্ছিলো পরিষ্কার করার । এইভাবে একজন পুরুষের সামনে তিনি ডাক্তার হলেও তার প্যান্টের প্রায় অনেকটা অংশ ছিঁড়ে গেছে, প্রবল অস্বস্তি আর যন্ত্রনা নিয়ে উজানীর চোখ বন্ধ করলো দাঁতে দাঁত চেপে ,চোখের জল গাল বেয়ে টপ করে পড়লো এক ফোঁটা অগ্নির হাতে ।পুরোটা ভালো করে পরিষ্কার ব্যান্ডেজ করে দিল সে । ভেঙেছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিল । যাক শুধু কাটার উপর দিয়েই গেছে ব্যান্ডেজের সময় ক ফোঁটা রক্ত অগ্নির টি শার্ট এ লেগে গেল । উজানী সংকোচ ও ব্যাথাতুর চোখে তাকালো । সরি! ফর হোয়াট ? আপনার টি-শার্ট টা নষ্ট হলো যে , চোখাচোখি হতে চোখ নামিয়ে নিল উজানী ।কি করে পড়লেন বলুন তো অন্যমনস্কতা না অনভ্যাস ? দুটোই । ইনজেকশন দেবো ভয় পান ? জানিনা উজানী চোখ বন্ধ করলো ।অগ্নির ঠোঁটে এক চিলতে দুষ্টু হাসি । আচ্ছা দেখতে তো পাবো । কয়েকটা ওষুধ আনার আছে । কাকু তো নেই এখন , আমি আছি এনে দেবো ।উজানী চোখ খুললো এক মুহুর্ত । অগ্নি উজ্জনীর জামার হাত টা একটু সরিয়ে দিলো ।অস্ফুটে শব্দ করলো উজানী । চেয়ার এর হাতল টা চেপে ধরলো শক্ত করে ।ওদিকে তাকিয়ে অগ্নি বললো দুদিন রেস্ট নেবেন । ওষুধ আমি এনে দিচ্ছি ।আমি বাইরে যাবো একটু কাজ আছে । কল্যাণী বললো তুমি কিছু খেয়ে যাও অগ্নি আমি লুচি করছি ,তোমায় গরম গরম ভেজে দি । অনেক করলে তুমি । কাকিমা এ আর এমন কি ! এইটুকু সবাই করে ।এ তো কর্তব্য ।আজ একটু বেরোনো আছে ।আমি অন্য একদিন নিশ্চয় খাবো ।তাহলে প্লিজ দুটো মিষ্টি অন্তত খাও ।প্রথম বার এলে এক মিনিট ওয়েট ,কল্যাণী রান্না ঘর থেকে সুন্দর দেখতে একটা কাঁচের ডিস এ একটা মিল্ক কেক্ আর একটু সীতাভোগ নিয়ে এলেন ।চামচ এ করে মিল্ককেক টা অগ্নি নিল । সীতাভোগ টাও খেলো, বললো কাকু কি অফিসে ? হ্যা রেল সার্ভিস করেন টিটি । জল খেয়ে উঠে পড়ল অগ্নি । আর চোখে দেখল উজানী বিশ্রাম নিচ্ছে । উজানী কিছুটা কনফিউজ ফিজ এর কথা তুলবে কিনা ! বললো আপনার ফিজ ? আরে কি বলছেন ! প্রতিবেশী এর কাছে ফিজ কিসের ।কোনো দিন না হয় ফুচকা খাইয়ে দেবেন! উঠি ।আমি আপনার ওষুধ দিয়ে যাবো । বেরোবো ।মিষ্টি করে হাসলো অগ্নি । কল্যাণীর মনে হলো স্বয়ং গৌরাঙ্গ বুঝি এই মাত্র ফিরে গেলেন মেঝেতে পায়ের ছাপ রেখে ! দেড় ঘণ্টা পর কলিং বেল বাজলো নীচে । উজানী তখন সদ্য চান করে শুয়ে ছিল ওপরে নিজের ঘরে । গান শুনছিল , হাতে মিতিনমসির রহস্য অভিযান । আজ কিছু ক্ষন আগে শোনা আওয়াজ টায় নীচে শুনতে পেলো । উঠলো না ।তার ঘুম ঘুম আসছিল । তার পর বাইকের স্টার্ট আর সেটা থামলো ঠিক তাদের বাড়ীর পিছন দিকের নতুন বাড়ীটাতে। কল্যাণী দিয়ে গেলো ওষুধ গুলো ।এই যে রাই ।বুঝে নে ।সব লেখা আছে । এখন একটা খাবার আছে ওঠ ।তুমি রাখো মা আমি খেয়ে নিচ্ছি । মা চলে গেলো উজানী প্যাকেট টা খুলল ওষুধ গুলো দেখলো এখন খাবার ওষুধ টা নিল।খেয়ে নিয়ে প্রেসক্রিপশন টা দেখলো । ডক্টর অগ্নিভ মুখার্জী । উজানী ইজেনকশন এর জায়গা টা হাত বোলালো । গান বাজছিল 'ছু কর মেরে মনকো .. কিয়া তুনে কেয়া ইশারা ...!' বাবা ফোন পেয়ে দ্রুত ফিরতে চায়লেন , কল্যাণী আশ্বস্ত করলেন ভাঙেনি ।ঠিক আছে এখন ।অগ্নি নিজে সব দেখেছে ওষুধ এনে দিয়েছে । বাবা মেয়ের কথা হলো ফোন । আজ তাড়াতাড়ী ফিরবেন জানালেন । সামান্য বকলেন দরকার নেই স্কুটি চালানোর । রিকশা নিবি কোথাও গেলে ; বিকালে বারান্দায় বসলো উজানী । উল্টোদিকের বারান্দা টা খালি । টবে টবে নানা ফুল ফুটেছে । একটা ইজি চেয়ার দেখা যাচ্ছে আর তার সাথে একটা ছোট টেবিল।টেবিল দুটো বই । পর্দা সরিয়ে দুম করে অগ্নিভ এর মা এই বয়সেও বেশ সুন্দর দেখতে । হাতে একটা ছোট বালতি ।কেমন আছো ? ভালো আছি মাসিমা । কি কথা বলবে আর উজানী বুঝতে পারছে না । মাসিমা দারুন ত ফুল হয়েছে । হুম ! আমাদের সবার সখ বিশেষ করে অগ্নির । ছাদেও আছে ।একদিন এসো না মাকে নিয়ে । মা কি করছে বলতে বলতে দড়িতে মেলে দিলেন কালো টি শার্ট , রুমাল আর একটা হালকা সবুজ রঙের তোয়ালে । ওহ ওই টি শার্ট । উজানী বললো মা নীচে , মাসিমা আসি পরে চা খাবো । ঠিক আছে এসো আর সাবধানে থেকো । উজানী ঘরে এসে চুপ করে দাঁড়ালো পর্দাটা টেনে । সামান্য ফাঁক করে দেখলো উনি চলে গেছেন কিনা ! গেলে হাঁফ ছাড়লো উজানী । কি কথা চালিয়ে যাবে বুঝতে পারছিল না । রাতে খেয়ে অনেক ক্ষন ঘুম আসছিল না কাঁচের জানালায় পর্দা টানা । উজানী বারান্দায় এলো , নীল রঙের নাইটি পরনে ।মৃদু। হাওয়া বইছে । অজস্র তারার কুচি আকাশ জুড়ে । কোথাও থেকে কুকুরের ডাক আসছে । চুলের ক্লিপ টা খুলে দিল উজানী । হাওয়া তে চুল অল্প অল্প নড়ছে । ওদিকের বারান্দায় অন্ধকার কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে একটা আলোর রেখা ভেসে আসছে , পর্দা হওয়ায় মাঝে মাঝে বেশ খানিকটা সরে গিয়ে উড়ছে আর তাতে দেখলো টেবিল ঝুঁকে চার্জার এর আলোতে বই পড়ছে অগ্নিভ । চকিতে একটা কথা মনে এলো সে কি বিবাহিত ? সারাদিন এই কথাটা মাথায় আসেনি , ওরা রিসেন্ট এসেছে এখানে । গৃহ প্রবেশ এ মা বাবা গেছিলো ওরা জানে । ভাবনা টা মনে আসতেই উজানীর আর ইচ্ছা করছিল না দাঁড়াতে । দরজা লক করে শুয়ে পড়লো ।উজানী চলে যাবার পর সেদিন ঐদিকের বারান্দাতেও কেউ এসেছিল । সিগারেটের ধোঁয়া, শহরের নিঝুম রাত , ট্রেন এর আওয়াজ আর ঝুল বারান্দায় একলা কেউ ! কিছু পরে ঐদিকের দরজাও লক হয়ে যায় ।
পর পর দুদিন ড্রেসিং করে দিয়ে গেছে ডক্টর অগ্নিভ , নাইটির নিচে টা হাঁটু পর্যন্ত তুলে দিলো অগ্নিভ, এই তো আসতে আসতে ঠিক হচ্ছে গরম জল দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলো উজানী যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো খামচে ধরলো অগ্নির কাঁধ । অগ্নি সেদিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি ধরে রেখে বললো রাত্রে ঘুমোচ্ছেন তো ? মানে? লেট নাইট শোন কেনো? অবশ্য বারান্দা থেকে রাতের শহর দেখতে সত্যি আলাদা এক অনুভূতি । হয়ে গেছে । এখন কিছুদিন স্কুটি চালাবেন না । উজানী একটু লজ্জা পেলো ; আসতে আসতে উজানীর ব্যথা ,আর ক্ষত ভালো হয়ে আসছিল ,সেও ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার নিজের কাজে । হাওড়ায় সে বি এড করবে ,বন্ধু দের সাথে কথা হয় ফোন মাঝে মাঝে । স্কুটির ঘটনার পর থেকে মাঝে মাঝেই খোঁজ নিচ্ছে ওরা ।মধু কলকাতায় ওদের বাড়ির নিচে একটা ঘরে নাচের স্কুল খুলেছে ।তার ওপেনিং ও হলো । পলাশী প্রাইমারি এর পরীক্ষার জন্য খুব খাটছে । শিরিন এর অনেক দিন ফোন পায়নি । ওকেও করা হয়নি ।মাঝে মাঝে এসএমএস করে । দুপুরে মেসেজ এলো ঢাকা থেকে । বাড়ীর লোক রাজী । আবার সে ইন্ডিয়া আসছে পাকাপাকি বাসিন্দা হতে । ফিরোজ ওদের ঐদিকে লাইব্রেরীয়ান এর জব পেয়েছে । বাহ! দারুন নিউজ ।সাথে সাথে ফোন করলো মধুজাকে । নাচের ক্লাস এ ছিল মধু । ফোন ধরলো সেও পেয়েছে মেসেজ । তো কি করবি যাবি ঢাকা ? ওর বিয়েতে ? কবে বিয়ে ? লেখেনি তো! উজানী বললো ।আরে কিছুদিন পর তো হবে ,তখন মধুজার গলায় খুশীর আমেজ । কি জানি রে এর মধ্যে হলে আমার বোধ হয় যাওয়া হবে না । বি এড এর ক্লাস থাকবে । ওতো এখানেই আসবে তখন সবাই মিলে গেলে কেমন হয় ফিরোজ দাদাদের বাড়ী । পলাশী যেতে পারবে না । হ্যা তাও ঠিক কিন্তু আমার ভীষণ ইচ্ছা জানিস একবার যাবো ।বাবাদের পূর্বপুরুষ রা ওখানেই থাকতো । যদিও ১৯৩০ তে এখানে চলে আসে । কিন্তু এখনও ওখানে ভিটে আছে জানিস । তাই ! তাহলে ঘুরেই আয়! নিজের ভিটে মাটি কে দেখে আয় । যদি শিরিন নেমতন্ন করে । তোরা বাঙাল জানতাম নাতো , শুটকি করলি নাতো সেবার ! উজানী হাসলো । হাহাহা মধু জোড় হাসলো তোরা ঘটিরা পারবিনা খেতে তাই মা করেনি । আমিও খাইনি কোনোদিন ।তবে শুটকি নাহোক মা কত কিছু করে খাওয়ালো বল । ঘটিরা কিন্তু এত প্রণালী জানে না । পোস্ত করে ভালো শুধু । বিশেষ করে বর্ধমান এর লোকরা ।ওরে বদমাশ আমাদের পুজোয় কত রান্না হয় জানিস উজানী হাসলো পাল্টা । দুই বন্ধুর মধুর কলহ চলতে লাগলো । দিন তিন পর ছিল উজানীর জন্মদিন । কল্যাণীর ইচ্ছা করলো এই উপলক্ষ্যে অগ্নি আর ওর মা বাবা কে নেমতন্ন করে । এটা যদিও কৃতজ্ঞতা থেকে কিন্তু তবু ভাবছিল ওনারা আবার কিছু অন্য রকম মনে করবেন কিনা তবু স্বামীর সাথে আলোচনা করে ইতস্তত করে বললো । দিদি রাই এর জন্মদিন পরশু ,আর অগ্নি তো কদিন রয়েছে আবার চলে যাবে আমার ভীষণ ইচ্ছা আপনাদের খেতে বলি , ও নিজের লোকের মতো উপকার করেছে । যদি সেদিন দুপুরে সবাই আসেন আমরা খুব আনন্দ পাবো ।আমার বড়ো মেয়েও আসবে । দাদা আপনি অগ্নি আর আমরা কজন ।সামান্য একটু ঘরোয়া আয়োজন । নিশ্চয় যাবো। ভালই তো সবার সাথে পরিচয় হবে । গাছে অজস্র পেয়ারা হয়েছে নষ্ট হয় পড়ে, পাড়ার একে ওকে কিছু দিয়ে পাঠালেন উজানী কে দিয়ে । অগ্নিদের বাড়িতে দরজা খুললেন অগ্নির মা ।মাসিমা মা এগুলো দিলো । এসো এসো । তুমি ভালো আছ রাই ?আপনি আমার নাম জানেন ? উজানীর প্রশ্নে হাসলেন অগ্নির মা ,তোমার মার কাছে শুনেছি ।এসো বসো ।একটু চা করি ।খাও তো? মাস্টার ডিগ্রী করলে এবার কি করবে ? জব এর পরীক্ষা দেবে ? বি এড করবো উজানী মৃদু হাসলো ।নেট স্লেট দেবে না ? দেখি যদি আগে যদি আগে কিছু পেয়ে যাই ! অগ্নি দা বৌদি কেউ নেই , মেসোমশাই?সতর্ক ভাবে জানতে চায়লো উজানী । মেসোমশাই একটু ব্যাংক এ গেছেন আর অগ্নিও বেরিয়েছে , অগ্নির বিয়ে হয়নি এখনও । এম ডি কমপ্লিট হয়ে গেছে । এমার্জেন্সি মেডিসিন । ও আচ্ছা ! কিছুটা যেনো স্বস্তির সুর উজানীর গলায় ।আমি কি আপনাদের গাছ গুলো দেখতে পারি । হ্যা হ্যা কেনো নয় যাও ।চা নিয়েই যাও তুমি চলো আমি যাচ্ছি হাতের কাজ টা সেরে ।ছাদ বাগান দেখাবো । ওপরে উঠে এলো উজানী , বাড়ীটা ছোট হলেও বেশ সুন্দর আর গোছানো ।ঝুল বারান্দায় নানারকম গাছ । ভারী সুন্দর লাগছে । বারান্দার একদিকে বইয়ের র্যাক। বই গুলো দেখলো উজানী । বেদ , উপনিষদ, মনুসংহিতা , গীতা , রামায়ণ ,মহাভারত , পুরোহিত দর্পণ থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণ , বিবেকানন্দ , রাশিয়া , মার্কস , লেনিন ভারতের স্বাধীনতা,নাইপাল , রুশদি, গোর্কী , জন রীডস কি নেই! বাপরে এত কালেকসন ।খুশী হলো দেখে । ওই ওর সখ ঘরেও তাই বই এর রাজত্ব । ডাক্তারি বই আর এসব ভালো ভালো সংগ্রহ । ওতো রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র ছিল । হুঁ সন্ন্যাসী ডাক্তার মনে মনে ভাবলো ,ছাদ বাগান দেখলো সত্যি তারিফ করার মত । ওখানে ঠাকুর ঘর । ছায়া ঘেরা জায়গা ।একটা দোলনা । বসার জায়গা । ঘুম এসে যাবে এত হাওয়া ।ঠাকুর ঘর দেখে মুগ্ধ ।সত্যি শান্তি যেন! তাদের গ্রামের বাড়ির ঠাকুর ঘরটাও এমন শান্তির জায়গা । দেওয়ালে আঁকা একটা ছবি বাঁধানো । অপূর্ব পাহাড়ী ছবি । কার আঁকা এটা? নাম লেখা আছে ছোট করে ।ওটা অগ্নির । বেশ ক বছর আগের । ও উনি আঁকেন ও আবার ! মনে মনে ভাবলো । আমি আসি মাসিমা । স্নান এ যাবো । বাড়ী ফিরে স্নান করে খেয়ে কিছু পেপার ফাইল এ ঠিক করে রাখলো । কাল একটু রাজবাড়ী যেতে হবে কাজ আছে । ওদিকের বাড়ী তে বাইক এর শব্দ থামলো ।উজানী ঘড়ি দেখল প্রায় তিনটে ।
পরদিন মোড়ের মাথায় দাড়িয়েছিল রিকশা নেবে । আরে আপনি ? কোথায় যাবেন? এখন পা ঠিক তো? অগ্নিভ মুখার্জী বাইক থামলো ।এই একটু রাজবাড়ী । উজানী সানগ্লাস টা খুলল কিছু কাজ আছে । ওহ চলুন পৌঁছে দি ।আমিও যাবো ওদিকে । অগ্নি রুমালে চশমা মুছলো । উজানী জানতে চায়লো কোথায় রাজবাড়ী? না ভারত সেবাশ্রম সংঘ , আর একটু বি সি রোড এ উদয়চাঁদ লাইব্রেরী । ওহ ! আপনি যান আমি রিকশা করে নেব ।দরকারি কাজ হয়তো আপনার । উজানী হাসলো । দরকারি ঠিক বাট হাতে সময় আছে অনেকটা ।পরশু আমি চলে যাবো ।চলুন ।কাজ মিটিয়ে উজানী বাইরে এলো । রোদ মুখে চোখে, ভাঙ্গা রাজবাড়ীর একাংশে বসে আছে অগ্নিভ ।ওদিকে ছায়া । অগ্নির হতে কোনো বই ! হয়ে গেলো? মুখ তুললো অগ্নি । উজানী এক ঝলক তাকিয়ে চোখ নামাল । রীতিমত সুপুরুষ অগ্নি আর হলুদ পাঞ্জাবী আর জিন্স এ খুবই ভালো লাগছে । হ্যাঁ মিটলো কাজ ,হাসলো উজানী । হাসলে গালে টোল পড়ে ওর ,হাসিটা দেখতে দেখতে অগ্নি পকেট থেকে সিগারেট বার করলো ।খেতে পারি? নীল ওড়না হাওয়ায় উড়ছে উজানীর। নীল গোলাপী কুর্তি ।ঢিলা ঢালা গোলাপী প্যান্ট ।এলো মেলো চুল টা ঠিক করতে করতে উজানী বললো ডক্টর রা অন্যদের জ্ঞান দিয়ে নিজেরা কিন্তু বেশী খান সিগারেট । আচ্ছা অগ্নির ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। কি বই পড়ছেন ? বইটা দেখলো উজানী , ও ভি এস নাইপাল এর 'এ ওয়ে ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড '! পড়েছেন জিজ্ঞেস করলো অগ্নি? নাহ সলমন রুশদির 'মিডনাইটস চিলড্রেন' পড়েছি ।ওহ !গুড !কিন্তু ওটা আমার পড়া নেই , এটা নিয়ে যান ।আমার পড়া শেষ ,পড়ে আমায় মতামত দেবেন । কিভাবে? আপনি তো চলে যাবেন আর আমিও । দেখা হবে তো ! অগ্নি ধোঁয়া ছাড়লো । আইস ক্রিম খাবেন ? দাদা এদিকে আসুন ।আইস ক্রিম ওয়ালা কে ডাকলো উজানী ।অগ্নি টাকা বার করতে গেলো উজানী হাত চেপে ধরলো প্লিজ আমি দি । ওকে নো প্রবলেম ! আপনার স্কুল কোথায় ? মিউনিসিপ্যাল গার্লস । আপনার ? বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন , দেন আর জি কর ! ওহ! আমার বর্ধমান উইমেন্স কলেজ ও বিশ্বভারতী । ইংলিশ । ছাত্র রাজনীতি করেননি ? অগ্নি প্রশ্ন করলো আবার ধোঁয়া ছেড়ে । আমি যা দল পছন্দ করি সেই দলের এখনও সংগঠন গড়ে ওঠেনি সেই ভাবে ,তাই করিনি , গড়ে উঠলে জানিনা হয়তো যেতেও পারি আবার না , কি মতাদর্শ মেনে চলেন জানতে পারি ? নিজের দেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতি আমায় টানে । বিশ্বাসী আমাদের দেশের মনীষীদের কাজে । যদি কোনো কিছু তে ভুল থাকে সেটা সংস্কার করে মানুষ মানুষ এর সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করুক ।দেশের উন্নতি করুক । নিজ ধর্মের সাথে অন্য সকল ধর্মকে সমান শ্রদ্ধা এই কাম্য । নিজ ধর্মকে অশ্রদ্ধা খিল্লি ওড়ানো আমি লাইক করিনা । তার চেয়ে নাস্তিক থাকো ।কোনো কিছুই টানবে না বাট করলে সবাইকে সমান । কাউকে শোষণ আর কাউকে তোষণ না । ধার্মিক হবার থেকেও নাস্তিক হতে বেশি পড়াশোনা করতে হয় । আর একটিই তো দেশ আমাদের ! অনেকের তো অনেক দেশ !এটা টুকরো হলে যাবো কোথায় ! কমিউনিজম ভালো যদি গণতন্ত্র তাকে মান্য দেয় । বিবেকানন্দ বলেছেন এ কথা ।চোখ তুলে তাকালো উজানী অগ্নির দিকে ।এবার চোখ সরাল অগ্নি । তোমাদের আসল বাড়ী গ্রামে? হ্যাঁ । এখনও আছে ওখানে পরিবারের লোক জন থাকে ।আমরা যাই । কনজারভেটিভ কিন্তু খুব । আচ্ছা ! কিছু ক্ষেত্রে কনজারভেটিভ ভালো কিছু ক্ষেত্রে আধুনিক অগ্নি নিশ্বাস ছাড়ল ! আপনার আসল বাড়ী? অনেক আগে আমাদেরও গ্রামে ছিল । তবে দাদু তার কিশোর বয়স থেকে এখানেই । উনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন । বাবা অঙ্কের প্রফেসর ছিলেন ,গ্রামে কালী পুজোটা আমাদের । পৈতৃক বাড়ী ,বাগান পুকুর আছে তবে জমি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে , কেনো কি দেখাশোনা কে করবে ! গ্রামে বাবার তুতো ভাই দাদা আছে ,কালী পুজোয় যাই ঘর দেখাশোনার জন্য লোক রাখা আছে এখন ,কোথায় যাবেন এখন ?অগ্নি জানতে চায়লো আমি বাড়ী ,আপনি? ঐ যে তখন বলেছিলাম , ওখানেই ; ওকে চলুন উঠি । উঠলো উজানী। রামপ্রসাদ এর লস্যি খাবেন? ওতে আমার আপত্তি নেই হাসলো উজানী। অর্ডার দিয়ে দাঁড়ালো দুজনে , হটাৎ পিছন থেকে উজানী.. ই .... ই.. তাকাতে দ্যাখে স্কুলের বন্ধু মৌপিয়া । উচ্ছস্বিত দুজনে । জড়িয়ে ধরলো একে অপরকে । কলেজের পর ওর বিয়ে হয়ে যায় । দুর্গাপুরে থাকে ।কবে এলি । এই দুদিন । দীপন দা কেমন আছেন? ভালো রে ।এই উত্তরা, মিলিতা, জিনাত এর কি খবর? আর রুমকি? দুই বন্ধু আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ।এই এক সেকেন্ড উজানী সামান্য চেঁচিয়ে বললো ,অগ্নি দা আরেকটা অর্ডার দিন । এই সরে আয় এদিকে ,মাঝ রাস্তায় বকছি দুজনে মৌপিয়া টানলো উজানী কে , কেরে ও উজানী ? প্রেমিক ?দূর ! কি যে বলিস পাশের বাড়ির । রাস্তায় দেখা হলো ,লস্যি খাওয়াচ্ছে । আচ্ছা বদমাশ আমায় তুই ফাঁকি দিবি । তোর অগ্নিদা অগ্নিদগ্ধ বুঝতে পারছি । মৌপিয়া চোখ নাচালো । এই তোর নাম্বার টা দে না । রাতে ফোন করবো । দুজনে দুজনের নাম্বার নিল । অগ্নি ওখান থেকেই চলে গেলো । এই যাহ বইটা নেওয়া হলো না ।
পরদিন দুপুরে খেতে এলো অগ্নি মা বাবা সহ । উজ্জয়িনী আর অরুনিম ও এসেছে ,কাল সকালে চলে যাবে অরুনিম। উজ্জয়িনী কদিন থাকবে । মৌপিয়াকেও বলেছে উজানী রাতে ফোনে। ওর এক বছর এর বাচ্চা কেও এনেছে । উজ্জয়িনীর বাচ্চার সাথে খেলার সঙ্গী হয়ে উঠলো । শুভ জন্মদিন রাই অগ্নির মা একটি প্যাকেট দিলেন । এতে একটা শাড়ী আছে ।তোমায় ভালো লাগবে পড়লে । প্রণাম করলো উজানী ।একটা পেস্তা রঙের শাড়ি পড়েছিল । খোলা চুল ,কালো টিপ আর খুব হালকা লিপস্টিক ।মিষ্টি লাগছিল ওকে । অগ্নি একটা গিফট দিলো সম্ভবত কোনো বই ।এটা তোমার রাই ,আমার তরফ থেকে । ট্রে তে মিষ্টি এনে সবাইকে দিলেন কল্যাণী ।গুছিয়ে যত্ন করে সবাইকে খাওয়ালেন ভাত , শাকভাজা ,পটল ভাজা , মুগডাল , বড়ি পোস্ত, ডাঁটার ঝাল , মটন , চাটনি, পাঁপড় ,পায়েস , কমলাভোগ শেষে আইস ক্রিম । রায় বাড়ীর আতিথেয়তা তে মুগ্ধ মুখার্জী পরিবার ।একটা অলস দুপুর আলাপে মুখর হলো; মৌপিয়ার ছেলে কে কোলে নিয়ে অগ্নিকে জিজ্ঞেস করলো উজানী আপনি কোন মতাদর্শে বিশ্বাসী বলেননি তো কাল আমায় ! বুকের দিকের কাপড়টা টেনে ধরেছে বাচ্চাটা । সেফটিপিন ছিঁড়ে কাপড় টা অনেকটা সরে গেছে বুক থেকে । উজানী দ্রুত সরাতে গেলো পারলো না ।চোখে মুখে অস্বস্তি আর লজ্জা ।অগ্নি ওর বুক থেকে চোখ সরাল ,আসছি বলে ভিতরে গেলো ,বাচ্চাটাকে ওর মার কাছে দিয়ে সামলে এলো উজানী । আমার টা এখন থাক! অন্য দিন বলব । আজ গম্ভীর আলোচনা স্টপ ।জন্মদিন সবার সাথে হৈ চৈ করো উজানী লক্ষ্য করলো অগ্নি আজ ওকে তুমি বললো । মৌপিয়াকে ছাড়লো না উজানী সন্ধ্যেয় ওরা একটু বাইরে গেলো । হোটেলে বিরিয়ানি খেতে খেতে অরুনিম জিজ্ঞেস করলো ,তার পর শ্যালিকা সাহেবা মনের খবর সব ভালো ? মানে? না মানে ডাক্তার বাবুকে ভালই লাগলো আলাপ করে অরুনিম চোখ মচকালো । ও জামাইবাবু আপনার সাথে আমি একমত মৌপিয়া ফোরণ কাটলো । মোটেও না তোরা যা ভাবছিস এক বিন্দু তা না !উজানী রাগ দেখালো অল্প , সেদিন লস্যি টা দারুন ছিল , দুষ্টু গলায় বললো মৌপিয়া ,চোখ পাকালো উজানী মৌপিয়ার দিকে , ভালো হচ্ছে না কিন্তু !উজ্জয়িনী বললো কি ব্যাপার রে আমায় বলতো মৌ । রাত অব্দি গল্প করলো রাই আর মৌ ।পুরোনো অনেক দিনের কথা । উল্টো দিকের বাড়ী টাতেও অনেক ক্ষন একজনের ঘুম আসছিল না । অস্থির লাগছিল । অনেকক্ষন সে বারান্দায় বসেছিল । সিগারেট ধরিয়ে । একসময় উঠে যায় ।তার অনেক কাজ আগামী দিনে ।
দিন চলে যেতে লাগলো নদীর মত , উজানী হাওড়ায় এখন । শিরিন এর বিয়ে ।উজানী আর পলাশী যেতে পারলো না । মন খারাপ লাগছিল ।মধু ওর বাবা মাকে নিয়ে বিয়েতে গেলো, উদ্দেশ্যে বিয়েতে দুদিন থেকে ওদের পুরোনো ভিটে দেখা ।মাঝে মাঝেই ফোন করেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি গেছিলো শিরিন কে সাথে নিয়ে ।বর্ণনা শুনে উজানী মনে মনে দেখছিল সেও যেনো ওদের সাথে ।ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসার জায়গায় ,ওই শুকনো পাতা ঝরার শব্দ এর সাথে, ওই লাল বিশাল বিল্ডিং এ সেও দাঁড়িয়ে ।পুরোনো ভিটে থেকেও ফোন করেছিলো ।দেশ ভাগের যন্ত্রনা কত মানুষের বুকে । বিয়ের দিন খুব মজা করেছে মধু ওদের সাথে ।ওর এই প্রথম কোনো মুসলিম বিয়ে দেখা । এক সপ্তাহ থেকে ফিরে আসে । খুব তাড়াতাড়ী শিরিন ও ফিরছে । প্রেসক্রিপশন থেকে ফোন নাম্বার টা সেভ করেছিল উজানী । ইতস্তত করে দুবার ফোন করেছিল কিন্তু অগ্নি বোধ হয় খুব ব্যস্ত । ফোন প্রথম বার তুলেছিল সামান্য কথা হয় ।জিজ্ঞেস করে নাইপল এর 'এ ওয়ে ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড' বই টা পড়ছে কিনা? বি এড এর আর কতদূর ? টুকটাক কথা । দ্বিতীয় বার তোলেনি । মেসেজ করে একটা উজানী ।দেখা করা যাবে কি? কোথায় আছে অগ্নি? বাট রিপ্লাই আসেনি ,তাতে উজানী একটু আহত হয় , অভিমানী ও ।সে আর ফোন করেনি । ওদিকে থেকে আর উত্তর আসেনা রোজ অপেক্ষা করে উজানী ।এর মধ্যে বাড়ী গিয়েও দেখতে পায়নি অগ্নিকে । উজানীর বিয়ের সম্বন্ধ আসছে এখান ওখান থেকে ।উজানী হ্যা না কিছু বলতে পারছে না ।বুকে কোথাও অভিমান একটু কষ্ট জমা ! বি এড এর পরীক্ষা শেষে একদিন বেলুড় গেলো উজানী ক্লাসমেট দের সাথে ,বিকাল বেলা তখন সূর্য অস্ত যাবে যাবে ওদের ইচ্ছা সন্ধ্যারতি দেখবে । হটাৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো উজানী । ওটা অগ্নি না ! দ্রুত এগিয়ে এলো সে। একটু শুনুন না । চিনতে তার ভুল হয়নি সেই!সাদা পোশাক । আপনি এখানে ? ওহ! রাই কেমন আছো? ভালো ।আপনি ?বিএড শেষ? হুম হলো । ওহ! এখানে আছি আমি । মানে ! অবাক হলো উজানী । অগ্নি দ্রুত চোখ বোলালো আসে পাশে পথ চলতি লোক । ঐদিকে কথা বলি রাই । গঙ্গার ঝিরঝির বাতাস বয়ছে। একটা গাছের নীচে দাঁড়ালো দুজনে, তফাৎ রেখে । গঙ্গার দিকে তাকিয়ে অগ্নি ,এই পথে ব্রতী হলাম আমি । নয় বছর ব্রহ্মচর্য পালন করে সন্যাস ! আর মাসীমা মেসো মশায়?
আপনার তো কিছু কর্তব্য আছে । একমাত্র সন্তান হয়ে এইভাবে দূরে যাওয়া এটা কি অবহেলা না? উজানী ব্যাকুল চোখ রাখলো অগ্নির চোখে ,তেমনই শান্ত স্বরে অগ্নি বললো ভক্তি,যোগ আর কর্ম এই তিনের মাধ্যমেই মুক্তি । যেদিন সব মানুষ এর মনের কোণে ঈশ্বর এর অবস্থান অনুভব করবে সেদিন তোমার বন্ধন মুক্ত । প্রত্যেকের উচিত তার উপযুক্ত পথে চলা। নয় বছরের এই ব্রহ্মচর্য জীবনে কঠিন অনুশীলনে নিজেকে উপযুক্ত ও শুদ্ধ করে তুলতে হবে ।কর্তব্যের কাছে তুচ্ছ এই পার্থিব মোহ ! ত্যাগ না করলে সেই কর্তব্যে ব্রতী হবো করে ? আমি মা বাবার ব্যবস্থা করেছি ।তুমি কষ্ট পেয়ো না একটু থামলো অগ্নি , তার পর বললো যা কিছু শারীরিক , বৌদ্ধিক আধ্যাত্মিক ভাবে দুর্বল করে তোলে তা বিষ ! বিষয় হলো সেই বিষ তবে সেই বিষয় কেও মহৎ ভাবে কাজে লাগানো যায়। আর ডাক্তারি ? ওটা তো থাকলো। এই কাজ করে আশ্রম বা মঠে অনেকের প্রাণ বাঁচাতে পারবো ।মহৎ পেশা ।সেবা করতে পারবো । আর বাড়ী ফিরবেন না ? উজানী অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলো । এক মুহুর্ত তার দিকে চেয়ে গঙ্গার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললো অগ্নি, আমি এখন ব্রহ্মচর্যে ,এখন যেতে পারি ,সন্ন্যাস নিলে আর রাত থাকতে পারবো না । সন্ন্যাস নিলে নিজের পিন্ড দান করতে হয় ।তখন পূর্বাশ্রম পূর্ব জন্মের মতো! সব ত্যাগ করতে হয় সংসারিক যা কিছু । এই পৈতে ও !পিতৃপুরুষ এর শ্রাদ্ধ করে পিতৃ ঋণ শোধ করেছি ! একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ? হ্যা বলো । আমায় কি কোনদিন ....একটু হলেও ...কথাটা শেষ করতে পারলো না উজানী দুচোখ এর জল গাল বেয়ে ! গম্ভীর অথচ ধীর গলায় বললো অগ্নি আমার যে মনে দুর্বলতা আসেনি তা না কিন্তু আমি সংযমে এসেছি । ।কখনো কোনো দরকার হলে বলো নিশ্চয় সাহায্য করবো। কিন্তু খোঁজ নিও না আর ।দুর্বল করে দিও না রাই ! যদি কিছু ভুল করে থাকি আমায় ক্ষমা করো। ঠিক আছে করবো না আর কিন্তু আমি মানতে পারলাম না মাসীমা আর মেসোমশাই এর জন্য খুব খুব কষ্ট হচ্ছে আমার । গলা জড়িয়ে এলো উজানীর !ওনাদের অনুমতি নিয়েছি রাই । আমি দেশের জন্য যদি যুদ্ধে যেতাম , মৃত্যু হতেও পারে এটা ভেবেই তো মা বাবা কে ছাড়তে হতো । ভাবো তেমন ! সন্ধ্যা নামছে ধীরে , বেশিক্ষণ তোমার সাথে কথা বলা যাবে না এখানে ।আসি আমি । তুমি কি আরতি দেখবে? হ্যা ! ভালো থেকো রাই ,পা বাড়ালো অগ্নি ,তাকিয়ে তাকিয়ে অগ্নির যাওয়া দেখলো উজানী । একে আটকায় কার সাধ্য ! সে যে অগ্নি ! তার কাছে যাওয়া বারণ ! পুড়তে হয় । পুড়েই আছি আমি তোমাতে , আর পুড়িও না মৃত্যুর পর ! আকাশ জুড়ে অবেলার মন খারাপ এর আলো । বহুদূর জল ! ওই দূরে স্টিমার একটা ...! ঝাঁক বেঁধে পাখি দের নীড়ে ফেরা ! বুকের ভিতর একটা ফেরী ঘাট থাকে, কেউ ফিরে আসে কেউ না ! কাঁধে হাত রাখলো কেউ ,উজানী .... ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল উজানী, কুসুমিতা! ওর রুম মেট । হ্যা চলো ।উনি কি তোমার চেনা ? হ্যাঁ । পাড়ার । হটাৎ দেখা হলো ।তাই কথা বলছিলাম । ও কুসুমিতা বললো । একটা ঢিল ছুড়লো উজানী । কিছু জিনিস এর তল বোঝা যায়না । শঙ্খ ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল মন্দিরে ।
আর ইচ্ছা করছিল না উজানীর ওখানে থাকতে ,সে চলে এলো পরদিন বর্ধমান ।এমনিতে পরীক্ষা শেষ । রাতে খেতে খেতে মা তুললো কথাটা জানিস রাই অগ্নি সন্যাসী হয়ে গেছে । কে অগ্নি ? উজানী বুঝেও না বোঝার ভান করলো । আরে পাশের বাড়ির। আহারে বছর পঁচিশ ছাব্বিশ বয়স !কল্যাণী এর গলায় সমবেদনার সুর । গ্রাম থেকে দুজন লোক থাকছে সর্বক্ষণের ; এখানে কোন স্বেচ্ছা সেবক দের সাথে যোগাযোগ করেছে তারাও নাকি আশ্রম এর । বয়স্ক কারো কিছু হলে দেখা শোনা করেন । হয়তো আরও কিছু করেছে ব্যবস্থা ! ওদের এই মনের অবস্থায় জিজ্ঞেস করা যায়না ।খুব মন খারাপ লাগছে রে! অগ্নির মা বলেছিলেন,কোনো আশ্রমে নাকি ওনারা মাঝে মাঝে গিয়ে থাকেন আবার এখানে আসেন ।এক মাত্র ছেলে , সে হলো সন্ন্যাসী ! পাশে তো! আমাদেরও দায়িত্ব আছে কিছু হলে ,দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন কল্যাণী ! ও !উজানী সংক্ষেপে উত্তর করলো ।খেতে ইচ্ছা করছিলো না ।রুটি নিয়ে নাড়াচারা করতে লাগলো । কিরে শরীর খারাপ । হুঁ আর ইচ্ছা করছে না অ্যাসিডিটি বোধহয় । ঘরে ফিরে আকুল হয়ে কেঁদে ফেললো উজানী ।বালিশে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে ।কল্যাণী থমকে গেলেন । কাঁদুক একটু । কিছুটা হালকা হোক । ঠিকই বুঝেছেন তিনি । মেয়ের ব্যর্থ প্রেমে মার দুচোখে জল এলো । তিনি সেই প্রথম দিনই দেখেছিলেন এ যেনো সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গ ! এ ছেলে যেনো সংসারে আবদ্ধ হতে আসেনি ! কখন যেনো নিঃশব্দে সমরেশ এসে দাঁড়িয়েছেন ,কল্যাণী খেয়াল করেনি । কি হয়েছে রাই এর ? কেউ কোনো খারাপ ব্যবহার ? নাহ ! ঘরে চলো ।পরদিন থেকে প্রায় একমাস লেগেছিল স্বাভাবিক হতে । কষ্ট টা এমন পর্যায়ে চলে গেছিলো সে মা বাবার সামনেই কেঁদে ফেলছিলো । সমরেশ আর কল্যাণী আগলে রাখছিলেন , বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল , তুই বললে আমি অরুনিম আর রাহী কে পাঠাবো কিন্তু ওর দিকটায় যে আলাদা সোনা । ও ফিরবে না ।আমি দোষারোপ করতেও পারছিনা কারণ তুই নিজে বলছিস সেই ভাবে কোনো সম্পর্ক হয়নি ।আমি বুঝি রাই ,তুই ওকে মন থেকে ভালবেসেছিস। ভালোবাসা তো কোনো অপরাধ না । তুই এমন করে না খেয়ে থাকলে আমরা কি করে খাই বল ! উজ্জয়িনীর কাছে শুনে অরুণিম বললো যাহ এমন হয়ে যাবে কেস টা ভাবিনি । সব মিল ছিল ।এখন কি করে ফেরাই ! ওর পথ যে আলাদা ।রাই এর প্রথম প্রেমের ফুল কুঁড়ি তেই ঝরে গেল! ইতিমধ্যে শিরিন এখানে এসেছে । সমরেশ এর এক কলিগ উজানীর বিয়ের একটা সম্বন্ধ দিলো । আসানসোল এ বাড়ী ।বিরাট ধনী ব্যবসায়ী চ্যাটার্জি পরিবার । উভয় পক্ষের অপছন্দের কিছু ছিল না । পালটি ঘর ।এক পক্ষ এর জমিদারি বংশ তো অপর পক্ষ উচ্চ অভিজাত ব্যবসায়ী পরিবার ।ফল স্বরূপ এক শুভ দিনে উজানী রায় আর ঈভান চ্যাটার্জী এর চার হাত এক হলো । এসেছিল মধুজা, পলাশী ,ফিরোজ কে নিয়ে শিরিন ও । এসেছিলেন অগ্নির মা বাবাও । হয়তো সে শুনেছে হয়তো বা না । পূর্ব জন্ম তাঁরা স্মরণ করেন না ।সুপুরুষ ঈভান এর পাশে উজানী কে রাজ - রাজেশ্বরী এর মত লাগছিল । গাড়ীর দরজা খুলে যখন বিশাল গেট এর সামনে দাঁড়ালো উজানী বিশাল চ্যাটার্জী পরিবার রাজকীয় অভ্যর্থনার সাথে তাকে ঘরে নিয়ে গেলো । ঋতু বদলাতে লাগলো । বহতা নদীর মতো এগিয়ে চললো জীবন ।
এ বাড়ীতে উজানীর বিশেষ কাজ থাকতো না । শুধু পরিবারের পুরুষ দের মন বুঝে চলতে হতো । এ বাড়ীর মেয়ে বৌরাও রাও ডিগ্রী গুলো আলমারি বন্দী করে রাখতো তাদের বাড়ীর মতো । বিউটি পার্লার , গয়না গড়ানো আর নিত্য পোষাক কেনা ছিল কাজ । এর ওর আড়ালে সমালোচনা ছিল ওদের অবসর এর কাজ । যেগুলো অবশ্য ওদের বাড়ী তে ছিল না ।বড়ো পরিবার তাদের ও কিন্তু মিল মিশ আছে । আর এখানে যেনো সব ফাঁকা মনে হতো উজানীর ।এদের দান ধ্যান এও যেনো অহংকার মিশে থাকতো ।কিন্তু তাদের কাছে ছিল উজানী অহঙ্কারী । সে ওদের সাথে তাল মেলায় না । উজানীর বড় জা কঙ্কনা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল এ বাড়ী তে সেই আগে সেই সব । এমনকি ঈভান এর ব্যাপারেও কঙ্কনার মতামত গ্রহণ হতো ।সে কি খাবে, সেকি পড়বে ! সে লেখে শুনে সবাই হেসেছিল ।আজকাল আবার কেউ বই পরে নাকি ! ওসব কাব্য চর্চার চেয়ে ব্যবসা বোঝা ভালো ।যেখানে টাকা আসবে ঘরে । শাশুড়ি তুলনা করতেন কোন বৌমা বেশি ভালো ! কার বাপের বাড়ীর জিনিস গুলো বেশি টাকার । শ্বশুর মশায় এর আরো দুটি ভাই ছিল ।তারাও তাদের পরিবার নিয়ে এখানেই থাকতো । তিন ভাই এর ব্যবসা ।কোটি টাকার লেনদেন চলত ।ঈভান এর দাদা বৌদি তাদের বাচ্ছা ছাড়াও ওই দুই কাকা-শ্বশুর এর ছেলে মেয়েরা ,এক পিসি শাশুড়ির ছেলেও ও কজন কাজের লোক ও ছিল এখানকার বাসিন্দা । বাড়ী তে নারায়ণ কুলদেবতা । বিশাল রান্না ঘর সেখানে সর্বদা দুটি লোক কাজ করতো । তারা ছুটিতে গেলে অন্য দুজন করতো ।বাড়ীর মেয়েরা পুরুষ দের পরিবেশন করতো ।সব দরকারে রেডি থাকতো এমন কি বিছানাতেও তাদের রেডি থাকতে হতো ।সারাদিন কাজের পর এইটুকু পুরুষরা না পেলে তো কিসের বৌ ! পুরুষ রা কম সময় পেতেন বউ নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাবার । তবে একেবারেই যে যেতেন না তা না ! ভারত এর ভালো ভালো জায়গা বা বিদেশের কিছু জায়গা তে যেতেন ।তাদের জন্য ক্লাব , পার্টি , ড্রিংকস এর ব্যবস্থা থাকতো ।হানিমুন এ উজানী ঈভান সিঙ্গাপুর ঘুরে এলো । শুধু সেই কটা দিন উজানী একটু মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল যদিও সেই মুক্তি অন্য কারো হাতে ছিল ।ওই বাড়ীতে তার মুক্তির স্বাদ ছিল বিশাল ছাদের একটু আকাশ । কঙ্কণা জিজ্ঞেস করেছিল কি এত ছাদে ভাবো পুরোনো প্রেমিক ট্রেমিক ? দেখো আবার আমার ভাই এর লাইফ নষ্ট করোনা । উজানীর রাগ চলে এসেছিল ।জা কে একটু হেসে শান্ত ভাবে জবাব দিয়েছিল ভাই এর বিয়েটা তাহলে নিজেদের ফ্যামিলি তে দিতে হতো দিদিভাই এত চিন্তা করতে হতনা তখন ।কারণ সে তোমার চেনা জানা হতো । তোমাদের বিয়েটা যখন মেনে নিয়েছে এরা আরেকটা ও মেনে নিত ! বিভান কঙ্কনার বিয়েটা ছিল অসবর্ণ। তুলকালাম করে জা ।কান্না কাটি । ওই মেয়ে কোনো সম্মান দেয়না তাকে ।রাতে ঈভান মারতে আসে তাকে ।বৌদির অপমান সে মানবে না ।দাদা বৌদি তার কাছে রাম সীতা ।সে যেনো সকালে ক্ষমা চায় বৌদির কাছে । উজানী কিছুতেই যায়নি । কঙ্কণা দাঁত চেপে বলে আমার পিছনে লাগতে এসো না উজানী কি করতে পারি তোমার জানা নেই ! অথচ উজানীর ভাসুর জা এর বিয়েতে প্রথমে বিশাল আপত্তি থাকলেও পরে চ্যাটার্জি ফ্যামিলি মেনে নেয় । ওই বাড়ীতে উজানী কে ভালোবাসতো সব থেকে তার ঠাকুমাশাশুড়ী ।দুজনে অনেক গল্প করতো পুরোনো দিনের । এছাড়া আরও দু একজন ছিল ওখানে যারা ওকে ওখানে পছন্দ করতো , এর মধ্যে মধুজা ফোন করে । সায়ন্তন সান্যাল এর সাথে এখন চুটিয়ে প্রেম চলছে ।খুব জলদি বিয়ের পিঁড়িতে বসছে তারা । বাহ ! গ্রেট কিভাবে আলাপ হলো তোদের? প্রব্লেম হয়নি? ওরা বামুন আর তোরা কায়স্থ ।নারে একদম হয়নি । আমার এক মাসীর বিয়ে হয়েছে ব্রাহ্মণ পরিবারে ।মাসীর ননদ এর ছেলে । এরা কিন্তু ঘটি । বাহ ! বাঙাল ঘটি জমবে ভালো !দারুন উজানী খুশী হয় মধুজার আনন্দে ।কি করে ? ও ইঞ্জিনিয়ার ।ব্যাঙ্গালোরে জব করে । মধুজা বলে । ও তুইও তাহলে ওখানে চলে যাবি। আর সেইভাবে দেখা হবে না ।যখন আসবি একবার করে বছরে দেখা করিস মধু । বিয়ের নিমন্ত্রন অনেক আগেই করে রেখেছিল মধুজা সে কথা চ্যাটার্জি ফ্যামিলিতে জানতেই শাশুড়ি বলেন বিয়ের পর আবার কেনো বাপু এত বন্ধু ! শ্বশুরবাড়ি তে কেউ বন্ধু নেই? জা বলে ওতো মেশে না মা কি করে হবে ! জমিদারি বাড়ীর নই তো আমরা !যদিও এখন তালপুকুরে ঘটি ডোবে না । আড়ালে আবডালে অকারণ চলত উজানীর কুৎসা । উজানী জেদ ধরে মনে মধুর বিয়েতে সে যাবেই । ঈভান আগ্রহ দেখায়নি ।মধুর বিয়ের আগে উজানী বর্ধমান চলে যায় আর সেখান থেকে সে পলাশী এর সাথে জোট হয়ে মধু দের বাড়ী। শিরিন আসতে পায় না । প্রেগন্যান্ট । কল্যাণী উজানীর যাওয়া নিয়ে অশনি সংকেত দ্যাখেন ।বারণ করেন ।উজানী মায়ের কথায় অত্যন্ত বিরক্ত হয় ।মা প্লিজ তুমি থামো ।দিনের পর দিন ওখানে বন্দী আমি ।মিথ্যা আভিজাত্য । একটু শ্বাস নিতে দাও একটা দিন অন্তত ! কল্যাণী আর কিছু বলেননি ।মেয়েরা বড় হয়েছে তাদের বুদ্ধি হয়েছে কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই কি থেকে কি হয় ! বিয়ের পর মধুজা চলে যায় ব্যাঙ্গালোরে । ইতিমধ্যে পলাশী প্রাইমারীতে চাকরি পেয়েছে বাড়ীর কাছা কাছি স্কুল এ ।কিন্তু সে বিয়ে করতে চাইনা । বাড়ীর লোক তাকে সম্মান করে সে এত পড়া শিখেছে । আসতে আসতে তার কথা মেনে নেয় । গড়িয়ে চলে জীবন ।গঙ্গার উপর দিয়ে বয়ে গেলো মরসুমি হাওয়া ।
ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনোর পর কেটে গেছে ১৫ টা বছর এর মধ্যে আর তারা একসাথে শান্তিনিকেতন যায়নি । আজ সেই দিন ওরা শুধু চারজন দেখা করবে । এখন নেট এর যুগ । সবাই ফেসবুক , হোয়াটসঅ্যাপ এ যোগাযোগ রাখে ।একে অপরের ছবি দ্যাখে। প্রায় প্ল্যান চলে দেখা করার কিন্তু কারো না কারো কিছু কাজ পড়ে । হয়তো আর তাগিদ নেই সেই ভাবে ।এত গুলো বছরে মন ও হয়তো চেঞ্জ হয়ে গেছে ।যেমন করে বদলে গেছে চারজনের জীবন । উজানী গণদেবতায় এলো ।মধুজা এলো বরাবর বাড়ীর গাড়ীতে । পলাশী ও এলো গাড়ী ভাড়া করে । শিরিন কাছাকাছি থাকে সে বাসেতে এলো । সবার আগে ঢুকেছে পলাশী ।ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা । উফ কতদিন পর ! এর পর ঢুকলো উজানী ,মধুজা ,শেষে শিরিন ! সোনাঝুরির নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেলো চারজনে । বহু দিন পর একে অপরকে দেখে জড়িয়ে ধরলো ।সবার মুখে খুশীর ঝলক ।শিরিন কে দেখে বললো উজানী এই যে ঘরের কাছে ট্রেন ফেল ! সব লাস্টে । শিরিন বললো সেই আমার মেয়ের পাঁচ বছর এর জন্মদিনে দেখা হয়েছিল আর আজ ।সেই আজ তেরো বছর এর হলো । উজানী বললো কত গুলো বছর কেটে গেলো রে ! কিভাবে দিন যায় ! পলাশী বললো কিন্তু একি আমি শুধু শাড়ী পড়ে !এটা কি হলো? শান্তিনিকেতন এলি আর তোরা তিনজন অন্য ড্রেস এ । পলাশী একটা হলুদ সবুজ শাড়ী পরেছিল ।সবুজ ব্লাউজ । সম্ভবত শাড়ী টা এখান থেকেই নেওয়া । একদিকে বিনুনী করা ।হালকা কাজল ,হালকা মেরুন লিপস্টিক ,ছোট লাল টিপ , চুড়ি,হার ,দুল ম্যাচ করা। ছিমছাম সাজ । সরু ব্যান্ডের ঘড়ি বা হাতে।সঙ্গে একদিন থাকার মতো একটা কালো ব্যাগ এক হাতে ।আরেকটা হাতে জলের ব্যাগ ।রোগা হয়ে গেছিস একটু উজানী বললো ।কবে মোটা ছিলাম রে ! হাসলো পলাশী । তুই কিন্তু আগের চেয়ে মোটা হয়েছিস আর আরো ফর্সা । ,আগে কত লম্বা চুল ছিল রে তোর । কেটে দিয়েছিস এখন অনেকটা,আজ শাড়ী পড়লি না? উজানী তার ছোট চুল সরাতে সরাতে বললো ভেবেছিলাম পড়বো ।বেরোতে যাবো আর হয়ে গেলো । দূর! এই সময় এইসব শাড়ী নিয়ে ঝামেলা লাগে । বিধাতা নিজের পুরুষ বলে সব সুবিধা তো তিনি পুরুষ দের দিয়ে রেখেছেন । তাই এই লং স্কার্ট টা পড়লাম কেনো রে বাজে লাগছে ?খুব মোটু হচ্ছি বল ? উজানী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো?একদম এই বাজে লাগেনি ।তুই যা পড়িস তাতেই ভালো লাগে । . একটু মোটা হয়ে গেলেও ওই মোটা তে তোকে বেশ মিষ্টি লাগছে । সো কিউট !মধুজা বলল। তোর নীল খুব পছন্দ তাইনা ? শিরিন বললো ,উজানী নীল স্কার্ট আর হলুদ কুর্তিপড়েছিল ।কালো ছোট টিপ , কাজল আর গোলাপী লিপস্টিক ।দুল পড়েনি লম্বা বড়ো বড় নীল পাথর এর একটা হার ড্রেস এর সাথে ম্যাচ করা । ডান হাতে ঘড়ি ।তার সাথেও একদিন থাকার মতো একটা নীল ব্যাগ । মধু তুই কিন্তু খুব রোগা হয়ে গেছিস ? মুখটা শুকনো লাগছে ।খুব পরিশ্রম করছিস? শিরিন বললো । মধু সানগ্লাস টা খুললো । চুলের ঘনত্ব টা কমে গেছে । চুল টা বড়ো ক্লিপ দিয়ে আটকানো । বাহারি দুল । ব্রাউন লিপস্টিক ।লাল রঙের টপ আর নীল জিন্স । বেশ সুন্দর দেখতে একটা ঘড়ি । পায়ে স্নিকার্স । স্মার্ট লাগলেও মুখে কেমন ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট ! মেরুন কালারের ব্যাগ তার হাতে । হুঁ রে খুব পরিশ্রম হচ্ছে । মধু বললো শিরিন তোর মেয়ে বায়না করেনি পলাশী জিজ্ঞেস করলো? নারে ওর দাদী আছে তো ! এসে বোর হতো আমাদের মাঝে । বিহু এলেও কথা ছিল ওড়না ঠিক করতে করতে শিরিন বললো । শিরিন এর সবুজ সালোয়ার ।সবুজ ওড়না সবুজ , চুড়ি ,দুল হার । ডিপ লাল লিপস্টিক । মেরুন বড়ো ব্যাগ তার হাতে । তুই তো পুরো সবুজকলি রে শিরিন , বেশ লাগছে সবুজে সবুজ তা লিপস্টিক সবুজ পেলি না উজানীর কথায় হাসলো সবাই । তুই কিন্তু মোটামুটি একই আছিস খুব সামান্য মোটা হয়েছিস । রহস্য টা কি? পলাশী বললো । শিরিন চোখ নাচায় বলা যাবে না দারুন সিক্রেট !
শীত এর শেষ একদম , বসন্ত ঢুকছে ঠান্ডা টা আর তেমন নেই বললেই চলে ,গাছে গাছে অজস্র ফুল এর সম্ভার ! মধু ওর ড্রাইভার কে খেতে ডাকলো । লাগোয়া অনেক ছিমছাম সুন্দর রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে ।বাঁশের কারুকাজ করা এমনএক রেস্টুরেন্টে বসলো চারজনে । পরোটা , আলুরদম, মিষ্টি অর্ডার দিল । সাথে বাদাম এর সরবত । ভীষণ ভালো লাগছিল ওদের চারজনের, বাতাস এসে লাগছিল শরীরে ।যেনো ক্লান্তির অবসান ! এবার কি করবি ? উজানী জানতে চায়লো, চল একটু বসি সোনঝুড়ির ওখানে ছায়া দেখে । গল্প করি তার পর না হয় গাড়ীতে করে ঘুরবো । মধুজা বললো এই এখানে হাটে কিছু নিবি না? পলাশী জিজ্ঞেস করলো হ্যা কিন্তু এখন না ,আজ তো থাকছি ,বিকালে । শিরিন বললো ।মধু গাড়ী থেকে দুটো শতরঞ্জি বার করলো । ছায়া দেখে একটু নিরিবিলিতে বসলো ওরা শতরঞ্জি পেড়ে । মধু বললো আমি একটু শুই ।ব্যাগ থেকে একটা ফোলানো বালিশ বার করলো । কেউ ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে দে । আরে বাপরে দারুন ব্যবস্থা রে । এই মধু কি হয়েছে ? আর ইউ ওকে ? উজানী জিজ্ঞেস করলো ? ডোন্ট ওরি বেবী ! আই অ্যাম ফাইন ।মধু ওর হতে হাত রাখলো ।এমনি শুতে মন চাইছে । ওকে তুই শো ।হাটে এদিক ওদিক লোক আসছে । বিকিকিনির নানান পসরা । তোদের জন্য গিফট গুলো বার করি । মধু তিনজন কে তিন রকম দৃশ্যের ফটো বাঁধানো দিলো ।ওরা চার জনেই আছে । পলাশী এটা তোদের বাড়িতে তোলা সেই বাহা উৎসবে । সবাই দেখলো চারজনে নাচের সময় তুলেছিল সেই ছবি ।দারুন রে সবাই একসাথে প্রায় বললো । শিরিন এটা এখানে বসন্ত উৎসবে তোলা দ্যাখ । তোর বিয়েতে ওরা যায়নি ,আমি একা ছিলাম তাই চার জনকে একসাথে বাছতে তোর জন্য এটা ।সবাই দেখলো রঙ মাখা শাড়ী পরা ছবি। বিউটিফুল ! প্রত্যেকে এর মুখে একই বার্তা । উজানী এটা তোর জন্য তোদের গ্রামের বাড়ীতে সেই মাঠের ধারে সবুজ প্রকৃতি । ওমা ! সেই ছবিটা !মনে আছে এটা দিদি তুলেছিল । অপূর্ব । তোর বিয়ের দিনেও আমাদের একসাথে ছবি আছে বাট ওটা হয়তো তোর ....! মধুজা কথা শেষ করলো না । হুঁ এটাই ঠিক আছে ।অনেক অনেক থ্যাংকস তোকে ,সুন্দর মুহুর্ত গুলো মনে করিয়ে ফিরিয়ে দিলি । আর নিজের জন্য কোন ছবিটা রেখেছিস শিরিন জিজ্ঞেস করলো । উজানী বললো আমি বুঝেছি নিশ্চয় কলকাতা ঘোরার কোনো মুহুর্ত নিয়েছিস ! ইয়েস ডার্লিং! ইউ আর মাই ইন্টেলিজেন্ট ফ্রেন্ড । মধুজা উজানীর গাল টিপে দিল ।শেষ ছবিটা বার করলো মধুজা সবাই দেখলো সূর্যাস্তের সময় নেওয়া ওদের চারজনের সেই ছবিটা । ওর বাবা তুলেছিলেন মধুর অনুরোধে । অপূর্ব সুন্দর! শেষ বিকালের আলো মাখা, কিন্তু কি যেনো এক বিষণ্ণতা মেশানো । মন খারাপ হয়ে যায় !
পলাশী সবার জন্য পুরুলিয়ার আদিবাসী দের বানানো মুখোশ নিয়ে এসেছে । চারটে চার রকম ।মধুজা নিল ছৌ মুখোশ , পলাশী বাছলো আদিবাসী মহিলা ও পুরুষ নাচছে ওটা , উজানী দুর্গার এক রূপ বনদেবী, আর শিরিন কথাকলি । উজানী দিলো ওর লেখা নতুন বই ' বসন্তের বৃষ্টি ' আর শিরিন ওদের জন্য এনেছে শান্তিনিকেতনী গয়না । হার আর দুল । ভারী সুন্দর দেখতে ! চমৎকার হয়েছে সব গুলো যে যা এনেছিস । মধুজা বললো উজানী বললো একটু টয়লেট যাবো ।যাবি কেউ ? শিরিন বললো চল আমি যাবো ।ওরা চলে গেলে মধু বললো তারপর পলাশী পুরুলিয়ার কি খবর ? পলাশী হাসলো দেখতে যাবি চল , অযোধ্যা , লহরিয়া, গড়পঞ্চকোট ,এখন ওখানে সব বিদ্যুৎ , বেড়াতে গিয়ে সুলভ শৌচালয় ! আমাদের ওখানেও বিদ্যুৎ চলে এসেছে । পিপিএসপি গড়ে ওঠার ফলে ।কিন্তু কি জানিস বনভূমি ধংস করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠার ফলে বৃষ্টি কমে গেছে তাই খুব গরম । আগে ওখানে মেঘ এসে ধাক্কা খেতো । বৃষ্টি হতো ।এখন মেঘ উড়ে যায় অন্য প্রদেশে । পুরুল্যা মায়ের ' লেলহা ছেল্যে হয়েই থাক্যে যায়!' মধু বললো সেই রে! প্রকৃতি কে ধংস করলে একদিন তার ফল পাওয়া যাবেই কিন্তু ওই এলাকায় আর কিভাবে করা যেত ! টুকটাক কথার মাঝে ওরা ফিরলো । উজানী বসতে বসতে বললো তোদের ওখানকার এলাকা গুলো তো এখন তৃণমূল এর আন্ডারে তাইনা ? হ্যা বলে পলাশী ,মধুজা মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, বাথরুম ওকে? হুঁ ভালই । আজ লাঞ্চ এখানেই করবো ভাবছি ।উজানী মধুর পাশে শুলো ।তোদের কি হয়েছে বলতো এসে কোথায় ঘুরবি তা না শুয়ে কাটাবি নাকি ? শিরিন দু পা ছড়ালো । উজানী বললো একটু শুই ,কোমরে একটু লাগছে । মধু উজানীর চুলে হাত বোলালো উজানী অগ্নির সাথে আর দেখা হয়েছিল ?সেই বছর চার আগে ।আমি যেদিন দীক্ষা নিতে যাই । এখন তো আর অগ্নি নেই ,স্বামী ঋদ্ধানন্দ ।পূর্ণ সন্যাসী । পূর্ব পুরুষ এর শ্রাদ্ধ করে গেছে। বিরজা হোম করে নিজের নামে পিন্ড দিয়েছে ।সন্যাসী হয়ে গেলে আর করতে পারে না বাবা মার কাজ ,সে একমাত্র সন্তান হলেও , বাড়ী এলেও রাত থাকেন না ওনারা !ওর গুরুজীর কাছেই আমি দীক্ষা নিয়েছি । সবার সাথে ওকেও প্রণাম করি । বললো সৌভাগ্যবতী ভব! কিছু মনে হয়নি ওর মুখ দেখে ? পলাশী বলে , নাহ ! ভীষন ব্যক্তিত্ব, শান্ত , ধীর , মুন্ডিত মস্তক ।মুখে হালকা স্মিত হাসি। শ্রদ্ধা আসে দেখে ! ওর বাবা মা ?মধুজা ফের বললো ,উজানী উত্তর দিলো আছেন এখনও এখানে ।বেশির ভাগ সময় কোনো এক অনাথ আশ্রমে ওখান কার কাজ দেখা শোনা করেন । ছেলের আশ্রমেও যান , আশ্রম এর কাজে এবার আমিও যুক্ত হচ্ছি রে ! নেক্সট টাইম আমিও যাবো ।আবার মাঝে মাঝে বৃদ্ধাশ্রমে সম বয়সী লোকদের সাথে কাটিয়ে আসেন কিছুদিন । মাঝে মাঝে বেড়াতেও যান ।তবে সেটা কম ।বয়স হচ্ছে তো ! এখানে থাকলে আমরা খোঁজ নি ! তুই আরেকবার নতুন জীবন এর চেষ্টা করলিনা কেনো? পলাশী বললো ।হাসলো উজানী আবার ! একটা থেকে কোনরকমে বেড়িয়েছি !এই বেশ আছি ! যা বুঝেছি একা থাকার কোনো বিকল্প নেই । তোকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না কোনো বাড়ী তে যে এই বুঝি কোনো ভুল হলো! না জানি কত কথা শুনতে হবে নিজের পরিবার নিয়ে , তোর যখন মন হবে রান্না করলি কি কোনোদিন করলিই না , সবার কাজ করে দিতে দিতে নিজের ইচ্ছে গুলো চাপা পড়ে যায়! মা বাবা প্রচুর খরচা করে অন্যের বাড়ী তে অকারণ গাল খাওয়াতে পাঠায় । যে বাবা হয়তো তোর গায়ে কোনোদিন হাত তোলেনি কিন্তু অন্যের ছেলে কি তার পরিবার তোকে প্রহার করার সুযোগ পায় । ওরা বোঝে কেনো উজানী বলছে এগুলো ,তার নিজের বিয়ের অভিজ্ঞতা থেকে । ঈভানের সাথে তার বিয়ে টা সুখের হয়নি । শেষ অব্দি ডিভোর্স এ পৌঁছোয় । অনেক কষ্ট পেয়েছে সেই সময় ও । বাড়ীর লোক ও ভুল বুঝত ।মানিয়ে নিয়ে চলতে হয় এ কথায় বোঝাত । শেষ অব্দি মেয়েটা বেরোতে পেরেছে । উজানী দীর্ঘশ্বাস ফেললো কোনোদিন বুঝলাম না সে আমার না বৌদির ।এমন না যে বৌদির সাথে ওর কিছু আছে , বাট অন্ধ ভক্ত । হয়তো এখনো আছে হয়তো বা নেই ।দেখেছিস নাকি রিসেন্ট? ওই ফেসবুক এ দেখেছি ।নতুন বিয়ে করে বাচ্ছা নিয়ে কভার পিক । ব্লক করে রেখেছি । ছেলে না মেয়ে শিরিন জিজ্ঞেস করলো? ছেলে ।শিশু দের তো বোঝা যায়না ।নাম দেখলাম রেখেছে অর্চিষ্মান । জানিস এই নাম টা একবার আমি বলেছিলাম ওকে । ছেলে হলে এটা আর মেয়ে হলে অর্চিষ্মতী । ব্যাটা ঠিক মনে রেখে আমার নাম টা নিয়ে নিল ।ওর কথা শুনে হাসলো সবাই । আবার বললো উজানী জায়ের ফেস বুক আইডিও দেখেছি আগের মন্ডল টাইটেল এ ।কে জানে কি ব্যাপার ! আগে তো কঙ্কণা চ্যাটার্জি থাকতো, ফ্রেন্ড লিস্ট এ চ্যাটার্জি পরিবারের কাউকে পায়নি । মা মেয়ের তো গুণের ঘাটতি নেই । তীব্র অহংকার ! যাক সবাই ভালো থাকুক ।মধুজা বললো তুই চলে এলি লাভ কিন্তু জাএর হলো, ঈভান ঠিক থাকলে ওই জা এর ব্যবহার তুচ্ছ আমার কাছে ।কিন্তু ঈভান আমার না বোধহয় ! আর ওরা তাদের কৃতকর্মের ফল পাবে একদিন !কষ্ট হয়নি ?একেবারে হয়নি বলবনা একটু মন খারাপ লাগতো ।কি হবে আর ! চ্যাপ্টার ক্লোজড ! আমি তো সংসার করতে চেয়েছিলাম কপালে নেই ! অগ্নিকে ভোলা সম্ভব ছিল না কিন্তু সে হৃদয় এর এক কোণে নির্জনে থাকতো ,ঈভান এর সাথে সংসারে তার আঁচ ফেলতাম না কিন্তু সে বুঝল না ।অনেক কষ্ট দিয়েছে ! !একবার পিঠে এত মেরেছিল পিঠ জ্বলে উঠেছিল ! সেটা কেউ দোষ ধরেনি কিন্তু ডিভোর্স নিতে চেয়েছিলাম বলে আমাকে উল্টে সবাই দোষারোপ করেছিল । সম্মানে লেগেছিল রায় আর চ্যাটার্জি বাড়ীতে । চোখের কোনে জল এলো উজানীর ।থাক মনে করিস না সেসব কথা পলাশী ওর হাত ধরলো ! অথচ ওই বাড়ীতেও সবাই উচ্চ শিক্ষিত । আসল শিক্ষা নেই আর কি ! মধু বললো ।থাক ছাড় ওদের কথা একটা সত্যি বলবি ? কি ? উজানী পাল্টা জিজ্ঞেস করলো? অগ্নির দিকে তোর আকর্ষণ মানসিক না কিছু শারীরিক ও ছিল । আরে না আমাদের সেই সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি ।কিন্তু মনের ভিতর এক রকমের ভালোলাগা আর তা থেকে ভালোবাসা জন্ম নিচ্ছিল তার আগেই তো! ওর দিকেও ছিল হয়তো কিন্তু সে নিজেকে ...! উজানী একটু থামলো ,পেতে ইচ্ছা করতো না ? শারীরিক ভাবে ?মধুজা বলে, সেই সময় মন ইনোসেন্ট ছিল ওই নিয়ে ওতো ভাবতাম না ,জানি পাপ আমার এটা কিন্তু লুকোবো না ওর ঐ সন্ন্যাস রূপ এও ভীষন ইচ্ছে করতো কাছে পেতে । হুঁ শারীরিক মানসিক দুই ভাবেই! ভিতরে অস্থির হতাম । পরে নিজেকে অনেক কন্ট্রোল করি ।নিজের সাথে যুদ্ধ ছিল!কাছে বসলে যেন মানসিক শান্তি মেলে ।মনের বাসনা দূর হয়ে যায় ।এক অন্য অনুভূতি! কথা শুনতে ভীষণ ইচ্ছা হয় । অগ্নির জন্য ভালোবাসা আর ঋদ্ধানন্দ এর জন্য শ্রদ্ধা মিলিয়ে দুই রূপ এই আমার হৃদয়ে !এক মুহুর্ত চুপ করলো উজানী ।
তার পর বললো আমায় বলছিস তুই নিজে আর সংসার করলি না কেনো মধু?সায়ন্তন দার চলে যাবার পর ।মেয়েটার জন্য তো করতে পারতিস ।বাবা পেতো । মধুজা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সবাই কি বাবা হতে পারে রে? হয়তো হয় অনেকে কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম যদি সে আমার বিহু কে মেনে না নেয় ।যদি তার নতুন সংসার করতে গিয়ে বিহু কে অবহেলা করি !বিহু তার উপরে মা আর শাশুড়ি মা দুজনের দায়িত্ব । ছেলে চলে যাবার পর বিহু কে নিয়েই তো বেঁচে আছেন আমার শাশুড়ি মা । সায়ন্তন এর চলে যাবার পর আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম কিভাবে কি করবো ।ওর ফ্যামিলি আমার শাশুড়ি মা,আমার মা বাবা খুব পাশে থেকেছিলেন সেই সময় । সায়ন্তন ও চলে গেলো, বাবাও চলে গেলো , শ্বশুর মশায় তো আগেই ;সব দায়িত্ব আমার উপড়ে চাপিয়ে তিনজন দিব্যি চলে গেলো আকাশের তারা হতে । বাবা আর শ্বশুর এর পেনশন টা পায় মা আর শাশুড়ি মা । সায়ন্তন এর অ্যাকসিডেন্ট এর টাকা টা শেষ অব্দি পেয়েছি । আর এই নাচের স্কুল । চলে যাচ্ছে ।বিহু টা ঠিক করে মানুষ হোক ,জব করুক এই ইচ্ছা আমার । সংসারে যা অভিজ্ঞতা হলো আমি এখন ওকে পড়াশোনাটা ভালো করে করতে বলি যদি ভবিষ্যতে কিছু সরকারি জব পায় । তবে সায়ন্তন এর ফ্যামিলি হেল্প করে আমায় বিপদে আপদে । আমি চলে যাবার আগে গাড়ী টা বিক্রী করে দিয়ে যাব ।কে ওটার খরচ বহন করবে । অ্যাড দিয়েছি যদি কেউ কেনে ! আর সরকারি চাকরি ! রাজ্যে আর টাকা নেই! বৃথা আশা! উজানী বললো , আর তুই চলে যাবি মানে? কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে চলে যাবি ? না অন্য কোথাও কিছু জব পেলি? উজানী র কথায় হাসলো মধুজা ।আমি কোথায় যাবো বলবো পরে। হাসিটা খুব শীর্ণ লাগলো ওদের !
শিরিন বললো পলাশী চুপ করে আছিস যে ।বিরাজ ভাইয়া কে মনে পড়ছে বুঝি ওদের এসব শুনে । সত্যি ওর খোঁজ আর মেলেনি ? হাসলো একটু নারে ! যেটা তোদের বলিনি বিরাজ দা সম্ভবত মাওবাদী দের সাথে যুক্ত হয়েছিল । শহরে পড়তে গিয়ে , ওহহ! তিনজনেই বললো । উজানী বললো আমি এটা ভেবেছিলাম কিন্তু তুই হয়তো সেই সময় মাইন্ড করবি বলিনি কিছু । আসলে অর্থনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে এদের এইভাবে গড়ে তোলা হয়েছে । দুর্ভাগ্য বিরাজ দাও জড়িয়ে গেছিলো । হুম পলাশী বললো , পুলিশ এসেছিল সার্চ করতে ।আমাকেও অনেক জিজ্ঞেস করেছিল ওর সম্পর্কে । আমার দু একটা বই ছিল ওর কাছে ।গল্পের আর কি ! মলাটে আমার নাম দেখে ভেবেছিল কিছু ।কিন্তু আমি তো সত্যি জানতাম নারে বিরাজ দা কি করতো ,পুলিশ সত্যি টা বুঝে আমায় আর কিছু বলেনি । জানিনা বিরাজ দা আদৌ বেঁচে আছে কিনা, বা কোথায় আছে ! মধুজা বললো আর তুই তাই আজও ওর অপেক্ষায় বসে আছিস ফিরবে বলে ,বিয়ে করলিনা ।পলাশী বললো এই তো বেশ আছি শিশুদের নিয়ে সময় কেটে যায় । তাদের পড়ায় ।আঁকা শেখায় । মুখোশ বানায় । উৎসবে অংশ নি , তবে বিরাজ দাকে খুব মনে করি ।বিরাজ সরেন না থাকল আজ পলাশী হেমব্রম দাঁড়াতে পারতো না । অনুপ্রেরণা সে আমার ।উজানী বলে দ্যাখ নকশাল দের আমি খুব শ্রদ্ধা করি ।খুব হিম্মতবাজ ছিল কিন্তু এই মাওবাদীরা কি চায় বোধগম্য হয়না । তোকে আর বুঝতে হবে না । মধু বলে ,রাজনীতি আলোচনা বন্ধ ।উজানী বলে আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নারে ।সংসারে ও রাজনীতি চলে । ব্যাগ থেকে সিগারেট বার করলো উজানী । খেতে পারি? এটা আবার কবে থেকে ধরলি ? মধু চোখ কোঁচকালো, অগ্নি ধরিয়ে দিয়ে নিজে ছেড়ে দিয়েছে ।উজানী দুষ্টু হাসি হাসলো । আচ্ছা ওই দূরে খেয়ে আয় । আমার অসুবিধা । মধু বললো ।তুই বলছিস !উজানী অবাক হলো একটু , দলে তো তুই এই একটু আধটু সুখটান দিতিস রে । তোর ই ছিল ড্রিংক এর অভিজ্ঞতা । ওসব এখন অতীত । পুরোটাই পাঁচ তলা মল । হাসলো সবাই । ওকে ওকে ! লাঞ্চ করে খাবো ।আমি চেন স্মোকার নই ! এই আর কিছু পরে লাঞ্চ করে নেবো দেন একটু ঘুরবো । মধু বললো । কি রে শিরিন তোর কি খবর ? ফিরোজ দার আদরে তো দিব্যি সুন্দরী রয়েছিস । এনি গুড নিউজ ? নারে শিরিন হাসলো । আমার মোটামুটি সব ঠিক এই শ্বশুরবাড়িতে । শাশুড়ী একটু পুরোনো পন্থী হলেও মানুষ ভালো । কিন্তু ওই ইচ্ছে করলে ঢাকা যেতে পারিনা । কলকাতা থেকে কাছেই তো রে উজানী বললো ।বরং কলকাতা থেকে কিছু জেলা বেশ দুর ।যেতে সময় লাগে । ফ্লাইট এর তো একটা খরচা থাকে,বার বার গেলে , তাই ওই একবার বছরে ।তখন এক মাস থাকি ।এই এখন তো বাস যাচ্ছে রে ।ওতে যাবি তেমন হলে মধু বললো হুঁ কিন্তু ঐযে বাস জার্নি কষ্টের । সে যাক কি জানি আবার এদেশে থাকতে পারবো কিনা ! শিরিন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ,কেনো ? উজানী বলে ,ওহ ওই এন আর সির ভয় ? দূর ! আর তোর তো ১৪ বছর হয়ে গেছে রে ভয় এর কি।তোর তো সব বৈধ কাগজ ।দ্যাখ এভাবে কি দেশ চলে ! সব উন্নত দেশে নাগরিক পঞ্জি আছে ।এটা তো দরকার তাই না! যে যা পারছে ঢুকে দেশের বিরুদ্ধে খারাপ কাজে লিপ্ত হচ্ছে এটাও তো বন্ধ করতে হবে । যে কোনো সরকারের যে কোনো বিল আনার সময় তাদের বিরোধী দের সামলাতে সময় চলে যায়, ততদিনে আসে নতুন সরকার ।হাসলো উজানী । বিল চালু তে ত্রুটি গুলো যেনো শুধরে লাগু করে এটায় কাম্য নাহলে অনেকে অকারণ ঝামেলায় পড়বে বাট .... আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল উজানী ,মধু থামলো নো রাজনীতি টপিক । আরে তবে কি শুধু শাড়ী আর শাশুড়ী ?দূর !বন্ধু দের সাথে যদি দেশ , ধর্ম ,কর্ম ,রাজনীতি , সাহিত্য , বিজ্ঞান,ইতিহাস অর্থনীতি, কমিউনিজম ,সিনেমা খেলা ,প্রেম ,প্রাক্তন ,নতুন এসব নিয়ে আলোচনা করলাম তো কিসের বন্ধুত্ব ।আরে কাউকে তো শুনতে হবে ! কি ছেলে মেয়ে সমান সমান বলিস রে ?ওদের আলোচ্য বিষয় আর মেয়েদের গুলো আলাদা হয় দেখবি ।মেয়েগুলো সাজ আর শ্বশুর বাড়ী আর না হয় পাড়ার এর ওর কথা ।তুলনায় ছেলেরা বেটার । ব্যবসা , রাজনীতি দেশ প্রেম ।সাজ পোশাকে পড়ে থাকে না । উজানী একটু উত্তেজিত , আরে বাস বাস তুই নেক্সট টাইম প্রার্থী হো তো ।তোকে ভোট দেবো । রাজনীতিতে কিছু ভালো লোকের দরকার মধু হাসলো তার পর বললো উদাসী গলায় আরে তা না ,আজ শুধু নিজেদের গল্প !
টুকটাক কথায় বেলা গড়াতে লাগলো ।দুপুরে এখানেই লাঞ্চ করলো ! ভাত , ডাল ,বেগুন ভাজা ,পেঁয়াজ পোস্ত, পার্শে মাছের ঝাল ,চাটনি , দই ! খাওয়া শেষে মধুজা কিছু ওষুধ বার করে খেলো ।উজানী বললো কিসের ওষুধ রে ।এই সব নানা টুকটাক আর কি ! তারপর ওরা তিনজন যে যার বাড়ীতে খোঁজ নিল ফোনে ,সেই পৌঁছে ফোন করেছিল সব ,আর করেনি ,ওদের কথা বলার ফাঁকে উজানী একটা সিগারেট খেয়ে নিল একটু সরে গিয়ে ,মিনিট পনেরো বসে ওরা , গেলো আম্র কুঞ্জ, পাঠ ভবন , কলা ভবন ,বিশ্বভারতী , বাংলাদেশ ভবন । পুরোনো স্মৃতি তে ভারাক্রান্ত মন । একদিন আমরা কেউ থাকবো না শুধু স্মৃতি টুকু ছাড়া ...! কোপাই নদী র ধারে গেলো তখন প্রায় সূর্য অস্ত যাবে যাবে করছে ,বসলো চারজনে । তুই বলতিস উজানী সূর্য অস্ত যাবার সময় মানুষ কেমন অন্য রকম হয়ে যায় ।মায়া লাগে পৃথিবী কে তার ।চেষ্টা করেও মিথ্যা বলতে পারে না । আজ তোদের কে আমার কিছু বলার আছে । যার জন্য আমার অসুস্থ শরীরে আসা ! যদি আর কোনোদিন ও দেখা না হয় । এই কি বলছিস তুই পলাশী বলে? উজানী তাকায় মধুর দিকে ।অদ্ভুত শূন্য তার দৃষ্টি ! শিরিন বলে মধু তোর মন খারাপ কিছুতে ? মধু ম্লান হাসে , হ্যাঁ মন খারাপ বলতে পারিস! তোদের সবাই কে ছেড়ে যাবার , পৃথিবী ছেড়ে যাবার ,আমার বিহু কে ছেড়ে যাবার ! মানে উজানীর স্বর আলতো , আমার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে । জাস্ট কদিন আগে রিপোর্ট পেয়েছি । বাড়ীতে কেউ জানে না এখন ।এবার বলবো ফিরে । জানলে একা আসতে দিত না । শুধু আমাদের ড্রাইভার রহমান চাচা আর আমার মেসোমশাই যিনি একদিকে সায়ন্তন এর মামা জানেন ।তাঁদের ভরসায় আমার আসা এতদূর । মেসোমশাই বার বার ফোন করেছে রহমান চাচার কাছে,আমি ঠিক আছি কিনা ! আমি বারণ করেছিলাম তোদের সামনে ফোন না করতে !শুধু তোদের দেখবো বলে ছুটে এসেছি । হয়তো এই শেষ দেখা ! তোদের মনে আছে প্রায় ছয় সাত মাস আমাদের ভিডিও কল হয়নি ,তোরাও ব্যস্ত আমিও তখন ব্যস্ত এই রোগে । পুরোনো আলসার ক্যান্সার এ দাঁড়িয়ে গেছে । প্রথমে গুরুত্ব দিই নি । সামান্য ভেবেছি ।সেই ভাবে ডাক্তার দেখায়নি । কিছু দিন ভর্তি ছিলাম । তার পর বাড়ী আসি ।তোদের বুঝতে দিই নি । নর্মাল চ্যাট করেছি । কদিন এর অনুপস্থিতি কে কাজের চাপ বলেছি । আর তোদের ও কাজের চাপ যাচ্ছে সেটা আমি জানি !
সবাই হতবাক হয়ে শুনছে মধুজার কথা গুলো ! উজানী থাকতে না পেরে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো ।বল ইয়ার্কি করছিস মধু । লাভ ইউ সোনা ।তোকে ছাড়া আমরা সম্পূর্ণ না । বাকী দুজনের ও তখন চোখের জল গাল বেয়ে নামছে । মধুজার পাশে সরে আসে সবাই । মধুজা বলে চিন্তা বিহু টাকে নিয়ে ,বাবা মা ওর কেউ থাকলো না আর !জানিনা শুনে কি রিয়্যাক্ট করবে । মনে মনে ভাবি এই তো দশ সবে , ওর যখন প্রথম পিরিয়ড শুরু হবে , বয়ঃসন্ধির সময় গুলোয় বা কোনো অসুখ বিসুখ হলে কে ওর পাশে থাকবে আমি না থাকলে! জানি ওর দিম্মি, ঠাম্মি আছে কিন্তু মা তো মা ! আর যদি ঈশ্বর না করুন আমার পর ওনারাও চলে গেলেন ।মেয়েটা আমার একা হয়ে যাবে রে! ডুকরে কেঁদে ওঠে মধুজা । এর পর আমার কেমো স্টার্ট হবে ! যদি না নিতে পারি যদি আর না ফিরি ... ।তোর কিছু হবে না মধু আমরা সবাই আছি । বিহু তার মাকে হারাবে না ।ঈশ্বর এত নিষ্ঠুর না । উজানী বলে । পলাশী বলে চিন্তা করিস না এত, ঠিক হয়ে যাবে সব । শিরিন কাঁধে হাত রেখে তোকে বাঁচতেই হবে বিহুর জন্য , তোর মায়ের জন্য ,আমাদের সবার জন্য । মেঘ কেটে যাবে দেখিস ঠিক সূর্য হাসবে ! ওরা চেয়ে রইলো ডুবতে থাকা সূর্য টার দিকে ,সে যেনো ওদের কথায় শুনছিল । কথা শেষ হলো আর গা ঢাকা দিলো কমলা চাদরে ।
সন্ধ্যায় ওরা চলে এলো বুক করে রাখা রিসর্ট এ । চার জন একসাথে থাকবে এমন ঘর নেওয়া ছিল । রহমান চাচা গাড়ী ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের নির্দিষ্ট ঘরে গেলেন বিশ্রাম নিতে । ফ্রেশ হয়ে শিরিন আর মধুজা বাড়ীতে ফোন করলো ।তার পর এগ চাউমিন আর চা খেয়ে ওরা বাউল গান শুনতে বসলো । রহমান চাচাও যোগ দিলেন, গান শুনতে শুনতে মধুকে দেখলো উজানী । নিষ্পলক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে ! বাউল শিল্পী গান ধরেছে 'ও দয়াল কেন তোমার খেলা পলে পলে...!' মধু বললো আজ আমরা অনেক ক্ষন গল্প করবো ।কেউ ঘুমোবি না ।একটু বেলাতে উঠলে ক্ষতি নেই তারপর খেয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হবো । কোথাও যেন থমকে গেছে । হৈ চৈ এর সেই উচ্ছাস যেন আর আসছে না ।মধুজা কিন্তু উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে । রাতে হালকা অর্ডার দিল ওরা ।উজানী আর মধুজা রুটি ।পলাশী আর শিরিন ভাত। ভাত রুটির একই তরকারি ,স্যালাড , ডাল ,ধনিয়া পাতার বড়া, ডিমের কারী আর মিষ্টি । কথায় কথায় রাত বেড়ে চললো । ঘুম ঘুম ভাব সবার । মধু বললো ঠিক আছে ঘুমো তোরা ।একটু বাইরে ব্যালকনিতে যাই । ইচ্ছে করছে । বলে দরজা খুলে ব্যালকনিতে গেলো । চাঁদের নীল জোছনায় ভরে গেছে চারদিক । আকাশ জুড়ে রূপকথা আর চুপকথা নিয়ে তারাদের বাস । মধু ..দরজা ঠেলে এলো উজানী । একটা কথা বলতে চাই, হুম বল ।সিগারেট খাবি? খেতে পারিস উজানী আমার প্রবলেম নেই । না থাক ! মধু আমি চাই মনে প্রাণে চাই তুই সুস্থ হয়ে ওঠ কিন্তু তবু যদি তোর এত চিন্তা হয় ... বিহুর সব দায়িত্ব আমি নিতে চাই । মধু ওর হাত টা নিজের হাতে নিল । কিন্তু তোর ও তো লাইফ আছে উজানী ...লাইফ বিহু কে নিয়েই গড়ে উঠবে তখন ! আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত এটা! পাপ? কি বলছিস মধুজা একটু অবাক, একটু থেমে উজানী বলে ,যখন মনে মনে ডিভোর্স এর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তখন বুঝতে পারি আমি কনসিভ করেছি মনে হয়, ইচ্ছায় না । ভগবানের প্রতি খুব রাগ হচ্ছিলো ,সেই সময় আমি বর্ধমান চলে আসি একটু জোড় করে ।মা বাবা কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ী তে গেছিলো ।সুযোগ টা কাজে লাগাই । এক লেডি ডক্টর এর সাথে কন্টাক্ট করে সিউর হয়ে নই সত্যি কনসিভ করেছি কিনা ! কনফার্ম এর পর সেই দিনই ওই একমাসেই আমি ওষুধ খেয়ে ...! রাগে অন্ধ হয়ে গেছিলাম ওদের পরিবারের উপর , চাইনি আরেকটা ওদের মতো ছেলে কি মেয়ে হোক । কিন্তু সেতো তোর রক্ত নিয়ে আসছিল মধুজা বলে ,জিন তো ওদের ছিল তাইনা ! ওই বাড়িতে সে কিছুতেই আমার মনের মতো মানুষ হতো না । আমি মা হয়েও সেই অধিকার পেতাম না ।তাই তাকে আসতে দিই নি। আজ সে থাকলে বিহুর বয়সী হতো ,ক মাসের বড়ো ছিল । সেই বিহু হয়ে তোর কাছে গেছে বোধহয় ! দীর্ঘশ্বাস ফেললো উজানী। চোখের কোণে জল জমা!
মধু উজানীর হাত টা নিজের হাতে নিল । উজানী ফের বলতে শুরু করলো জানিস সেদিন ডক্টর এর কাছ থেকে ফিরে এসে সারাদিন খুব মন খারাপ । ততক্ষনে যা হবার হয়ে গেছে । ওষুধ তার কাজ শুরু করেছে ।ভীষণ কষ্ট আর কেমন একটা অনুশোচনা লাগছিল ! কি জানি সে অর্চিষ্মান না অর্চিষ্মতী ছিল ! সারা বাড়ী তে একলা আমি । কাউকে বলতে পারছি না ! মাও নেই !পাপবোধ লাগছিল । অগ্নি বাড়ী এসেছিল কোনো কাজে বুঝেছিলাম । মাসীমা মেসোমশাই ছিলেন না । সেদিন রাতে ফোন করি অগ্নিকে । ফোনে নাম্বার ডিলিট করে দিলেও ডায়েরী তে ছিল । তখনও ব্রহ্ম চর্য চলছে তার ,তো মাঝে কোনো কাজে মাঝে মাঝে দরকারি কাজে বাড়ী আসায় নিষেধ ছিল না । যায় হোক সে বোঝায় আমায়, কাউকে বলতে পেরে মন শান্ত হয় সেদিন ! সেদিন ওর কথায় মনে আসছিল আর কাউকে আসেনি ;কাজ টাকে সাপোর্ট না করলেও আমার মানসিক অবস্থা সে বুঝেছিল কি জন্য করেছি ! সেতো এক জন ডাক্তারও , ওই সময় আমার রোজ শরীর এর খোঁজ নিত ,মানসিক ভাবে শক্ত করেছে , জানি আমায় রাই হিসাবে করেনি হয়তো, মানবিকতা থেকে করেছে ।শুধু আমি মানুষী তখন । নারী সাহচর্য নিষেধ সেই তফাৎ মেনে পবিত্রতার সাথে সাহায্য করেছে । ক বছর পর দীক্ষা নিতে গিয়ে দেখি তখন তাকে । পরিব্রাজক হয়ে ফিরেছিলো, দীক্ষা নিয়ে খুব ভালো লাগছিল ।এখন আমি নিজেও মিশন এর সাথে যুক্ত । চেষ্টা করি ওনাদের কাজে অংশ নিতে । অনেক আশ্রমেই তো ওনাদের কর্ম পরিধি । হুঁ এখন অনেক টা নিশ্চিত বোধ করছি ।বিহু তার নতুন মা পাবে ! অনেক হালকা লাগছে । মধুজা উজানীর কাঁধে মাথা রাখে । এই রাত দুপুরে দুজনে অন্ধকারে কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়ালে অনেকে কেস দিয়ে দিতে পারে অন্য ভেবে ! দুজনে মেয়ে হলেও ।উজানী দুষ্টু হাসি হাসে ।মধু ও তার সাথে হেসে উঠলো ,যা বলেছিস ! সামনে অনেক বড় লড়াই ! চল আয় বাকি রাত টুকু একটু শুই বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে ।
পরদিন ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে বেরোলো ।আর তেমন ইচ্ছা না থাকলেও মধুজার উৎসাহে কিছু ক্ষন উদয়ন ঘুরে এলো ,শ্যামলী উদীচী ...! উজানী দুটো কুর্তি পালাজো নিল বিহু আর রিখিয়ার জন্য । কাল ওদের জন্য কিছু কেনা হয়নি ।শিরিন ,মধুজাও বাচ্চাদের জন্য নিল টুকটাক , পলাশী ও বিহু দের সাথে সাথে ওর ওখানকার বাচ্চাদের জন্য কিনলো কিছু , সাথে বাড়ীর জন্য ! ঠিক হলো শিরিন এখান থেকেই বাস ধরে চলে যাবে । মধুজার সাথে আর উজানী বর্ধমান অব্দি যাবে আর পলাশী মধুর সাথে গিয়ে ধর্মতলা থেকে পুরুলিয়ার রাত ৯ তার বাস ধরবে ভোরে পৌঁছে যাবে সে ।রহমান চাচা ওকে বাস ধরিয়ে দেবে ,রাতের শুকনো খাবার সব এখান থেকে কিনে নিল পলাশী। এর পর লাঞ্চ করে নিয়ে ওদের পুরোনো মেস বাড়ীটার বড়ো গেটের সামনে দাঁড়ালো গাড়ী । অলস দুপুর ।রাস্তায় লোক জন নেই ! দুপুরের হওয়া বয়ছে, পাখি গুলো ডাকছে নানা শব্দে । ঐ তো দেখা যাচ্ছে ওদের ঘর টা ।সামনে বারান্দা । একটা মেয়ে বারান্দায় বই হাতে দাঁড়িয়ে ,ওদের দেখে মুখ তুলে চেয়ে আবার বই এর দিকে মনোনিবেশ করলো ।ঐ তো সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ হাওয়াতে দুলছে ।যেন পুরোনো চার সখিকে দেখে খুশিতে মাথা দোলাচ্ছে ।এখনও ফোটেনি সেই ভাবে ,ফুটবে ফুটবে হয়ে আছে ! আবারো ওই লাগোয়া বারান্দায় টুপ টুপ করে পড়বে ..! অন্য মেয়েরা কুড়োবে।গেট ম্যান কে বললো উজানী ,আমাদের একটা ডাল দিতে পারবেন দাদা ।এক সময় এই খানে আমরা থাকতাম ।গেটম্যান দিলেন এনে ,একটা না চার জনকে চারটে । মনে মনে বলে সবাই যেন একই কথা ...তুমি ভালো থেকো কৃষ্ণচূড়া !এভাবেই কৃষ্ণচূড়ারা বসন্তের শরীর বেয়ে টুপ টুপ করে পড়ে থাকে পথে ।একরাশ মন খারাপ ফেলে রেখে যায় তার প্রিয় ভালোবাসার জন !
দিন আসে দিন যায় , কিন্তু কোনো কিছুই শেষ হয়ে যায়না । বৃষ্টির মতো , ফিরে আসে কৃষ্ণচূড়ায় ! আর সেই বৃষ্টি দেখতে দেখতে মনে পড়ে কবে কতদূর একসাথে হেঁটেছিলাম অনেকটা পথ। হাঁটতে হাঁটতে সমান্তরাল গল্প গুলো একসময় নিজেদের মতো ভালো থাকে অজান্তে ।আর অবেলায় কাব্য লেখে কৃষ্ণচূড়া।
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।
--------------------------------
Jayashri Banerjee Chakraborty
C/0 Sukhendu Chakraborty
Vill +po kalanabogram
Dist purbo Bardhoman
Pin 713124
আমার মতো একজনকে, যার অধুনা পাঠ্যসূচীতে কেবল দ্রুতগতির রহস্য-রোমাঞ্চ কিংবা হাল্কা হাস্যরসের গল্প, একদম ভিন্নরুচির এই গল্পটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখল, এতোটাই এর সাহিত্যরস।
উত্তরমুছুনঅস্বীকার করব না শুরুর দিকটা একটু বর্ণনাত্মক লাগছিল, কিন্তু লেখক যতো এগিয়েছেন, ততো সাবলীল লেগেছে, লেখার মধ্যে সম্পূর্ণ ডুবে গেছেন। তাঁর সংবেদনশীল, অনুভূতিসম্পন্ন মনের পরিচয় ছত্রে ছত্রে পাবেন পাঠক। নারীমনের গহনের খবর পাওয়া, চারটি ভিন্ন ভিন্ন নারীমনের -- আবেগ, ভালোবাসা, প্রেম, অস্ফুট আকর্ষণ, সবার ওপরে এক ওতপ্রোত কারুণ্যরস -- লেখাটির প্রধান আকর্ষণ।
সব লেখায় কিছুটা আত্মজৈবনিক, হয়তো লেখক উজানী, পলাশী, মধুজার মধ্যে একটু একটু মিশে আছেন। সবার উপরে, একজন ভালোমানুষের লেখা একটি হৃদয়ছোঁয়া গল্প পড়তে পেলাম।
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন