Click the image to explore all Offers

স্মৃতিকথা ।। স্মৃতির সরণি বেয়ে... ।। বিশ্বনাথ প্রামাণিক

 

স্মৃতির সরণি বেয়ে... 



 

বিশ্বনাথ প্রামাণিক

 

 গিখানা মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ঝপাৎ করে জলের মধ্যে ফেলে হাসেম মাঝি বলে উঠে- তালি এবার লউকা ছেড়ে দি বড়বাবু?   

-সবকিছু দেখে নিয়েছো তো? কিছু ফেলে টেলে...      

-না না বড়বাবু, সব ঠিক-ঠাক আছে। তারপর আবার একটু থেমে প্রায় পঁচিশ হাত লম্বা ও ফুট তিনেক চওড়া তার সাধের ডিঙি নৌকার মুখটা একটা মোচড় দিয়ে এক বিশেষ কায়দায় ডান দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে  বলে- তা এ বছর ধান তো বেশ ভালোই হয়েছে কি বল? বস্থা হল?

 দাদা খানিক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতেই উত্তর দিল- ওই তো তোমার সামনেই তোলা হল চাচা, কুড়িয়ে- বাড়িয়ে মো…টে… ছাব্বিশ বস্তা।    

-ও, তা, ও বছরের চেয়ে ভালো।    

বাবা খাল পাড়ে দাঁড়িয়ে হেঁকে বলেন- আর দেরি করো না হাসেম, এবার ছেড়ে দাও। সাবধানে যেও। ছেলেরা রইল তোমার হেফাজতে।  

হাসেম নৌকা থেকে হেঁকে জবাব দেয়- হাঁ কত্তাবাবু, এ…ই লউকো ছেড়ে দেব, মুখটা ঘুরিয়ে নি, আর ছেলেদের নিয়ে আপনি কিছু ভাববেন নি। এই হাসেম মাঝি থাকতে ওদের গায়ে আচর কাটবে কোন শালার পুত?   

-হ্যাঁ হ্যাঁ সে সব ঠিক আছে। তবে আমরা আসছি। তোমরা সাবধানে যেও। পথে দেরি করো না যেন।

-হ, হ…  হাসেম চাচা মাথা নেড়ে সায় দেয়।

বাবা-মা আশ্বস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্থুত হলে আমরাও আমাদের নৌকা ছাড়ার জন্য হাল ধরে ঠেলাঠেলি করতে শুরু করি।    

 

 আমাদের আবাদের চাষের জমির ধান। প্রতি বছর চাষের পর ঝাড়াই করে বস্থা ভরে বাড়ি নিয়ে আসি। অন্য কোনো পথে সুবিধা না থাকায় খাল পথ ধরেই আনতে হত। তাছাড়া একসঙ্গে এত ধান আনার খরচও অনেক, ঝামেলাও বিস্তর। তাই খাল পথে যাতায়াত, এতে খানিক সস্থাও হত।  

 

   মাঝি পীরবাবার নাম স্মরণ করে, এবার নৌকাখানি ছেড়ে দেয়। আমি ও আমার দাদা ধানের বস্তার উপর একটা জায়গা দেখে আরাম করে বসেছি। এখন শীতকাল। তাই সকালের রোদ্দুরে বেশ আরাম লাগছে। প্রতিবছর এই দিনটার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকি।  

  ছোট্ট, ফুট বারো চওড়া এই সরু খাল পথ, গ্রামীণ ভাষায় যাকে খাড়ি বলে, তারি হালকা ঘোলা জলের স্রোত বেয়ে এখন আমাদের ডিঙি-নৌকা ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে অপেক্ষাকৃত বড়, গভীর খালের দিকে। ওখানে জলও অনেক বেশি, টানও। এর আগে কোনদিন এমন করে জল পথে সারাদিন ভেসে আসার অভিজ্ঞতা আমার হয়নি।    

  আজ সারাদিনের ব্যাপার, তায়  হাসেম মাঝির বয়স হয়েছে। আবার তার ছেলেটাও এবারে সঙ্গে আসে নি। কোথায় নাকি কাজে গেছে, ফিরতে ফিরতে সেই চৈত্র মাস-  হাসেম মাঝি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- ওই এক মাত্তর ছেলে আমার বাপ, তাও দুটি পয়সার জন্যি কোন মুলুকে পড়ে আছে কে জানে!  

আমি বললাম- ছেলেকে ওই অতদুরে পাঠানো তোমার ঠিক হয়নি চাচা।

-কি করব বাপ? পাঠাই কি আর সাধ করে? তোমাদের চাচি তো শুধু ওই কথাই বলে। এবার ঘরে ফিরলে ওরে সাদি দিয়ে দেব। তারপর আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলে-আহা হা… মাথা নিচু কর বাপ, সামনে বাবলার কাঁটা ঝুলে রয়েছে। বড়বাবু এখন তোমারে হাল বাইতে হবেনি, ওখানে চুপটি করে বস দেকি। বড় খালে পড়ি, তারপর দেখব দু’ভাই কত হাল বাইতি পারো।   

  বাস্তবিক আমরা এই হাল বাওয়ার ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করি। বেশ একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতা, বলতে গেলে আমরা সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি এই দিনটির জন্যে।

একমনে হাল বেয়ে যাওয়া নবীন মাঝিটি তার প্রবীণ মাঝির কথায় যে কিঞ্চিত অভিমান হয়েছে, তা তার মুখ দেখেই বেশ অনুমান করা যায় বইকি। হাল খানা জল থেকে তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে নৌকার উপর রেখে এখন তিনি আমার কাছে এসে বসে পড়েন।   

 আমাদের নৌকা একটার পর একটা বাঁক ধরে এগিয়ে চলেছে তর তর করে।

  এখন সকাল সাতটা। ভোর ভোর নৌকায় মাল ভরে দিয়ে আমাদেরঅন্যান্য কাজের লোকজন ট্রেন পথে বাড়ি ফিরে গেছে।  আমরা শুধু জলপথে। এত বছরে তাও সুবল ভাইপো সঙ্গে থাকত। এই প্রথম আমরা দু’জন আনকোরা মাঝি।  দাদা আমার চেয়ে বয়সে বছর দু’একের বড়। আমি সবেমাত্র স্কুলের গণ্ডি ছেড়ে কলেজে পা দিয়েছি।    

খালের জল এ সময় অসম্ভব শান্ত। ছোট খাল পথ দিয়ে বড় খালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরও ঘন্টা দুয়েক লাগবে বলে মনে হচ্ছে। তার আগেই যদি এ পথে জোয়ারের জল ঢুকতে শুরু করে তাহলে আরো বেশি সময় লাগতে পারে!  তবে তাতে মাঝির কোন হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। তাও দুজনে  দ্রুত নৌকা বেয়ে  দশটার আগে বড় খালে পৌঁছাতে পারলে জোয়ারের চাপ খানিক সামলানো  যেত।   

বিরক্ত হয়ে দাদা বলে- যাগ গে মরুগ গে, আমি আর হাল ধরছি না।

-রাগ করছিস কেন দাদাভাই? দেখছিস না এই খালে কত বন জঙ্গল, ডাল-পালা খালের উপর ঝুঁকে রয়েছে! আমাদের লেগে যেতে পারে তাই হয়ত…  

- হাঁ, আমি কি বাইতে পারি না নাকি? লাগলেই হল?

আমি আর কিছু বলিনা। 

 খালের দু’ দিকের আগাছা জঙ্গলে খালপথ এখানে বেশ সঙ্কীর্ণ। তার উপর জল কম। লগি একবার কাদায় গেঁথে বেশ গায়ের জোরে টেনে তুলতে হয়। লগি তোলার কায়দা জানা থাকলে কষ্ট বিশেষ হয় না। কিন্তু আমাদের মতো সখের মাঝিদের যে সে কায়দা জানা নেই  হাসেম মাঝির সন্ধানী চোখ তা বোধকরি ঠিকি দেখে নিয়ে ছিল। তাছাড়া যেখানে সারাদিনের খেলা, সেখানে নতুন প্লেয়ারকে যে বিশ্রাম দিয়ে দিয়ে খেলাতে হবে তা একজন অধিনায়কের চেয়ে আর কে ভালো বুঝবে? তাই মাঝির উপর দাদাভাইয়ের রাগ হলেও, আমি অন্তত এতটুকু অবাক হই নি।   

 

   খালের দু’পাড় জুড়ে ছোট বড় তাল গাছ, খেজুর গাছ, বুনো বাবলা গাছের সারি। এখানে জল বেশি নেই, মাঝির হাতের ওই ছোট বাঁশের লগির অর্ধেকটাও ডোবে না। সেটি জলে ডুবিয়ে কাদায় চাপ দিয়ে ধীর পদক্ষেপে সামনে থেকে পেছনের দিকে পিছিয়ে যেতে হয়, তাতে নৌকা তরতর করে এগিয়ে চলে। দেখতাম হাসেম মাঝি নৌকার পিছন দিকে হাত দশেক জায়গা খালি রেখেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে উনি নিপুন হাতে নৌকা বেয়ে চলেছেন।         

    মাঝির পরনে সাদা কালো চেক লুঙ্গি, আর মাথায় সামনে থেকে পিছনের দিকে ঘুরিয়ে   গামছা বাঁধা, খালি গা, গলায় কালো রঙের মোটা সুতোয় ঝুলানো একটা তাবিজ বাঁধা। বয়স পঞ্চাশ- পচ্ছান্ন হবে, কিন্তু বেশ শক্ত-সমর্থ চেহারা। সেই এতটুকু বয়স থেকে ওনার বাবার সঙ্গে খালে নৌকা বাওয়ার কাজ করে আসছেন। শুধু আমাদের ধান বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছে- তা প্রায় চৌদ্দ বছর হল। আমি এই প্রথম। দাদা গত দু’ বছর সুবল ভাইপোর সঙ্গে এসেছিল বলে তার কৌতুহল এখন অনেক কম।   

দেখতে দেখতে ছোট খাল ছেড়ে আমরা বড় খালের মুখে এসে ঢুকেছি। এখানে খাল অনেক চওড়া, মনে হয় যেন ছোট্ট গলি পথ ছেড়ে আমরা এখন রাজপথে এসে পড়েছি। তখনও জোয়ার আসেনি। দুদিকের খাল পাড় বেশ উচু। আমরা তারি একটা দিক ধরে এগিয়ে চলেছি। ওপারের সারিবদ্ধ মেহগিনি, শিরিশ, বাবলা, খিরিশ - প্রভৃতি গাছগুলো অবাক দৃষ্টি মিলে আমাদের দিকে চেয়ে আছে।   


    

 

  আমি চারিদিক চেয়ে চেয়ে জল দেখি। এত্তো জল কোথা থেকে আসে, আর কোথায় যায় কে জানে! মনে পড়ল একদা পড়ে ছিলাম জগদীশ চন্দ্র বসুর- “ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে” লেখাটি। তাহলে সব ওই হিমালয়ের মানস সরোবরের মহাদেবের জটা থেকেই আসে, আবার ওখানেই মিলিয়ে যায়! হিমালয়ের গাত্র বেয়ে নেমে আসা সরু রুপালি রেখার সেই স্রোত আমাদের এখানে এসে দুকূল প্লাবিত করে বয়ে চলেছে। মনে মনে প্রণাম করি সেই মানস লোককে।  

  কতশত কচুরিপানার দল আমাদের ডিঙি নৌকার কোল ঘেঁষে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে।  খালের দু'পাশের মাঠে চাষীদের ব্যস্ততার ছবি দেখা যাচ্ছে। কেউবা ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার কায়দায় কালো কুচকুচে তেলো ডিঙির  পিছনের অংশটি পায়ের চাপে জলের মধ্যে ডুবিয়ে আবার তুলে জল ভরে সামনের নালা পথে ছেড়ে দিচ্ছে। মাটির নালা পথ বেয়ে  রাশি কৃত সেই জল চলে যায় শুকনো মাঠের বুকে ধুঁকতে থাকা চারা গাছের পায়ে পায়ে। এখন আনন্দে ওরা মাথা দোলাছে, হাওয়ার হাসি ওদের চোখে-মুখে।  দুটি রাখাল বালক তাদের গরু ছেড়ে দিয়ে বাবলার তলায় বসে  হা করে একভাবে আমাদের  দিকে চেয়ে আছে।

 

 নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে  হাসেম মাঝি বলে, নৈনানের ঘাটে গিয়ে টিফিন করে নেবে বড় বাবু।

আমরা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললাম- তুমি কি আবার বাড়ি ঢুকবে নাকি  হাসেম চাচা?

-না, এই যাব আর আসব। চারটি পান্তা নিয়ে এসেছি। শুধু এই লগিটা পাল্টে নিতে হবে এই যা।  

 --     কেন? লগি পালটাতে হবে কেন?

 কেন কি ছোট বাবু? এবার যে বড় খাল পড়েছে। এই ছোট লগি কি ঠাঁই পাবে?

-ও, এখানে জল বুঝি অনেক?

 মাঝি হাসে। তা তো হবে, পানি অনেক না হলি চাস-বাস হবে ক্যামনে? এই এত্ত পানি তোমার ছোট্ট খাল বেয়ে জমিন ভেজাবে, আর সেই জমিনে ফসল ফলবে, সোনার ফসল।  হাসেম মাঝি উদাস হয়ে পড়ে কি?

দাদাভাই এবার বলে- তোমার জমি- জায়গা নেই বুঝি! চাস-বাস করো না?

-আমি বলে উঠি- সারা বছর এই নৌকো বাও?

জলের বুকে ঝুপ করে লগি খানা গেঁথে দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে মাঝি বলে- তা থাকবে না ক্যান, আছে ওই কাটা দশেক জমি। বাপকেলে জমি, ফেলা রাখা তো যায় না, চাষ করি, কটা ধান পাই! তাতে আর কদিন চলে বাপ? এই গতর খেটে চলে।

আমি আর কিছু বলি না।  মাঝি চাচা খুব গরীব। ইচ্ছা করছিল আমাদের এই এত ধানের বস্থার কটা যদি ওকে দেওয়া যেত বেশ হত। মানুষ গুলো দুটো ভাতের জন্যে মুখে রক্ত তুলে খাটে।

হাসেম মাঝি বোধ হয় আমার মনের কথা টের পেয়েছে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- আল্লা যারে যে কাজের জন্যি পাঠিয়েছে, তাকে তো সে কাজ করতি হবে বাপ। নইলে এই এত বড় জগত খান চলবে কেমন করি বলতি পারো?

 মাঝি বড় ভালো কথা বলেন। জীবনটাকে কত সহজে মেনে নিয়েছেন এরা! এদের চাহিদা তেমন কিছু নয়, শুধু একটু খেয়ে- পড়ে বাঁচতে পারলেই খুশি।

 

আমি চুপ করে জলের দিকে চেয়ে আছি। বোঝার চেষ্টা করছি এর গভীরতা, দেখে দাদাভাই হেসে বলে- তোর খিদে পেয়েছে নারে?

- না… না, তো হাটে গিয়ে খেয়ে নেব কিছু। 

- ওখানে নৌকা আধ ঘন্টাটাক বাঁধা থাকবে। তখন কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে'খন। আমাদের সঙ্গে মুড়ি, কেক, বিস্কুট জলের বোতল আছে।  

 দেখতে দেখতে নৈনানের ঘাট এসে গেল। সামনে ইট-বালি- সিমেন্ট দিয়ে তৈরি পুল আছে। তার পাশের ঘাটে নৌকা বেঁধে  মাঝিচাচা তার লগি হাতে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল- তোমরা কি খাবে খেয়ে নাও বাপ সকল। এরপর পথে আর কিছু মিলবে না। আমি এই যাব আর আসব।

 আমরা নামব নামব করছি, এমন সময় দেখি বাবা, সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছেন- আয়, নেমে আয়। আ হা… হা  সাবধানে নামবি।

আমি তো অবাক- তুমি!

 বাবা হেসে বলেন- আয়, এখানে বসে আগে দুটো ভাত খেয়ে নে।

-তুমি ভাত কোথায় পেলে এখানে? অবাক হয়ে দাদা প্রশ্ন করে।

 বাবা বলে- নিয়ে এসেছি তোমাদের জন্য, খেয়ে নাও। এরপর আর কিছু পাবে না।

 আমরা নৌকায় বসে পরম তৃপ্তির সঙ্গে গরম ডাল আলু সবজি দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে নিলাম।  কিন্তু মনের মধ্যে একটা খটকা রয়ে গেল। বাবাও পরিস্কার করে কিছু বলেননি। তবে পরে দাদার কাছে শুনেছিলাম সবি  হাসেম চাচি রান্না করেছেন। আমাদের ডিঙি ছাড়ার পর বাবা সকাল সকাল এসে আমাদের তিন জনের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করেছেন। পাছে আমরা খেতে অস্বীকার করি, তাই বাবা কষ্ট করে  এসে আমাদের খাইয়ে গেলেন।      

 

 সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে বাবা চলে গেলেন। আরও কিছু পরে  হাসেম মিয়া হাতে বড় একটা বাঁশের লগি নিয়ে নৌকায় এসে উঠল। আবার বড় খাল বেয়ে আমাদের নৌকা চলতে লাগলো।  চাচা শৌখিন মানুষ, কোমরের লুঙ্গির গিঁট থেকে পানের ডিবে বের করে , তার থেকে একটা পান মুখে দিয়ে কৌটোটা আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন-  নেবে নাকি বড়বাবু একটা পান?

 দাদা হাত বাড়িয়ে কৌটোর ভেতর থেকে একটা পান তুলে গালে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে ওঠে- আঃ, বড্ড ঝাল!  

 আমি সেদিকে চেয়ে আছি দেখে মাঝি চাচা হেসে বলে- একটু চুন গালে ফেলো ঠিক হয়ে যাবে। তারপর উত্তরের প্রত্যাশা না করে লম্বা লগি খানা ঝুপ করে খালের জলে ফেলে যতদূর ডোবে ডুবিয়ে কাদা মাটিতে চাপ দিয়ে, এক বিশেষ কায়দায় ডিঙি নৌকার মুখখানা ঘুরিয়ে পুলের নীচ দিয়ে পার করতে লাগলো। এখন  আমরা এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে।    

এখানে খালের গভীরতা বেশ অনেকটাই মনে হল। দেখলাম  হাসেম মাঝির প্রায় বিশ ফুট লম্বা বাঁশের লগির তিন ভাগ ডুবে গেল। আরও একটা লগি আমাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে মাঝিচাচা বলল- নাও এবার বাও দেখি কেমন ধারা বাইতে পারো।

আমি লগিটা হাতে তুলে নিয়ে বলি, বাপরে কি ভারি!

দাদাভাই উঠে এসে আমার হাত থেকে সেটি নিয়ে বলে- তুই বস। আমাকে দে।

-আমি একটু বাই না।

-এখানে অনেক জল ভাই, সামলাতে পারবিনে, আমাদের ছোট খালে গেলে বাস।

অগত্যা আমি দাদাভাইয়ের হাতে আমার লগির গুরু দায়িত্ব অর্পণ করে আমাদের বসার জায়গায় গিয়ে বসে পড়ি।    

 দুই মাঝির হাতে পড়ে ডিঙি নৌকা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তরতর করে এগিয়ে চলেছে- ময়ূর পঙ্খি নৌকার মতো। দেখতে দেখতে সেই পুল, হাট- ঘাট ফেলে, খিরিস গাছের ছায়া পার হয়ে, খালের পাড়ে অস্থায়ী কেঠো ঘাটের স্নান রত বধুর চোখে বিস্ময় জাগিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি।   ঘাট থেকে একজন বয়স্ক লোক কৌতূহলী চোখে আমাদের দেখতে দেখতে বলে ওঠে,    হাসেম কত-দূর যাবিইইই? কার ধাআআন?

হাসেম মাঝিও চেঁচিয়ে উত্তর দেয়- মাস্টারের গো চাচা…আআআ

-ও…ও ও … 

 লোকটি আর কিছু বলে না একদৃষ্টে চেয়ে থাকে আমাদের নৌকার দিকে।

বুঝলাম বাবা এখানেও বেশ পরিচিত। মাস্টার নামটাই তাকে চিনে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।     

 

নৌকা যত এগিয়ে চলেছে, তত বেলাও বাড়ছে চরচর করে। শীতল জলের উপর দিয়ে হালকা হাওয়ায় ভেসে আসা কচুরিপানার  ক্রমে ক্রমে পিছনে সরে যাওয়া দেখতে থাকি এক মনে।  কেউবা দলবদ্ধ, কেউবা একা। খালের দু’পাড়ে কত তাল, খেজুর গাছের সারি। কোথাও বা বাঁশের বন, কোথাও বা নাম না জানা আগাছা জঙ্গলের নিবিড় বনরাজি। থেকে থেকে পাখিদের  কোলাহল কানে আসছে। অদুরে একটা বাঁশের চেরা-বাকারি দিয়ে তৈরি বাঁধ- খালের এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্ত পযন্ত জাল দিয়ে ঘেরা  আর আমাদের সামনে থেকে  ভেসে আসা জলের স্রোতে কচুরি পানার দল তারি গায়ে ভিড় করে প্রতিবাদের ঝাণ্ডা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁধের মাঝ দিয়ে নৌকা পারাপারের খোলা পথ ধরে এগোতে হবে আমাদের।  হাসেম মাঝি দাদাকে বলে- এখন লগি বাওয়া বন্ধ করো বড়বাবু, লৌওক বাঁধের মাঝখান দিয়ে পার করে নিই, তারপর বেও।   

    মাঝি অতি সন্তর্পনে বাঁধের মাঝ খান  দিয়ে, চেরা-বাখারির গায়ে ঠোক্কর খেতে খেতে,   মাঝখানের খোলা জায়গা থেকে নৌকা পাস করে নিয়ে এগিয়ে চলে। ডিঙি-নৌকার ধাক্কায় গোটা বাঁধ থরথর করে কেঁপে উঠে- যেন অসময়ে ঘুমন্ত দৈত্যর ঘুম ভেঙেছে বলে সে কিঞ্চিত বিরক্ত। কচুরি পানার দল একান্ত অনিচ্ছা স্বত্তেও আমাদের পথ করে দেয়। পিছনে চেয়ে দেখি আমাদের বেয়ে আসা পথ বেয়ে এখন ওরা ভেসে চলেছে – মুক্তির আনন্দ ওদের পাখায় ভর করেছে বোধহয়।  এখানে জল অনেক বেশি বলে দাদাভাই আর লগি বায়বার চেষ্টা করে না। তাছাড়া ওকে এখন বেশ ক্লান্ত মনে হল। বসে বসে দুজনে গল্প করছি আর মাঝির কেরামতি দেখছি।   

 

   আর একটা বড় খালের তিন মুখো সংযোগ স্থান এসে পড়ল। এখানে খাল অনেক বড়, যেন নদীর মতো । ওপারের গাছগুলো ছোট দেখাচ্ছে। আমরা একটা পাড় ধরে এগিয়ে চলেছি।   এটাকে নাকি মাগুর পুকুরের খাল বলে। খুব ভয়ের জায়গা। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। কোথাও কোনও জন-মনিস্যির চিহ্ন নেই । বড় নিস্তব্ধ এ অঞ্চল। খুন করে কেউ ফেলে দিয়ে গেলে টের পাওয়ার উপায় নেই। এমনটা নাকি কতবার হয়েছে!  লোকে বলে এই অঞ্চলে ডাকাতের বড় উৎপাত। দৈবাৎ পথচলতি লোকের টাকা-পয়সা জিনিসপত্র নিয়ে বচসা হলে তাকে খুন করে  দেহ খালের জলে ভাসিয়ে দেওয়া এমন কিছু ব্যাপার নয়। এমনটা নাকি হয়েছে কতবার! তারপর সেই খত-বিখত দেহ জলে ভাসতে ভাসতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে! মাঝির মুখে এ সব গল্প শুনতে শুনতে ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যায়। 

  এখন দুপুর। মাথার উপর সূর্যের প্রখর রৌদ্র। পরিষ্কার নীল আকাশে থেকে থেকে দু-একটা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। দূরে বাঁশের বনে কি একটা পাখি পিক পিক করে ডাকছে, আর লেজ দোলাচ্ছে। ফিঙে- টিয়ে হবে বোধ হয়। দূর থেকে ভালো করে ঠাওর করা যাচ্ছে না। জোয়ারের জলের স্রোত যেন নিস্তব্ধ রাজপুরীর নীরব প্রহরীর মতো আমাদের নৌকাকে শাসিয়ে দিয়ে চলেছে।   

  খাওয়ার জলের বোতলটা উপর করে দু’ঢোক  জল খেয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম, তোমাকে তো রাত্রে ফিরতে হবে  চাচা, তোমার ভয় করবে না?

  হাসেম মাঝি হা হা করে হেসে ওঠে- জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ নিয়ে যে ঘর করতে হয় ছোটবাবু, ভয় করলি চলবে কেন?

দাদা বলে- তা বটে । তবু সাবধানে থাকবে, চারিদিকে শতুরের তো অভাব নেই।

চাচা নৌকার লগি ঝপাৎ করে জলে ফেলে দিয়ে বলে- গরিব মানসের প্যাটের  থেকে বড় শত্তুর আর কে আছে বাপ? 

তা বটে সবকিছুই তো এই পেটের জন্য। আমি একমনে ওদের গল্প শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে পড়ি। কখন যে আমাদের নৌকা মাগুর পুকুরের খাল ছেড়ে ডোডালিয়ার খালে এসে পড়েছে খেয়াল করিনি। এখন সামনের দিকে চেয়ে আমাদের তিনজনের চক্ষু চড়কগাছ। সর্বনাশ এবার কি হবে?      

এখন প্রায় তিনটে বাজে। এখনো আমাদের পৌঁছাতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লাগবে। তারপর খালের এই অবস্থা দেখে মাঝি নৌকা পারে ভেড়াতে থাকে। মাঝি হাল ছেড়ে গভীর হতাশায় বলে উঠে- অনেকদিন এদিক পানে আসা হয়নি কো, খালের এই অবস্থা তা কে বা জানত? এই এতো  পচাদাম ঠেলে  লউকা নিয়ে যাওয়া পেরায় অসম্ভব কাজ। যে আর এগোবে না বড়বাবু।  

  সামনের পরিত্যক্ত বাঁধের গায়ে এই এ…তো বড় বড় কচুরি পানার ঘন জঙ্গল। তা প্রায় হাফ কিলোমিটার খাল পথ জুড়ে- এদিক থেকে ওদিক পযন্ত। কোথাও কোন ফাঁক নেই যে আমাদের ছোট্ট ডিঙি খানা পার হতে পারে। ঘন মরা পচা পানার দামে ভেসে এসে আটকে পড়া মরা গরুর মৃতদেহ, কুকুরের মৃতদেহ পচে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। আর তারি  বীভৎস গন্ধে চারিদিকে ম ম করছে। গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার জোগাড়। আমি নাকে গামছা বেঁধে বলি- সর্বনাশ এবার কি হবে দাদাভাই?          

 

 মাঝি কিন্তু ঘাবড়ায় না। চট জলদি একটা উপায় বের করতে হবে। দেখলাম, একটা কাছি বের করে নৌকার মাথায় বেঁধে বলে, নাও এবার পাড়ে উঠে টানতে হবে বড়বাবু, তোমরা দু’ভাই ওপরে যাও দেকি।  আমি নিচে লগি ধরে ঠেলে যাই।  এই দাম কেটে বের হতি হবে যেমন করে পারি।    সন্ধ্যা হওয়ার আগেই না বের হতে পারলে পৌঁছানো যাবে না। অগত্যা আমরা দু’ভাই খালপাড়ে উঠে নৌকায় দড়ি বেঁধে প্রানপনে টানতে থাকি, কিন্তু তাতে নৌকা যত না এগোয় তার  থেকে পিছিয়ে যায় বেশি। এভাবে ঠেলাঠেলি- টানাটানির বিস্তর চেষ্টা করেও নৌকা একটুও এগোয় না।  হাসেম মাঝি এবার আমার ডাক দিয়ে বলে, ছোটবাবু তুমি লউকতে এসো দেখি, হাল ধরো। আমি নিচে নামব এই শালার পানা একটু একটু করে  সরায়ে পথ বের করতি হবে। বড়বাবু তুমি উপরে থেকে যেমন  দড়ি ধরে টানতিছও, তেমনি টান দাও।       

আমি লগি জলের মধ্যে ডুবিয়ে গায়ের জোরে ঠেলতে থাকি। দাদাভাই পাড় ধরে কাছি ধরে টানতে থাকে আর মাঝিচাচা কোমর জলে নেমে নৌকার সামনের পানা তুলে পথ পরিষ্কার করে চলেছে- এভাবে একটু একটু করে এগোচ্ছে আমাদের পণ্যবাহী রথ- কি মেজাজ তার!  সমস্ত জঙ্গল পথ পার হয়ে যখন ওপারের পরিষ্কার জল এসে পড়েছি, তখন  সুর্য প্রায় ডুবুডুবু।   

  এরপর আমাদের একটু বিশ্রাম নেওয়া। শীতের দিনেও সেদিন ঘাম এসে গিয়েছিল। কেন জানিনা সেদিন  মাঝির প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে এসেছিলো। আমাদের সঙ্গে থাকা কেক-বিস্কুট মুড়ি দিয়ে টিফিন সেরে নিলাম আমরা তিনজনেই। তারপর জল খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার নৌকা ছাড়া হল যখন, তখন নীল আকাশ আলো করে উঁকি দিয়েছে চাঁদ। মৃদু- মন্দ দক্ষিণা পবনে এই প্রথম আমার গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছা করছিল।         

 

 এরপর শুধু ভেসে যাওয়া। দেখতে দেখতে রাত বাড়তে থাকে। চাঁদের দিকে চেয়ে  বসে আছি দুজনে। হালকা লগির চাপ আর ভাটার টানে তর তর করে এগিয়ে চলেছি আমরা। চারিদিক অসম্ভব নিস্তব্ধ। শুধু জলে লগি ফেলা তোলার আওয়াজ। খালের দু'পাশের জঙ্গল এখন বেশ ঘন। কালো কালো ছায়া যেন দু’দিক থেকে খাল পথকে আরও সঙ্কীর্ণ করে দিয়েছে। এখন  আমাদের ডিঙি চলেছে  খালের  মাঝ বরাবর- চাঁদনী আলোর পথ ধরে। চাঁদের আলোয় সে পথ বড় মায়াবী বলে মনে হয়। দূরে কোথায় একটা প্যাঁচার ডাক শোনা গেল। আমরা চাকদহের পুল পার হয়ে আমাদের বাড়ির চেনা খাল পথে পড়েছি। তবে এই জল পথে এর আগে কোনদিন যাইনি। এখন রাত প্রায় এগারোটা। আরো ঘন্টা দুয়েকের পথ বাকি। ভাসতে-ভাসতে এগিয়ে চলেছি আমরা। ডোডালিয়ার ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আমাদের সারাদিনের অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ যেন মাটি হয়ে গেছে!  কেউ বেশি কথা বলছি না। এই তিনটি প্রাণী ছাড়া জগতের আর সবাই যে ঘুমের দেশে!    

  এর মাঝে হঠাৎ দূরের দিক থেকে একটা মৃদু আলোর রেখা আমাদের চোখে এসে পড়ল। ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে বললাম,ওটা কিসের আলো দাদাভাই? আলেয়া নাকি!   

 -দূর বোকা ওটা মনে হয় সুরলহকের কুঁড়ের আলো।     

শুনেছি উনি নাকি রাতে খাল ভেড়িতে বাঁধ পাহারা দেওয়ার জন্য থাকেন। ভয়ডর নেই মানুষটার। এই জন-মনিসি বর্জিত জঙ্গলে কি করে একা থাকে কি জানি!  

  এখন আর ওটা থেকে থেকে আমাদের চোখ সরছে না। মনে হয় যেন আলোটা ক্রমশ বড় হচ্ছে। একদৃষ্টে সে দিকে চেয়ে আছি, বোঝার চেষ্টা করছি এত রাতে ও কিসের আলো! আলোটা কি ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে? কুঁড়ের আলো হলে এগোবে কেন? তবে কি উনি কিছু সন্ধেহ করে…, শুনেছি সুরলহক বন্দুক নিয়ে রাতে পাহারা দেয়। এটা আমাদের পাঁচবিঘার খাল। উনি আমাদের চেনেন ঠিকই, কিন্তু তার আগেই যদি গুলি চালিয়ে দেন! ভয়ে আমার মুখ শুখিয়ে গেছে। মাঝিচাচা বলে- অ কিসির আলো বলো তো খোকারা! শুনেছি এখানেই রাতে-ভিতে চোর- ডাকাতের উৎপাত আছে! উৎকণ্ঠিত চিত্তে তিনি যে আমাদের উত্তরের প্রতীক্ষা করছেন বুঝে দাদাভাই বলেন- এককালে ছিল ঠিকই, কিন্তু এখন… 

 মাঝিও কি তবে ভয় পেয়েছে?     

 

 আর ঠিক তখনই ফিসফিসিয়ে একটা আওয়াজ ভেসে আসছে।  

নিঘাত ডাকাতের হাতে পড়েছি। সর্বনাশ! ভয়ে আমাদের বুক শুকিয়ে গেছে।  হাসেম মাঝিও জলে লগি ফেলা বন্ধ করে নীরবে আওয়াজটা অনুসরণ করার চেষ্টা করছে বলে মনে হল। তিনজনেই এখন কান পেতে আছি। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সে আওয়াজ  ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

 হাঁ, ঠিক শুনেছি, কিন্তু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি কৈ?  

আবারও কান খাড়া করে আওয়াজটা বোঝবার চেষ্টা করি।  

দাদাভাই বলে- এ… তো… মার গলার আওয়াজ, কিন্তু এত রাতে, এই জঙ্গলের দেশে তা কেমন করে সম্ভব? শুনেছি ভুতেরা নানান আওয়াজ করে ডাকতে থাকে। কিন্তু সাড়া দিলে বিপদ! তক্ষুনি তার ঘাড় মটকে রক্ত খাবে!

 এই সব যখন ভাবছি দেখি দাদা উঠে দাঁড়িয়ে সে আওয়াজ অনুসরণ করে ডাক দেয়- কে ওখানে? কি চায়? সাড়া না দিলে এই লাঠির ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলবো।  

খোকাবাবু তুমি বস, আমি দেখচি,  হাসেম চাচা ঢাল হয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।

-খোকা… আআআ…

ডাকটা এবার স্পষ্ট। আমি প্রায় তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠি- মা আআআ?

-কোথায় তোরা!

এই তো এখানে। অন্ধকারে আমি চিৎকার করতে থাকি।   

 একটি গাছের নীচ থেকে মাথার উপর হ্যারকিন উঁচু করে ধরে মা বলে- হ্যাঁ,  এত রাত হল তোদের?  

মায়ের গলায় বিস্ময়।   

- চাচা নৌকো পাড়ে নিয়ে চলো,  বাবা-মা এসেছেন আমাদের খোঁজে- প্রায় আনন্দে লাফাতে লাফাতে এক-নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলি।

দাদাভাই কিন্তু গম্ভীর ভাবে বলে- এত রাতে এভাবে তোমাদের আসা ঠিক হয়নি।

-জানি রে খোকা, কিন্তু ঘরে বসে থাকি বা কি করে!  

 

  এরপর নৌকায় তাদেরকে তুলে নিয়ে আমরা খোশ গল্পে মেতে উঠি। আমি বলি- তোমরা আবার এতরাতে এসেছ কেন? বন-জঙ্গল, সাপ- খোপে যদি কামড়ে দিত!   

মা হেসে বলে- তোরা বাড়ি ফিরলি নি, আমরা স্থির থাকতে পারি? সেই কখন থেকে ময়রা গাজি তলায় বসে পথের দিকে চেয়ে আছি! তা তোর বাবা বলল, চলো, একটু পায়ে পায়ে এগিয়ে দেখি?

বাবা এখন হাসেম চাচার সঙ্গে কথা বলে চলেছে।          

এরপর আমরা পাঁচজন যখন আমাদের ছোট্ট খাড়ির ( আঞ্চলিক ভাষায় বলে সোত) মধ্যে এসে ঢুকলাম , তখন রাত্রি প্রায় একটা।

 এখন থালার মতো গোল চাঁদটা মাথার উপর। স্বচ্ছ জ্যোৎস্নার দুধ সাদা আলোয় গোটা খালপাড় যেন ভেসে যাচ্ছে।

 এরপর সেই রাতে আমরা খালে নৌকা বেঁধে রেখে বাড়ি চলে এলাম।

   

  পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, দেখি বাড়ির উঠানে চারিদিকে ধানের বস্তা ডাই করে রাখা আছে। হাসেম চাচা সেই ভোরবেলা কখন যে চলে গ্যাছে, কে জানে!

 আবার এক বছরের প্রতীক্ষা।  

                                       ----------------------    

 
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট

      ২৭/০৪/২০২১ 

সোনারপুর।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.