ছবিঋণ- ইন্টারনেট
কৃষ্ণচূড়া
অরূপ কুমার গোপ মন্ডল
সুরথ বলেছিল রাস্তার বাঁ পাশেই আছে গাছটা । মোটা আর লম্বা গুঁড়ির মাথায় ঝাঁকড়া ডালপালা । তার উপরে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া ফুল । দূর থেকে দেখলে মনে হয় আগুন লেগেছে । কতজনের মনে আগুন লাগিয়েছে তাইবা কে জানে ? যুগ যুগান্ত থেকে ব্যস্ত শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে । সবাইকে দেখছে আর আপন মনে হাসছে।
গাছটা চিনতে ভুল হয়নি তিতিরের। টোটো থেকে নেমে তাকালো ঘড়ির দিকে। চারটা বাজতে পাঁচ। তাহলে সুরথের আসতে আর দেরি নেই। কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স হর্ণ বাজিয়ে চলে গেল। কভিড রোগী আছে হয়তো। একটা টোটো এসে দাঁড়িয়ে গেল সামনে।
-" দিদিভাই দশটাকা । বাস স্ট্যান্ড, শপিংমল, নামোপাড়া । যাবেন নাকি ?"
মাথা নাড়ে তিতির । সত্যি সুরথ এত দেরি করছে কেন ? ফেসবুকে পরিচয় । মাস দুয়েকের বন্ধুত্ব । তিতিরই জোর দিয়ে বলেছিল, একদিন দেখা হোক না কেন ? না বলেনি সুরথ । শেষে কী এমন হলো ? সময় কাটতেই চাইছে না । উপরের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারল না । কৃষ্ণচূড়া ফুল তার বড় প্রিয়। তার গায়ের চুড়িদারটাও কৃষ্ণচূড়ার মতোই টকটকে লাল। একটা ফুল যদি কেউ পেড়ে দিত। খোঁপায় গুঁজতো। বর্ণা বলেছিল খোঁপায় কৃষ্ণচূড়া গুঁজলে হেব্বি লাগে তাকে। লাজে রাঙ্গা কনে বউ । মনে মনে ভাবে তিতির , কৈ কোন ছেলে বলে নি তো ?
কয়েকটা ডালের উপরে একটা কপোত বসে আছে। একা একা। বড় বেমানান লাগছে। ঠিক তার মতই । পাশ দিয়ে গেছে রাঁচি পুরুলিয়া রোড। কত মানুষের আনাগোনা । চরকির মতো ঘুরছে সবাই। কভিড জ্বরে কাঁপছে শহর থেকে গ্রাম। দ্বিতীয় ঢেউটা নাকি খতরনক । সবাই বলছে। মাস্ক পরার হেলদোল নেই কারো। মরবে তবু মুখ ঢাকবে না। পাশ দিয়ে যারা যাচ্ছে আড়চোখে একবার দেখে নিচ্ছে । কৃষ্ণচূড়া ফুল নয়। কৃষ্ণচূড়ার মত একটি মুখ। কালো ভুরুর নিচে সুন্দর দুটি চোখ । সুডোল বুক আর তন্বী দেহ । চোখ দিয়ে চুমু খেতে চাইছে তার সারা অঙ্গ।
একটা বুড়ো এগিয়ে আসছে। তার দিকেই।
-"আচ্ছা দাদু, আমি শুনেছি কৃষ্ণচূড়ার আশেপাশে একটা রাধাচূড়া থাকে। কই দেখছি নাতো ?"
-"আমিও শুনেছি দিভাই । কাছেই আছে হয়ত ।"
ডানদিক বাঁদিক কী খুঁজতে লাগল লোকটা। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় স্কুল মোড়ের দিকে চলে গেল । আর তিতির বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো গাছের তলায় । গভীর অভিমান নিয়ে । ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মত কৃষ্ণচূড়া ফুল পড়ছে তার সারা গায়ে। তখনো কপোত পাখিটা বসে আছে গাছের ডালে। চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। না জানি কার প্রতীক্ষায় !
হঠাৎ একটা মোটরসাইকেল এসে থেমে গেল । ছিমছাম পোশাক। দেখে মনে হচ্ছে যুবক । হেলমেট খুলছে। তার আগেই পিছন ঘুরে দাঁড়ালো তিতির। জানে ইঁচড়পাকাদের কারবার। সুন্দরী হওয়ার বিড়ম্বনা। সহ্য করতে হয় অনবরত । বাসে ট্রেনে হাটে বাজারে মেলায় এরা ঠেলা দেয়। স্পর্শ অনুভূতি পেতে চায় । মন নয় ওদের দরকার শরীর। লোকটা গলাখাঁকারি দিচ্ছে। কিছু বলবে হয়তো।
-"তিতির, আমাকে চিনতে পারছো তুমি ?"
গলাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে কয়েকবার দেখে নেয় তিতির। চোখের কাছে কাটা দাগ।
-"কে ?.. ও বিতানদা তুমি ?"
-"হ্যাঁ তিতির। সামনেই ব্লক অফিস। মাস ছয়েক আগে জয়েন করেছি। কিন্তু তুমি ?"
-"না মানে..." কি বলবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা তিতির । পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। গাছের কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো কেমন বিবর্ণ মনে হচ্ছে। বিতানদা কলেজে একবছরের সিনিয়র । কবিতা লিখত। দারুন আবৃত্তি করতো। জোকস বলে মাতিয়ে রাখত সবাইকে। কি বলবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা তিতির। কয়েকবার ঢোঁক গিলে বলে
-" বিতানদা কতদিন পরে দেখা ? দেখতে দেখতে বছর গুলো জলের মতো পেরিয়ে গেছে। কতদিন তোমার জোকস আর কবিতা শুনি নি। ভালো আছো তো ? " এক নিঃশ্বাসে বলে চলে তিতির।হাসি চেপে রাখতে পারেনা বিতান। প্রসন্নতার হাসি । কি হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। এক ভাবে তাকিয়ে থাকে তিতির।
ধীরে ধীরে তিতিরের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। মাথা নিচু করে নেয়। কেমন করে কথাটা তুলবে বুঝতে পারছে না । কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিচু গলায় বলল -"বিতানদা হাতটা তোমার ভালো আছে ?" আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। দুজনেই। যেন কথা ফুরিয়ে গেছে।
-"হ্যাঁ গো দাদা। শখ হয়েছিল খোঁপায় একটা কৃষ্ণচূড়া ফুল গুঁজব। তাই সেদিন একটা ফুল পেড়ে দিতে বলেছিলাম তোমাকে।"
-"আমিও না করিনি। কে জানতো ভাগ্য খারাপ। এমন করে পড়ে যাব গাছ থেকে। দেখো এখনো দাগটা আছে। দাগটা দেখলেই তোমার কথা মনে পড়ে।"
তিতির এগিয়ে আসে বিতানের দিকে। বাঁ হাতে কনুয়ের কাছে লম্বা একটা সাদা দাগ। কয়েকবার ইতস্তত করে তিতির। কি করবে বুঝতে পারে না। তারপর মাখন হাতটা বুলিয়ে দেয় সাদা দাগটার উপর। একটা সুগন্ধ ভেসে আসে। ইচ্ছে করে ... কি জানি কি ইচ্ছে করে ? নিজেই বুঝতে পারেনা তিতির। একটা অন্যরকম অনুভূতি হয় বিতানেরও । দুটো চোখ আটকে গেছে দুটি চোখে। কারো মুখে কথা নেই। বিতানই নিরবতা ভেঙ্গে বলে-"দেব নাকি একগোছা কৃষ্ণচূড়া পেড়ে ? খোঁপায় গুঁজবে। দারুন লাগবে তোমাকে।" তিতির অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিতানের দিকে। হ্যাঁ বা না বলতে ভুলেই গেছে। তখনো হাতটা তার সাদা দাগটার উপর। দাগটা যদি সারা গায়ে থাকত তার !
এমন সময় বুড়োটা হেসে হেসে আসছে তাদের দিকেই।
-------------------------------
অরূপ কুমার গোপ মন্ডল।
নতুন বাঘমুন্ডি রোড
ঝালদা, পুরুলিয়া