অনুস্মৃতি
তপতী মণ্ডল
জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমে ঘরে আর থাকা যাচ্ছে না। আবার রোদের তেজ ও এত বেশি যে বিকাল সাড়ে পাঁচটার আগে ছাদে যাওয়া যায় না। সেদিন বিকালে ছাদে ঘুরছি হঠাৎ গেটের বাইরে রাস্তায় কে গাড়ির হর্ণ বাজাচ্ছে। উপর থেকে ঠিক বুঝতে পারলাম না। নীচে নেমে দেখি আমার বন্ধু মিতা। সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। হাইস্কুলে একসঙ্গে পড়েছি। তারপর কলেজ আলাদা হওয়ায় আমাদের গতিপথও আলাদা হয়ে যায়। দুজনেই পড়াশুনা শেষ করে চাকরি পেয়েছি, সংসার ও হয়েছে দুজনের। কিন্তু আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল না দীর্ঘদিন। বছর পাঁচেক আগে ফেসবুকেই আবার মিলন।
ওকে দেখেই তো আমি হতবাক। আমি কিছু বলার আগেই ও শুরু করল--'আর ভালো লাগছে না রে। লকডাউনে ঘরে থেকে শুধু খেটে মরছি। এখন আমি রান্নার মাসি,ঘরমোছার মাসি এমনকি বাসনমাজার ও মাসি'--বলে হা হা করে খানিকক্ষণ হাসল।
আমি বললাম-লোক ছেড়ে দিয়েছিস?
ও বলল--একমাস হল ছেড়েছি, তবে আবার ডেকে নেব নইলে খাটতে খাটতে মরেই যাব। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে বেরিয়েছি,ভাবলাম তোদের সঙ্গে একটু দেখা করে যাই।
বললাম--ভালো করেছিস।
ও স্কুটিটা ভিতরে ঢুকিয়ে, হাত- পা ধুয়ে, হাতে স্যানিটাইজার দিয়ে ঘরে এসে বসল। বাড়ির বাচ্চারা তখন ঘুমাচ্ছে, তাই ওদের সঙ্গে কথা হল না। একটু বিশ্রাম নিয়ে চা খেল। এই করোনা পরিস্থিতি নিয়েই কথা হচ্ছিল, হঠাৎ মিতার ফোন বেজে উঠল। মিতা ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপার থেকে ধীর কণ্ঠস্বর--'আমি কি মিতার সঙ্গে কথা বলছি' ?
-------- হ্যাঁ, তবে আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না?
------- আমি অমিয় , মানে কলেজের অমিয় স্যার । চিনতে পারছো?
মিতার মুখটা যেন নিমেষেই রং বদলাল।
সারাটা মুখ কেমন করুণ হয়ে উঠল। চোখদুটো ছলছল করছে। আবার যেন মনে হচ্ছে এক অমোঘ আনন্দ ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে আমার দিকে একবার তাকাল তারপর বলল---হ্যাঁ স্যার। আপনি ভালো আছেন তো?
বাড়ির সবার খবর ভালো?
------হ্যাঁ, আমরা সবাই ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো? স্কুলের খবর কী? Online class কেমন চলছে?
একেবারে কাছাকাছি বসে থাকায় দুজনের কথা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। মিতা এবার বেশ উৎফুল্ল মনে উত্তর দিল---হ্যাঁ স্যার, সবই ভালো চলছে। তবে এই লকডাউন হওয়াতে বাড়িতে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছি আর স্কুলটাকে খুব মিস্ করছি। আমরা তো বাচ্চা পড়াই তাই ওদের ছাড়া আর ভালো লাগছে না। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে বেরিয়েছি,সেই সুযোগে আমার বন্ধু বীণার বাড়িতে এসে উঠেছি গল্প করতে। আমার মায়ের ফ্লাটটা ওদের বাড়ির কাছেই হয়েছে।
কথাটা শুনে খুশি ও নন আবার অখুশিও নন এমন গলায় বললেন--- ঠিক আছে তুমি গল্প করো আমি পরে ফোন করব। তুমি চাইলে এই নাম্বারে কল্ করতে পারো।
---------- ঠিক আছে স্যার, ভালো থাকবেন।
মিতা ফোনটা কেটে দিল।
আমি একটু আঁচ করতে পেরেছি বিষয়টা কারণ কলেজে থাকতে ওর আর অমিয় স্যারের মধ্যে একটা ভালোলাগার গল্প তৈরি হয়েছিল সেটা আমি শুনেছিলাম কিন্তু মিতার সঙ্গে এনিয়ে কোনো কথা হয়নি কখনো। তবে মিতা স্যারের কাছে নিজেকে কখনো মেলে ধরেনি এরকমই শুনেছি। বরং অন্তরে ওর ভালোলাগাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছিল আর আজও রেখেছে তা ওর অভিব্যক্তিতেই প্রকাশ পেল।
আমি বললাম---- স্যার কি মাঝে মাঝেই ফোন করেন তোকে?
ও বলল---- না না, কলেজ ছাড়ার পর দু- একবার কথা হয়েছে। তবে প্রায় বছর তিনেক পর স্যার ফোন করলেন।
আমি একটু ঝালিয়ে নিতে ঢিলটা সোজা ছুঁড়লাম---- তা তোরা দুজন যখন দুজনকে এত ভালোবাসিস্ তো মাঝে মাঝে দেখা করতে বা কথা বলতে আপত্তি কোথায়? এসব তো এখন আকছার -------
মিতা আমার কথা শেষ করতে দিল না, বলল---- না না, এখানে ঠিক ভালোবাসি কথাটা আসে না বরং বলতে পারি ভালোলাগে। আর আমি এই ভালোলাগাকে আর এগোতে দিচ্ছি না। উনিও হয়তো তাই।
মিতা বলতে থাকে---- এই ভালোলাগা তৈরি হওয়ার আগে আমাদের দুজনের দুটো সংসার ছিল, আছে ও। ভালোলাগাকে ভালোবাসার পিছনে ছোটালে আমাদের দুটো সংসারই যে ক্ষতিগ্রস্ত হত, আর সেই ক্ষতি কোনো কিছুর বিনিময়ে পূরণ হত না, এটা বোঝার মত বুদ্ধি আর চেতনা আমাদের দুজনেরই ছিল আর আছেও।
বললাম---- কী লাভ এই ভালোলাগাকে আঁকড়ে থাকার?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল---- 'ফুল আমাদের সকলকে আকৃষ্ট করে। তাই উপহার হিসেবে, ফুলদানিতে, অনুষ্ঠানে ফুল সমহিমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমরা মেয়েরা ফুল হাতে নিয়ে, কানে গুঁজে, খোপায় দিয়ে কত না ছবি তুলি। কখনো বাড়ির ফুলগাছটির ছবি তুলে শেয়ার করি। তবে প্রকৃতিকে ভালোবাসলে,সে ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয় যথাসময়ে। কিন্তু মানুষকে ভালোবেসে সবসময় ভালো প্রত্যাশা করা যায় না। পরিবেশ পরিস্থিতি সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে কোথায়, কখন, কাকে যে কার ভালো লাগবে কিছু বলা যায় না। আর কাউকে অন্তর থেকে ভালো লাগলে তার প্রতি একটা টান অনুভূত হয়। ক্ষেত্রবিশেষে সেই টানটা বেশি বাড়তে দিলে বিপদ বাড়ে।
আমার ক্ষেত্রটা সেরকম। আমরা দুজনে দুজনকে বেশ পছন্দ করি। তাইতো যখন কাজের ফাঁকে একদম একা থাকি মুহূর্তে কখন মনটা অতীতপানে হাঁটা শুরু করে। সেখানে সুখের আনন্দ, দুঃখের কান্না, অপমান, হতাশা--সবকিছুর মাঝে কেমন উজ্জ্বল কলেজের দিনগুলি। মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে একদল প্রাপ্তবয়স্কের আড্ডাহাসি, হুল্লোড়, সেইসাথে মন ছুঁয়ে যায় স্যারের পড়ানো বইখানার সাদাকালো পাতা, স্যারের দৃষ্টির তীক্ষ্মতা, পড়ানোর নিপুণতা আর চলার ছন্দের নিপাট ভদ্রতা। মনটা এক মুহূর্তে ফুরফুরে হয়ে যায়। মনে মনে কেমন একটা অনাবিল আনন্দ উপভোগ করি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। চাইলে আমি তখন ফোন করে স্যারের সঙ্গে কথা বলতে পারি। কিন্তু করি না। যা আমার নয় তাকে পাওয়ার জন্য আকুলতা মানায় না। '
--------মিতা যেন আজ মনের দুয়ার খুলে দিয়েছে, থামছেই না। গড়গড় করে বলে যাচ্ছে আর আমি অবাক হয়ে নির্বাক শ্রোতার ভূমিকায়। বললাম--- একটু মিষ্টি খা।
ও বলল--- 'না, পরে আর একবার চা দিস। '
তারপর আবার স্মৃতিচারণ মিতার----'এই তো সেবার কোলকাতা বইমেলায় দেখলাম স্যারকে সপরিবারে। ছোট্টো মেয়ে আর সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে বেশ হাসিখুশি তিনি। ভীষণ ইচ্ছা করছিল সামনে যাই, সবার সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু না, আমি যাইনি। আমার বিবেক আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল।আমাকে দেখে স্যার ও খুব খুশি হতেন জানি। কিন্তু আমাদের দৃষ্টির আকুলতা আর পরস্পরের ভাববিনিময় অন্যের কাছে যদি অপরাধী করে-- এই ভেবে নিজেকে সামলে নিয়েছি। '
ওকে থামিয়ে বললাম---- তুই তো তোর স্বামীকে ঠকাচ্ছিস।
মিতার নির্লিপ্ত উত্তর----'একদম না। আমার এই ভালোলাগা তো আমার কোনো কাজে ব্যাঘাত ঘটায় না আর কারো প্রতি অবহেলা দেখাতেও উদ্বুদ্ধ করে না। আমরা দুজনেই আমাদের ভালোলাগাকে অন্তরের আঙিনায় সযত্নে আগলে রেখেছি আর আশা করি আজীবন রাখতেও পারব অমলিনভাবে। এতে অপরাধ কোথায়? এ অনুভূতি আমার মনকে আনন্দ দেয়, অন্যের তো ক্ষতি করে না। '
------------ মিতাকে হঠাৎ চমকে দিয়ে ওর ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রীনে স্বামীর নাম দেখে উঠে দাঁড়ায়----'এই রে অনেক দেরি হয়ে গেল। '
তারপর ফোনটা তুলে ----'হ্যালো'।
ওপার থেকে ওর স্বামীর কণ্ঠস্বর----'তা বলি ওষুধ বুঝি বানাতে এত দেরি হচ্ছে। আজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলে ভালো হত না? করোনায় না এককাপ চায়ের জন্য এবার বোধহয় প্রাণটা বেরিয়েই যাবে। '
মিতা বেশ রসিকতা করেই উত্তর দেয়---'ও আমি বুঝি চায়ের উপকরণসমূহ সাথে করেই নিয়ে এসেছি? একটু চা করেও খেতে পারো না? '
--------- 'আরে তুমি তো জানো চা-টা আমার দ্বারা হয় না। আর মা ও লিকার চা ঠিকমত বানাতে পারেন না। দোকানে যাব তার ও উপায় নেই। '
---------'তাহলে আর একটু ঘুমাও। আমি আসছি এখনি।' মিতা হাসতে হাসতে উত্তর দেয়।
এরপর আমার হাতটা ধরে মিতা বলল--- 'আজ আসি রে, অনেক দেরি হয়ে গেল। পরে ফোন করব।'
--------এই বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
মিতা বরাবরই ন্যায়ের পক্ষে। স্কুলে মেয়েদের মধ্যে অন্যায় দেখলে প্রথমে ওই প্রতিবাদ করত।তারপর আমরা অনেকেই ওর সঙ্গে জুটে যেতাম। সহজে কাজ না হলে সোজা টিচার্সরুমে নিয়ে সবচেয়ে রাগী দিদির হাতে সমর্পণ করে তবেই ছাড়তাম।ব্যাক্তিগত জীবনে ও অন্যায় প্রশ্রয় দেবে না এটাই স্বাভাবিক তবুও ওর কথা শুনে আমি কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। শুধু মনে মনে বলতে ইচ্ছা করল----
তোরা ভালো থাক্, ভালো থাকুক তোদের ভালোলাগা, আর ভালোবাসাও তার বাসায় নিশ্চিতে ঘুমাক্।
---------------------------------------------------
_________&&&&&&&__________
নাম--- তপতী মণ্ডল
ঠিকানা--- রহড়া,উত্তর ২৪ পরগণা
ফোন নম্বর----8017278110
Valo laglo DiDi 😍❤
উত্তরমুছুন