ছবিঋণ- ইন্টারনেট
মহান আত্মা
অচিন্ত্য কুমার ধাড়া
শো কেশে সাজানো খেলনা গুলো অর্পিতার খুব পছন্দের। ছেলে বেলায় অর্পিতা মাঝে মধ্যে একটা খেলনা শো কেশ থেকে বের করে দেওয়ার আবদার মায়ের কাছে করতো । এই খেলনা গুলো অর্পিতা র দাদা জন্ম দিনে উপহার হিসেবে পেয়ে ছিল । কখনো সকনো মেয়ের আবদার পূরণের জন্য মা একটা খেলনা বের করে দিত । অর্পিতা মাঝে একবার মা কে বলেছিল , মা কবে আমার জন্ম দিন পালন করবে? মা বলে ছিল সময় হলেই করবো ।বারো বছর হোক ঠিকই করবো। সেই থেকেই অর্পিতা স্বপ্ন দেখতো তার জন্মদিন পালিত হবে, বাড়িতে কত বন্ধু আসবে, নতুন জামা হবে, কত উপহার পাবে, ভালো খাওয়া দাওয়া হবে। জমিয়ে আড্ডা, আনন্দ হবে।
যৌথ পরিবারের সদস্য বলতে অর্পিতা র জ্যেঠু, বড়মা, জ্যেঠু র মেয়ে অর্থাৎ এক দিদি ছিল তার বিয়ে হয়ে গেছে। আর আছে অর্পিতার বাবা, মা ও দাদা। জ্যেঠু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, বর্তমানে রির্টায়ার হয়ে গেছেন। অর্পিতা র বাবা চাষি। বাবার চার পাঁচ বিঘার মতো জমি আছে। সারা বছর চাষবাস করে যা টাকা কড়ি উপার্জন হয় বেশ স্বচ্ছল ভাবে চলে যায়। জ্যেঠু র পেনশনের টাকা য় কিছু টা সংসারে এবং কিছু টা অর্পিতা ও তার দাদার পড়াশোনা র খাতে খরচ হয়। বলা ভাল দুই ভাই বোনের মধ্যে বয়সের তফাৎ অনেক খানি, প্রায় নয় বছরের। অর্পিতা র দাদা খুব মেধাবী। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এম বি বি এস পড়ছে। দেখতে দেখতে অর্পিতা র বয়স ও অনেক টাই এগিয়েছে। অর্পিতা র মা অর্পিতার বাবা কে মাঝে একবার বলে,মেয়ের বয়স তো বারো ছুঁই ছুঁই, ওকে কথা দিয়েছি জাঁক জমক করে ওর জন্মদিন পালন করবো । বিষয়টা মাথায় রেখ । অর্পিতার বাবা বলল দেখা যাবে ,কিছু টাকা পয়সা রাখা আছে।সময় আসুক আমি মেয়ের সাথে কথা বলে নেব । অর্পিতা র বাবার মতি গতি যেন মা ঠিক বুঝতে পারে না । অর্পিতা র বাবা খুব সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ। গরীব হলেও পরোপকারে সিদ্ধ মন ।কেউ অভাবের তাড়নায় হাত পাতলে নিজের সংসারের টাকা থেকে থেকেও ঔষধ কেনা ই হোক বা চাল,ডাল নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যই হোক তাকে সাধ্য মতো খরচ দিয়ে দেয়।
এক দিন বিকেলে বেশ বৃষ্টি হল ।অর্পিতার বাবা মাঠে কাজে বের হতে পারলো না ।হাতে অনেক টা সময় পেয়ে গেল। মনে মনে ভাবে মেয়ে র জন্মদিন আসতে আর মাত্র মাস কয়েক বাকি এই সুযোগে মেয়ে র সাথে আজি একটু আলোচনা করা দরকার। মেয়ে কে কাছে ডেকে বসালো। বলল মা, আমাদের বাড়ি হতে পিচ রাস্তা পর্যন্ত যেতে সাত শো ফুট মাটির কাঁচা রাস্তা ,বর্ষা হলে রাস্তা কাদা হয়ে যায়। সকলের ই কাদায় হেঁটে গিয়ে পিচ রাস্তায় উঠতে এইটুকু পথ বেশ কষ্ট কর হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমি ভেবেছি তোমার জন্মদিন করার জন্য যে টাকা রেখেছি ঐ কাঁচা রাস্তা টা ঢালাই করে দেব। শিশু মন, অর্পিতা ঠিক যেন কথাটা মানতে পারছিল না । মেয়ে বললো, বাবা মা যে বলেছে জাঁক জমক করে আমার জন্ম দিন পালন করা হবে। বাবা বললো জানি তোমার মা আমাকেও বলে রেখে ছিল । কিন্তু ভেবে দেখলাম এই রাস্তা টা একান্তই ঢালাই করার দরকার হয়ে পড়েছে। যদি জন্মদিন করি একদিন সকলে আসবে খাবে কিছু পুরস্কার দেবে হৈচৈ হবে ব্যস এই পর্যন্ত, কিন্তু এই রাস্তা টা ঢালাই হলে শুধু আমারা নয় সকলের উপকার হবে বর্ষা কালে ।বহু মানুষ বহু দিন ধরে উপকৃত হবে , একটা মহৎ কাজ হবে। আমি ও সকলের কাছে বলতে পারবো আমার মেয়ে র ত্যাগ স্বীকারের কথা। প্রতি জন শুনে খুব খুশি হবে। মেয়ে কিছু না ভেবে বললো বাবা তুমি যা ভালো বোঝ কর ।বাবার চোখে আনন্দাশ্রু ঝরতে লাগলো ।
যথারীতি সেই দিন উপস্থিত হল । অর্থাৎ মেয়ে র জন্মদিন। আগে থেকে সব ব্যবস্থা করাছিল, এবং সেই দিনই কাঁচা রাস্তা ঢালাই হল । বিষয়টা গোপন থাকল না ।সকলে জানতে পারল যে মেয়ে র জন্মদিনের জন্য গচ্ছিত টাকায় কাঁচা রাস্তা টা ঢালাই করে দিল বাবা। বাবা এবং মেয়ে উভয়ের জন্যই গ্রামের সকলেই গর্ব বোধ করতে লাগল। ঐ দিনই পাড়ার কিছু সজ্জন চাঁদা তুলে পাড়ার সকল সদস্যদের জন্য মিষ্টি ও অর্পিতার জন্য সুন্দর একসেট পোষাক, আকর্ষণীয় একখানা খেলনা নিয়ে সকলে সন্ধ্যায় অর্পিতাদের বাড়ি হাজির হল । সবার উপস্থিতি দেখে অর্পিতা খুব খুশি হল । একসাথে জমায়েত হয়ে অর্পিতা কে তার বাবা কে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানাল সকলে। সকলে মিলে মিষ্টি মুখ করল। অর্পিতা দের বাড়ি টায় সকলে কিছু ক্ষণের জন্য আনন্দ ভেলায় ভাসতে থাকল।
দেখতে দেখতে অর্পিতা অনেক বড়ো হয়ে গেল। যখন অর্পিতা র বয়স বাইশ বছর তখন তার জন্য এক প্রতিবেশী একটা বিয়ের সমন্ধ আনল।ছেলে হাই স্কুলে র শিক্ষক। অর্পিতা দেখতে শুনতে রূপ সুন্দরী। সবে মাত্র বি ,এ টা পাশ করেছে, এখন ই বিয়ে করতে হবে অর্পিতা তবুও বাবার কথায় কোন দিন অসম্মতি দেয় না ।তাই হল । অর্পিতাকে দেখে পাত্র পক্ষে র খুব পছন্দ হল। শুভ দিন দেখে অর্পিতা র বিয়ে হয়ে গেল।
অর্পিতা র বাবা নিশ্চিত হল এবং বেশ স্বস্তি মনে এল ।কিছুটা ছাড়া হাত পা হয়ে একবার তারাপীঠ যাবে মা এর কাছে পূজা দিতে। সুযোগ ও এসে গেল। পাশের গ্রামের পল্লী সমাজ ক্লাব থেকে এক বাস পূর্ণার্থী কে তারাপীঠ, বক্রেশ্বর, শান্তি নিকেতন ভ্রমণের প্রস্তাব এল । তাতে রাজি হয়ে গেল কর্তা গিন্নি , দুই জনে একসাথে যাবে। যথারীতি সেই দিন টা উপস্থিত । তারাপীঠ যাওয়ার আশা পূরণ। তারাপীঠে র উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ল রাত্রি এগারো টায়। পথে একবার বিরতি দিয়ে বাস পরদিন সকালে তারাপীঠ পৌঁছে গেল। সকলের সাথে কর্তা গিন্নি ও মন ভরে পূজা দিল, প্রসাদ ভক্ষণ হল, কেনা কাটি হল।খুব ভালো কাটল তারাপীঠে সারাটা দিন ।
পর দিন সকালে শান্তি নিকেতনের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়ল। দুরত্ব খুব কম ।তবু যাত্রীদের অনুরোধে মাঝে একবার বাস বিরতি দিল । কেউ কেউ চা পান করছিল। অর্পিতার বাবা বাথরুম করবে বলে রাস্তা টা পার হচ্ছিল, হঠাৎ ই গেল গেল রব । দুরন্ত গতিতে আসা একটি লরি অর্পিতা র বাবাকে সজরে ধাক্কা মরল। সারা শরীর রক্তাক্ত করে একেবারে থেঁতলে দিয়ে এক নিমেষে বেরিয়ে গেল লরিটি। সেই দৃশ্য দেখার নয়। অর্পিতার বাবা তৎক্ষণাৎ প্রাণ ত্যাগ করল। সকলের আনন্দ মুহূর্তে নিরানন্দে পরিণত হল । বাসের সকলে হা হুতাশ করতে লাগল। অর্পিতার মা কান্নায় ভেঙে পড়ল । কিছুটা পথ ফিরে গিয়ে তারাপীঠে র শ্মশানে অর্পিতা র বাবার অন্তিষ্ঠ ক্রিয়া সম্পন্ন হল । ওখান থেকেই সকলে ম্লান বদনে বাড়ি ফিরে এল ।
চাষিবাসি হলেও ভদ্রলোক গ্রামে সকলের প্রিয় ছিল । গ্রামের মানুষ তাদের ভালো বাসার নমুনা রাখতে সকলে মিলে চাঁদা তুলে অর্পিতা র বাবার একখানি স্ট্যাচু রাস্তা র মোড়ে বসালো। রোজ সকালে অর্পিতা র মা সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যায়। আর দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল । অর্পিতা সেই দিন উপলক্ষে মায়ের বাড়ি গতকাল সন্ধ্যায় এসেছে ।
আজ হল সেই দিন, আজকের দিনে অর্পিতা র বাবা পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিল তারাপীঠে । অর্পিতা খুব সকালে ধূপ, ধুনা, ফুল, মালা নিয়ে বাবার স্ট্যাচু তে শ্রদ্ধা জানাতে গেল। বাবার গলায় মালা দেওয়া র সময় সেই দিনের কথা মনে পড়ছে অর্পিতা র। অঝোরে অশ্রু বরণ হচ্ছে বাবার চরণে। স্মৃতি তে দগদগে হয়ে আছে সেই কথা, বাবা বলেছিল তোমার জন্মদিনের জন্য গচ্ছিত টাকায় কাঁচা রাস্তা টা ঢালাই করবো। অর্পিতা বাবাকে প্রণাম জানিয়ে বিড় বিড় করে বলল বাবা তুমি ঠিক কাজ ই করেছ বাবা । তোমার জন্য আমারা সকলে গর্বিত । তুমি মহৎ কাজ করেছ। তুমি মহান বাবা তুমি............ কান্নায় ভেঙে পড়ল ।
-----------------------------------
অচিন্ত্য কুমার ধাড়া।
সাহাচক ,আমতা ,হাওড়া ।
9830378864 ।