অণুগল্প।। বউমা ।। অঞ্জনা দেব রায়
বউমা
অঞ্জনা দেব রায়
অলোকবাবু তাঁর স্ত্রী বীণাদেবী , তাঁদেরএক ছেলে ও চার মেয়ে নিয়ে বেশ শান্তিতেই থাকেন । পাটনাতে
নিজেদের বাড়ি । অলোক বাবু ও বীণাদেবি দুজনেই স্কুল শিক্ষক ছিলেন । ছেলে ও মেয়েদের ঠিকমতো লেখাপড়া
শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । ছেলে একটা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার ও মেয়েরা স্কুলের শিক্ষিকা । আস্তে আস্তে
এক এক করে মেয়েদের ও ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন অলোকবাবু । মেয়েদের বেশ ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছিলেন
ফলে মেয়েরা সবাই যার যার সংসারে সুখেই ছিল । ছেলেরও ভাল ঘরেই বিয়ে হয়েছে তবে বউমা ছেলের থেকে
অনেকটা প্রায় পনেরো বছরের ছোট । কিন্ত শ্বশুর বাড়িতে নতুন পরিবেশেএসে বেশ সবার সাথে মানিয়ে গুছিয়ে
নিয়েছে । একমাত্র ছেলের বউ বলে অলোকবাবু ও বীণাদেবী নাম ধরে না ডেকে বউমা বলে ডাকেন । আর
ননদরা সবাই দাদার বউকে বউমনি বলে ডাকে। অরিত্রের বউ অলি খুব খুশি হয়ে সবাইকে নিজের করে
ভালবাসে ।
অলোকবাবু ছিলেন খুব সরল ও ভাল মনের মানুষ । বউমাকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসেন । কিন্তু অলি কোন
কাজ ঠিক মতো করলেও সেই কাজের খুঁত ধরে বীণাদেবী অলির বাপের বাড়ি নিয়ে উল্টো পাল্টা কথা বলতে
থাকেন । আর অলি তখন মন খারাপ করে কাঁদতে থাকে । অরিত্র সব কিছু শুনেও চুপচাপ থাকত । ফলে
অলির আরবেশি দুঃখ হত । অথচ অরিত্রের অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও অলি কিন্তু সবকিছু মেনে নিয়ে ভালবেসে
সবকাজে অরিত্রের পাশে থাকত । বীণা দেবী অলোক বাবুর কোন কথাই পাত্তা না দিয়ে নিজের মতকেই গুরুত্ব
দিয়ে ঘরে বউমার সাথে কিছু না কিছু অশান্তি করে থাকত ।
বীনাদেবীর ব্যবহার দেখে অলি মনে মনে বলতে লাগল " আসলে বীণাদেবী ছেলের সাথে বউমার মিলমিশ সহ্য
করতে পারে না । এইরকম 'মা' সমাজের অনেক ঘরেই আছে । যারা বউমাকে নিজের মেয়ের মতো মনে না করে
পরের বাড়ির মেয়ে বলে মনে করে বাজে ব্যবহার করে থাকেন । কিন্তু শাশুড়িরাও যে পরের বাড়ির মেয়ে সেটা
মনে রাখেন না । আসলে মেয়েরা মেয়েদের শত্রু, এটাই সত্যি কথা । যখন মেয়েরা মেয়েদের পাশে দাঁড়াবে তখন
আমাদের সমাজ আর উন্নত হবে ।"
যাইহোক বিয়ের দুবছর বাদে অলির কোল জুড়ে কন্যাসন্তান আসল । শ্বশুর বাড়ি ও বাপের বাড়ির সবাই খুশি হল
কিন্তু একমাত্র বীণাদেবী শিক্ষিত হয়েও ছেলে হয়নি বলে অলিকে দুঃখজনক কথা শোনাল । অলি চুপচাপ থেকে
লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে হালকা হয়ে নেয় । মেয়ের যখন দুবছর বয়স হল তখন অলির শ্বশুরমশাই মানে অলোকবাবু
মারা গেলেন । অলির খুব কষ্ট হয়েছিল অলোকবাবুর জন্য।
অলোকবাবু মারা যাওয়ার একবছর বাদেই বীনাদেবী আবার অলির সাথে অশান্তি শুরু করলেন । অরিত্র তখন
মাকে বললেন " মা অশান্তি না করে ভালভাবে থাকো । দেখবে সবাই ভাল থাকবে ।" বীনাদেবী তখন ছেলেকেও
উল্টোপাল্টা কথা বলল আর পরের দিন সকালে উঠে রাগ করে বড় মেয়ের কাছে চলে গেলেন । অরিত্র ও অলি
মানা করা সত্ত্বেও বীনাদেবী যখন চলে গেলেন তখন দুজনেরিই খুব মন খারাপ হয়েছিল। তবে অরিত্র অলিকে
বলল যে " মা কিছুদিন দিদির কাছে থাকলে মার ভাল লাগবে আর দেখবে ভাল হয়ে যাবে , যখন এখানে ফিরে
আসবে মা কোনো অশান্তি করবে না ।" অলি কিছু না বলে রান্না ঘরে চলে গেল ।
অরিত্র অফিস থেকে ঘরে ফিরে ফোন করে মার সাথে কথা বলেনিল । অলি রাতের খাবার টেবিলেনিয়ে আসলো
এবং তিনজনে খেয়ে শুয়ে পড়ল । অলি তাঁর সংসারে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগল । বীণাদেবী যাওয়ার পর
থেকে অলি ফোন করলেও অলির সাথে উনি কথা বলতেন না । ফলে অলি মনে মনে কষ্ট পেত । যাইহোক
এইভাবে একবছর কেটে গেল । অলি অরিত্র ও মেয়ে টিনাকে নিয়ে ভালোই ছিল । কিন্তু হঠাৎ একদিন রাতে
বীনাদেবী অলিকে ফোন করে । অলি অবাক হয়ে যায় এবং শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে ? বীনাদেবী
কাঁদতে কাঁদতে অলিকে বলল," বড় মেয়ে আমাকে রাখতে চাইছে না আর অন্য মেয়েরা বলেছে তাঁরাও রাখতে
পারবে না । বউমা তুমি আমাকে নিয়ে যাও । আমি তোমার কাছেই থাকব । " অলি অবাক হয়ে মনে মনে ভাবল
শাশুড়ি মায়ের কি হয়েছে যে আমার কাছে থাকতে চাইছে , যাইহোক অরিত্রকে অলি সব কথা বলল। অরিত্রের
অফিসের ছুটির দিন দেখে অলি ও অরিত্র একসাথে গিয়ে বীনাদেবীকে নিয়ে আসলো । বীনাদেবী খুব খুশি
হলেন ছেলে বউমার কাছে এসে । অরিত্র মাকে বলল " মা তোমার বউমা তোমাকে এত যত্ন করত তবু তুমি
আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে , কিন্তু মেয়েদের কাছে গিয়ে বুঝলে তো বউমাই তোমাকে বেশী যত্ন করে রাখে ,
তাহলে এবার থেকে বউমাকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসো, দেখবে বউমাও তোমাকে ভালবাসবে ও যত্ন করবে । " আর জানো তো মা ,আমাদের সমাজে সব ' বউমারা ' নিজের বাড়ির লোকেদের ছেড়ে নতুন বাড়ি , নতুন
পরিবেশে আসে , তাঁদের শ্বশুর বাড়ির মানুষেরা যদি ভাল ব্যবহার করে তবেই তো বউমারা শ্বশুর বাড়ির সবাইকে ভালবেসে সম্মান করবে ও যত্ন নেবে । বীনাদেবী অরিত্রকে বলল
" ঠিক বলেছিস খোকা , আমি আমাকে দিয়েই বুঝেছি । দেখবি আমি আর বউমার সাথে অশান্তি করবো না ।
বউমা আমার কাছে মেয়ে হয়ে ও বন্ধু হয়ে থাকবে ।"
------------------------------
ফোন নম্বর - ৯৩৩০৬১৭১২৮ / ৯৪৩২১৬০১০৯