গল্প ।। আলোআঁধার ।। রণেশ রায়
আলো আঁধার
রণেশ রায়
নার্সিং হোমে বসে আছি সবার মধ্যে । আত্মীয় বন্ধু পরিজন সবাই। সবার মধ্যেও আমি একা। আমার সঙ্গে স্মৃতি, একান্তে আলাপ চারিতায় ব্যস্ত। আমরা দুজনেই পরিব্রাজক। শৈশব থেকে আজের প্রৌঢ়ত্বে হেঁটে চলেছি । বাবা মায়ের সঙ্গে আমরা পূর্ব বঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে । সঙ্গে কাকা কাকী। সব মিলে এক কুড়ি জ্যাটতুতো খুড়তুতো ভাইবোন । এন্টালিতে তিনটে ঘরে ভাড়া বাড়িতে। সঙ্গে ঠাকুমা। গাদাগাদি ঢাসাঢাসি করে আমাদের বাস। ভিটে ছাড়া, ছিন্নমূল। বাবাকাকার যা আর্থিক অবস্থা তাতে কোনমতে চলে । আয়ব্যয় যেন মিলতে চায় না। সবাই মিলে সোরগোল তুলে দিব্যি দিন কাটে । তেমন কিছু চাহিদা নেই তাই অভাব বোধ নেই । এরই মধ্যে পড়া খেলা গপ্প তামাশা। শৈশব বাল্য কাটে দৌড়তে দৌড়তে। কখন যে বড় হয়ে যাই দিদিদের কোলে কোলে, উঠনে আছাড় খেতে খেতে, হামাগুড়ি দিতে দিতে, খেলে বেড়িয়ে, ভাই বোনদের সঙ্গে মিলে মিশে ঝগড়া করে টের পাই না । একটু বড় হলে চলে আসি বালিগঞ্জে বাবার অফিস থেকে পাওয়া ফ্ল্যাটে । সেই যৌথ পরিবার ভেঙে যায় । বাবার একক পরিবারে আমরা তাঁর সাত সন্তান, সঙ্গে কোন পিসতুত জ্যটতুতো ভাই বোন। আগের থেকে আর্থিক অবস্থা ভালো হয়েছে। ফোন ফ্রীজের মত জীবনযাপনের আধুনিক উপকরণ ঘরে যা যথেষ্ট সামর্থের সূচক । আমি স্কুল ছেড়ে কলেজ, কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে চাকুরীজীবি । সংসার পেতেছি । বাবা মা ভাই নিয়ে বাবার অবসরের পর তৈরী করা নিজেদের বাড়িতে শহর ছেড়ে এক বর্ধিষ্ণু পল্লীতে আমাদের বাস ।
আমার বাবা সিংহ পুরুষ । তার কড়া শাসন আর মায়ের আদরে আমাদের বেড়ে ওঠা । বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস আমাদের ছিল না । মায়ের ওপরই যত হম্বি তম্বি। এরই মধ্যে গোপনে দৌড়াত্বের শেষ নেই । শাসনের নজর এড়িয়ে সবই হয় । তাতে ওই কড়া ধাঁচের মানুষের হয়রানিও কম হয় নি । তবে মায়ের আদরে আর প্রশ্রয়ের জন্য আমাদের মানুষ করা যায় নি । মানুষের বদলে বাঁদর হয়েছি । অর্থাৎ মানুষ গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়া l বাবার অভিযোগ। স্মৃতির সঙ্গে বসে কত কথা! বিভিন্ন ঘটনাবলির পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা। কত হাস্যকর মজার কথা আবার কত আপদ বিপদ সুখ দুঃখের ইতিকথা। স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় বাবার কড়া শাসনে আমি কত বিরক্ত, বিব্রত থাকতাম।
হঠাৎ কে আমায় ডাকে । তাকিয়ে দেখি নার্স। আমার যেন স্বপ্ন ভাঙে । বাস্তবে ফিরে আসি। এক কঠিন অসুখে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ অবস্থায় বাবা ভর্তি । তাঁর অপেরেশন চলছে। তবে কি অপারেশন হয়ে গেছে? সবাই ছুটে আসে । জানতে চাই কেমন আছেন । নার্স জানান ডাক্তার চেম্বারে ডাকছেন। উনি এর থেকে বেশি কিছু বলেন না। সবার উদ্বেগ বাড়ে। তবে কি বাঁচানো গেলো না ! আমি আর দাদা ডাক্তারের চেম্বারের দিকে পা বাড়াই । স্মৃতি অপেক্ষায় থাকে। ওর সঙ্গে সবাই ।
ডাক্তার বসতে বলেন । আমাদের দুশচিন্তার পারদ বেড়ে চলে। জানতে চাই বাবা কেমন আছেন? অপারেশন সাফল্য পেয়েছে কি না । ডাক্তার হেসে জানান চিন্তা নেই ভালো আছেন, প্রাণের ভয় নেই। জানিয়েই আবার উনি গম্ভীর হয়ে ওঠেন। মুহূর্তে আমাদের মধ্যে এক সুখানুভূতি, যাক বেঁচে গেছেন । ডাক্তারেরও সংশয় ছিল। সেটা তিনি আগে জানিয়েছিলেন। তবে উনার গাম্ভীর্যে কিন্তু কেন ? আমাদের আনন্দ অনুভূতির সঙ্গে সংশয়ানুভূতি, একটা দুঃখের ছোঁয়া, অস্বস্তিতে ভারাক্রান্ত। যেন বসন্তের উষ্মতার সঙ্গে মাঘের শীতের ফল্গুধারা। শরতের শুভ্র সকালে কালো মেঘ। ডাক্তার আমাদের মনের অবস্থা বোঝেন। উনি বলেন, আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্নে উনিও ভারাক্রান্ত । বাঁচানো গেলেও অপারেশন সম্পূর্ণ সফল নয় ? তবে কি ? বিপদ কাটেনি ? এখনও প্রাণের আশঙ্কা ? আমরা জানতে চাই । উনি বলেন, না প্রাণের আশঙ্কা নেই । সুস্থ ভাবে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। তবে কি ? আমাদের অজানা এক আশঙ্কা । ডাক্তার জানান রোগটা গভীরে ঢুকে ছিল বলে তাঁর স্বরযন্ত্রটা বাদ দিতে হয়েছে ।
আমাদের আনন্দের ছোঁয়া বিষাদের ছোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আলো আঁধারের লুকোচুরি। ভাবি ওই মানুষটা আর কথা বলবে না । চিৎকার করবে না ! কাউকে শাসন করবে না ! কেমন যেন মনের মধ্যে একটা শূন্যতা তাকিয়ে থাকে। মুহূর্তে বুঝি আমাদের জীবনে বাবার শাসনের প্রয়োজনটা কি ছিল। আর তার শাসনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাটা এতদিনে যেন আমরা চিনতে পারলাম। সিংহের অন্তরে এক শাবক ছানা সুপ্ত ছিল। সংসারের মাথার ছাতাটা সরে গেছে । অঝরে বৃষ্টি পড়তে থাকে। একটা ভয় পেয়ে বসে, সংসারটা বানের জলে ভেসে না যায় !
--------------------------------------