মায়ের চিঠি.........
অর্পিতা মজুমদার
(আজ আমার বৃদ্ধাশ্রমে ৯ বছর, চিঠি টি আমার প্রিয় খোকাকে লিখছি এক বিধবা অসহায় মা রূপে)
প্রিয় খোকা,
তখন আমার গর্ভে তুই,তোকে ধারণ করেছিলাম ১১ মাস।তোর বাবা একটা ছোটো কোম্পানিতে চাকরি করতেন।খুব অভাব ছিলনা আমাদের,কিন্তু খুব বিলাসিতাও ছিলনা। জানিস খোকা যখন তুই এই পৃথিবীর আলো দেখলি তখন আমার চোখে জল এসেগেছিল আনন্দে,আমি নতুন এক প্রাণ এর জন্ম দিতে পারলাম এই ভেবে।
তোর বাবা তোর নাম রেখেছিলেন রেহান।
......কখনও তোকে অভাবের মধ্যে কাটাতে দেইনি আমরা। আমার কোনওদিন থালায় অন্ন না থাকলে অথবা কম থাকলেও তোর অন্নের অভাব হতে দেইনি। সবসময় তোকে দুধে ভাতেই রাখার চেষ্টা করতাম,যেমনটি করে পৃথিবীর সকল বাবা মায়েরা তাঁদের অভাব অনটনের মধ্যেও তাদের সন্তানদেরকে রাখেন। তোর বাবা অফিস যাওয়ার পরে তোকে রোজ স্কুল নিয়ে যেতাম আমি ,আর ছুটি না হওয়া অবদি বসে থাকতাম। জানিস খোকা মাঝে মাঝে স্কুল থেকে তুই বাড়ি ফিরলে তোর পছন্দের খাবার গুলো তোর মুখে তুলে দিতাম। নিজে হাতে কত দিনই না তোকে আমি খাইয়ে দিয়েছি।
তারপর জীবনে আসলো এক ঝড় আর সেই ঝড় এর সাথে লড়াই।
.....তখন খোকা তুই সপ্তম শ্রেণীতে পড়িস।হঠাৎ একদিন খবর আসলো অফিস থেকে ফেরার পথে তোর বাবার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কি করবো?তোকে কি খাওয়াব? কিভাবে মানুষ করবো ? কিছুই আসছিলনা আমার মাথায়।তারপর আমি সেলাই এর কাজ শুরু করলাম।তোকে স্কুল পউছে আমি রোজ যেতাম সেলাই এর কাজে। যা টাকা পেতাম নিজে না খেয়ে তোর মুখে অন্নের গ্রাস তুলে দিতাম। ডাক্তারি পড়ালাম তোকে,অনেক কষ্টে লোকের কাছে হাত পেতে দুয়ারে দুয়ারে। কি না সহ্য করেছি খোকা তোর জন্যে!হাজার অভাবেও প্রত্যেক টা দুর্গা পুজোতে তোর জন্যে জামা কিনে দিয়েছি আমি। তোর জন্মদিন গুলোতে পায়েসের চামুচ মুখে তুলে দিয়েছি।
.তোকে ডাক্তার বানানোর পর ভেবেছিলাম মা ছেলে মিলে একটু শান্তি একটু সুখের নিঃশ্বাস নেবো। কিন্তু তা আর হলো কই খোকা? তুই আজ এতোই বড় মাপের ডাক্তার যে বিদেশে তোর খ্যাতি প্রতিপত্তি। তোর নিজের মাকে এতো বড় বড় মানুষ জনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তোর নিজের রুচিতে বাধে,তোর সম্মান হানি হয়। তাই আজ তুই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলি তাইনা খোকা?
.....প্রথম যেদিন জানতে পারলাম তুই ফোনে কোনও এক বৃদ্ধাশ্রম এর মালিক এর সাথে ক্থা বলছিস সেদিন বড্ড আঘাত লেগেছিলো কিন্তু কিছু বলিনি মুখ ফুটে। শুধু চোখের জলটুকু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল তোর অনুপস্থিতিতেই। যেদিন তুই নিজে হাতে আমার সব জামা কাপড় গুলো গুছিয়ে দিলি ব্যাগ ভর্তি করে,সেদিন আমার ঠোঁটের কোণে এক হাসি ফুটেছিল। জানিনা সেই হাসি টা কীসের? সেই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই আমার।
খোকা তুই বড্ড ভুলো মানোসি জানিস তো! সব গুছিয়ে দিয়েছিলিস সেদিন শুধু দিসনি তোর বাবার ছবি টা।ওটা আমাকেই তাই নিয়ে নিতে হয়েছিল পরে।
বাড়ি ছেড়ে তোর হাত ধরে চলে যাওয়ার সময় নিজেকে যে কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না খোকা। সব স্মৃতি গুলো যেন আমায় ঘিরে ধরেছিল।
খোকা রে আজ আমি বৃদ্ধাশ্রমে তোর ইচ্ছেতেই।
......বৃদ্ধাশ্রমে আজ আমার না অনেক বন্ধু অনেক বান্ধবী হয়েগেছে জানিস খোকা।তারা কত ভালো মানুষ।এখানে আবার প্রত্যেক মাসে আনন্দ দেওয়ার জন্যে আমাদের প্রত্যেকের মনে ,অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হয়।কিন্তু মনের দুঃখ আর সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর বেদনা কি ভোলা যায় খোকা?
জানিস দুর্গা পুজোর দিনগুলোতে অন্য কোনও বাবা মায়ের ছেলে মেয়েরা এসে আমাদের বৃদ্ধাশ্রমে জামা কাপড় দিয়ে যায় তখন বড্ডো তোর কথা মনে পরে আর চোখের কোণে জল গড়ায়।
......সেই যে রেখে গেলি সেদিন আমাকে আর খোঁজ ও নিসনি। হয়তো আজ তুই অন্য খোকার বাবা। সে তোকে বাবার পরিচয় দিচ্ছে।হ্যাঁ রে খোকা তোরা সুখে থাক এই তো চাই।
আজ আমি চোখে আন্দাজ করতে পারিনা রে কোনও জিনিস।চিনতে পারিনা কোনও জিনিস ঠিক করে। কিন্তু তুই খোকা সামনে এসে যদি দাঁড়াতিস ঠিক চিনতাম।
....জানিস খোকা সেদিন শরীর টা খুব খারাপ করেছিল,খুব জ্বালা পোড়া করছিলো বুকের ভেতরটা। ডাক্তার বাবু আসলেন,দেখে বললেন হাসপাতালে ভর্তি হতে। তারপর থেকে এলাম ৯ দিন,বললেন ডাক্তার বাবু আমার নাকি ক্যান্সার হয়েছে।আমি তাঁকে বলেছি আমার খোকা ও খুব বড় ডাক্তার,অনেক নাম তার।এই ক্থা শুনে ডাক্তারের মুখ খানা কেমন যেন বেদনাদায়ক হয়ে চোখ ছল ছল করছিল জানিস তো খোকা।
...আর বেশিদিন আয়ু হয়তো আমার নেই রে খোকা। খুব কষ্ট হয় বুকের ভেতর টা। খালি একটাই যন্ত্রণা আমার সন্তান এতো বড় ডাক্তার হয়েও তার চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত এক মা হতে হলো আমায়।
....আজ তুই খোকা মানুষের সেবা করছিস,কত বৃদ্ধা মায়ের বৃদ্ধ বাবার সেবা করছিস,কিন্তু তোর নিজের মায়ের চিকিৎসা ই করা হয়ে উঠল না তোর।
...মারা যাওয়ার আগে এই চিঠি খানি লিখে রাখলাম,আর এখানকার মালিককে বলে দিয়ে গেলাম আমি মারা যাওয়ার পর আমার খোকার ঠিকানায় যেন এই চিঠি খানি পৌছে দেয়। আর খোকা কখনও তো তোর কাছে কিছু চাওয়ার সুযোগ পেলাম না, তাই আমার মৃত্যুর পর আমার আর তোর বাবার কাজ টা একটু ভালো করে করিস পারলে কোনও বৃদ্ধাশ্রমের মানুষ গুলোকে খাওয়াস তাঁদের জামা কাপড় দিয়ে আসিস। এই আমার চাওয়া।
......এই চিঠি টি পরে তোর চোখে জল আসলে মনে করিস তোর মা তোর সাথেই আছে। নিজেকে অপমানিত বোধ এর দায় দিস না খোকা। ভালো থাকিস। আমি আর তোর বাবা সবসময় তোদের সাথেই থাকবো।
ইতি:তোর বৃদ্ধা মা।
=========================================
কলমে:অর্পিতা মজুমদার
লেখা প্রকাশিত হলে 7479115608 নম্বরে যোগাযোগ করবেন।
ঠিকানাঃ
জেলা:নদীয়া, গ্রাম:হরিণঘাটা
পোস্ট:সুবর্ণপুর,থানা:হরিণঘাটা।