ডঃ রমলা মুখার্জী
মুম্বাইয়ের ফ্ল্যাটটা বিক্রি করতে পেরে অনীকের মেজাজটা একদম বিন্দাস। আজই কলকাতা ফিরে যাবে বলে শেষ ফ্লাইটটা ধরতে এসে একমাত্র অবশিষ্ট টিকিটটা কাটতে ঠিক যাবে অনীক, হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসলেন অনীকের কলেজের প্রবীণ প্রফেসর সুজয়বাবু। মুম্বাইতে শীতেও বেশ গরম, আর সেই গরমেই পেটুক সুজয়বাবু বড়াপ্পাউ খেয়ে বেশ অসুস্থ বোধ করছেন আর তাই কাতর নিবেদন অনীকের কাছে সুজয়বাবুর যদি ঐ শেষ টিকিটটা কাটতে তাঁকে সুযোগ দেয় অনীক। পরোপকারী অনীকও বিগলিত করুণা হয়ে সুজয়বাবুকে টিকিটটা কাটতে সুযোগ দিয়ে বসল। ফোন করে সবকথা অনীক অপেক্ষারত স্ত্রীকে জানাতেই উপমা তো একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। অনীকের মা উমাদেবী অবশ্য তাঁর পাগল ছেলেকে চেনেন। কত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেই না বড় করেছেন ছেলেকে তিনি। অনীকের বাবা অশোকবাবুও ছিলেন বড় উদারচেতা। ফলে কোন অর্থই সঞ্চয় করতে পারেননি কোনদিন। প্যাঙ্ক্রিয়াটাইটিসের মত কঠিন অসুখে প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। শ্বশুর-ভাসুরদের মন যুগিয়ে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অনীককে ভালভাবেই মানুষ করেছেন উমাদেবী। ভগবান কিন্তু একেবারে বঞ্চিত করেননি তাঁকে। অসম্ভব মেধাবী অনীক ফিজিক্সে পি.এইচ.ডি করে জুনিয়র সায়েন্টিস্টের পদে মুম্বাইতে যোগ দেয়। কিন্তু মুম্বাইয়ের অতি ব্যস্ত ছুটে চলা জীবনে অনীক ক্রমশই হাঁপিয়ে উঠছিল, মায়ের জন্যেও তার মনটা হু-হু করছিল। আর একটা বিশেষ কারণও অবশ্য ছিল। উমাদেবীর বাবা ছিলেন গানের শিক্ষক, উমাদেবীও তাই উত্তরাধিকার সূত্রে আর বাবার শিক্ষায় সুগায়িকা হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু সংসারের চাপে সেসব অতীত গেছে। অনীক মায়ের কাছে সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি নিয়ে নিজেকে ক্রমশই বর্ধিত করেছে, গড়ে তুলেছে মাটির গানের লোকদল। সেসব ছেড়ে কি গান-পাগল অনীক মুম্বাইতে থাকতে পারে? তাই আবার পশ্চিমবঙ্গেই একটি সরকারি কলেজে লেকচারারের পদে যোগ দিয়ে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এবার লোকদলে সে উমাদবীকেও টেনে নিল। উমাদেবীর ধামাচাপা পড়া গান উন্মুক্ত মেঘের মত নীলাকাশে ইচ্ছেপাখি হয়ে ভাসতে লাগল। আর বাচিক শিল্পী উপমা তো লোকদলের অঙ্কুর থেকেই সঞ্চালনার কাজ করে আসছে, আর সেই সূত্রেই তো আলাপ তার অনীকের সাথে। উপমাও নিজের মাটিতে ফিরে ভীষণ খুশি। মুম্বাইতে যে ফ্ল্যাটটা অনীক কিনেছিল সেটা বিক্রি করার জন্যই অনীক মুম্বাইতে এসেছে।
হঠাৎ উমাদেবীর আর্ত চিৎকারে উপমা ছুটে আসে উমাদেবীর ঘরে। ঘরে ঢুকে উপমা দেখে উমাদেবী ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আঙুল দিয়ে টিভির দিকে দেখাচ্ছেন। মুম্বাই থেকে দমদমে আসার পথে একটা প্লেনের দুর্ঘটনা হয়েছে শুধু এইটুকুই দেখতে পায় উপমা, বিস্তারিত কিছুই কোন চ্যানেলেই সেই মুহূর্তে দেখতে পায় না। জ্ঞান হারিয়ে উমাদেবী মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। উপমা তাড়াতাড়ি অনীককে ফোন করে, কিন্তু ফোন 'সুইচড অফ' বলছে। লোকদলের দুটি ছেলেকে ফোন করে উপমা। তাড়াতাড়ি ছেলেদুটি ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসে। সঠিক খবর না পাওয়া পর্যন্ত সন্তানসম্ভবা উপমার শরীরও অবসন্ন হয়ে পড়ছে। "তোমায় হৃদ-মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবোনা"- উপমার মোবাইলটা বেজে ওঠে। ও প্রান্ত থেকে অনীকের গলা ভেসে আসে, "দমদমে এইমাত্র পৌঁছালাম। প্লেনে ফোনটা সুইচড অফ করে রেখেছিলাম। একটা খুব দুঃখের খবর সুজয়বাবু যে প্লেনটায় ছিলেন সেটার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ঐ প্লেনের কেউই বেঁচে নেই।"
--------------------------------
ডঃ রমলা মুখা
বৈঁচি, বিবেকানন্দ পল্লী
হুগলী, ৭১২১৩৪, পঃ বঃ
হোয়াটসঅ্যাপ- ৯৪৭৪৪৬২৫৯০
মোবাইল- ৭০০৩৫৫০৫৯৫