গল্প ।। পোর্ট্রেটে হীরের নেক্লেস ।। রানা জামান
পোর্ট্রেটে হীরের নেক্লেস
রানা জামান
করোনা ভাইরাসের সংক্রমন থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য দেশব্যাপি লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। সেকারণে সবার মতো হাস্নাহেনা দম্পতিও গৃহবন্দি। দু'জনের গৃহবন্দিত্ব কাটছে সিনেমা দেখে এবং ফেসবুক ঘেটে। মার্চ-জুন প্রান্তিকের অসহ্য গরম শুরু হওয়ায় এসি-ননএসি-তে আনাগোনায় হঠাৎ করেই সামান্য সর্দিকাশি হয়ে গেলো হাস্নাহেনার। একটা হাচি দিয়ে নাক টানতে টানতে শয্যাকক্ষে ঢুকতেই রবিউল আলম ওর দিকে তাকালো।
হাস্নাহেনা একটা টিসু পেপার নিয়ে নাক পরিস্কার করতে থাকলে রবিউল আলম ট্যাব থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বললো, কী ব্যাপার? সর্দি-গর্মি লেগে গেলো নাকি? একটা এলাট্রল খেয়ে ফেলো, নাহলে আবার লোকজন মনে করবে তোমার করোনা হয়ে গেছে!
হাস্নাহেনা আরেকটা হাঁচি দিয়ে বললো, এলাট্রল খেয়ে একটা ঘুম দেবো। তুমি এঁটো থালাবাসনগুলো মেজে ফেলো। আজ তোমারই থালাবাসন মাজার পালা। ঘর মুছা হবে আগামীকাল; আমার পালা।
রবিউল আলম বললো, যাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি, তাদের এখন কাজের চাপ কম।
বুঝলাম না। এ কথার মানে কী?
আমাদের যদি গোটা দুই বা তিন বাচ্চা থাকতো তাহলে এখন আমাদের দুজনের উপর কাজের এতো চাপ থাকতো না। কিন্তু তুমি রাজি হলে না।
হাস্নাহেনা কিছু না বলে রবিউল আলমের নাক টেনে দিলো। রবিউল আলম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো শুধু। হাস্নাহেনা একটা এলাট্রল খেয়ে শুয়ে পড়লো; রবিউল আলম গেলো রান্নাঘরে। দু'জনের সংসারে এঁটো থালাবাসনের সংখ্যা বেশি হয় না-করোনা ভাইরাস কাল শুরু হওয়ায় এঁটো থালাবাসনের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। রবিউল আলম এঁটো থালাবাসন মেজে শয্যাকক্ষে এসে দেখলো নাক ডাকছে হাস্নাহেনা-বুকের উপর ট্যাব। আলগোছে ট্যাবটা তুলে ওয়ারড্রোবের উপর রেখে হাস্নাহেনার পাশে নিঃশব্দে শুয়ে টিপতে লাগলো স্মার্টফোন। স্মার্টফোনে ফেসবুক ঘাটতে ঘাটতে গেলো ঘুমিয়ে। ঘুম ভাংলো বিকেলে হাস্নাহেনার কানে দেয়া সুড়সুড়িতে। বরাবর এমনটা হয়ে আসছে। রবিউল রাগতে পারে না-সামান্য চোখ লাল করলে হাস্না শুরু করে কান্না। একটানা তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর বিয়ের সময় হাস্নাহেনার এই শর্তটি রবিউলের মানতে হয়েছে যে হাজার ভুল বা অন্যায় করলেও চটতে বা রাগ দেখাতে পারবে না রবিউল হাস্নার প্রতি।
রবিউল বিছানায় উঠে বসে হাসিমুখে বললো, কী খবর বলো!
হাস্নাহেনা একটু উচ্ছল স্বরে বললো, আমার একটা পোর্ট্রেট বানাতে হবে।
হঠাৎ পোর্ট্রেট কেনো?
স্বপ্নে দেখলাম পোর্ট্রেটের প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে।
রবিউল আলম বিস্মিত হয়ে বললো, স্বপ্নে দেখেছো!
হাস্নাহেনা জিভে মৃদু কামড় দিয়ে বললো, সরি! ঘুমাবার আগে ফেসবুকে দেখেছি।
পোর্ট্রেট পাঠাবে কিভাবে?
ই-মেইলে।
ই-মেইলে? ই-মেইলে কিভাবে পাঠাবে এতো বড় একটা জিনিস?
বুদ্ধু! পোর্ট্রেটের ফটো তুলে ই-মেইলে পাঠাতে বলেছে।
তাই বলো! কিন্তু এসময় আর্টিস্ট পাবো কোথায়?
সকল আর্টিস্ট বেকার বসে আছে বাসায়। কল দিলে বাসার সামনে লাইন লেগে যাবে!
কিন্তু বাসায় ঢুকাবো কিভাবে?
পিপিই কিনে দাও!
তোমার এরকম একরোখা স্বভাবের কারণে আজো আমাদের কোনো সন্তান হলো না। তুমি প্রেগনেন্ট হবে না, প্রেগনেন্ট হলে ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে! পেটে দাগ পড়ে যাবে, মেদ জমবে! আরো কত কী!
হাস্নাহেনা নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো, ফিগার ডাজ মেটার ম্যান!
টেস্ট টিউব বেবি নিতেও রাজি হচ্ছো না!
দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে আমি রাজি না!
কী মুস্কিল!
এখন বাবা হবার চিন্তা বাদ দিয়ে একজন আর্টিস্ট আনার ব্যবস্থা করো! কালকেই। এমন একজন আর্টিস্ট যে এক সিটিং-এ পোর্ট্রেট এঁকে শেষে করবে।
পরদিন সকাল দশটা। অতিথি কক্ষে হাস্নাহেনা পোজ দিয়ে বসে আছে। চিত্রভূজ নামের একজন আর্টিস্ট ছবি আঁকছে। রবিউল লক্ষ্য করলো চিত্রভূজ নামের আর্টিস্ট ক্যান্ভাসের চেয়ে হাস্নাহেনার দিকেই তাকিয়ে থাকছে বেশি। কিছু বলা যাবে না এ নিয়ে আর্টিস্টকে বা হাস্নাকে। কিছুক্ষণ বসে থেকে রবিউল আলম চলে গেলো শয্যাকক্ষে।
চিত্রভূজ ক্যান্ভাসে রংতুলির আঁকিবুঁকি আঁকছে নিবিষ্ট মনেই বলা যায়। হাস্নাহেনা একটু কাত হয়ে পোজে আছে। হাঁচি আসতে চাচ্ছে। হাস্নাহেনা হাঁচিটাকে আসতে দিতে চাচ্ছে না-নাক কুচকানো যাবে না। কিন্তু নাক-মুখ না কুচকে কি হাঁচি রোধের চেষ্টা করা যায়?
হাঁচি চেপে রাখার প্রচেষ্টায় হাস্নাহেনার পেট ফুলে উঠায় শরীর দুলে উঠলে চিত্রভূজ ওর দিকে তাকিয়ে বললো, উহু! নট নড়নচড়ন!
হাঁচি আর বাগে থাকলো না হাস্নাহেনার-হেচ্চো! একবার না-পরপর তিনবার; সাথে লম্বা নাকটান!
চিত্রভূজ ছবি আঁকা থামিয়ে হাস্নাহেনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কী হলো?
হাস্নাহেনা বললো, গতকাল থেকে মাঝেমধ্যে হাঁচি আসছে। শরীরও সামান্য গরম।
চিত্রভূজ ব্যাগে আঁকার সামান ভরে বললো, আমি আসতাছি।
হাস্নাহেনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেলো চিত্রভূজ। এই সুযোগে কয়েকবার হেঁচে নিলো হাস্নাহেনা। একবার কাশি দিয়ে সামনের টি-টেবিলে রক্ষিত টিসুপেপার বক্স থেকে একটা টিসু নিয়ে আচ্ছামতো নাক পরিস্কার করে নড়েচড়ে আগের পোজ নিয়ে ফের বসলো। সময় যাচ্ছে; এক মিনিট দুই মিনিট তিন মিনিট..।
পাঁচ মিনিট পার হবার সাথে সাথে রবিউল আলম কক্ষে ঢুকে বললো, চিড়িয়া ফুড়ুৎ!
হাস্নাহেনা অনড় বসে থেকে ঠোঁট না নেড়ে বললো, ফুড়ুৎ মানে?
তুমি কি হাঁচি দিয়েছিলে?
বহু চেষ্টা করেছিলাম আটকে রাখতে; কিন্তু পারি নাই-মুখ ফেটে হাঁচি বিস্ফোরিত হয়েছে।
তুমি হাঁচি দেয়ায় ও মনে করেছে তোমাকে করোনা ভাইরাস এটাক করেছে।
তাহলে আরেকজনকে ডাকো!
আজকে কন্টাক্ট করে রাখি। আগামীকাল আসবে।
আজকে হবে না কেনো?
পোর্ট্রেট সাবমিটের লাস্ট ডেট কবে?
আরো চারদিন পর।
তাহলে নো চিন্তা ডু ফুর্তি।
দু'জন ঢুকলো ড্রয়িংরুমে। হাস্নাহেনা বললো, আমি কফি করে আনছি। তুমি যোগাযোগটা করে ফেলো।
হাস্নাহেনা চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে। দশ মিনিট পর দুই মগ ধূমায়িত কফি নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই রবিউল বললো, এভাবে আর কোনো আর্টিস্ট আসতে চাচ্ছে না মাই ডিয়ার।
হাস্নাহেনা টি-টেবিলে রবিউলের সামনে কফির মগ রেখে বললো, এভাবে মানে?
তোমার হাঁচি গড়বড় করে দিয়েছে। সবাই বলছে করোনা ভাইরাস টেস্ট না করা হলে কেউ আসবে না।
হাস্নাহেনা বিস্মিত কণ্ঠে বললো, সবাই জানলো কিভাবে?
চিত্রভূজ নামের আর্টিস্ট তথ্যমন্ত্রীর কাজটা করেছে!
তাহলে আজকেই করোনা ভাইরাস টেস্টের ব্যবস্থা করো। আগামীকাল সকালে টেস্ট রিপোর্ট পেতে হবে। আর্টিস্ট ঠিক করে রাখো এগারোটায় টেস্ট রিপোর্ট দেখে সাড়ে এগারোটায় চলে আসবে বাসায়।
ব্যবস্থা হয়ে গেলো হাস্নাহেনার ইচ্ছেমতোই। অধিক ফি দিয়ে আজকেই একটি বেসরকারি হাসপাতালে নমুনা দিয়ে এলো দু'জনই। ঘুষ দিতে হয়েছে মোটামোট পরিমাণ দ্রুত টেস্ট করানো ও রিপোর্ট পাবার জন্য। পরদিন সকাল দশটার মধ্যে রিপোর্ট তুলে পাঠিয়ে দিতে হবে চিত্রআঁখি নামের এক মহিলা আর্টিস্টের কাছে।
রাতে শোবার সময় রবিউল আলম হাস্নাহেনাকে বললো, কালকে হাঁচি কাশি যাতে না আসে সেই ব্যবস্থা করো।
হাস্নাহেনা বুঝতে না পেরে বললো, বুঝলাম না।
কুসুম গরম পানিতে এক চিমটি লবন দিয়ে গার্গল করো কয়েকবার। পানির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি আমি। আর এলাট্রল খাও দুইটা। কাশির সিরাপ আছে না ঘরে? দুই চামচ খেয়ে নিও।
রবিউল আলম ওভেনে এক মগ পানি কুসুম গরম করে তাতে দুই চিমটি লবন মিশিয়ে হাস্নাহেনার হাতে দিলো গরগরা করার জন্য। হাস্নাহেনা ডাইনিং স্পেসের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার গরগরা করলো, যদিও প্রতিবার কিছু তেতো পানি শ্বাসনালিতে ঢুকে যাওয়ায় কাশতে হয়েছে। শোবার সময় দুইটি এলাট্রল ট্যাবলেট ও দুই চামচ কফ সিরাপ খাইয়ে দিলো রবিউল হাস্নাকে।
পরদিন। যথাযথ পিপিই পরিধান করে রবিউল আলম সকাল দশটার মধ্যে চলে গেলো ঐ হাসপাতালে। টাকার গুণে পেয়ে গেলো যাবার সাথে সাথে রিপোর্ট। একটা বিজনেস সেন্টারে ঢুকে স্ক্যান করে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলো চিত্রআঁখির ই-মেইলে এবং মোবাইল ফোনে বলে চলে এলো বাসায়।
চিত্রআঁখি সকাল সাড়ে এগারোটার মধ্যে চলে এলে হাস্নাহেনা বসে গেলো পোজ নিয়ে। এবার রবিউল আলম সঙ্গত কারণে আর যায়নি ছবি আঁকা দেখতে। চিত্রআঁখি চিত্রভূজের ক্যান্ভাসে আঁকা অসমাপ্ত ছবিটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা ক্যান্ভাস সেঁটে শুরু করলো ছবি আঁকা।
বিকেল দুইটা নাগাদ পোর্ট্রেট আঁকা শেষ হয়ে এলে হাস্নাহেনা কাতার এয়ারলাইন্সের ম্যাগাজিনে একটি হীরের নেক্লেস, ঝুমকো, ব্রেসলেট ইত্যাদি দেখিয়ে বললো, পোর্ট্রেটে এগুলো এঁকে দিতে হবে যে!
গয়নার ছবিগুলো একবার দেখে চিত্রআঁখি বললো, এসব ওর্নামেন্ট কি আপনার আছে?
নাহ।
তাহলে এগুলো আঁকাতে চাচ্ছেন কেনো?
আমার উনি পোর্ট্রেটটা দেখার পর যাতে লজ্জায় পড়েন।
হাসবেন্ডকে লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছেন কেনো?
ও লজ্জায় পড়লে আমার খুব ভালো লাগে!
অদ্ভূত ভালো লাগা আপনার!
হাস্নাহেনা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কি হাসবেন্ড আছে?
এখনো হয় নাই।
তাহলে বুঝবেন কিভাবে হাসবেন্ডকে নিয়ে খেলায় কী মজা।
ওদিকে শয্যাকক্ষে বিছানায় বিষন্ন মনে বসে আছে রবিউল আলম। সামনে আসল করোনা ভাইরাস টেস্ট রিপোর্ট-ওতে রেজাল্টের ঘরে পজেটিভ লেখা আছে।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
-----------------
রানা জামান , মিরপুর-২;
ঢাকা; বাংলাদেশ।
আমার গল্পটা প্রকাশের জন্য সম্পাদক দাদার কৃতজ্ঞতা।
উত্তরমুছুন